রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন ও বাংলাদেশ

সাতটি অগ্রসর দেশের জোট জি-সেভেনের নেতারা বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়াবলি নিয়ে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টায় বছরে একবার শীর্ষ বৈঠকে মিলিত হন। চাপমুক্ত পরিবেশে অন্তরঙ্গ আলোচনা চালানোর উদ্দেশ্যে বার্ষিক এই সম্মেলন সাধারণত রাজধানী থেকে দূরের কোনো অবকাশকেন্দ্রে আয়োজন করা হয়। জোটের সদস্যরা পালাক্রমে শীর্ষ সম্মেলনের স্বাগতিক দেশের দায়িত্ব পালন করে থাকে। সেই হিসাবে ২০০৮ সালে জাপানের উত্তরের দ্বীপ হোক্কাইডোতে সর্বশেষ সম্মেলনের আয়োজন করার পর ২০১৫ সালে পরবর্তী বৈঠকের আয়োজন দেশটির করার কথা ছিল। 
২০০০ সালের গ্রীষ্মে দক্ষিণের দ্বীপ ওকিনাওয়ায় জাপান অগ্রসর দেশের জোটের শীর্ষ বৈঠক আয়োজন করার সময় রাশিয়াকে ধনী রাষ্ট্রসমূহের এই জোটের অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়েছিল এবং তখন থেকে প্রায় দেড় দশক কাল ধরে জোটটি জি-৮ জোট নামে পরিচিতি পায় এবং জোটভুক্ত রাষ্ট্রের সংখ্যা দাঁড়ায় আটটি। এই আটের হিসাবের মারপ্যাঁচেই জাপানের আয়োজন করা পরবর্তী দুটি সম্মেলনের মধ্যে সময়ের ব্যবধান দাঁড়ায় ১৬ বছর। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করে নিয়ে সেই অঞ্চলকে রাশিয়ার অংশ হিসেবে যুক্ত করে নিলে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে এবং সেই উষ্মার জের হিসেবে সেই একই বছর রাশিয়াকে জি-৮ থেকে খারিজ করে দেওয়া হলে জোট আবারও স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের জি-৭ জোট নামে আগের পরিচিতি ফিরে পায়। এবারের সম্মেলন হচ্ছে সংকুচিত আকারের তৃতীয় সম্মেলন। 
পশ্চিমের অগ্রসর দেশগুলোর আগের সেই অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক দাপট এখন অনেকটাই সংকুচিত। এর কারণ অবশ্য নতুন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের আবির্ভাব এবং বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়ার হারানো অবস্থান আংশিকভাবে হলেও ফিরে পাওয়া। এরপরও সাতটি রাষ্ট্রের শীর্ষ বৈঠক এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে বিশ্বরাজনীতিতে যার প্রভাব একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এ ছাড়া অর্থনৈতিক দিক থেকে জোটের তিনটি সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও জার্মানির অবস্থান হচ্ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ।
স্বাগতিক দেশ জাপানের আয়োজনে এবারের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে মধ্য জাপানের মিয়ে জেলার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত দ্বীপ ইসে-শিমায়। এর অল্প দূরেই আছে জাপানের পবিত্রতম শিন্তো মন্দির ইসে-জিঙ্গু। 
জি-৭ শীর্ষ সম্মেলন হচ্ছে নানা বিষয় নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা করা। শীর্ষ বৈঠকের আগে ও পরে মন্ত্রী পর্যায়ের গোটা দশেক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। জাপানের বিভিন্ন শহরে সে রকম বৈঠক এপ্রিল মাসের গোড়া থেকে শুরু হয়েছে এবং শেষ বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে সেপ্টেম্বর মাসে। তবে সংবাদমাধ্যম ও বিশ্বের নজর মের ২৬ ও ২৭ তারিখে নির্ধারিত নেতাদের শীর্ষ বৈঠকের দিকেই মূলত নিবদ্ধ।
শীর্ষ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আইনি উপায় জি-৭ জোটের নেই। ফলে সেসব সিদ্ধান্তকে জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক পর্যায়ের বিভিন্ন সংগঠনের সামনে রাখা সুপারিশ হিসেবে গণ্য করা মনে হয় অনেক বেশি যুক্তিসংগত। এবারের শীর্ষ সম্মেলনের আলোচ্যসূচিতে বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনীতির সামনে দেখা দেওয়া হুমকি থেকে শুরু করে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, দারিদ্র্য বিমোচন ও নারীর ক্ষমতায়ন পর্যন্ত বিস্তৃত নানা রকম বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অগ্রসর দেশগুলোর মধ্যে চলা আলোচনা ও সম্মেলনের বিভিন্ন সুপারিশকে আরও অর্থবহ করে তোলার উদ্দেশ্যে কয়েক বছর ধরে সম্মেলন চলাকালে নির্বাচিত কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশের প্রতিনিধিদের সেখানে আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ লক্ষ করা গেছে। আগের কয়েকটি সম্মেলনে সাধারণত উন্নয়নশীল কয়েকটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের জোটের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয়। জোট এই উদ্যোগের নামকরণ করেছে আউট-রিচ বা যেটাকে আমরা অন্য প্রান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা বলে আখ্যায়িত করতে পারি। এবারের সম্মেলনে এই আউট-রিচ উদ্যোগ অবশ্য ভিন্ন অবয়ব লাভ করতে চলেছে এবং তা বাংলাদেশের জন্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। 
জি-৭ সম্মেলনের স্বাগতিক দেশ জাপান এবারের আউট-রিচ বৈঠককে ভিন্ন অবয়বের একটি শীর্ষ বৈঠকে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জোটবহির্ভূত সাতটি উন্নয়নশীল দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ নেয়। এর উদ্দেশ্য হলো, ধনী দেশের নেতারা বিশ্ব সমস্যা সমাধানে কী ভাবছেন এবং কী করতে চাইছেন, সেসব প্রশ্নে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তোলা। জাপান যেহেতু অগ্রসর সাতটি দেশের জোটের একমাত্র এশীয় প্রতিনিধি এবং এবারের সম্মেলন যেহেতু এশিয়া মহাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেসব বিষয় বিবেচনায় রেখে এশিয়ার কয়েকটি দেশের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জি-৭ নেতাদের সঙ্গে নির্বাচিত সাতটি উন্নয়নশীল দেশের নেতাদের আলোচনার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে সম্মেলনের শেষ দিন, ২৭ মে।
জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের আউট-রিচ বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য জাপানের নির্ধারণ করে নেওয়া শর্তাবলির ভিত্তিতে এশিয়া মহাদেশের ছয়টি রাষ্ট্রের পাশাপাশি আফ্রিকা ইউনিয়নের সভাপতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনরত দেশের নেতাকেও আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। এশিয়ার ছয়টি বাছাই দেশের মধ্যে তিনটিকে বেছে নেওয়া হয়েছে আসিয়ান জোটের সদস্যভুক্ত ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও লাওস। অন্যদিকে এশিয়ার দ্বীপদেশ হিসেবে জি-৭ শীর্ষ বৈঠকে আমন্ত্রণ পেয়েছে শ্রীলঙ্কা ও সমুদ্রপথের ওপর নির্ভরশীল পাপুয়া নিউগিনি। আর সর্বশেষ শর্ত, অবকাঠামো চাহিদা থাকা দেশ হিসেবে জি-৭ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৭ মের বিশেষ বৈঠকে যোগ দিতে জাপান ভ্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, বিশ্বের সাতটি অগ্রসর দেশের নেতাদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সেখানে আলোচনার সুযোগ পাবেন তিনি।
জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের এই আউট-রিচ বৈঠকে বিশ্বনেতাদের সঙ্গে বসার এই দুর্লভ সুযোগকে ভালোভাবে কাজে লাগাতে হলে নেতাদের আস্থা লাভ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কিছু অঘটন নিয়ে অগ্রসর দেশের নীতিনির্ধারকেরা বেশ উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে জঙ্গিবাদীদের হাতে একের পর এক মানুষ খুন হওয়া এবং অপরাধীদের খুঁজে বের করায় প্রশাসনের ব্যর্থতা। বাংলাদেশে বিনিয়োগ করায় জাপানি ব্যবসায়ীদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ভ্রমণে দেশটির নাগরিকদের জন্য জারি করা সতর্কতা এখনো তুলে নেওয়া হয়নি। উল্লেখ্য, গত বছর অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে একজন জাপানি নাগরিক নিহত হওয়ার পর এই সতর্কতা জারি করা হয়। 
বাংলাদেশে জাপান ও অন্যান্য অগ্রসর দেশের সরকার ও ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ সম্ভাবনা পুরোপুরি কাজে লাগাতে হলে হত্যাকারীদের কেবল শনাক্ত করা নয়, তাদের বিচারের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে পারলে জি-৭ নেতাদের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকটি অনেক বেশি অর্থবহ হবে আশা করি। 

0 comments:

Post a Comment