পাকিস্তানের
খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারে ইসলামি জঙ্গিদের হামলায় ১৩২
জন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কোন
পথে এখন পাকিস্তান! অনেকগুলো প্রশ্ন এখন ভিড় করেছে এই হত্যাকা-ের ঘটনায় এবং
এসব প্রশ্ন যে আগামী দিনের পাকিস্তানের চলমান রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার
করবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। প্রথমত, পাকিস্তানে ইসলামি জঙ্গিদের
আক্রমণের ঘটনা এই প্রথম নয়। এর আগেও ২০১১ সালে পাকিস্তানের নেভাল এয়ারবেস
মেহরানে হামলা কিংবা ৮ জুন করাচির জিন্নাহ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে হামলা
প্রমাণ করে জঙ্গিরা কত শক্তিশালী। পেশোয়ার হত্যাকা-ের পর এর দায়-দায়িত্ব
গ্রহণ করেছে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি নামে একটি জঙ্গি সংগঠন।
টিটিপি জানিয়েছে, তারা আরও হামলা চালাবে। তাই পাকিস্তান সরকার এই হামলাকে
কত গুরুত্বের সঙ্গে নেবে, এটা বড় প্রশ্ন এখন। দ্বিতীয়ত, এ ধরনের একটি
হত্যাকা-, বিশেষ করে সেনা নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে, অভ্যন্তরীণভাবে সমর্থন না
পেলে পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এর অর্থ পরিষ্কার টিটিপির সমর্থন রয়েছে
সেনাবাহিনীর ভেতরে। সেনাবাহিনীর একটি মহলের সমর্থন ও সহযোগিতা ছাড়া
সেনাছাউনির ভেতরে অবস্থিত স্কুলে জঙ্গি হামলা চালানো সম্ভব নয়। তাই
সেনাবাহিনীর এই অংশকে যদি নিষ্ক্রিয় করা না যায়, তাহলে জঙ্গিদের দমন করা
যাবে না। এরা বারবার হামলা চালাবে। তৃতীয়ত, যারা ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’-এ
বিশ্বাস করেন, তারা এই হামলার সঙ্গে একটি ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজে পেতে পারেন। আর
ষড়যন্ত্রটি হচ্ছে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা বা আইএসআই সিভিল প্রশাসনের
ওপর তাদের কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখতে চাইছে। পাকিস্তানে জেনারেল পারভেজ
মোশাররফের ক্ষমতা থেকে উৎখাত এবং রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে ক্ষমতা পরিচালনা
আইএসআই কোনো ভালো চোখে দেখছে না। আইএসআই অনেকদিন থেকেই সরকারের ভেতরে
আরেকটি সরকার হিসেবে কাজ করছে। এখন মোশাররফ-পরবর্তী প্রথমে পিপিপির
নেতৃত্বে একটি সরকার ও চলতি বছরে নওয়াজ শরিফের পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার
মধ্য দিয়ে আইএসআইর ক্ষমতা কিছুটা হলেও হ্রাস পেয়েছে। ফলে গোয়েন্দা সংস্থার
ওপর নির্ভরতা বাড়াতেই আইএসআইর যোগসাজশে এই হত্যাকা- ঘটে থাকতে পারে! এটা তো
বলার অপেক্ষা রাখে না, নওয়াজ শরিফকে এখন জঙ্গি দমনে বেশি মাত্রায়
সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভর করতে হবে। আইএসআই এমনটিই চাচ্ছে, যাতে করে তারা
সিভিল প্রশাসনের ওপর প্রভাব খাটাতে পারে। চতুর্থত, ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ এর বড়
প্রমাণ কিছুদিন আগে ইমরান খানের নেতৃত্বে একটি আন্দোলন সরকার পতনে ব্যর্থ
হয়েছিল। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ইমরান খানের সমর্থকরা রাজধানী
ইসলামাবাদের একটা অংশ দখল করে নিয়ে অবস্থান ধর্মঘট করলেও সরকারের পতন
ঘটেনি। অনেকেই ধারণা করেছিলেন সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের দ্বন্দ্বের সুযোগে
সেনাবাহিনী আবার ক্ষমতা দখল করতে পারে। ওই ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই
পেশোয়ারে নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটল। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে নওয়াজ শরিফকে আরও
সেনাবাহিনী মুখাপেক্ষী করবে। সিভিলিয়ান প্রশাসন আরও দুর্বল হবে এখন
পাকিস্তানে। পঞ্চমত, জঙ্গিদের বারবার হামলা একটি সম্ভাবনাকে উসকে দিল যে,
পাকিস্তান কি আগামী দিনে তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারবে?
ঐতিহাসিকভাবেই বৃহত্তর খাইবার অঞ্চলের জনগণ কারোরই কর্তৃত্ব মানেনি। তারা
ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব মানেনি। পাকিস্তানি কর্তৃত্বও তারা মানেনি।
পাকিস্তানের এই অঞ্চল বিশেষ একটি অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত। পরিস্থিতি যে দিকে
যাচ্ছে, তাতে এটা দৃশ্যমান যে, এই অঞ্চল অদূর ভবিষ্যতে আফগানিস্তানের একটা
অংশের সঙ্গে মিশে গিয়ে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিতে পারে। বেলুচিস্তানও
আলাদা হয়ে যেতে পারে। করাচিকে কেন্দ্র করে মোহাজিরদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের
দাবিও কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হচ্ছে। ফলে অদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তান
নামের রাষ্ট্রটি যদি শুধু লাহোর আর ইসলামাবাদভিত্তিক হয়ে পড়ে, তাহলে অবাক
হওয়ার কিছু থাকবে না। ষষ্ঠত, শিশু হত্যার এই ঘটনা পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক
দলকে অন্তত একটি ইস্যুতে এক পতাকাতলে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে।
পাকিস্তানে ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন তেহরিক-ই-ইনসাফ দলটি বর্তমান
পাকিস্তানে প্রধান বিরোধী দল। তারা এই ঘটনায় তাদের সরকারবিরোধী আন্দোলন
আপাতত স্থগিত করেছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ। তবে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে,
খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে যে সরকার রয়েছে, সেই সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছে
ইমরান খানের দল। অনেকে অভিযোগ করেন, ইমরান খানের দলের সঙ্গে ইসলামি
জঙ্গিদের সম্পর্ক রয়েছে। এর পেছনে সত্যতা যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে
খাইবার পাখতুনখাওয়ায় জঙ্গিদের সঙ্গে সেখানে তেহরিক-ই-ইনসাফের এক ধরনের
সহাবস্থান হয়েছে। না হলে দলটি ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারত না। এ ক্ষেত্রে
জঙ্গি দমনে ইমরান খানের ভূমিকাকে ফেলে দেওয়া যাবে না। সপ্তমত, পাকিস্তানে
তালেবানি জঙ্গিদের যদি নিয়ন্ত্রণে আনা না যায়, তাহলে তা পাকিস্তান ছাড়িয়ে
ভারত ও বাংলাদেশেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে এবং এই দেশ দুটির নিরাপত্তায়
হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। ভারতে জঙ্গিদের তৎপরতার খবর আমরা জানি। সর্বশেষ
পশ্চিম বাংলার বর্ধমানে যে জঙ্গি তৎপরতার খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে,
তা আমাদের উৎকণ্ঠার জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতা তেমন একটা নেই।
কিন্তু ওরা আছে। পাকিস্তানে ওরা যদি ‘উৎসাহিত’ হয়, তাহলে তা আমাদের এ
অঞ্চলের জঙ্গিদের উৎসাহ জোগাবে। অষ্টমত, পাকিস্তানে জঙ্গি তৎপরতা বৃদ্ধি
শুধু পাকিস্তানের নিরাপত্তাকেই ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে না, বরং বৈশ্বিক
নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে থাকবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, পাকিস্তান একটি
পারমাণবিক রাষ্ট্র। পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করে
সেনাবাহিনী। এখন এই কর্মসূচি যদি কোনোভাবে জঙ্গিদের হাতে চলে যায় তাহলে তা
বিশ্বের অন্যত্র স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিশেষ করে
ইরাক-সিরিয়াজুড়ে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যাপারে
উৎসাহিত হবে বেশি। তাই জঙ্গি তৎপরতা রোধ করাটা জরুরি। এ ক্ষেত্রে সার্কের
আওতায় একটি যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে
গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানও জরুরি। মনে রাখতে হবে, জঙ্গিবাদ আজ শুধু
পাকিস্তানের একার সমস্যা নয়। জঙ্গিবাদ আজ মানবতার শত্রু। তাই এটাকে দমন করা
না গেলে সার্কের উন্নয়ন প্রক্রিয়া থমকে যাবে। এ ক্ষেত্রে দুটি বড় দেশ
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সব ধরনের বৈরিতা কমিয়ে আনা প্রয়োজন। দুটি দেশের
গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধেই বড় অভিযোগ রয়েছে যে, তারা একে অন্য দেশের
অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মদদ জোগায়। এই অভিযোগ কমিয়ে আনার জন্যই উভয় দেশের
গোয়েন্দা সংস্থার জঙ্গি দমনে একসঙ্গে কাজ করা উচিত। নবমত, জঙ্গি দমনে
পাকিস্তানের ‘বিশেষ স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে’ (যা ঋঅঞঅ নামে পরিচিত) দীর্ঘদিন
যাবৎ মার্কিন ড্রোন হামলা পরিচালিত হয়ে আসছে। এতে করে বেশ কিছু জঙ্গি
নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষও সেখানে মারা যাচ্ছেন। এই
হামলা বন্ধ করা উচিত। ড্রোন হামলা চালিয়ে জঙ্গি দমন করা যাবে না। বরং
তালেবানদের সঙ্গে যে ‘সংলাপ’ শুরু হয়েছিল, সেই ‘সংলাপ’ অব্যাহত রাখতে হবে।
পাকিস্তানে ইসলামপন্থী দলগুলোকেও এই প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে
একটি সর্বদলীয় সংসদীয় কমিটি গঠন করে তালেবানদের সঙ্গে ‘সংলাপ’ শুরু করতে
হবে। দশমত, পাকিস্তান সরকার বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে সেনাপ্রধান ও
গোয়েন্দা সংস্থার প্রধানকে কাবুলে পাঠিয়েছিল। সেখানে নয়া আফগান
প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তারা কথা বলেছেন। এটা ভালো দিক। তালেবান দমনে আফগান
সরকারের সহযোগিতা দরকার।
নিরপরাধ শিশুদের হত্যা করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা
করা যাবে না। তালেবানরা হত্যার নামে যে ইসলামি রাজনীতির কথা বলছে, তা কখনোই
ইসলাম ধর্মসম্মত নয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলোকে আজ এই প্রশ্নে একমত
হতে হবে যে, তালেবান রাজনীতি সনাতন রাজনীতির ধারাকে নষ্ট করে দেবে। এই
হত্যার রাজনীতি কখনোই সমর্থনযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে
বিভক্তি জঙ্গিদের উৎসাহ জোগাবে মাত্র। এই জঙ্গি হামলা দিয়ে টিটিপির কোনো বড়
ধরনের অর্জন হবে না। সারা বিশ্ব এর ধিক্কার জানিয়েছে। একমাত্র সাধারণ
মানুষের সচেতনতাই জঙ্গিদের রুখতে পারে। এক সময় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা
সিআইএর অর্থায়নে এই ঋঅঞঅ অঞ্চলে ইসলামিক জঙ্গিদের তৈরি করা হয়েছিল। এদের
পাঠানো হয়েছিল আফগানিস্তানে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
করার জন্য। এটি আশির দশকের কথা। তারপর কেটে গেছে ৩৪ বছর। সেই জঙ্গিরাই এখন
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবে পরিণত হয়েছে। এদের রুখতে হলে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা
আর মানুষের সচেতনতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
Daily Amader omoy
22.12.14
0 comments:
Post a Comment