গত
২২ মে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে
ঢাকায় একটি বৈঠক করেছেন। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি হত্যাকা- ও
তথাকথিত আইএস বা ইসলামিক স্টেটের এসব হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত থাকার দাবির
আলোকেই এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং
ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পাঠানো প্রেস বিজ্ঞপ্তি বিশ্লেষণ করলে কতগুলো
বক্তব্য পাওয়া যায়, যা বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আবার প্রায় একই সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকের
শেষে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুও যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাও কম
গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখানে অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীর বক্তব্যের
মধ্যে কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেখানে বলেছেন সাম্প্রতিক
সময়ে যেসব হত্যাকা- সংগঠিত হয়েছে, তার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী জড়িত এবং
বিএনপি এসব হত্যাকারীদের শেল্টার দিয়েছে। অন্যদিকে শিল্পমন্ত্রী বলেছেন,
দেশে অতি সম্প্রতি যে ৩৭টি হত্যাকা- সংগঠিত হয়েছে_ তার ২৫টির সঙ্গে জেএমবি
জড়িত। আর বাকি ৮টির সঙ্গে আনসারউল্লাহ বাংলা টিম ও ৪টির সঙ্গে অন্যান্য
জঙ্গি সংগঠন জড়িত। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের পর ইইউর পক্ষ থেকে যে
বিবৃতি দেয়া হয়, তাতে বলা হয় এসব হত্যাকা- দেশের মানুষের মানবাধিকার ও
বাক-স্বাধীনতার জন্য হুমকি। ইইউ মনে করে বিশ্বে সহনশীল ও মুক্তচর্চার দেশ
হিসেবে বাংলাদেশের নাম এতে করে ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এসব হত্যাকা-ের কারণে
বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেও ইইউর বক্তব্যে
উল্লেখ করা হয়। ইইউ অনেক দিন ধরেই বিদেশি নাগরিকদের নিরাপত্তা ও হত্যাকা-ের
সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার দাবি করে আসছে। তারা গণতান্ত্রিক আচরণ
নিশ্চিত ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ারও আহ্বান জানিয়েছে।
হঠাৎ করেই যেন বাংলাদেশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলো। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের তথাকথিত উত্থান নিয়ে দুজন মার্কিন মন্ত্রী ঘুরে গেছেন। এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিবও। বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সরকার উৎখাতের জন্য_ এমন খবরও পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে বলেছেন, মোসাদ বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। এই বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোসাদের জড়িত থাকার বিষয়টি। অতীতে এরকমটি তেমন শোনা যায়নি। আদর্শগতভাবে মোসাদ আর বিএনপি দুই বিপরীত অবস্থানে থাকলেও, এখন সরকার উৎখাতে বিএনপি-মোসাদ সমঝোতা রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশে মোসাদ বিতর্ক এখন তুঙ্গে। বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী মোসাদ কানেকশনে বিতর্কিত হয়ে এখন পুলিশ রিমান্ডে। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তিনি মোসাদ এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে ভারতের আগ্রায় 'গোপন বৈঠক' করেছেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সরকারকে উৎখাত করা। বিষয়টি রাজনীতিতে ভালো উত্তাপ ছড়িয়েছে। এই ঘটনাটি ঘটল এমন এক সময় যখন বাংলাদেশকে নিয়ে বহির্বিশ্বে 'ষড়যন্ত্র' হচ্ছে। বাংলাদেশে তথাকথিত আইএসের উত্থানকে কেন্দ্র করে একাধিক মার্কিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসেছেন এবং তাদের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। ঢাকা ঘুরে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিবও। তিনিও জানিয়ে গেলেন ভারত সরকারের উদ্বেগের কথা। আর সর্বশেষ খবরে কলকাতার একটি জনপ্রিয় পত্রিকা আমাদের জানাচ্ছে যে আইএস সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে! এই সংবাদের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা আমাদের দেশের গোয়েন্দারা ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা যে অবাস্তব একটি বিষয়, সেটা সবাই স্বীকার করবেন। কেননা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এভাবে কোনো জঙ্গিগাষ্ঠী একটি রাষ্ট্রকে আক্রমণ করতে পারে না। এ ছাড়া যেখানে আইএসের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে, সেখানে এ ধরনের 'পরিকল্পনা' অর্থহীন। তবে বাংলাদেশে মোসাদ কানেকশনের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। এটি আরো গুরুত্ব পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কারণে। প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে বাংলাদেশিদের এক সভায় এই বিষয়টির অবতারণা করেছেন।
একজন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যের সঙ্গে বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিবের 'বৈঠক', নিঃসন্দেহে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেবে। ইসরাইলের সঙ্গে আমাদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। আর এটা বিবেচনা করেই ইসরাইলের সঙ্গে কখনো কোনো পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়নি বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসরাইলিদের সহযোগিতা বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছিল। যদিও এটা সত্য, ইসরাইল দীর্ঘদিন চেষ্টা করে আসছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায় করতে। বেশকিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভাগের একজন শিক্ষক একটি প্রসঙ্গে ইসরাইলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। ওই সময় কম বিতর্ক হয়নি। এরপর থেকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ইসরাইলি নেতাদের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সম্পর্ক পরিহার করে আসছে বাংলাদেশ। তাহলে আসলাম চৌধুরী কীভাবে মেন্দি এন সাফারির সঙ্গে বৈঠক করেন? জনাব চৌধুরী একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বটে; কিন্তু তিনি বিএনপিকে একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি দলের সিনিয়র নেতা। এটা কি শুধু 'একটি ভুল'? তিনি কি কোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার জালে আটকা পড়েছিলেন? ঘটনা যাই ঘটে থাকুক না কেন, বিএনপির এক সংকটকালিন সময়ে তিনি নিজ দলের অনেক ক্ষতি করেছেন। তিনি এখন পুলিশ রিমান্ডে আছেন। তাতে করে তার দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না। তিনি 'সব দায়-দায়িত্ব মাথায় নিয়ে' পদত্যাগ করতে পারতেন। অথবা দলের চেয়ারপারসন 'শৃঙ্খলা ভঙ্গের' অপরাধে দলের যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে তাকে অপসারণ করতে পারতেন। এটা দলের জন্য মঙ্গল ছিল। কিন্তু তা হয়নি।
বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় যখন নানা চাপের মুখে আছে, তখন উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা। একজন আনসার কমান্ডারকে খুন করা হলো। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে এটা ডাকাতির ঘটনা। আসলেই কি এটা ডাকাতি ছিল? আমি নিশ্চিত নই। বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ, বসবাস, নানা রকম কর্মকা-, আমাদের জন্য নানা সংকট সৃষ্টি ক েছে। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তবে ভয়টা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিকাশ ঘটাচ্ছে। পাঠক নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) কথা স্মরণ করতে পারেন। ঝড়ঁঃয অংরধ ঞবৎৎড়ৎরংস ঢ়ড়ৎঃধষ এ বার্টিল লিনটনারের (ইবৎঃরষ খরহঃহবৎ) একটি প্রবন্ধ আছে। অনলাইনে পাঠক এটা পড়ে দেখতে পারেন। লিনটনার বলার চেষ্টা করেছেন যে আরএসওর অনেক জঙ্গি আফগানিস্তানের খোসত প্রদেশে ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং শেষ করে তাদের এই অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে। উদ্দেশ্য নাশকতামূলক ও জঙ্গি তৎপরতা বাড়ানো। একটি আন্তর্জাতিক চক্র এই রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে। এরা রোহিঙ্গাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র চায়। অর্থাৎ রাখাইন স্টেট তারা 'স্বাধীন করতে চায়। গহিন অরণ্যে ট্রেনিং হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন সূত্র থেকে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। এরা পুরো ও অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা তুলতে চায়। তাই আনসার কমান্ডারের হত্যাকা-কে আমি শুধু ডাকাতি হিসেবে ভাবতে পারছি না। এটা রোগিঙ্গা জঙ্গিদের কাজ। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা হচ্ছে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যাকে আন্তর্জাতিক দরবারে নিয়ে যেতে পারিনি। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় যারা রেজিস্টার্ড নন এবং মিয়ানমার এদের স্বীকারও করে না। ফলে এদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কাজটিও সহজ নয়। প্রচ- মুসলমান বিদ্বেষী অং সান সু চি এদের ব্যাপারে নির্বিকার। আমার মনে হয় খুব দ্রুত উখিয়ার গহিন অরণ্যে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জঙ্গিদের উৎখাতের জন্য সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানো উচিত। এবং সেনা মোতায়েন করাও জরুরি। নতুবা এই জঙ্গিরা কিছু বৈদেশিক শক্তির সহযোগিতায় এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এতে বিঘি্নত হতে পারে।
আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভক্তি আর বিভেদ বাড়ছে। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার, তা নেই। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছে। আর এতে সুযোগ নিচ্ছে বাইরের শক্তিগুলো। বাংলাদেশে 'মোসাদ কানেকশন'-এর বিষয়টি এমনই। কিংবা জঙ্গি উত্থানের যে কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে এই 'অনাস্থা'র সম্পর্কটি। দুটি বড় দলের মধ্যে যদি 'ঐক্য' থাকত, তাহলে বাইরের কোনো শক্তিই আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাতে পারত না। আজ আসলাম চৌধুরীর মতো একজন নেতার পক্ষে বিএনপির নেতারা যত ছাপাই গান না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তিনি দল ও সেই সঙ্গে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মান-সম্মানও ক্ষুণ্ন করেছেন। আসলাম চৌধুরী দলের শীর্ষপদ পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের অবদান কী, তা জানেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তিনি কি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোনো বইপুস্তক পড়েননি? জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিলেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জিয়া মনে করতেন বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্রিজস্বরূপ। জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বের নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশকে তিনি ইসলামিক বিশ্বে ব্যাপকভাবে পরিচিত করেছিলেন। তখন থেকেই মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনতে শুরু করেছিল। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করেছিল। সুতরাং তার গড়া বিএনপি কী করে ইসরাইলের সঙ্গে 'ষড়যন্ত্র' করে? আসলাম চৌধুরী আজ অভিযুক্ত। টিভি প্রতিবেদনে দেখলাম তিনি সাংবাদিকদের 'ভি' চিহ্ন দেখাচ্ছেন। এর অর্থ কী? তিনি বিজয়ী হয়েছেন, এটা তিনি বোঝাতে চান! কীভাবে তিনি বিজয়ী হয়েছেন আমি বুঝতে অক্ষম।
বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভক্তি আর আস্থার অভাবের সুযোগ নিতে পারে ইসরাইল। ইসরাইল আসলাম চৌধুরীকে দীর্ঘদিন ধরেই 'ফ্রেম' করেছিল, এটাও আমার বিশ্বাস। আজ যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোসাদের 'ষড়যন্ত্র' নিয়ে কথা বলেন, আমি তাতে অবাক হইনি। এই 'ষড়যন্ত্র' নস্যাৎ করতে তাই প্রয়োজন দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব দলের মধ্যে আস্থার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। ইইউর বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে এ কথাটি। ইইউ 'গণতান্ত্রিক আচরণ নিশ্চিত' করার যে আহ্বান জানিয়েছে, এর মধ্যদিয়ে সেই 'আশ্বাস আর বিশ্বাস' স্থাপনের কথাটাই বলতে চেয়েছে। তাই জঙ্গি উত্থান কিংবা মোসাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।Daily Jai jai Din28.05.16
হঠাৎ করেই যেন বাংলাদেশ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলো। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের তথাকথিত উত্থান নিয়ে দুজন মার্কিন মন্ত্রী ঘুরে গেছেন। এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিবও। বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সরকার উৎখাতের জন্য_ এমন খবরও পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে বলেছেন, মোসাদ বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে। এই বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর। বিশেষ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোসাদের জড়িত থাকার বিষয়টি। অতীতে এরকমটি তেমন শোনা যায়নি। আদর্শগতভাবে মোসাদ আর বিএনপি দুই বিপরীত অবস্থানে থাকলেও, এখন সরকার উৎখাতে বিএনপি-মোসাদ সমঝোতা রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশে মোসাদ বিতর্ক এখন তুঙ্গে। বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরী মোসাদ কানেকশনে বিতর্কিত হয়ে এখন পুলিশ রিমান্ডে। তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ তিনি মোসাদ এজেন্ট মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে ভারতের আগ্রায় 'গোপন বৈঠক' করেছেন। উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সরকারকে উৎখাত করা। বিষয়টি রাজনীতিতে ভালো উত্তাপ ছড়িয়েছে। এই ঘটনাটি ঘটল এমন এক সময় যখন বাংলাদেশকে নিয়ে বহির্বিশ্বে 'ষড়যন্ত্র' হচ্ছে। বাংলাদেশে তথাকথিত আইএসের উত্থানকে কেন্দ্র করে একাধিক মার্কিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশে এসেছেন এবং তাদের উদ্যোগের কথা জানিয়েছেন। ঢাকা ঘুরে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিবও। তিনিও জানিয়ে গেলেন ভারত সরকারের উদ্বেগের কথা। আর সর্বশেষ খবরে কলকাতার একটি জনপ্রিয় পত্রিকা আমাদের জানাচ্ছে যে আইএস সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশে আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে! এই সংবাদের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা আমাদের দেশের গোয়েন্দারা ভালো বলতে পারবেন। তবে এটা যে অবাস্তব একটি বিষয়, সেটা সবাই স্বীকার করবেন। কেননা বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এভাবে কোনো জঙ্গিগাষ্ঠী একটি রাষ্ট্রকে আক্রমণ করতে পারে না। এ ছাড়া যেখানে আইএসের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন আছে, সেখানে এ ধরনের 'পরিকল্পনা' অর্থহীন। তবে বাংলাদেশে মোসাদ কানেকশনের বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর। এটি আরো গুরুত্ব পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কারণে। প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে বাংলাদেশিদের এক সভায় এই বিষয়টির অবতারণা করেছেন।
একজন ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যের সঙ্গে বিএনপির একজন যুগ্ম মহাসচিবের 'বৈঠক', নিঃসন্দেহে ব্যাপক জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেবে। ইসরাইলের সঙ্গে আমাদের কোনো কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। মুসলিম বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। আর এটা বিবেচনা করেই ইসরাইলের সঙ্গে কখনো কোনো পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়নি বাংলাদেশ। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসরাইলিদের সহযোগিতা বাংলাদেশ প্রত্যাখ্যান করেছিল। যদিও এটা সত্য, ইসরাইল দীর্ঘদিন চেষ্টা করে আসছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি আদায় করতে। বেশকিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভাগের একজন শিক্ষক একটি প্রসঙ্গে ইসরাইলকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেয়ার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। ওই সময় কম বিতর্ক হয়নি। এরপর থেকে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ইসরাইলি নেতাদের সঙ্গে যে কোনো ধরনের সম্পর্ক পরিহার করে আসছে বাংলাদেশ। তাহলে আসলাম চৌধুরী কীভাবে মেন্দি এন সাফারির সঙ্গে বৈঠক করেন? জনাব চৌধুরী একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন বটে; কিন্তু তিনি বিএনপিকে একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিয়েছেন। তিনি দলের সিনিয়র নেতা। এটা কি শুধু 'একটি ভুল'? তিনি কি কোনো বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার জালে আটকা পড়েছিলেন? ঘটনা যাই ঘটে থাকুক না কেন, বিএনপির এক সংকটকালিন সময়ে তিনি নিজ দলের অনেক ক্ষতি করেছেন। তিনি এখন পুলিশ রিমান্ডে আছেন। তাতে করে তার দলের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না। তিনি 'সব দায়-দায়িত্ব মাথায় নিয়ে' পদত্যাগ করতে পারতেন। অথবা দলের চেয়ারপারসন 'শৃঙ্খলা ভঙ্গের' অপরাধে দলের যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে তাকে অপসারণ করতে পারতেন। এটা দলের জন্য মঙ্গল ছিল। কিন্তু তা হয়নি।
বাংলাদেশ জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় যখন নানা চাপের মুখে আছে, তখন উখিয়ার রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ঘটনা। একজন আনসার কমান্ডারকে খুন করা হলো। কোনো কোনো মহল থেকে বলা হচ্ছে এটা ডাকাতির ঘটনা। আসলেই কি এটা ডাকাতি ছিল? আমি নিশ্চিত নই। বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ, বসবাস, নানা রকম কর্মকা-, আমাদের জন্য নানা সংকট সৃষ্টি ক েছে। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। তবে ভয়টা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করে একটি আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী এখানে জঙ্গিবাদের উত্থান ও বিকাশ ঘটাচ্ছে। পাঠক নিশ্চয়ই রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশনের (আরএসও) কথা স্মরণ করতে পারেন। ঝড়ঁঃয অংরধ ঞবৎৎড়ৎরংস ঢ়ড়ৎঃধষ এ বার্টিল লিনটনারের (ইবৎঃরষ খরহঃহবৎ) একটি প্রবন্ধ আছে। অনলাইনে পাঠক এটা পড়ে দেখতে পারেন। লিনটনার বলার চেষ্টা করেছেন যে আরএসওর অনেক জঙ্গি আফগানিস্তানের খোসত প্রদেশে ট্রেনিং নিয়েছেন। ট্রেনিং শেষ করে তাদের এই অঞ্চলে পাঠানো হয়েছে। উদ্দেশ্য নাশকতামূলক ও জঙ্গি তৎপরতা বাড়ানো। একটি আন্তর্জাতিক চক্র এই রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছে। এরা রোহিঙ্গাদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র চায়। অর্থাৎ রাখাইন স্টেট তারা 'স্বাধীন করতে চায়। গহিন অরণ্যে ট্রেনিং হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন সূত্র থেকে অস্ত্র সরবরাহ করা হচ্ছে। এরা পুরো ও অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফায়দা তুলতে চায়। তাই আনসার কমান্ডারের হত্যাকা-কে আমি শুধু ডাকাতি হিসেবে ভাবতে পারছি না। এটা রোগিঙ্গা জঙ্গিদের কাজ। এ ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা হচ্ছে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যাকে আন্তর্জাতিক দরবারে নিয়ে যেতে পারিনি। কয়েক লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায় যারা রেজিস্টার্ড নন এবং মিয়ানমার এদের স্বীকারও করে না। ফলে এদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কাজটিও সহজ নয়। প্রচ- মুসলমান বিদ্বেষী অং সান সু চি এদের ব্যাপারে নির্বিকার। আমার মনে হয় খুব দ্রুত উখিয়ার গহিন অরণ্যে অবস্থানরত রোহিঙ্গা জঙ্গিদের উৎখাতের জন্য সেখানে সেনাবাহিনী পাঠানো উচিত। এবং সেনা মোতায়েন করাও জরুরি। নতুবা এই জঙ্গিরা কিছু বৈদেশিক শক্তির সহযোগিতায় এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফেলতে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এতে বিঘি্নত হতে পারে।
আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভক্তি আর বিভেদ বাড়ছে। রাজনীতিতে যে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার, তা নেই। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছে। আর এতে সুযোগ নিচ্ছে বাইরের শক্তিগুলো। বাংলাদেশে 'মোসাদ কানেকশন'-এর বিষয়টি এমনই। কিংবা জঙ্গি উত্থানের যে কথা বলা হচ্ছে, তার সঙ্গেও পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে এই 'অনাস্থা'র সম্পর্কটি। দুটি বড় দলের মধ্যে যদি 'ঐক্য' থাকত, তাহলে বাইরের কোনো শক্তিই আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাতে পারত না। আজ আসলাম চৌধুরীর মতো একজন নেতার পক্ষে বিএনপির নেতারা যত ছাপাই গান না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে তিনি দল ও সেই সঙ্গে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মান-সম্মানও ক্ষুণ্ন করেছেন। আসলাম চৌধুরী দলের শীর্ষপদ পেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের অবদান কী, তা জানেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? তিনি কি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে কোনো বইপুস্তক পড়েননি? জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছিলেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। জিয়া মনে করতেন বাংলাদেশ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ব্রিজস্বরূপ। জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশকে মুসলিম বিশ্বের নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশকে তিনি ইসলামিক বিশ্বে ব্যাপকভাবে পরিচিত করেছিলেন। তখন থেকেই মুসলিম বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনতে শুরু করেছিল। জিয়ার শাসনামলেই বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করেছিল। সুতরাং তার গড়া বিএনপি কী করে ইসরাইলের সঙ্গে 'ষড়যন্ত্র' করে? আসলাম চৌধুরী আজ অভিযুক্ত। টিভি প্রতিবেদনে দেখলাম তিনি সাংবাদিকদের 'ভি' চিহ্ন দেখাচ্ছেন। এর অর্থ কী? তিনি বিজয়ী হয়েছেন, এটা তিনি বোঝাতে চান! কীভাবে তিনি বিজয়ী হয়েছেন আমি বুঝতে অক্ষম।
বাংলাদেশে বড় রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিভক্তি আর আস্থার অভাবের সুযোগ নিতে পারে ইসরাইল। ইসরাইল আসলাম চৌধুরীকে দীর্ঘদিন ধরেই 'ফ্রেম' করেছিল, এটাও আমার বিশ্বাস। আজ যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোসাদের 'ষড়যন্ত্র' নিয়ে কথা বলেন, আমি তাতে অবাক হইনি। এই 'ষড়যন্ত্র' নস্যাৎ করতে তাই প্রয়োজন দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ সব দলের মধ্যে আস্থার রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করা। ইইউর বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে এ কথাটি। ইইউ 'গণতান্ত্রিক আচরণ নিশ্চিত' করার যে আহ্বান জানিয়েছে, এর মধ্যদিয়ে সেই 'আশ্বাস আর বিশ্বাস' স্থাপনের কথাটাই বলতে চেয়েছে। তাই জঙ্গি উত্থান কিংবা মোসাদের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা জরুরি।Daily Jai jai Din28.05.16
0 comments:
Post a Comment