রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দক্ষিণ এশিয়ায় পানি সংকট ও আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক


দক্ষিণ এশিয়া একটি বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। এশিয়া ফাউন্ডেশনের এক রিপোর্টে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরই মধ্যে ভারতের কোনো কোনো রাজ্যের খরার খবর আমরা সংবাদপত্র থেকে পাচ্ছি। খরায় মৃত্যুর খবরও আছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের দিকে বিশ্ব বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে পড়বে। তখন মাত্র ৬০ ভাগ জনগোষ্ঠী পানি পাবে, বাকি ৪০ ভাগের ক্ষেত্রে পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত হবে না। জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিশ্ব পানি উন্নয়ন সংস্থার এক রিপোর্টেও দক্ষিণ এশিয়ার ভয়াবহ পানি সংকটের বিষয়টি উঠে এসেছে। বলা হচ্ছে, ভারতের ২২ থেকে ৩২টি শহর ভয়াবহ পানি সংকটের মুখে পড়বে। কাঠমান্ডু ও করাচির মতো শহরও পানি সংকটের মধ্যে পড়বে। বাংলাদেশের পরিস্থিতি খুব ভালো, তা বলা যাবে না। ভারতের পানি রাজনীতির শিকার হয়েছে বাংলাদেশ। তিস্তা যখন ‘মরা খালে’ পরিণত হয়েছে, তখন একটি উদ্যোগের কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের আপত্তি সত্ত্বেও ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত চালু করতে যাচ্ছে। স্বয়ং পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী আমাদের এ কথা জানিয়েছেন। অথচ বাংলাদেশ প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়ে আসছিল। গেল জুনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় যে ৬৫ দফা সংবলিত যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখানে ২১নং দফায় অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছিল যে, ‘ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ব্যাপারে এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়।’ এখন উমা ভারতীর বিবিসিকে দেয়া বক্তব্য কী ওই প্রতিশ্রুতিকে ভঙ্গ করল না? যৌথ ঘোষণায় যখন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়, তখন তা রক্ষা করার দায়িত্ব ওই রাষ্ট্রের। ভারতের এ ‘আচরণ’ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং তা দুই দেশের সম্পর্ককে একটি বড় ধরনের প্রশ্নের মুখে ঠেলে দেবে। বাংলাদেশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তারা এর ব্যাখ্যা চাইবে। কিন্তু শুধু ‘ব্যাখ্যা চাওয়া’ই যথেষ্ট নয়। এখানে বলা ভালো, খোদ ভারতেই এ আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক আছে। ভারতের পরিবেশবাদীরা প্রথম থেকেই এর বিরোধিতা করে আসছেন। এ নিয়ে তারা সেখানে আন্দোলন পর্যন্ত করেছেন। এখানে বলা ভালো, ভারতে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, অর্থাৎ হিমালয় অঞ্চল থেকে উৎপন্ন নদীগুলোর পানি ৩০টি খালের মাধ্যমে ভারতের খরাপীড়িত দক্ষিণাঞ্চলে সরিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার এই যে মহাপরিকল্পনা, তার ইতিহাস অনেক পুরনো। ১৯৮০ সালে এ পরিকল্পনার কথা প্রথম জানা যায় এবং ২০০২ সালে বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে উচ্চ আদালতের একটি রায়ও তাদের পক্ষে যায়। তবে সাম্প্রতিক এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার পেছনে কাজ করছে ভারতের কয়েকটি অঞ্চল প্রচ- পানির অভাব ও খরা দেখা দেয়ার বিষয়টি। কৃষক পানি পাচ্ছেন না। পানির অভাবে কৃষকের আত্মহত্যার খবরও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সম্ভবত এটা বিবেচনায় নিয়েই ভারতের নীতিনির্ধারকরা দ্রুত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছেন। কিন্তু এটা যে মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা সৃষ্টি করবে ও পার্শ¦বর্তী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটাবেÑ এটা তারা বিবেচনায় নেননি। ভারতের এ পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে এবং দুই দেশের সম্পর্কের ওপর তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বলা হয়, ভারতের খরা এলাকার জন্য পানি দরকার। কিন্তু এক নদী থেকে পানি প্রত্যাহার করে খালের মাধ্যমে অন্য এলাকায় (দক্ষিণে) নিয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। ভারতের ভাকরা বাঁধ নিয়ে একটি গবেষণায় দেখানো হয়েছিল, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা প্রদেশের জন্য ভাকরা থেকে পাওয়া পানি নয়, বরং ভূগর্ভস্থ পানি এবং উন্নত কৃষি ব্যবস্থা বেশি জরুরি। পাঞ্জাবের মোট ২০ শতাংশ এবং হরিয়ানার ৩১ শতাংশ চাষযোগ্য জমি বাঁধ নিয়ন্ত্রিত। এমনকি ৫০ বছর পর আজও সেখানকার বাস্তুহারা মানুষ কঠোর সংগ্রাম করে যাচ্ছেন মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুর জন্য। ওই গবেষণার ফলই বলে দিচ্ছে, নর্মদা বাঁধের উচ্চতা না বাড়িয়ে কীভাবে আরও বেশি পানি ও বিদ্যুৎ পাওয়া যেতে পারে, সে বিষয়ে মাথা ঘামানো দরকার। নর্মদা বাঁধসংলগ্ন অঞ্চলের বাস্তুহারা ৫০ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে কীভাবে ক্ষতিপূরণ দেবে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্র, যখন কিনা ওইসব রাজ্যে বাড়তি কোনো জমি নেই তাদের পুনর্বাসনের জন্য? তিহরি বাঁধের শিকার হয়েছেন যারা, তারাই সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার। কেননা, না ইউপি, না কেন্দ্র সরকার কোনোরূপ সহানুভূতি নিয়ে এগিয়ে এসেছিল তাদের সাহায্যার্থে। এখন আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প যে শুধু বাংলাদেশকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে তা নয়। বরং খোদ ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ভারতের নীতিনির্ধারকরা এটা বিবেচনায় নিচ্ছেন না। এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। আন্তর্জাতিক আইনবিশারদ অধ্যাপক ওপেনহেইম বলেছেন, কোনো রাষ্ট্রকে নিজ ভূখ-ের প্রাকৃতিক অবস্থা এমনভাবে পরিবর্তন করতে দেয়া যাবে না, যার ফলে তা প্রতিবেশী কোনো রাষ্ট্রের ভূখ-ের প্রাকৃতিক অবস্থার অসুবিধা সৃষ্টি করে। এ আলোকেই আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পটি অবৈধ। যখন কোনো রাষ্ট্র একটি অভিন্ন সম্পত্তির উন্নতি, পরিবর্তন বা ধ্বংস সাধনের জন্য কোনো প্রকল্প গ্রহণ করে, তখন ওই রাষ্ট্রকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে কিছু নীতিমালা অনুসরণ করতে হয়। আন্তর্জাতিক আইন আরও বেশি সুনির্দিষ্ট, যখন তা আন্তর্জাতিক নদী সম্পর্কিত হয়। আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের সব ক’টি নদীই আন্তর্জাতিক নদী। তাই এসব নদীর একতরফা পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা পানি প্রত্যাহার আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে বেআইনি এবং অগ্রহণযোগ্য। আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। তা অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের কোনো ক্ষতি না করেই হতে হবে। কিন্তু ভারতের এ উদ্যোগে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে, ভারত বাংলাদেশের ওপর এ প্রকল্পের বিরূপ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবেই উপেক্ষা করছে।
হেলসিংকি নীতিমালার অনুচ্ছেদ ২৯ এ বলা হয়েছে, এক অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র অপর অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্রকে অবশ্যই আন্তর্জাতিক, নিষ্কাশন অববাহিকার পানির ব্যবহারের ব্যাপারে কৃত পদক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করবে। ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার (আন্তর্জাতিক নদী ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত) ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা অবশ্যই সবার অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ক্ষেত্রে ভারত একটি অস্বচ্ছ ও স্বেচ্ছাচারমূলক পদ্ধতিতে অগ্রসর হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে জলপ্রবাহ কনভেনশনটি গ্রহণ করা হয়। এ কনভেনশনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সৎ প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। কনভেনশনের ৬ অনুচ্ছেদে যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্দিষ্টকরণে কতগুলো শর্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহার নির্ধারণে এ অনুচ্ছেদে উল্লিখিত সব ক’টি শর্তকে একই সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে এবং সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বিবদমান দেশগুলোকে আলোচনার মাধ্যমে একটি ঐকমত্যে পৌঁছতে হবে। জলপ্রবাহ কনভেনশনে উল্লিখিত নীতিমালাগুলোর আলোকে ভারতে প্রস্তাবিত নদী সংযোগ প্রকল্পকে বিচার করলে দেখা যাবে, ভারত সুস্পষ্টভাবে কনভেনশনে বিধিবদ্ধ প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন করছে। এমনকি জলাভূমিবিষয়ক রামসার কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ অনুসারে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলো পরস্পর পরামর্শ করবে এবং একই সঙ্গে জলাভূমির এবং সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণীগুলোর সংরক্ষণের স্বার্থে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা এবং বিধিবিধান প্রণয়ন করবে। কিন্তু আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জলাভূমিগুলোকে ধ্বংস করার নামান্তর, যা কিনা রামসার কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদের কথাও উল্লেখ করতে পারি। যেখানে ওই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘উভয় পক্ষ সমতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং পারস্পরিক ক্ষতি না করার নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে’, সেখানে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করা হলে, তা হবে ওই চুক্তির বাধ্যবাধকতা ও অঙ্গীকারের চরম লঙ্ঘন।
এখানে আরও একটা কথা বলা প্রয়োজন, আর তা হচ্ছে পানির বণ্টন বা পানি ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের ওপর কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। ভারতীয় সংবিধানের ২৪৬নং ধারা এবং সপ্তম শিডিউল অনুযায়ী কোনো রাজ্যের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহের অধিকার সেই রাজ্যের। এখানে কেন্দ্র কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না। অতীতে কৃষ্ণা নদীর পানির ব্যবহার, প্রত্যাহার ও পানির সংরক্ষণ নিয়ে তিনটি রাষ্ট্র মহারাষ্ট্র, কর্নাটক আর অঙ্গরাজ্যের মধ্যে বিবাদের সৃষ্টি হয়েছিল, যা ভারতে আন্তঃরাজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় ধরনের এক সংকটের সৃষ্টি করেছিল। এ বিবাদ মীমাংসার জন্য একটি ট্রাইব্যুনালও গঠিত হয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত রাজ্যগুলোর প্রাপ্ত অধিকার স্বীকার করে ওই ট্রাইব্যুনাল একটি রায় দিয়েছিল। আজ বেশ ক’টি রাজ্যের আপত্তির মুখে কীভাবে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে, সেটাই বড় প্রশ্ন। আসলে একটি ব্যবসায়ী শ্রেণী মোদিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। তারা চান ব্যবসা। আর এ প্রকল্পটি হচ্ছে বিশাল একটা ব্যবসার জায়গা, যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৬০ হাজার কোটি রুপি, যা দীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে ব্যবহৃত হবে। কোর্টের রায় অনুযায়ী তা এখন ১০ বছরে নামিয়ে আনা হয়েছে। ফলে এ অর্থটাই হচ্ছে মূল কারণ। তবে আমরা বসে থাকতে পারি না। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে একটি ‘নোট ভারবাল’ পাঠিয়েছে। এটা যথেষ্ট নয়। অতি দ্রুত দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এ বিষয়টি উত্থাপন করা প্রয়োজন এবং প্রকাশিত সংবাদটির ব্যাপারে ভারতের কাছ থেকে একটি ব্যাখ্যা চাওয়াও প্রয়োজন।
Daily Alokito Bangladesh
19.06.16

0 comments:

Post a Comment