এ কোন বাংলাদেশকে আমরা দেখছি! মাত্র দু’সপ্তাহ আগে ইসলামিক স্টেটের (আইএস)
পক্ষ থেকে যখন ঘোষণা করা হল বাংলাদেশে আইএস ঘাঁটি করতে যাচ্ছে এবং সেখানে
একজন দলীয় প্রধান আছেন (শেখ আবু ইব্রাহিম আল হানিফ), এ বক্তব্যের রেশ
ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই দেশে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে দুটি ঘটনা ঘটল। প্রথম
ঘটনায় চাপাতির কোপে হত্যা করা হল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের
শিক্ষক অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে। এর একদিনের মাথায় ঢাকার কলাবাগানে
হত্যা করা হল মার্কিন দূতাবাসের সাবেক প্রটোকল কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান ও
তার বন্ধু মাহবুব রাব্বী তনয়কে। আর সাইট ইন্টেলিজেন্স বরাবরের মতো প্রকাশ
করল, ‘এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত আল কায়দার উপমহাদেশ শাখা।’ এর আগে সিজারি
তাভেল্লা (সেপ্টেম্বর ২০১৫) ও কুনিও হোশি (অক্টোবর ২০১৫) হত্যাসহ আরও
কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের খবর প্রকাশ করে সাইট দাবি করেছিল, ‘এসব হত্যাকাণ্ডে
আইএস জড়িত।’ আর সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে মার্কিন
রাষ্ট্রদূত বার্নিকাট বলেছেন, ‘বাংলাদেশে আইএস আছে এবং বাংলাদেশ সরকারকে তা
বিশ্বাস করতে হবে।’ এর আগে সরাসরিভাবে কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ
থেকে বলা হয়নি যে বাংলাদেশে আইএস আছে। অবশ্য আকার-ইঙ্গিতে তারা বারবার বলার
চেষ্টা করেছে, এখানে আইএস বা আল কায়দা আছে।
বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু দিন ধরেই একটি চাপের মুখে আছে। এখন বার্নিকাট সরাসরি বললেন, আইএস আছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কারও বক্তব্যেই বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি স্বীকার করে নেয়া হয়নি। শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করলেন একটা কথা- ‘সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে সেল গঠন করবে।’ এর আগে অবশ্য তথ্যমন্ত্রী ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, বাংলাদেশে আল কায়দা আছে। এটা নিয়ে অনেককে আমি উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখেছি। একজন সিনিয়র মন্ত্রী যখন আল কায়দা আছে বলে স্বীকার করেন, আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন নিজে (২৭ এপ্রিল) বলেন, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই, কিন্তু জঙ্গি আছে; তখন এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয় বৈকি। জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডে যে আল কায়দার উপমহাদেশ শাখা জড়িত (বাংলাদেশে এরা অপারেট করছে আনসার আল ইসলাম নামে), তা তো ইতিমধ্যে সাইট ইন্টেলিজেন্স আমাদের জানিয়েই দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইএস নেই, কিন্তু জঙ্গি আছে, এমন কথা কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করে না। তথ্যমন্ত্রী যখন কথা বলেন, তখন বোধকরি আমরা ধরে নিতেই পারি এটা সরকারের অবস্থান। যদিও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এখন অব্দি এ ধরনের কোনো স্বীকারোক্তি আমরা শুনিনি। আমাদের ভয়টা হচ্ছে এখানে- এখন একজন মন্ত্রী বলছেন আল কায়দা আছে, কাল যদি আরেকজন মন্ত্রী বলেন আইএস আছে(?), তখন আমরা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের যে অভিযান, তার আওতায় এসে যাব! যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশে সন্ত্রাসীদের নির্মূলের নামে সামরিক অভিযান পরিচালনা করলেও সেসব দেশে সন্ত্রাস দমন হওয়া তো দূরের কথা, সন্ত্রাসের মাত্রা সেখানে আরও বেড়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া- যেখানেই মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে, সেখানে সন্ত্রাসের মাত্রা কীভাবে বেড়েছে, তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এখন এ ‘খেলায়’ বাংলাদেশকেও কি জড়ানো হচ্ছে?
বাংলাদেশে আইএস বা আল কায়দার ঘাঁটি রয়েছে, এ ধরনের ‘তত্ত্ব’ যারা উপস্থাপন করেছেন কিংবা করতে চান, তারা সত্য বলছেন না। কেননা আইএস যেভাবে তাদের সংগঠন পরিচালনা করে, বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব আমার চোখে ধরা পড়েনি। বলতে গেলে নেইও। আর যারা বাংলাদেশে আল কায়দা আছে বলে মনে করেন এবং বলেনও, তারা আবু মুসাব আল সুরির 'Global Resistance Movement' বইটি পড়ে দেখতে পারেন। বইটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে এবং এর অংশবিশেষ ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। আবু মুসাবকে বলা হয় আল কায়দার তাত্ত্বিক। কীভাবে একটি জিহাদি সংগঠন পরিচালিত হবে (স্পাইডার ওয়েব বা মাকড়সার জাল তত্ত্ব) তার বর্ণনা আছে এতে। আল কায়দার সন্ত্রাসীরা এ তত্ত্ব তাদের অপারেশন পরিচালনার সময় ব্যবহার করে। এদের স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো উগ্র সংগঠনের মিল আছে বলে আমার কখনোই মনে হয়নি। তবে এটা সত্য, দেশে কিছু উগ্র সংগঠন রয়েছে। এরা ইসলামের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই এবং মানুষ এদের পছন্দও করে না। বাংলাদেশ একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। সে ক্ষেত্রে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এখানে মানুষ এদের ‘রাজনীতি’ গ্রহণ করে নেয়নি কোনোদিন। তাই সাম্প্রতিক সময়ের সব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএস জড়িত বলে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা বাহ্যত নিছক বিভ্রান্তিকর একটি অপচেষ্টা। প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। লন্ডনের Institute for Economics and Peace প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের একটি তালিকা তুলে ধরে। Global Terrorism Index 2014 সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে (২০১৫ সালে প্রকাশিত) ইরাককে যেখানে সন্ত্রাসকবলিত দেশ হিসেবে এক নম্বরে দেখানো হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩ নম্বরে। এতে বোঝা যায়, সন্ত্রাসের কারণে বাংলাদেশে ঝুঁকি কত কম। মোট ১৬২টি দেশ নিয়ে এ গবেষণা হয়েছিল। যেহেতু সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং কর্পোরেট হাউসগুলোর স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্ব একে টিকিয়ে রাখছে, সেহেতু বাংলাদেশের মতো দেশে এর ছিটেফোঁটা যে লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশ কখনোই ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ছিল না এবং এখনও নেই। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক Reader Supported News আমাদের জানাচ্ছে, ২০০২ সালের পর থেকে বিশ্বে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে ৬৫০০ ভাগ হারে। আর সন্ত্রাসী আক্রমণের হার বেড়েছে ৪৫০০ ভাগ হারে। মূলত যেখানে মার্কিন সেনার উপস্থিতি ছিল (ইরাক ও আফগানিস্তান), সেখানেই এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৪ সালে ৭৪ ভাগ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে ৫টি দেশে- ইরাক, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও সিরিয়ায়। তাই কোনো পর্যায়েই বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তালিকায় ফেলা যাবে না। বাংলাদেশ অতীতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড মোকাবেলায় যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রশংসা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের Country Report on Terrorism 2014-এ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে কোনো বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। South Asia Terrorism Portal-এও বাংলাদেশের এ ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। বাংলাদেশ Global Coalition to Counter ISIL-এ যোগ না দিলেও Global Fund for Community Engagement and Resilience-এর বোর্ড মেম্বার। এটির জন্ম হয় ২০১৪ সালে। ফলে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বাংলাদেশের স্পষ্ট কমিটমেন্ট রয়েছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসকে জড়ানো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের একটি উদ্যোগ বলেই আমার মনে হয়েছে। এর পেছনে কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ যে নেই, তা হলফ করে বলা যাবে না।
আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এখন যত দ্রুত সম্ভব প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের মোটিভ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এটা যদি অনুদ্ঘাটিত থেকে যায়, তাহলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ সম্পর্কে বিদেশে বিভ্রান্তি বাড়বেই। এটা আমাদের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। বাংলাদেশ এখন Global Coalition of Counter ISIL-এ যোগ দিতে পারে। আইএসের জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ এবং সিরিয়া-ইরাক থেকে আইএস জঙ্গিদের উৎখাতের ব্যাপারে পশ্চিমা উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশ সংহতি প্রকাশ করেছে ইতিমধ্যে। তবে সর্বশেষ জুলহাজ-তনয় হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনটা জরুরি। একই সঙ্গে সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশে সব দলের ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন। আমরা যদি ‘ব্লেম গেমের’ আশ্রয় নিই, তাহলে এ থেকে সুযোগ নেবে তৃতীয় পক্ষ। জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ড নিছক একটি সাধারণ ঘটনা নয়। যারা হত্যা করেছে, তারা প্রশিক্ষিত খুনি ও বাংলাদেশী। কিন্তু তাদের কারা প্ররোচিত করেছে, কোন ‘শক্তি’ এর পেছনে কাজ করেছে, এটা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেক ‘প্রশ্ন’ ও ‘জিজ্ঞাসা’ থেকে গেল। জানি না আমাদের গোয়েন্দারা এসবের কোনো জবাব আমাদের দিতে পারবেন কি-না। সেই সঙ্গে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন- জঙ্গিবাদ প্রশ্নে একজনেরই বক্তব্য প্রদান করা ভালো। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বক্তব্য দিলে তা বিভ্রান্তি বাড়ায়। আমাদের তথ্যমন্ত্রী প্রায়ই জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেন। একই সঙ্গে আমাদের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ, এমনকি আইনশৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ জঙ্গিবাদ নিয়ে এমনসব কথা বলেন, যা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায়। এখন যেদিকে বেশি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে- এক. প্রতিটি ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সম্পন্ন করা এবং দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। না হলে এক ধরনের আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে। দুই. বাংলাদেশে ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’ ফোর্সকে আরও শক্তিশালী করা। এ ক্ষেত্রে দক্ষ তরুণ অফিসারদের নিয়োগ দেয়া। তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিয়ে দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ দেয়া। তিন. গোয়েন্দা কার্যক্রমে শৈথিল্য রয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। রাতে তল্লাশি বেড়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। এটা যেন স্থায়ী হয়। মনিটরিং যেন বাড়ানো হয়। একটা ঘটনা ঘটল, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কিছুদিন থাকল, তারপর তৎপরতা থেমে গেল- এমনটি যেন না হয়। চার. যদি আইএস (বা আল কায়দা) থেকে থাকে, তা স্পষ্ট করা হোক। পাঁচ. জঙ্গি প্রশ্নে রাষ্ট্রের একজন মুখপাত্র কথা বলবেন। সবাই কথা বললে নানা রকম বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
জঙ্গি কার্যক্রম পুলিশি তৎপরতার কারণে থেমে থাকবে, এটা আমার মনে হয় না। হয়তো জঙ্গিরা প্রস্তুত হচ্ছে। পরবর্তী টার্গেট ঠিক করছে। আর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন যদি সত্য হয়, তাহলে পরবর্তী টার্গেট হবেন মুক্তচিন্তার যে কোনো একজন বুদ্ধিজীবী! এ দানবের হাত থেকে আমরা কেউই মুক্ত নই। তাই প্রয়োজন জনসচেতনতার। প্রয়োজন সন্ত্রাস প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যের। ‘ব্লেম গেমের’ রাজনীতি জঙ্গিদের হাতকে আরও শক্তিশালী করবে মাত্র। কোনো বড় দল যদি সত্যি সত্যিই জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে, আমরা চাইব ওই দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হোক। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্মে জঙ্গিবাদের কোনো সুযোগ নেই। সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান পবিত্র কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। সেখানে তিনি সূরা আন আমের ১৫১ আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে : ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না’। কাজেই উগ্রপন্থীরা ইসলামের নামে গলা কেটে যাদের হত্যা করছে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে ইসলাম সমর্থন করে না। যারা এ ধরনের কাজ করছে তারা বিভ্রান্ত। তারা দেশে একটি অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। এ বিষয়গুলো আজ ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। জুলহাজ হত্যার পর গত এক সপ্তাহ ধরে টিভি চ্যানেলগুলো এটা নিয়ে অনেক টকশো করেছে। শুধু একটি চ্যানেলে (বিটিভি নয়) আমি দেখলাম ইসলামী চিন্তাবিদদের এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এ ধরনের অনুষ্ঠান আরও হওয়া উচিত, যাতে করে বিভ্রান্তরা মূলধারায় ফিরে আসতে পারে। জঙ্গি তৎপরতায় অর্থ একটা ফ্যাক্টর। আমার ধারণা, জঙ্গিদের কাছে বিভিন্ন সূত্র থেকে বিদেশ থেকে অর্থ আসছে। এটা বন্ধ করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
আমরা নিশ্চিত হতে চাই, আমরা যারা শিক্ষক, সংবাদপত্রের কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী বা অভিনেতা-অভিনেত্রী- আমরা কেউই জঙ্গিদের পরবর্তী টার্গেটে পরিণত হব না। ইসলাম মানবতার ধর্ম, শান্তির ধর্ম। আততায়ীর গুলি এ ধর্ম পালনে, বিশ্বাসে আমাকে যেন ভীত না করে। বেঁচে থাকার স্বাভাবিক গ্যারান্টি আমরা সবাই চাই। রাষ্ট্র আমাদের এতটুকু নিশ্চয়তা দেবে, এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।
আরও একটা কথা। কূটনৈতিকভাবেও আমাদের আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য সিনেটর কার্ডিন এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের শিকড় চিহ্নিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। একই অভিমত যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথবিষয়কমন্ত্রী হুগো সোয়্যারের। জাতিসংঘের ঢাকাস্থ প্রতিনিধি জুলহাজ-তনয় হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন এভাবে : দোষীদের দায়মুক্তি অসহিষ্ণুতা আরও বাড়িয়ে দেবে। এ ধরনের মন্তব্য আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। আমরা যদি সব হত্যার (অভিজিৎ থেকে জুলহাজ-তনয় পর্যন্ত) বিচার করতে ব্যর্থ হই, তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের চাপে এবং পশ্চিমা মিডিয়ার প্রচারণায় বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব স্বীকৃতি পেয়ে যাবে! এরপর মার্কিন চাপের কাছে আমরা ‘হেরে’ যাব। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) একেএম শহীদুল হক একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন অতি সম্প্রতি। তিনি বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশকে ইরাক-সিরিয়া বানাতে চায়। পুলিশের সর্বাধিনায়ক যখন এ ধরনের কথা বলেন তখন তা আমাদের ভাবনায় ফেলে দেয় বৈকি। তাই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখার জন্য সব পক্ষকে আহ্বান জানাই। Daily Jugnator 01.05.16
বাংলাদেশ সরকার বেশ কিছু দিন ধরেই একটি চাপের মুখে আছে। এখন বার্নিকাট সরাসরি বললেন, আইএস আছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী কিংবা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কারও বক্তব্যেই বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি স্বীকার করে নেয়া হয়নি। শুধু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকার করলেন একটা কথা- ‘সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে সেল গঠন করবে।’ এর আগে অবশ্য তথ্যমন্ত্রী ভারতের ‘দ্য হিন্দু’ পত্রিকাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, বাংলাদেশে আল কায়দা আছে। এটা নিয়ে অনেককে আমি উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখেছি। একজন সিনিয়র মন্ত্রী যখন আল কায়দা আছে বলে স্বীকার করেন, আবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন নিজে (২৭ এপ্রিল) বলেন, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই, কিন্তু জঙ্গি আছে; তখন এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয় বৈকি। জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডে যে আল কায়দার উপমহাদেশ শাখা জড়িত (বাংলাদেশে এরা অপারেট করছে আনসার আল ইসলাম নামে), তা তো ইতিমধ্যে সাইট ইন্টেলিজেন্স আমাদের জানিয়েই দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইএস নেই, কিন্তু জঙ্গি আছে, এমন কথা কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করে না। তথ্যমন্ত্রী যখন কথা বলেন, তখন বোধকরি আমরা ধরে নিতেই পারি এটা সরকারের অবস্থান। যদিও প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এখন অব্দি এ ধরনের কোনো স্বীকারোক্তি আমরা শুনিনি। আমাদের ভয়টা হচ্ছে এখানে- এখন একজন মন্ত্রী বলছেন আল কায়দা আছে, কাল যদি আরেকজন মন্ত্রী বলেন আইএস আছে(?), তখন আমরা ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ যুক্তরাষ্ট্রের যে অভিযান, তার আওতায় এসে যাব! যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশে সন্ত্রাসীদের নির্মূলের নামে সামরিক অভিযান পরিচালনা করলেও সেসব দেশে সন্ত্রাস দমন হওয়া তো দূরের কথা, সন্ত্রাসের মাত্রা সেখানে আরও বেড়েছে। আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া- যেখানেই মার্কিন সামরিক হস্তক্ষেপ হয়েছে, সেখানে সন্ত্রাসের মাত্রা কীভাবে বেড়েছে, তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এখন এ ‘খেলায়’ বাংলাদেশকেও কি জড়ানো হচ্ছে?
বাংলাদেশে আইএস বা আল কায়দার ঘাঁটি রয়েছে, এ ধরনের ‘তত্ত্ব’ যারা উপস্থাপন করেছেন কিংবা করতে চান, তারা সত্য বলছেন না। কেননা আইএস যেভাবে তাদের সংগঠন পরিচালনা করে, বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো সংগঠনের অস্তিত্ব আমার চোখে ধরা পড়েনি। বলতে গেলে নেইও। আর যারা বাংলাদেশে আল কায়দা আছে বলে মনে করেন এবং বলেনও, তারা আবু মুসাব আল সুরির 'Global Resistance Movement' বইটি পড়ে দেখতে পারেন। বইটি ২০০৪ সালে প্রকাশিত হয়েছে এবং এর অংশবিশেষ ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। আবু মুসাবকে বলা হয় আল কায়দার তাত্ত্বিক। কীভাবে একটি জিহাদি সংগঠন পরিচালিত হবে (স্পাইডার ওয়েব বা মাকড়সার জাল তত্ত্ব) তার বর্ণনা আছে এতে। আল কায়দার সন্ত্রাসীরা এ তত্ত্ব তাদের অপারেশন পরিচালনার সময় ব্যবহার করে। এদের স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো উগ্র সংগঠনের মিল আছে বলে আমার কখনোই মনে হয়নি। তবে এটা সত্য, দেশে কিছু উগ্র সংগঠন রয়েছে। এরা ইসলামের নামে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এদের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই এবং মানুষ এদের পছন্দও করে না। বাংলাদেশ একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। সে ক্ষেত্রে মানুষকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এখানে মানুষ এদের ‘রাজনীতি’ গ্রহণ করে নেয়নি কোনোদিন। তাই সাম্প্রতিক সময়ের সব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএস জড়িত বলে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, তা বাহ্যত নিছক বিভ্রান্তিকর একটি অপচেষ্টা। প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন। লন্ডনের Institute for Economics and Peace প্রতিবছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সন্ত্রাসবাদী কার্যক্রমের একটি তালিকা তুলে ধরে। Global Terrorism Index 2014 সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে (২০১৫ সালে প্রকাশিত) ইরাককে যেখানে সন্ত্রাসকবলিত দেশ হিসেবে এক নম্বরে দেখানো হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ২৩ নম্বরে। এতে বোঝা যায়, সন্ত্রাসের কারণে বাংলাদেশে ঝুঁকি কত কম। মোট ১৬২টি দেশ নিয়ে এ গবেষণা হয়েছিল। যেহেতু সন্ত্রাসবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা এবং কর্পোরেট হাউসগুলোর স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্ব একে টিকিয়ে রাখছে, সেহেতু বাংলাদেশের মতো দেশে এর ছিটেফোঁটা যে লাগবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশ কখনোই ঝুঁকিপূর্ণ দেশ ছিল না এবং এখনও নেই। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক Reader Supported News আমাদের জানাচ্ছে, ২০০২ সালের পর থেকে বিশ্বে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে ৬৫০০ ভাগ হারে। আর সন্ত্রাসী আক্রমণের হার বেড়েছে ৪৫০০ ভাগ হারে। মূলত যেখানে মার্কিন সেনার উপস্থিতি ছিল (ইরাক ও আফগানিস্তান), সেখানেই এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৪ সালে ৭৪ ভাগ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে ৫টি দেশে- ইরাক, নাইজেরিয়া, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও সিরিয়ায়। তাই কোনো পর্যায়েই বাংলাদেশকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের তালিকায় ফেলা যাবে না। বাংলাদেশ অতীতে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড মোকাবেলায় যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রশংসা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের Country Report on Terrorism 2014-এ স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে কোনো বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেনি। South Asia Terrorism Portal-এও বাংলাদেশের এ ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। বাংলাদেশ Global Coalition to Counter ISIL-এ যোগ না দিলেও Global Fund for Community Engagement and Resilience-এর বোর্ড মেম্বার। এটির জন্ম হয় ২০১৪ সালে। ফলে সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে বাংলাদেশের স্পষ্ট কমিটমেন্ট রয়েছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি স্পর্শকাতর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসকে জড়ানো বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের একটি উদ্যোগ বলেই আমার মনে হয়েছে। এর পেছনে কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ যে নেই, তা হলফ করে বলা যাবে না।
আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এখন যত দ্রুত সম্ভব প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের মোটিভ খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এটা যদি অনুদ্ঘাটিত থেকে যায়, তাহলে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ সম্পর্কে বিদেশে বিভ্রান্তি বাড়বেই। এটা আমাদের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। বাংলাদেশ এখন Global Coalition of Counter ISIL-এ যোগ দিতে পারে। আইএসের জঙ্গি তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ এবং সিরিয়া-ইরাক থেকে আইএস জঙ্গিদের উৎখাতের ব্যাপারে পশ্চিমা উদ্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশ সংহতি প্রকাশ করেছে ইতিমধ্যে। তবে সর্বশেষ জুলহাজ-তনয় হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনটা জরুরি। একই সঙ্গে সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশে সব দলের ঐকমত্য থাকা প্রয়োজন। আমরা যদি ‘ব্লেম গেমের’ আশ্রয় নিই, তাহলে এ থেকে সুযোগ নেবে তৃতীয় পক্ষ। জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ড নিছক একটি সাধারণ ঘটনা নয়। যারা হত্যা করেছে, তারা প্রশিক্ষিত খুনি ও বাংলাদেশী। কিন্তু তাদের কারা প্ররোচিত করেছে, কোন ‘শক্তি’ এর পেছনে কাজ করেছে, এটা খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেক ‘প্রশ্ন’ ও ‘জিজ্ঞাসা’ থেকে গেল। জানি না আমাদের গোয়েন্দারা এসবের কোনো জবাব আমাদের দিতে পারবেন কি-না। সেই সঙ্গে আরও একটি কথা বলা প্রয়োজন- জঙ্গিবাদ প্রশ্নে একজনেরই বক্তব্য প্রদান করা ভালো। বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন বক্তব্য দিলে তা বিভ্রান্তি বাড়ায়। আমাদের তথ্যমন্ত্রী প্রায়ই জঙ্গিবাদ নিয়ে কথা বলেন। একই সঙ্গে আমাদের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ, এমনকি আইনশৃংখলা রক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তিবর্গ জঙ্গিবাদ নিয়ে এমনসব কথা বলেন, যা শুধু বিভ্রান্তিই বাড়ায়। এখন যেদিকে বেশি দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন তা হচ্ছে- এক. প্রতিটি ক্ষেত্রে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সম্পন্ন করা এবং দোষী ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা। না হলে এক ধরনের আস্থার সংকট সৃষ্টি হবে। দুই. বাংলাদেশে ‘কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স’ ফোর্সকে আরও শক্তিশালী করা। এ ক্ষেত্রে দক্ষ তরুণ অফিসারদের নিয়োগ দেয়া। তাদের বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নিয়ে দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ বাজেট বরাদ্দ দেয়া। তিন. গোয়েন্দা কার্যক্রমে শৈথিল্য রয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ঢাকা শহরে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বেড়েছে। রাতে তল্লাশি বেড়েছে। এটা ভালো লক্ষণ। এটা যেন স্থায়ী হয়। মনিটরিং যেন বাড়ানো হয়। একটা ঘটনা ঘটল, আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা কিছুদিন থাকল, তারপর তৎপরতা থেমে গেল- এমনটি যেন না হয়। চার. যদি আইএস (বা আল কায়দা) থেকে থাকে, তা স্পষ্ট করা হোক। পাঁচ. জঙ্গি প্রশ্নে রাষ্ট্রের একজন মুখপাত্র কথা বলবেন। সবাই কথা বললে নানা রকম বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
জঙ্গি কার্যক্রম পুলিশি তৎপরতার কারণে থেমে থাকবে, এটা আমার মনে হয় না। হয়তো জঙ্গিরা প্রস্তুত হচ্ছে। পরবর্তী টার্গেট ঠিক করছে। আর নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন যদি সত্য হয়, তাহলে পরবর্তী টার্গেট হবেন মুক্তচিন্তার যে কোনো একজন বুদ্ধিজীবী! এ দানবের হাত থেকে আমরা কেউই মুক্ত নই। তাই প্রয়োজন জনসচেতনতার। প্রয়োজন সন্ত্রাস প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দলের ঐক্যের। ‘ব্লেম গেমের’ রাজনীতি জঙ্গিদের হাতকে আরও শক্তিশালী করবে মাত্র। কোনো বড় দল যদি সত্যি সত্যিই জঙ্গি কার্যক্রমের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত থাকে, আমরা চাইব ওই দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হোক। ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম ধর্মে জঙ্গিবাদের কোনো সুযোগ নেই। সাবেক প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান পবিত্র কোরআন শরিফের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন। সেখানে তিনি সূরা আন আমের ১৫১ আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে : ‘আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করো না’। কাজেই উগ্রপন্থীরা ইসলামের নামে গলা কেটে যাদের হত্যা করছে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডকে ইসলাম সমর্থন করে না। যারা এ ধরনের কাজ করছে তারা বিভ্রান্ত। তারা দেশে একটি অরাজকতা সৃষ্টি করতে চায়। এ বিষয়গুলো আজ ব্যাপকভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। জুলহাজ হত্যার পর গত এক সপ্তাহ ধরে টিভি চ্যানেলগুলো এটা নিয়ে অনেক টকশো করেছে। শুধু একটি চ্যানেলে (বিটিভি নয়) আমি দেখলাম ইসলামী চিন্তাবিদদের এ বিষয়ে কথা বলার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এ ধরনের অনুষ্ঠান আরও হওয়া উচিত, যাতে করে বিভ্রান্তরা মূলধারায় ফিরে আসতে পারে। জঙ্গি তৎপরতায় অর্থ একটা ফ্যাক্টর। আমার ধারণা, জঙ্গিদের কাছে বিভিন্ন সূত্র থেকে বিদেশ থেকে অর্থ আসছে। এটা বন্ধ করার ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত।
আমরা নিশ্চিত হতে চাই, আমরা যারা শিক্ষক, সংবাদপত্রের কর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মী বা অভিনেতা-অভিনেত্রী- আমরা কেউই জঙ্গিদের পরবর্তী টার্গেটে পরিণত হব না। ইসলাম মানবতার ধর্ম, শান্তির ধর্ম। আততায়ীর গুলি এ ধর্ম পালনে, বিশ্বাসে আমাকে যেন ভীত না করে। বেঁচে থাকার স্বাভাবিক গ্যারান্টি আমরা সবাই চাই। রাষ্ট্র আমাদের এতটুকু নিশ্চয়তা দেবে, এ প্রত্যাশা আমাদের সবার।
আরও একটা কথা। কূটনৈতিকভাবেও আমাদের আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য সিনেটর কার্ডিন এক বিবৃতিতে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের শিকড় চিহ্নিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। একই অভিমত যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথবিষয়কমন্ত্রী হুগো সোয়্যারের। জাতিসংঘের ঢাকাস্থ প্রতিনিধি জুলহাজ-তনয় হত্যাকারীদের আইনের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি মন্তব্য করেছেন এভাবে : দোষীদের দায়মুক্তি অসহিষ্ণুতা আরও বাড়িয়ে দেবে। এ ধরনের মন্তব্য আমাদের জন্য কোনো ভালো খবর নয়। আমরা যদি সব হত্যার (অভিজিৎ থেকে জুলহাজ-তনয় পর্যন্ত) বিচার করতে ব্যর্থ হই, তাহলে পশ্চিমা বিশ্বের চাপে এবং পশ্চিমা মিডিয়ার প্রচারণায় বাংলাদেশে আইএসের অস্তিত্ব স্বীকৃতি পেয়ে যাবে! এরপর মার্কিন চাপের কাছে আমরা ‘হেরে’ যাব। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি) একেএম শহীদুল হক একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন অতি সম্প্রতি। তিনি বলেছেন, পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশকে ইরাক-সিরিয়া বানাতে চায়। পুলিশের সর্বাধিনায়ক যখন এ ধরনের কথা বলেন তখন তা আমাদের ভাবনায় ফেলে দেয় বৈকি। তাই বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখার জন্য সব পক্ষকে আহ্বান জানাই। Daily Jugnator 01.05.16
0 comments:
Post a Comment