রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ভারতের পানি রাজনীতির অবসান হোক

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের প্রশ্নটি অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। দু’দেশের মধ্য দিয়ে ৫৪টি নদী প্রবাহিত হলেও শুধু একটি নদীর অর্থাৎ গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি হলেও বাকি নদীগুলোর পানি বণ্টনের ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে অতীতে একটি চুক্তির সম্ভাবনা সৃষ্টি হলেও এ ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি নেই। এই যখন পরিস্থিতি তখন ভারত থেকে আসছে নানা উদ্বেগজনক সংবাদ। এই সংবাদগুলো আমাদের শুধু উদ্বিগ্নই করেনি, আমাদের নানা ‘প্রশ্নের’ মাঝেও ফেলে দিয়েছে। এ সংবাদগুলো আসছে এমন এক সময় যখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন এক উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারত যদি ইতিবাচক সাড়া না দেয়, তাহলে তা দু’দেশের সম্পর্ককে প্রশ্নের মাঝে ফেলে দেবে। এতে করে যে আস্থাহীনতার সৃষ্টি হবে, তা থেকে সুবিধা নেবে ‘তৃতীয় পক্ষ’।

অনেকগুলো উদ্বেগজনক খবর আমরা সম্প্রতি পেয়েছি- এক. গত ১৬ মে ভারতের পানি সম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন, ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের আওতায় ৩০টি লিংক ক্যানালের মাধ্যমে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি সরিয়ে নেয়া হবে। দুই. গত ১০ মে (২০১৬) ফারাক্কা পয়েন্টে বাংলাদেশ মাত্র ১৬ হাজার কিউসেক পানি পেয়েছে। গত বছর এ সময় পানির প্রবাহ ছিল ৬৭ হাজার কিউসেক (সকালের খবর, ১৬ মে ২০১৬)। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এটা বাংলাদেশের সর্বনিু পানিপ্রাপ্তি। সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী নভেম্বর (২০১৫) থেকেই পদ্মায় পানি নেই। যার ফলে সংকটে রয়েছে ২১ জেলার ১২০টি নদী। তিন. তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্নে যখন একটি অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, ঠিক তখনই ভারত গ্রীধারি নদীর ওপর বাঁধ নির্মাণ করছে। ভারত থেকে নেমে আসা এ নদী ধরলার সঙ্গে মিলিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এখন বাঁধ দেয়ার ফলে শুষ্ক মৌসুমে ধরলায় ভয়াবহ নাব্য সংকট দেখা দেবে। ধরলা পরিণত হবে মরা গাঙে। আর বর্ষায় দেখা দেবে ব্যাপক ভাঙন। গ্রীধারি নদী ভারতে উৎপত্তি হয়ে লালমনিরহাট জেলার আদিতমারী উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের নামমাটারি এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। নদীটি আনুমানিক সাড়ে চার কিলোমিটার বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে প্রবাহিত হয়ে লালমনিরহাট জেলার কুঠিবাড়ি দিয়ে পুনরায় ভারতে প্রবেশ করে। প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার প্রবাহিত হয়ে এটি ধরলা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়। অতীতে শতবর্ষের এই ধরলায় ছিল স্বাভাবিক পানি প্রবাহ। এবার এই নদীর পানি শুকিয়ে ধুঁ ধুঁ বালুচরে পরিণত হয়েছে (সমকাল, ২২ মে)।

এই তিনটি উদ্বেগজনক খবরের সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও অনেক ইস্যু। ক. টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও প্রশ্ন রয়ে গেছে। ভারত বারবার বলে আসছে, টিপাইমুখে এমন কিছু করা হবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। এ ধরনের কথা ভারত আন্তঃনদী সংযোগের ক্ষেত্রেও বলেছিল। এখন দেখা যাচ্ছে ভারত এই প্রকল্পে হাত দিয়েছে। ফলে আশংকাটা হচ্ছে, ভারত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প নিয়েও এগিয়ে যাবে। খ. মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরের আগে তিনি কলকাতার একটি পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেছিলেন, বাংলাদেশ আত্রাই নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে! স্পষ্টতই মমতা তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার জন্যই আত্রাই প্রসঙ্গটি তুলেছিলেন। এখন মমতা বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন। ফলে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে শংকা থাকলই।

আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প সংক্রান্ত খবর নতুন নয়। গেল বছর বাংলাদেশ একটি ‘নোট ভারবাল’ও পাঠিয়েছিল। ওই নোটে বাংলাদেশের ভয়াবহ ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিশেষ কমিটির পঞ্চম বৈঠকে মানস-সংকোস-তিস্তা-গঙ্গা সংযোগের মাধ্যমে দক্ষিণে পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে (সকালের খবর, ২৩ জুলাই ’১৫)। শুধু সরকারের পক্ষ থেকে নয়, বরং তখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপির পক্ষ থেকেও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, এই ইস্যুতে (ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প) সরকারকে বিএনপি সব ধরনের সাহায্য করতে প্রস্তুত। আন্তঃনদী সংযোগ ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে দেনদরবারে বিএনপি সরকারকে ‘ব্লাইন্ড সাপোর্ট’ দেবে বলেও বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল। ধারণা করছি, বাংলাদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক সংগঠনও এই ইস্যুতে সরকারের

পাশে থাকবে।

তবে বিষয়টি ভারত সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত কি-না এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। যদিও ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতীর নাম উল্লেখ করে সংবাদটি প্রচারিত হয়েছে, তারপরও ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যাখ্যা এতে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ সরকারের উচিত অতি দ্রুত বিষয়টির ব্যাপারে ভারত সরকারের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া। সাধারণত ‘নোট ভারবাল’ একটি রুটিন ওয়ার্ক। এটা কোনো প্রতিবাদ নয়। ভারত যদি সত্যি সত্যি এ প্রকল্প কার্যকর করে, তাহলে তা হবে মোদির ঢাকা সফরের সময় যে ৬৫ দফা যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার বরখেলাপ। কারণ ৬৫ দফা সংবলিত যৌথ ঘোষণাপত্রের ২১নং দফায় বলা হয়েছে- ‘হিমালয় অঞ্চলের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিষয়ে বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো সিদ্ধান্ত এককভাবে না নেয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।’ এখন ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতীর বক্তব্য কিংবা ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিশেষ কমিটির পঞ্চম বৈঠকের সিদ্ধান্তটি কি যৌথ ঘোষণার ২১নং দফার পরিপন্থী নয়? সুতরাং বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।

এখানে বলা ভালো, ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি মূলত আজকের নয়। এই প্রকল্প নিয়ে খোদ ভারতেই বিতর্ক রয়েছে। এই বিশাল নদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে ভারতের অভ্যন্তরে ৩০টি নদীকে ৯ হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা প্রদান করার জন্য। প্রকল্পটির মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দা ও কাবেরীতে। গোদাবরির পানি নিয়ে যাওয়া হবে কৃষ্ণায় এবং সেখান থেকে পেনার ও কাবেরীতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। এই বিশাল আন্তঃঅববাহিকা পানি প্রত্যাহার প্রকল্প সম্পন্ন করার কথা ২০১৬ সালের মধ্যে। ভারতীয় সুপ্রিমকোর্ট একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্তের মাধ্যমে সরকারকে এ প্রকল্প একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার পরামর্শ প্রদান করেছিল (আগে নির্ধারিত ৪৫ বছরের পরিবর্তে ১০ বছরের মধ্যে)। কিন্তু ভারতের সর্বোচ্চ আদালত এই সত্য অনুধাবনে ব্যর্থ হয়েছে যে, গঙ্গা-কাবেরী সংযোগ প্রকল্প কোনো নতুন ধারণা নয়। এ প্রকল্প কৌশলগতভাবে অগ্রহণযোগ্য ও অবাস্তব হওয়ায় আগেই বেশ কয়েকবার পরিত্যক্ত হয়েছিল। এ কাজের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিক হচ্ছে, ভারত সরকারের এই প্রকল্প তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর জন্য কী ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনবে, তা বিবেচনায় নেয়া হয়নি। একই সঙ্গে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনুসরণযোগ্য আন্তর্জাতিক আইনের স্বীকৃত সব রীতিনীতির প্রতি নিদারুণ উদাসীনতা প্রদর্শন করা হয়েছে।

এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থ-সামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে। তাছাড়া এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থার ভয়াবহ প্রকৃতিগত পরিবর্তন সাধিত হতে পারে। এ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের যেসব ক্ষতি হতে পারে, তা ব্যাখ্যা করা যেতে পারে এভাবে- ১. বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশের যে পানি থাকার কথা, তা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে। ২. বাংলাদেশের মিঠা পানির শতকরা ৮৫ ভাগের উৎস হচ্ছে ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা। ব্রহ্মপুত্র থেকেই শতকরা ৬৫ ভাগ পানি পায় বাংলাদেশ। এ প্রকল্পের কারণে এই পানিপ্রাপ্তি বিঘ্নিত হতে পারে। ৩. ভারতের পানি প্রত্যাহারের ফলে ভূউপরিস্থ পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে আর্সেনিক সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করবে। ৪. মিঠা পানির প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় মৎস্য উৎপাদন কমে যাবে এবং জল পরিবহন ব্যাহত হবে। ৫. পানির অভাবে কৃষি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আন্তঃনদী সংযোগ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ যখন বাড়ছে, তখন তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্নটিও আমাদের জন্য আরেক চিন্তার কারণ। এটিও ঝুলে আছে।

তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনায় নেবে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন’কে বিবেচনায় নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি তীরবর্তী রাষ্ট্র তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানি সম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিতে। কিন্তু এই ‘যুক্তি ও ন্যায়ের ভিত্তিটি’ উপেক্ষিত থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ কনভেনশন’ নামে একটি নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ব্যবহার, অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে সমর্থন করে না।

আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের ১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমি বিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ- প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।

তিস্তায় পানির প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মাঝে রয়েছে। আমরা চাই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান। এ ক্ষেত্রে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, মোদি সরকার একটি চুক্তিতে যেতে চায়। ইতিমধ্যে স্থলসীমানা চুক্তিতে সম্মতি দিয়ে মমতা ব্যানার্জি ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন। এখন তিস্তার ব্যাপারেও তিনি এমনটি করতে পারেন। এটা কঠিন নয়। তিনি যদি সত্যিই আন্তরিক হন, তাহলে তিনি কল্যাণ রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি নিজে এই কমিশন গঠন করেছিলেন। কলকাতার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রুদ্র কমিশন পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দেয়া রিপোর্টে বলেছে, পশ্চিমবঙ্গকে ক্ষতি না করেও বাংলাদেশকে শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেয়া সম্ভব। তার এই বক্তব্যকে সমর্থন করেছেন আরেকজন পানি বিশেষজ্ঞ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক প্রণব কুমার রায়। অধ্যাপক রায়ের অভিমত হচ্ছে, তিস্তায় পানি নেই এ কথাটা ঠিক নয়। পানি মজুদ রেখে (বর্ষা মৌসুমে) ও ম্যানেজমেন্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে এ সমস্যার সমাধান করা যায়। সে কারণেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার নির্বাচনে মমতা ব্যানার্জির বিজয় যখন নিশ্চিত হয়েছে, তখন সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি ওঠে তা হচ্ছে, যে ‘আস্থা ও বিশ্বাস রাখার’ কথা তিনি ঢাকায় বলে গিয়েছিলেন, তা তিনি রাখবেন কি-না? চতুর মমতা তিস্তা চুক্তি না করে উত্তরবঙ্গে তার আসন বাড়িয়েছেন। আগেরবার তার আসন কম ছিল। তিস্তা চুক্তি নিয়ে উত্তরবঙ্গের মানুষের আপত্তি আছে। তিনি শুধু ভোটের রাজনীতি বিবেচনা করেই ঢাকায় এসেও তিস্তা চুক্তিতে সম্মতি দেননি। এখন ভোট শেষ। ২০২১ সাল পর্যন্ত তিনি ক্ষমতায় থাকবেন। এখন একটি ‘প্যাকেজ ডিলে’ তিনি যেতে পারেন, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের বড় ধরনের আর্থিক সহযোগিতার বিনিময়ে তিনি কেন্দ্রীয় সরকারকে একটি ‘গ্রিন সিগনাল’ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অদূর ভবিষ্যতে তিস্তায় পানি বণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি হলেও তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, সেটাই বড়

প্রশ্ন এখন।

এটা সত্য, ভারতে বড় ধরনের পানি সংকট চলছে। পানির অভাবে সেখানে কৃষকের আত্মহত্যার খবরও পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প চালু করতে পারে না। কিংবা তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি না করে বাংলাদেশকে পানিশূন্য করতে পারে না। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক আহ্বান অতি জরুরি। গেল বছর ‘নোট ভারবাল’ পাঠিয়েও বাংলাদেশ কোনো ‘উত্তর’ পায়নি। বাংলাদেশ শুধু ভারতের আশ্বাসের ওপর বসে থাকতে পারে না। Daily Jugantor 27.05.16

0 comments:

Post a Comment