ইসলামী জঙ্গিরা যে মানবতা ও স্থিতিশীলতার প্রতি কত বড় হুমকি, পেশোয়ারে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত স্কুলে পাকিস্তানি তালেবানের হামলা ও ১৩৮টি শিশুকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে তা প্রমাণিত হলো। নিরপরাধ এই শিশুদের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যাকাণ্ড শুধু যে পাকিস্তানে একটি সিভিলিয়ান প্রশাসনের অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে তা নয়, বরং পাকিস্তানের অস্তিত্বই আজ প্রশ্নের মুখে। পাকিস্তানের সমাজব্যবস্থা যে আজ এক ধর্মীয় অপরাজনীতি দ্বারা চালিত হচ্ছে, এই হত্যাকাণ্ড এর বড় প্রমাণ। ধর্মীয় উগ্রবাদ সেখানে ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। ভাবতে অবাক লাগে, একসময় যে এলাকায় বাম রাজনীতির প্রভাব ছিল, 'সীমান্ত গান্ধী' হিসেবে পরিচিত গাফফার খান যে অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জন্য জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাজ করে গেছেন ও অহিংস পদ্ধতিতে তাঁর 'লড়াই' অব্যাহত রেখেছিলেন, সেই অঞ্চল আজ ধর্মীয় উগ্রবাদে আক্রান্ত। সেখানকার মানুষের মানসিকতা বদলে গেছে। ধর্মীয় কূপমণ্ডূকতা এই একুশ শতকে এসেও সমাজ বিনির্মাণে প্রভাব খাটাচ্ছে। পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদের শিকড় যে কত গভীরে, এটা আবারও প্রমাণিত হলো। তবে সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে ২০১৪ সালে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে মুসলিম বিশ্বে এক ধরনের উগ্রবাদ। এই উগ্রবাদ আজ সিরিয়া-ইরাকের অস্তিত্ব যেমন বিপন্ন করে তুলেছে, ঠিক তেমনি তা সম্প্রসারিত হয়েছে আফ্রিকায়, বিশেষ করে সুদান ও নাইজেরিয়ায়। উগ্রবাদী গোষ্ঠী আল শাবা (সুদান) ও বোকো হারামের (নাইজেরিয়া) অনেক সহিংস কর্মকাণ্ড ২০১৪ সালে বারবার আলোচিত হয়েছে। ধর্মান্ধ একটি গোষ্ঠী বোকো হারাম যেভাবে শত শত বিরোধীকে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের ধর্মান্তর করছে (খ্রিস্টান থেকে মুসলমান) ও এক ধরনের 'যৌনদাসিত্ব' গ্রহণ করতে বাধ্য করছে, তা বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিয়ে গেছে। কিশোরীদের উদ্ধারে নাইজেরিয়ার সেনাবাহিনীকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বোকো হারামের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সিরিয়ায় জুন মাসে (২০১৪) উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী 'ইসলামিক স্টেট অ্যান্ড লেভেন্ট'-এর উত্থান এর এক অদ্ভুত মিল লক্ষ করা যায়। আরো অবাক করার বিষয় হচ্ছে, অন্তত ৬০টি দেশের মুসলমান নাগরিক বা তথাকথিত 'জিহাদি'রা আজ সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধাদের সঙ্গে তথাকথিত একটি 'খিলাফত' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে! এক চরম উগ্রবাদ এখন এ অঞ্চলের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। 'ইসলামিক স্টেট'-এর (আইএস) আবির্ভাব ও জনৈক আবু বকর বুগদাদির নিজেকে ইসলামী বিশ্বের 'খলিফা' হিসেবে ঘোষণা করা কিংবা কুর্দি অঞ্চলে ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মহিলা তথা কিশোরীদের ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের 'যৌনদাসী'তে পরিণত করার কাহিনী একাধিকবার সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও বিশ্ব সম্প্রদায় এ ক্ষেত্রে ছিল অনেকটা নির্লিপ্ত। আইএসের উত্থান তথা অগ্রযাত্রা রোধ করা সম্ভব হয়নি। ইরাক ও সিরিয়ার কিছু অঞ্চল নিয়ে অলিখিত এক 'সুন্নিস্থান'-এর জন্ম হয়েছে। সুন্নি নিয়ন্ত্রিত এই বিশাল এলাকায় তথাকথিত 'ইসলামিক স্টেট'-এর জঙ্গিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্র এই 'ইসলামিক স্টেট'-এর জঙ্গিদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা শুরু করলেও তাদের অগ্রযাত্রা রোধ করা সম্ভব হয়নি। তাই ২০১৫ সালের বিশ্বরাজনীতিতে এই ইসলামী জঙ্গিরা বারবার আলোচনায় আসবে।
২০১৪ : বিশ্বরাজনীতির চালচিত্র
২০১৪ সালে দুটি বড় দেশ ভারত ও ইন্দোনেশিয়ায় 'গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা' অব্যাহত থাকলেও ইউক্রেন পরিস্থিতি সেখানে যে সংকটের জন্ম দিয়েছিল, তা ডিসেম্বরের শেষ দিন পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ভারতে মোদির বিজয় ও ইন্দোনেশিয়ায় জোকো উইদোদোর প্রসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি প্রমাণ করে বড় গণতান্ত্রিক সমাজে এক ধরনের 'পপুলিজম'-এর জন্ম হয়েছে। অর্থাৎ সাধারণ একজন মানুষ শুধু তাঁর নিষ্ঠা, সততা আর 'কমিটমেন্ট'-এর কারণে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হতে পারেন। মোদি ও উইদোদো এর বড় প্রমাণ। মোদি একসময় রেলস্টেশনে চা বিক্রি করতেন। আর অত্যন্ত জনপ্রিয় উইদোদো ছিলেন বস্তির ছেলে। শুধু জনপ্রিয় নীতি আর সততার কারণে তাঁরা আজ বিশ্বনেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। ভারতে কংগ্রেসের ব্যর্থতাই বিজেপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। আর মোদি সেখানে এক ধরনের 'পপুলিজম'-এর জন্ম দিয়েছেন।
তবে উইদোদোর বিজয় অতি সহজ ছিল না। সেনা নিয়ন্ত্রিত ইন্দোনেশিয়ায় তিনি নিজেকে একজন 'যোগ্য নেতা' হিসেবে প্রমাণ করেছেন। তবে গণতন্ত্রের জন্যও 'অশনিসংকেত' ছিল থাইল্যান্ড, হংকং ও পাকিস্তানে। মে মাসে সেনাবাহিনী থাইল্যান্ডে ক্ষমতা দখল করে ও সেনাপ্রধান নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঘোষণা দেন। থাই রাজনৈতিক দলের ব্যর্থতার কারণেই সেখানে গণতন্ত্র বিকশিত হতে পারছে না। আর সেনাবাহিনী এই সুযোগটাই গ্রহণ করেছে। পাকিস্তানে ইমরান খানের নেতৃত্বে ইসলামাবাদে একটি 'অক্যুপাই মুভমেন্ট'-এর জন্ম হলেও সরকারের পতন হয়নি। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের জন্য সেটা ছিল খারাপ সংবাদ। একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে সেখানে সাধারণ নির্বাচন সম্পন্ন হয় এবং নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ আবার ক্ষমতা ফিরে পায়। পেশোয়ারের শিশু হত্যাকাণ্ড ঘটনায় নওয়াজ শরিফ ও ইমরান খানকে কাছাকাছি আনলেও তা কত দিন স্থায়ী হয়, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। ডিসেম্বরে জাপানে নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আবেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থেকে গেছেন।
চলতি বছর ইউক্রেন সংকট এ অঞ্চলে একটি বড় ধরনের 'যুদ্ধের' আশঙ্কার জন্ম হলেও শেষ পর্যন্ত 'যুদ্ধ' হয়নি সত্য; কিন্তু এই সংকট ২০১৫ সালের বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। সংকটের জন্ম ক্রিমিয়ায় মার্চে অনুষ্ঠিত একটি গণভোটের মধ্য দিয়ে। ভূ-রাজনৈতিকভাবে ক্রিমিয়ার অবস্থান রাশিয়ার কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিকভাবেই রুশ নাগরিকরা ক্রিমিয়ায় বসবাস করে। গণভোটে তারা রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির পক্ষে রায় দেয়। এর প্রভাব পড়ে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দোনেতসক ও লুসাক অঞ্চলে। সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের জন্ম হয় এবং রাশিয়ার মদদে তা ব্যাপকতা পায়। ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সংকটের কোনো সমাধান হয়নি। বরং যুক্তরাষ্ট্র বারবার চেয়ে এসেছে, ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। তাতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে ন্যাটো তথা যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে রাশিয়া মনে করে, তার সীমান্তে ন্যাটোর সেনাবাহিনীর উপস্থিতি তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। ফলে এই সংকট থেকে গেছে এবং ধারণা করছি, ২০১৫ সালেও এই সংকট থাকবে।
চলতি বছর আরো একটি 'ভালো খবর'-এর জন্ম হয়েছে। জলবায়ুবিষয়ক কপ-২০ সম্মেলনে (লিমা, পেরু) একটি আংশিক সমঝোতা হয়েছে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত হয়েছে, বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে বিশ্বের প্রতিটি দেশ স্ব-উদ্যোগে কর্মসূচি গ্রহণ করবে এবং ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষর করবে। লিমায় বাহ্যত কোনো চুক্তি হয়নি। হয়েছে একটি সমঝোতা। চূড়ান্ত বিচারে মার্কিন কংগ্রেস এই 'আংশিক সমঝোতা'টি মেনে নেবে কি না, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। ফলে প্যারিস কপ-২১ সম্মেলন নিয়েও প্রশ্ন থাকবে অনেক। এবোলায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু নিয়ে চলতি বছর কম কথা হয়নি। পশ্চিম আফ্রিকার তিনটি দেশে এই রোগের বিস্তার ও খোদ যুক্তরাষ্ট্রে একজনের মৃত্যু সারা বিশ্বে আলোচিত হয়। তবে বছরের শেষ দিন পর্যন্ত কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কারের খবর আমাদের জানা নেই। মালয়েশিয়ান এয়ারলাইনসের একটি বিমান (ফ্লাইট ৩৭০) উধাও হয়ে যাওয়া ও এর কোনো হদিস না পাওয়ার ঘটনাও কম আলোচিত হয়নি। স্কটল্যান্ডে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারিতে। গণভোটে স্বাধীন হওয়ার পক্ষে রায় পড়েনি। স্কটিশরা যুক্তরাজ্যের সঙ্গে থাকতেই রায় দিয়েছে। এটা ইউরোপের রাজনীতির জন্য ছিল উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা। ইরান নিয়ে আলোচনা ছিল কম। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে 'গোপন সমঝোতা' ও সিরিয়ায় আইএসের উত্থান ঠেকাতে ইরানকে ব্যবহার করার বিষয়টিও গণমাধ্যমে আলোচিত হয়েছে। ইসরায়েলের দীর্ঘ সাত সপ্তাহ ধরে গাজায় বোমা করা বর্ষণ এবং নারী ও শিশুদের হত্যা করার ঘটনায় বিশ্ববিবেক জাগ্রত হলেও যুক্তরাষ্ট্র বা জাতিসংঘ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
Daily kalerkontho
28 December 2014, Sunday
0 comments:
Post a Comment