মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার শাসনামলের শেষদিকে এসে এশিয়া সফর করে
গেলেন। এ সফরে তিনি জাপানে জি-৭ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার ভিয়েতনাম সফর। ভিয়েতনাম যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর
তৃতীয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভিয়েতনামের মাটিতে তিনি পা রেখেছিলেন। এর
আগে বিল ক্লিনটন ২০০০ সালে, আর জর্জ বুশ ২০০৬ সালে ভিয়েতনাম সফর করেছিলেন।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর ২৫ বছরের ব্যবধানে ক্লিনটন প্রথম ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন।
তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি ভিয়েতনামের ওপর থেকে অর্থনৈতিক
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। আর ওবামা হচ্ছেন তৃতীয় মার্কিন
প্রেসিডেন্ট, যিনি অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন।
ওবামা এমন এক সময় ভিয়েতনাম সফর করলেন যখন দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে তার সীমান্তবর্তী অনেক দেশের (ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান) বিরোধ আছে। এমনকি চীনের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে তার যুদ্ধজাহাজ পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের সঙ্গে একটি যৌথ নৌমহড়ায়ও অংশ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তার ভিয়েতনাম সফর এবং ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত এ কথাই প্রমাণ করে যে, ভিয়েতনামকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে ‘তৈরি’ করছে! এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, অর্থাৎ চীনের বিরুদ্ধে একটি বলয় তৈরি করা, তাতে ভিয়েতনাম এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পার্টনার। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বাদ দিয়ে ভিয়েতনামকে সঙ্গে নিয়ে টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি করেছে। ভিয়েতনাম এখন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড পার্টনার। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে শতকরা ১২০০ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৬ সালের মার্চ মাসে রফতানি করেছিল ১৭৩৬ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, অথচ আমদানি করেছিল ৯৯৩১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ৩০৯২১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার (রফতানি ৭০৭১ দশমিক ৭ মি. ডলার, আমদানি ৩৭৯৯৩ মি. ডলার)। ২০০৭ সালে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ওবামা নিজেই বলেছিলেন, ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক নীতির কেন্দ্রবিন্দু। কাজেই ওবামার ভিয়েতনাম সফর শুধু সাধারণ একটি সফর ছিল না। একদিকে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক ও অর্থনৈতিক বলয় সৃষ্টি করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে। আর এ মহাপরিকল্পনার অংশ ছিল ওবামার এই সফর। এখানে বলা ভালো, চীনের বিরুদ্ধে একটি সামরিক বলয় তৈরি করার অংশ হিসেবেই দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনসহ একাধিক দেশের সঙ্গে সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ফিলিপাইন এবং অতি সম্প্রতি ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের নৌ ইস্টার্ন কমান্ডের চারটি গাইডেড মিসাইল সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ জাহাজগুলো দক্ষিণ চীন সাগর ও উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী যে নীতি, তাতে ভারতকেও পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে আমরা ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে লিখেছি। ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম নৌশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর তার অংশ হিসেবেই ভারত এই প্রথমাবরের মতো তাদের ইস্টার্ন কমান্ডের চারটি যুদ্ধজাহাজকে এ অঞ্চলে মোতায়েন করল। যদিও দক্ষিণ চীন সাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। ভারত ভিয়েতনামের সঙ্গে চুক্তি করে এ অঞ্চলে তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
এখন ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ৩২০ কোটি ডলারের ছয়টি ইলেকট্রিক সাবমেরিন বিক্রির যুক্তরাষ্ট্রের একটি সিদ্ধান্ত নতুন করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় থার্ড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে দক্ষিণ কোরিয়া এ সিদ্ধান্তটি নিল। তবে চীনে আধা ঘণ্টারও কম সময়ে আঘাত হানতে সক্ষম এমন হাইপারসনিক গ্লিড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও মোতায়েন করা হয় সেখানে। চীন বিষয়গুলোকে খুব সহজভাবে দেখছে না। এতে করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়বে। সর্বশেষ ওবামার সফর এতে একটি নতুন মাত্রা এনে দেবে।
দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। আগামী দিনে এ অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতন বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। প্রায় ৩৫ লাখ বর্গকিলোমিটারজুড়ে চীন সাগরের বিস্তৃতি। এ অঞ্চলটি চীনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণে, ফিলিপাইনের পশ্চিমে, মালয়েশিয়ার উত্তরে, ব্রুনাইয়ের উত্তর-পশ্চিমে, ইন্দোনেশিয়ার উত্তরে এবং ভিয়েতনামের পূর্বে অবস্থিত। এ অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়েছে এ কারণে যে, দক্ষিণ চীন সাগরে প্রায় ২ দশমিক ০১ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রয়েছে এবং গ্যাস রয়েছে ২৫ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার থেকে ৫৬ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার। চীনের প্রচুর ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ রয়েছে। চীনের অর্থনীতি সঠিক পথে চলতে প্রচুর জ্বালানি দরকার। এ ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যদি চীনের কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে চীন তার জ্বালানি চাহিদা এখান থেকে মেটাতে পারবে। এ সমুদ্রপথটি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ। এ কারণে এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। পৃথিবীর সমুদ্রপথে যত বাণিজ্য হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ হয় এই পথে। চীন, জাপান, কোরিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় যাওয়ার বাণিজ্যিক রুট হিসেবে এ পথকে ব্যবহার করে। দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত স্প্রাটলি, প্যারাসেল ও টনকিন উপসাগরে অবস্থিত কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে আশপাশের দেশ, বিশেষ করে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার সঙ্গেই চীনের বিরোধ।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ অঞ্চলের অর্থাৎ দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে একাধিক কারণে। শুধু চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’ কিংবা চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে একটি ঐক্য করার পাশাপাশি জাপানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকির মোকাবেলা করা, এ সাগর দিয়ে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করার ব্যাপারে মার্কিন স্বার্থ রয়েছে। এর ওপর রয়েছে এ এলাকার তেল ও গ্যাসসম্পদের ওপর মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির লোলুপ দৃষ্টি। ফলে এ অঞ্চলটি যে আগামী দিনে প্রভাব বিস্তারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে আজ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান, এমনকি ভারতও তৎপর। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশগুলোকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে। এটি বিশ্বের বড় সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটের একটি। বিশ্ব বাণিজ্যের ৩২ ভাগ এ পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়। চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এটি সংযুক্ত নয়। মূল ভূখণ্ড থেকে ১ হাজার নটিক্যাল দূরে এ দ্বীপগুলো অবস্থিত। জাপান এ রুটকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করে এবং ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। জাপান এ দ্বীপগুলোর নাম দিয়েছে সেনকাকু, যা চীনের কাছে পরিচিত দিয়াওইউ নামে। ঐতিহাসিকভাবে চীনের শিও হান রাজবংশের কর্তৃত্ব অনুযায়ী চীন এ অঞ্চলের মালিকানা দাবি করে এলেও এ অঞ্চলের আশপাশের দেশগুলো তা মানতে নারাজ। জাপানের নিজস্ব কোনো তেল ও গ্যাস নেই। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর দেশটি পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। জাপান দৈনিক ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এ সামুদ্রিক পথটি ব্যবহার করে আমদানি করে থাকে।
এ অঞ্চলের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব থাকায় চীন এ অঞ্চলে নতুন করে একটি কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছে। সেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েনের জন্য বড় বড় রানওয়ে তৈরি করছে। মিসাইল ব্যাটারি স্থাপন করেছে। এমনকি আগামীতে এখানে পারমাণবিক সাবমেরিন যাতে ‘ডক’ করতে পারে, সে ব্যবস্থাও পাকাপাকি করেছে চীন। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একটি আতংক ছড়িয়ে গেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এ আতংককে ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। ইতিমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরের এ বিরোধটি জাতিসংঘের সামুদ্রিক বিপদ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত হয়েছে। ফিলিপাইন এর উদ্যোক্তা। তবে চীন এ শুনানিতে অংশ নেয়নি। চীন আদালতের কর্তৃত্ব মানতে চাইছে না। ফলে বিবাদ নিষ্পত্তি নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকেই গেছে।
দক্ষিণ চীন সাগরের এ বিরোধ যখন অনিষ্পন্ন, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন। এর ফলে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার অস্ত্র আমদানি শুরু করবে, যা কিনা এ অঞ্চলে এক ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতার জš§ দেবে। অতীতে চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবর আমরা জানি। ১৯৭৯ সালের মার্চে সেই যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৩ সপ্তাহ। তখন চীনের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। আজ যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে ব্যবহার করছে চীনের বিরুদ্ধে। প্রেক্ষাপট এক। চীন এ অঞ্চলের তথা বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। অর্থনৈতিক তথা সামরিক দিক দিয়ে চীন অন্যতম একটি শক্তি। তাই ঘুরেফিরে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী ‘কনটেনমেন্ট থিওরি’, অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলা ও সমাজতন্ত্রের পতন ঘটানোর কৌশল। দীর্ঘ ৪৬ বছর লেগেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ফেলতে। আজ চীনকে নিয়ে শুরু হয়েছে ‘খেলা।’ চীনের পতন ঘটিয়ে চীনকে কয়েকটি রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে নতুন করে ‘কনটেইনমেন্ট থিওরি’ ব্যবহৃত হচ্ছে! সে কারণেই একদিকে ভিয়েতনাম (সেই সঙ্গে ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান), অন্যদিকে ভারত আজ ‘মার্কিন বন্ধু’, মার্কিন স্ট্রাটেজির অংশ তারা। খুব সঙ্গত কারণেই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে নয়া স্নায়ুযুদ্ধের একটি নয়া রূপ।
চীন বিষয়গুলোকে যে খুব সহজভাবে নিয়েছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আগামী ৬ ও ৭ জুন বেইজিংয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ‘স্ট্র্যাটেজিক ও ইকোনমিক ডায়ালগ’ অনুষ্ঠিত হবে। এ সম্মেলনে চীন দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। এই দীর্ঘ উপস্থিতি ও যৌথ নৌ মহড়াকে যে চীন ভালো চোখে দেখছে না, এটাও সম্মেলনে তারা জানাবে। গত ৩১ মে বেইজিংয়ের সংবাদপত্র ‘চায়না ডেইলির’ এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক আগের মতো ভালো নয়। অতীতের পিংপং ডিপ্লোমেসির সেই স্পিরিট এখন আর নেই। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন এক মাত্রা দিয়েছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এ চীন-যুক্তরাষ্ট্র অ্যালায়েন্স একটি ‘পক্ষ’ হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রায় ২৫ বছর পর এই ঐক্যের এখন আর প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। উপরন্তু চীনও এখন আর সমাজতন্ত্রের পথে নেই। তবে চীন এখন বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম একটি শক্তি। বিশ্বব্যাপী চীনা বিনিয়োগ, চীনা বাণিজ্য মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করছে। তাই ধীরে ধীরে দেশ দুটি একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওবামার ভিয়েতনাম সফর, ভিয়েতনামকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা এবং জি-৭কে চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করা- সবই একই পরিকল্পনার অংশ।
ওবামা তার ভিয়েতনাম সফরে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যে গণহত্যা হয়েছিল (১৫ লাখ ভিয়েতনামবাসী ও ৫৮ হাজার মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু) তার জন্য ‘ক্ষমা’ চাননি। তিনি অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বটে; কিন্তু তাতে করে দেশটি কতটুকু লাভবান হবে, সে প্রশ্ন থাকলই। Daily Jugantor 06.06.16
ওবামা এমন এক সময় ভিয়েতনাম সফর করলেন যখন দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে চীনের সঙ্গে তার সীমান্তবর্তী অনেক দেশের (ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান) বিরোধ আছে। এমনকি চীনের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীন সাগরে তার যুদ্ধজাহাজ পর্যন্ত পাঠিয়েছিল। শুধু তাই নয়, দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনের সঙ্গে একটি যৌথ নৌমহড়ায়ও অংশ নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। তার ভিয়েতনাম সফর এবং ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত এ কথাই প্রমাণ করে যে, ভিয়েতনামকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিরুদ্ধে ‘তৈরি’ করছে! এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি, অর্থাৎ চীনের বিরুদ্ধে একটি বলয় তৈরি করা, তাতে ভিয়েতনাম এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পার্টনার। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র চীনকে বাদ দিয়ে ভিয়েতনামকে সঙ্গে নিয়ে টিপিপি বা ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি করেছে। ভিয়েতনাম এখন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেড পার্টনার। দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে শতকরা ১২০০ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৬ সালের মার্চ মাসে রফতানি করেছিল ১৭৩৬ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য, অথচ আমদানি করেছিল ৯৯৩১ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। আর ২০১৫ সালের পরিসংখ্যান বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ৩০৯২১ দশমিক ৩ মিলিয়ন ডলার (রফতানি ৭০৭১ দশমিক ৭ মি. ডলার, আমদানি ৩৭৯৯৩ মি. ডলার)। ২০০৭ সালে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে। ওবামা নিজেই বলেছিলেন, ভিয়েতনাম হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক নীতির কেন্দ্রবিন্দু। কাজেই ওবামার ভিয়েতনাম সফর শুধু সাধারণ একটি সফর ছিল না। একদিকে চীনের বিরুদ্ধে সামরিক ও অর্থনৈতিক বলয় সৃষ্টি করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র একটি মহাপরিকল্পনা তৈরি করছে। আর এ মহাপরিকল্পনার অংশ ছিল ওবামার এই সফর। এখানে বলা ভালো, চীনের বিরুদ্ধে একটি সামরিক বলয় তৈরি করার অংশ হিসেবেই দক্ষিণ চীন সাগরে ফিলিপাইনসহ একাধিক দেশের সঙ্গে সামরিক মহড়ায় অংশ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রকে পাঁচটি সামরিক ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে ফিলিপাইন এবং অতি সম্প্রতি ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে তাদের নৌ ইস্টার্ন কমান্ডের চারটি গাইডেড মিসাইল সজ্জিত যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ জাহাজগুলো দক্ষিণ চীন সাগর ও উত্তর-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে মোতায়েন করা হয়েছে। এর অর্থ পরিষ্কার, এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী যে নীতি, তাতে ভারতকেও পাশে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে আমরা ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌ স্ট্র্যাটেজি নিয়ে লিখেছি। ভারত এ অঞ্চলে অন্যতম নৌশক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আর তার অংশ হিসেবেই ভারত এই প্রথমাবরের মতো তাদের ইস্টার্ন কমান্ডের চারটি যুদ্ধজাহাজকে এ অঞ্চলে মোতায়েন করল। যদিও দক্ষিণ চীন সাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ভারতের স্বার্থ রয়েছে। ভারত ভিয়েতনামের সঙ্গে চুক্তি করে এ অঞ্চলে তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
এখন ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং ৩২০ কোটি ডলারের ছয়টি ইলেকট্রিক সাবমেরিন বিক্রির যুক্তরাষ্ট্রের একটি সিদ্ধান্ত নতুন করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেবে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ায় থার্ড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও বলা হচ্ছে, উত্তর কোরিয়ার ক্রমবর্ধমান হুমকির মুখে দক্ষিণ কোরিয়া এ সিদ্ধান্তটি নিল। তবে চীনে আধা ঘণ্টারও কম সময়ে আঘাত হানতে সক্ষম এমন হাইপারসনিক গ্লিড ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাও মোতায়েন করা হয় সেখানে। চীন বিষয়গুলোকে খুব সহজভাবে দেখছে না। এতে করে এ অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বাড়বে। সর্বশেষ ওবামার সফর এতে একটি নতুন মাত্রা এনে দেবে।
দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। আগামী দিনে এ অঞ্চলের রাজনীতির উত্থান-পতন বিশ্ব রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। প্রায় ৩৫ লাখ বর্গকিলোমিটারজুড়ে চীন সাগরের বিস্তৃতি। এ অঞ্চলটি চীনের মূল ভূখণ্ডের দক্ষিণে, ফিলিপাইনের পশ্চিমে, মালয়েশিয়ার উত্তরে, ব্রুনাইয়ের উত্তর-পশ্চিমে, ইন্দোনেশিয়ার উত্তরে এবং ভিয়েতনামের পূর্বে অবস্থিত। এ অঞ্চলের গুরুত্ব বেড়েছে এ কারণে যে, দক্ষিণ চীন সাগরে প্রায় ২ দশমিক ০১ বিলিয়ন ব্যারেল অপরিশোধিত তেল রয়েছে এবং গ্যাস রয়েছে ২৫ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার থেকে ৫৬ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ঘনমিটার। চীনের প্রচুর ‘জ্বালানি ক্ষুধা’ রয়েছে। চীনের অর্থনীতি সঠিক পথে চলতে প্রচুর জ্বালানি দরকার। এ ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে যদি চীনের কর্তৃত্ব থাকে, তাহলে চীন তার জ্বালানি চাহিদা এখান থেকে মেটাতে পারবে। এ সমুদ্রপথটি পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ত সমুদ্রপথ। এ কারণে এর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। পৃথিবীর সমুদ্রপথে যত বাণিজ্য হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ হয় এই পথে। চীন, জাপান, কোরিয়া, দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ায় যাওয়ার বাণিজ্যিক রুট হিসেবে এ পথকে ব্যবহার করে। দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত স্প্রাটলি, প্যারাসেল ও টনকিন উপসাগরে অবস্থিত কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে আশপাশের দেশ, বিশেষ করে ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়ার সঙ্গেই চীনের বিরোধ।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এ অঞ্চলের অর্থাৎ দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব বেড়েছে একাধিক কারণে। শুধু চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’ কিংবা চীনের বিরুদ্ধে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে একটি ঐক্য করার পাশাপাশি জাপানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক হুমকির মোকাবেলা করা, এ সাগর দিয়ে মার্কিন যুদ্ধজাহাজের প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করার ব্যাপারে মার্কিন স্বার্থ রয়েছে। এর ওপর রয়েছে এ এলাকার তেল ও গ্যাসসম্পদের ওপর মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির লোলুপ দৃষ্টি। ফলে এ অঞ্চলটি যে আগামী দিনে প্রভাব বিস্তারের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা রাখবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ অঞ্চলে নিজেদের কর্তৃত্ব ও প্রভাব বৃদ্ধি করতে আজ চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান, এমনকি ভারতও তৎপর। যুক্তরাষ্ট্র এ দেশগুলোকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করছে। এটি বিশ্বের বড় সামুদ্রিক বাণিজ্য রুটের একটি। বিশ্ব বাণিজ্যের ৩২ ভাগ এ পথ দিয়ে প্রবাহিত হয়। চীনের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে এটি সংযুক্ত নয়। মূল ভূখণ্ড থেকে ১ হাজার নটিক্যাল দূরে এ দ্বীপগুলো অবস্থিত। জাপান এ রুটকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি করে এবং ইউরোপের সঙ্গে বাণিজ্যিক রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। জাপান এ দ্বীপগুলোর নাম দিয়েছে সেনকাকু, যা চীনের কাছে পরিচিত দিয়াওইউ নামে। ঐতিহাসিকভাবে চীনের শিও হান রাজবংশের কর্তৃত্ব অনুযায়ী চীন এ অঞ্চলের মালিকানা দাবি করে এলেও এ অঞ্চলের আশপাশের দেশগুলো তা মানতে নারাজ। জাপানের নিজস্ব কোনো তেল ও গ্যাস নেই। মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর দেশটি পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল। জাপান দৈনিক ১০ মিলিয়ন ব্যারেল তেল এ সামুদ্রিক পথটি ব্যবহার করে আমদানি করে থাকে।
এ অঞ্চলের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব থাকায় চীন এ অঞ্চলে নতুন করে একটি কৃত্রিম দ্বীপ বানিয়েছে। সেখানে যুদ্ধবিমান মোতায়েনের জন্য বড় বড় রানওয়ে তৈরি করছে। মিসাইল ব্যাটারি স্থাপন করেছে। এমনকি আগামীতে এখানে পারমাণবিক সাবমেরিন যাতে ‘ডক’ করতে পারে, সে ব্যবস্থাও পাকাপাকি করেছে চীন। ফলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে একটি আতংক ছড়িয়ে গেছে। আর যুক্তরাষ্ট্র এ আতংককে ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। ইতিমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরের এ বিরোধটি জাতিসংঘের সামুদ্রিক বিপদ নিষ্পত্তি সংক্রান্ত ট্রাইব্যুনালে উত্থাপিত হয়েছে। ফিলিপাইন এর উদ্যোক্তা। তবে চীন এ শুনানিতে অংশ নেয়নি। চীন আদালতের কর্তৃত্ব মানতে চাইছে না। ফলে বিবাদ নিষ্পত্তি নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকেই গেছে।
দক্ষিণ চীন সাগরের এ বিরোধ যখন অনিষ্পন্ন, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভিয়েতনামের ওপর থেকে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন। এর ফলে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার অস্ত্র আমদানি শুরু করবে, যা কিনা এ অঞ্চলে এক ধরনের অস্ত্র প্রতিযোগিতার জš§ দেবে। অতীতে চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের খবর আমরা জানি। ১৯৭৯ সালের মার্চে সেই যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল মাত্র ৩ সপ্তাহ। তখন চীনের বিরুদ্ধে ভিয়েতনামকে সমর্থন করেছিল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। আজ যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামকে ব্যবহার করছে চীনের বিরুদ্ধে। প্রেক্ষাপট এক। চীন এ অঞ্চলের তথা বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম একটি ফ্যাক্টর। অর্থনৈতিক তথা সামরিক দিক দিয়ে চীন অন্যতম একটি শক্তি। তাই ঘুরেফিরে আসছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী ‘কনটেনমেন্ট থিওরি’, অর্থাৎ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলা ও সমাজতন্ত্রের পতন ঘটানোর কৌশল। দীর্ঘ ৪৬ বছর লেগেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে ভেঙে ফেলতে। আজ চীনকে নিয়ে শুরু হয়েছে ‘খেলা।’ চীনের পতন ঘটিয়ে চীনকে কয়েকটি রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে নতুন করে ‘কনটেইনমেন্ট থিওরি’ ব্যবহৃত হচ্ছে! সে কারণেই একদিকে ভিয়েতনাম (সেই সঙ্গে ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান), অন্যদিকে ভারত আজ ‘মার্কিন বন্ধু’, মার্কিন স্ট্রাটেজির অংশ তারা। খুব সঙ্গত কারণেই এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে নয়া স্নায়ুযুদ্ধের একটি নয়া রূপ।
চীন বিষয়গুলোকে যে খুব সহজভাবে নিয়েছে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আগামী ৬ ও ৭ জুন বেইজিংয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ‘স্ট্র্যাটেজিক ও ইকোনমিক ডায়ালগ’ অনুষ্ঠিত হবে। এ সম্মেলনে চীন দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। এই দীর্ঘ উপস্থিতি ও যৌথ নৌ মহড়াকে যে চীন ভালো চোখে দেখছে না, এটাও সম্মেলনে তারা জানাবে। গত ৩১ মে বেইজিংয়ের সংবাদপত্র ‘চায়না ডেইলির’ এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার সম্পর্ক আগের মতো ভালো নয়। অতীতের পিংপং ডিপ্লোমেসির সেই স্পিরিট এখন আর নেই। বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক থেকে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বিশ্ব রাজনীতিতে নতুন এক মাত্রা দিয়েছিল। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে এ চীন-যুক্তরাষ্ট্র অ্যালায়েন্স একটি ‘পক্ষ’ হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের প্রায় ২৫ বছর পর এই ঐক্যের এখন আর প্রয়োজনীয়তা বোধ করছে না যুক্তরাষ্ট্র। উপরন্তু চীনও এখন আর সমাজতন্ত্রের পথে নেই। তবে চীন এখন বিশ্ব অর্থনীতির অন্যতম একটি শক্তি। বিশ্বব্যাপী চীনা বিনিয়োগ, চীনা বাণিজ্য মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করছে। তাই ধীরে ধীরে দেশ দুটি একটি সংঘাতময় পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ওবামার ভিয়েতনাম সফর, ভিয়েতনামকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা এবং জি-৭কে চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে উদ্বুদ্ধ করা- সবই একই পরিকল্পনার অংশ।
ওবামা তার ভিয়েতনাম সফরে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যে গণহত্যা হয়েছিল (১৫ লাখ ভিয়েতনামবাসী ও ৫৮ হাজার মার্কিন নাগরিকের মৃত্যু) তার জন্য ‘ক্ষমা’ চাননি। তিনি অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন বটে; কিন্তু তাতে করে দেশটি কতটুকু লাভবান হবে, সে প্রশ্ন থাকলই। Daily Jugantor 06.06.16
0 comments:
Post a Comment