রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মার্কিন সমাজে বৈষম্য বাড়ছ

ছোট ঘটনা যে কত বড় হয়ে দেখা দিতে পারে, মিসৌরির ফার্গুসন আর নিউইয়র্কের দুটো ঘটনা এর বড় প্রমাণ। ফার্গুসনের ঘটনা ৯ আগস্টের। আর নিউইয়র্কের ঘটনা ১৭ জুলাইয়ের। দুটো ঘটনায় গ্র্যান্ডজুরি অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারদের কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের হত্যাকা-ে অভিযুক্ত করেননি। তবে দুটো ঘটনায়ই গ্র্যান্ডজুরি রায় দিয়েছেন অতি সম্প্রতি। নিউইয়র্কে কৃষ্ণাঙ্গ মধ্য বয়সের মানুষ এরিক গার্নারকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। কিন্তু গ্র্যান্ডজুরি অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারকে খালাস দিলেন। আর ফার্গুসনকে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেন উইলসন প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেন এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে। তার নাম মাইকেল ব্রাউন। এটি নিয়ে তখনই আন্দোলন হয়েছিল। শত-শত দোকানপাট ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। তিন মাস পর ওই হত্যাকা-ের যখন বিচার শুরু হলো, তখন ২৪ নভেম্বর বিচারকার্যে সহায়তাকারী জুরিরা অভিযুক্ত শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার ডেরেন উইলসনকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দিলেন। অর্থাৎ জুরিদের চোখে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেন। যেখানে মিডিয়ায় বলা হচ্ছে, তিনি কোনো সতর্কবাণী ছাড়াই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ব্রাউনকে গুলি ও হত্যা করেন। এ ঘটনা প্রমাণ করে, মার্কিন সমাজে এখনো বৈষম্য রয়েছে। শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব, তা এখনো রয়ে গেছে এবং প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ, যেখানে শেতাঙ্গদের সংখ্যা বেশি, সেখান থেকেও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। যারা ইতিহাসের ছাত্র, তাদের অনেকেরই মনে থাকার কথাÑ যুক্তরাষ্ট্রের মানবতাবাদী নেতা ড. মার্টিন লুথার কিংয়ের সেই বিখ্যাত উক্তিÑ ‘আমার একটি স্বপ্ন ছিল’। ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট লিংকন মেমোরিয়ালের সামনে (ওয়াশিংটন ডিসি) হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গের উপস্থিতিতে তিনি বলেছিলেন সেই দুঃখ-কষ্টের কথাÑ যেখানে মার্কিন সমাজে কৃষ্ণঙ্গরা এক সময় দাস হিসেবে এ দেশে এসেছিল। কিন্তু তারা সাধারণ মানুষ হিসেবে সমমর্যাদা পায়নি কখনো। লুথার কিং হাজার হাজার কৃষ্ণাঙ্গের উপস্থিতিতে সেদিন বলেছিলেন, I have a dream that one day this nation will rise up and live out the true meaning of its creed. We hold these truths to be self evident; that all men one created equal. I have a dream that one day on the red hills of georgia the sons of former slaves and the sons of former sloweowners will be able to sit down together at a table of brotherhood. আজ যখন এ নিবন্ধটি লিখছি, তখন লুথার কিংয়ের ওই উক্তিটির কথা মনে পড়ে গেল। মাইকেল ব্রাউনের হত্যাকা- আবারও প্রমাণ করল লুথার কিংয়ের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। মার্টিন লুথার কিং স্বপ্ন দেখেছিলেন, এই যুক্তরাষ্ট্রে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। সবাই এক দেশের নাগরিক। সবাই মানুষ। দাস ও মালিকদের সন্তানরা সব ভেদাভেদ ভুলে এক টেবিলে বসে নতুন এক সমাজ নির্মাণ করবে। ৪০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও এই দ্বন্দ্ব দূর হয়নি। ফার্গুসন কর্তৃক মাইকেল ব্রাউনের হত্যাকা- এর বড় প্রমাণ।এটি দুঃখজনক যে, জুরিরা অভিযুক্ত ডেরেন উইলসনকে অভিযোগ থেকে খালাস দিলেন। এ নিয়ে গত কয়েক দিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়েছে। আমি ভয়ে ভয়ে গত দুদিন সাবওয়েতে চলাফেরা করেছি। বিক্ষোভ হয়েছে। কিন্তু বড় কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। এখানে যে বৈষম্য আছে, কৃষাঙ্গরা যে নিগৃহীতÑ তা প্রমাণিত। কৃষাঙ্গরা তাদের যোগ্য মর্যাদা পাচ্ছে না। পুরো যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যা এখন ৩০৮ মিলিয়ন। এই জনসংখ্যা আবার মোট ৬টি ‘রেসিয়াল গ্রুপ’-এ বিভক্ত। এই গ্রুপগুলো হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ, আলাস্কা নেটিভ, এশিয়ান, কৃষাঙ্গ বা আফ্রো-আমেরিকান, হিসপানিক বা লাতিনো ও নেটিভ হাওয়াইয়ান। শ্বেতাঙ্গরা বড় গোষ্ঠীÑ শতকরা ৭৪ দশমিক ৮ ভাগ। এরপর হচ্ছে হিসপানিক বা লাতিনো অভিবাসী (তারাও সেখানে মূলত শ্বেতঙ্গ বা মিশ্র গোষ্ঠী)Ñ শতকরা ১৬ দশমিক ৩ ভাগ। কৃষাঙ্গ তৃতীয় জনগোষ্ঠীÑ ১৪ দশমিক ১ ভাগ। এশীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫ দশমিক ৬ ভাগ। মজার কথা হচ্ছে, শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ এসেছে জার্মান থেকে। এই সংখ্যা ১৬ দশমিক ৯০ ভাগ। এরপরের শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠী এসেছে আয়ারল্যান্ড থেকেÑ শতকরা ১১ দশমিক ৫০ ভাগ। মনে করিয়ে দিই, প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির পূর্বপুরুষ এসেছিলেন আয়ারল্যান্ড থেকে। প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের পূর্বপুরুষ ছিলেন ইংল্যান্ডের অধিবাসী। এই যুক্তরাষ্ট্রে দাস হিসেবে আফ্রিকা থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের আনা হয়েছিল ভার্জিনিয়ার জেমস টাউন শহরে ১৬১৯ সালে। তাদের তামাক চাষে কৃষি শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ওই জনগোষ্ঠীই আফ্রো-আমেরিকান হিসেবে পরিচিত। তবে পরে ক্যারিয়ান দীপগুঞ্জ থেকে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর একটা অংশ যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছে। লাতিনো জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশই এসেছে মেক্সিকো থেকে। তাদের সংখ্যা ১০ দশমিক ২৯ ভাগ। তাদের নিয়েই এখন বড় সমস্যা। অবৈধ অভিবাসীদের একটা বড় অংশই হচ্ছে এই মেক্সিকান। একটা কথা এখানে না বললেই নয়। যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে অভিবাসীদের দেশ। শত-শত বছর আগে এ দেশে মূলত ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা এসে বসবাস করতে শুরু করে। এই যুক্তরাষ্ট্রের মূল অধিবাসী ছিল ‘রেড ইন্ডিয়ান’। তাদের সংখ্যা কমতে কমতে এখন একটা সীমিত কোটায় এসে পৌঁছেছে। তাদের ক্ষুদ্র একটা অংশ এখন নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস করে। মূলধারার রাজনীতিতে তাদের অংশগ্রহণ কম। আজকের যে যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতিÑ এই যুক্তরাষ্ট্রকে এ অবস্থায় নিয়ে এসেছে ওই শ্বেতাঙ্গ অভিবাসী ও তাদের পরবর্তী বংশধররা। শ্বেতাঙ্গ অভিবাসীরা এখানে যেসব কোম্পানি পরিচালনা করছে, এর মূলধনের পরিমাণ বছরে ৭৭৫ মিনিয়ন ডলার। তারা আয় করে বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলার। প্রতি ১০ কর্মীর মধ্যে একজন অভিবাসী। প্রতিবছর স্থায়ীভাবে এ দেশে থাকার অধিকার পান ৩ লাখ ৭৬ হাজার অভিবাসী। তাদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছেন। তবে কোনো দেশই শতকরা ৭ ভাগের বেশি অভিবাসীর কোটা অতিক্রম করতে পারে না। ২০১৩ সালে ‘গ্রিন কার্ড’ দেওয়া হয়েছে ৪ দশমিক ৩ মিলিয়ন (৪৩ লাখ) অভিবাসীকে। ২০০৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন। ২০০৮ সালে যেখানে ৫০ হাজার চিনা ছাত্র দেশে ফিরে গেছে, সেখানে ২০১১ সালে ফিরে গেছে ১ লাখ ৮০ হাজার। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ২৮ ভাগ ব্যবসা শুরু করেছেন অভিবাসীরা। অথচ জনসংখ্যার মাত্র ১২ দশমিক ৯ ভাগ তারা। শীর্ষ ৫০০ বড় কোম্পানি বা ব্যবসার মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ প্রথম জেনারেশনের অভিবাসী বা তাদের সন্তানরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব কোম্পানির মধ্যে আছে, অঞ্ঞ, ঢ়ৎড়পঃবৎ ড়ভ এধসনষব, এড়ষফসধহ ংধপযং, ঢ়ভরুবৎ, বইধু, এড়ড়মষব, ষহঃবষ, কৎধভঃ, ঈরমহধ, শড়যষ ইত্যাদি। চিন্তা করা যায়, বিশ্বব্যাপী নামকরা এসব কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা! শুধু তাই নয়Ñ পরিসংখ্যান আরও বলছে, বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির একটা বড় অংশ এই অভিবাসীদের নিয়ন্ত্রণে। যেমনÑ বলা যেতে পারে সিমেন্সের কথা। ফরচুন ম্যাগাজিনের গবেষণায় দেখা গেছে, এই কোম্পানির ৬৩ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করেন অভিবাসীরা। গবৎপশ-এর ক্ষেত্রে ৬৫ ভাগ, ঈড়ংপড়-এর ৬০ ভাগ, এবহবৎধষ ঊষবপঃৎরপ-এর ৬৪ ভাগ, ছঁধষপড়স-এর ৭২ ভাগ অভিবাসীরা নিয়ন্ত্রণ করে। সুতরাং বারাক ওবামা যখন অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন, এর পেছনে একটা যুক্তি অবশ্যই আছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন কারণে। প্রায় ৫ লাখ নাগরিকÑ যাদের একটা বড় অংশ মেক্সিকো তথা লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের অধিবাসী এবং স্প্যানিশভাষী, তারা এই সুযোগ পাবেন। তাদের কাজ করার অনুমতি দেওয়া হবে। কিন্তু ‘গ্রিন কার্ড’ দেওয়া হবে না। অথাৎ স্থায়ী থাকার অধিকার তারা পাবেন না। ফলে এই অবৈধ বসবাসকারীদের আর তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না। বেশি সুযোগ তারা পাবে, যারা শিশু অবস্থায় এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন। কিন্তু মা-বাবা অবৈধ থাকায় তারাও অবৈধ হয়ে গেছে। অনেকে আছেন, ১০ বছর থাকার পরও তাদের ‘গ্রিন কার্ড’ হয়নি। ওবামার এই ঘোষণা তাদের কাজ করার অনুমতি দেবে। তবে স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি আপাতত দেবে না। দুই ক্যাটাগরিতে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক. কৃষি শ্রমিক। তারা কাজ করার বৈধ অনুমতি পাবেন। নিউইয়র্কের আপার স্টেটে বাংলাদেশিদের বেশ কয়টি কৃষি ফার্ম রয়েছে। এখানে বাংলাদেশিরাই কাজ করেন। তারা নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সবজির জোগান দেন। এখানে অবৈধ কিছু বাংলাদেশি কাজ করেন। তারা কাজ করার অনুমতি পাবেন। তবে বেশি সুযোগ পাবে মেক্সিকানরা। তারা প্রচুর সংখ্যায় এ দেশে আছে। কৃষি শ্রমিক থেকে শুরু করে নির্মাণ শ্রমে তাদের অংশগ্রহণ বেশি। কোনো আমেরিকান বেকার থাকলেও সাধারণত এসব কাজ তারা করে না।সাধারণত কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বেকার, কাজ না করার মানসিকতা বেশি। তারা শিক্ষা-দীক্ষায়ও বেশি দূর যেতে পারে না। ফলে তাদের ভাগ্যে ভালো চাকরি জোটে না। স্কুলের সীমানা পার হতে পারে না অনেকেই। তাই বেকার জীবন তাদের বেছে নিতে হয়। বেছে নিতে হয় ‘ঘেটো’ জীবন। মিসৌরিতে যেখানে মাইকেল ব্রাউনের হত্যাকা- ঘটেছিল, ওই এলাকা কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত। সেখানে শ্বেতাঙ্গ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কম। এখন ওই একটি ঘটনায় বৈষম্যের বিষয়টি আবার সামনে এলো। এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম ঘটল না। এর আগেও ঘটেছে। এতে উচ্চমহলে কোনো বড় উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। প্রেসিডেন্ট ওবামা এই ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন, ধৈর্য ধরতে বলেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মধ্যে হতাশা আছে। তবে তারা শক্তিশালী নয়। তাদের রাজনৈতিক শক্তিও দুর্বল। হঠাৎ করেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে। আবার তা থেমেও যায়। ফার্গুসনের ঘটনার এভাবেই অবসান হবে। তবে শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ বৈষম্য ও দ্বন্দ্ব থেকেই যাবে। Daily Amader Somoy 08.12.14

0 comments:

Post a Comment