প্রধানমন্ত্রী জাপান সফর শেষে দেশে ফিরেছেন ২৯ মে। জাপানে জি-৭ আউটরিচ
সভায় তিনি যোগ দিয়েছেন। সেখানে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ও জাপানের
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। একই সঙ্গে মার্কিন
প্রেসিডেন্ট, জার্মানির চ্যান্সেলর, কানাডার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও
মতবিনিময় করেছেন। বিশ্বের শিল্পোন্নত দেশগুলোর এ শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশকে
আমন্ত্রণ জানানো বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা।
এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ যে একটি উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি, এটাই স্বীকার করে
নিলেন শিল্পোন্নত সাতটি দেশের নেতারা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের উন্নয়নের
অংশীদারও হতে চায় এ দেশগুলো। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়
আলোচনায় তারা উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। এটা
বাংলাদেশের জন্য একটা বড় স্বীকৃতি। প্রধানমন্ত্রী শীর্ষ সম্মেলনে গিয়ে তার
বক্তৃতায় লক্ষ্যমাত্রার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ও উত্তরণে প্রযুক্তি হস্তান্তর
করার জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। দরিদ্র দেশগুলোর
সামর্থ্য বৃদ্ধির ব্যাপারে ধনী দেশগুলোর আরও তৎপর হওয়া উচিত বলে
প্রধানমন্ত্রী মনে করেন। আসলে এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। গরিব দেশগুলোকে
সাহায্যের নামে ধনী দেশগুলোর ওপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল না হওয়া এবং একই
সঙ্গে দরিদ্র দেশগুলোর সামর্থ্য বাড়ানো সময়ের দাবি। এটা করতে হলে পশ্চিমা
দেশগুলোর প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রয়োজন রয়েছে। গরিব দেশগুলোর প্রতিনিধি
হিসেবে প্রধানমন্ত্রী জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে এ কথাগুলোই তুলে ধরেছেন। এখানে
বলা ভালো, গেল এপ্রিলে জাপানের চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি ইশোহিদে মুগা
জানিয়েছিলেন, ‘জি-৭ ইসে-শিমা’ সামিটে অর্থাৎ জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে
বাংলাদেশসহ লাওস, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও পাপুয়া নিউগিনির
সরকারপ্রধানের পাশাপাশি শীর্ষ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রধানদের এ
সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হবে। আর তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ
আউটরিচ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন আফ্রিকার চাদের প্রেসিডেন্ট ইদরিস ডেবি
ইটনো, ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো, লাওসের প্রধানমন্ত্রী থনলউন
সিসে লিথ, পাপুয়া নিউগিনির প্রধানমন্ত্রী পিটার ও’নিল, শ্রীলঙ্কার
প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা ও ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী নগুয়েন জুয়ান ফুক। মূলত
তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে জাপান এই জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে এ ছয়টি দেশের
সরকারপ্রধানদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ, স্বাস্থ্যসেবা ও
নারী উন্নয়ন। জাপানের এ আমন্ত্রণের পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে, জাপান মনে করে,
দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়নে জাপানের একটি ভূমিকা রয়েছে
এবং জাপান এ দেশগুলোকে আগামী দিনে পণ্য উৎপাদনের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করতে
চায়। এক্ষেত্রে যে দেশগুলো সামুদ্রিক পথের ওপর নির্ভরশীল, জাপানের আগ্রহ ওই
দেশগুলোর ব্যাপারে বেশি। আর আগামীতে জাপানে আফ্রিকার দেশগুলোর উন্নয়নে যে
সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, সেটা বিবেচনা করেই আফ্রিকার দেশ চাদকে
আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমেই বাংলাদেশ-জাপান সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা
করা যেতে পারে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক ৪৪ বছর
পার করেছে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাপান বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি
দিয়েছিল। এরপর দীর্ঘ ৪৪ বছর দুই দেশের সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।
বাংলাদেশের প্রায় সব প্রধানমন্ত্রীই জাপান সফর করেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা ২০১৪ সালে জাপান সফর করেন। জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে
বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে। ১৪ বছরের মধ্যে সেটা ছিল কোনো
জাপানি প্রধানমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। এর আগে ২০০০ সালে জাপানের
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মোরে বাংলাদেশ সফর করে গিয়েছিলেন।
জাপান বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপানের অবদান রয়েছে যথেষ্ট। জাপান হচ্ছে বাংলাদেশের ১১তম রফতানি বাজার। জাপান বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে, তা উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে আমদানি করা পণ্যের শতকরা ২৬ ভাগ। বাংলাদেশের অবস্থান কম্বোডিয়ার পরে। কম্বোডিয়া আছে প্রথম অবস্থানে। পরিসংখ্যান বলে, ৫ বছরে জাপানে বাংলাদেশের পণ্যের রফতানি বেড়েছে আড়াই গুণ। তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে ২০ গুণ। যদি বাণিজ্য সম্পর্ক আলোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে, বাণিজ্যে ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি জাপানের অনুকূলে। অঙ্কের হিসাবে এ ঘাটতির পরিমাণ ৬৪৬ মিলিয়ন ডলার। বর্তমান সরকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর আরও উদ্যোগ নিচ্ছে। জাপান তার বৈদেশিক বাণিজ্যের মাত্র ১ ভাগ সম্পন্ন করে বাংলাদেশের সঙ্গে। এটা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে এবং এক্ষেত্রে নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে বাংলাদেশী পণ্য তার বাজার সৃষ্টি করতে পারে। বিনিয়োগ পরিস্থিতিও তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম জাপান সফর ও জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের পর বিনিয়োগ পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। গঙ্গা ব্যারাজ তৈরি, যমুনা ব্রিজে রেললাইন নির্মাণ, ঢাকায় ইস্টার্ন বাইপাস নির্মাণ ও ঢাকার আশপাশে চারটি নদী দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে জাপানি সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব প্রকল্পে জাপানি বিনিয়োগ বাড়তে পারে। জাপানের পক্ষ থেকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার কথা বলা হয়েছে, তা যথেষ্ট যৌক্তিক। জাপান যখন কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, তখন তারা কতগুলো শর্ত জুড়ে দেয়। যেমন ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকল্প দুর্নীতিমুক্ত ও মসৃণ বাস্তবায়ন হতে হবে। বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও একটা বড় সমস্যা। নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম জাপান সফরের পর পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। জাপান তখন ৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই সঙ্গে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্পে আরও ১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলারের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ব্যাপক আঞ্চলিক উন্নয়নের আলোকে জাপান এ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। জাপান বঙ্গোপসাগরের সম্পদ আহরণের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। ইধু ড়ভ ইবহমধষ ওহফঁংঃৎরধষ এৎড়ঃিয ইবষঃ (ইরম ই ওহরঃরধঃরাব) এর আওতায় জাপান তার আগ্রহ দেখিয়েছে। এতে করে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে জাপানের আলাদা পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে জাপান তার পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। এখন দেখতে হবে এ পরিকল্পনা চীনের ‘ওয়ান বেল্ট’ পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা! চীনের ‘ওয়ান বেল্ট’, যা কিনা পুরনো ‘সিল্ক রুট’ এর নব্য সংস্করণ এরই মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভারতও তার প্রাচীন ‘কটন রুট’কে পুনরুজ্জীবিত করতে চায়। ফলে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগর ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে জাপানের ভূমিকা লক্ষ্য করার মতো। জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে জাপান ও বাংলাদেশের অবস্থান এক। জাপান (একই সঙ্গে জার্মানিও) আগামীতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের অন্যতম দাবিদার। জাতিসংঘ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় জাপানি নেতৃত্ব এখন স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় জাপানি সেনাবাহিনী এখন অংশ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাপানের ভূমিকাকে সমর্থন করে। নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য পদে জাপানের দাবিকেও বাংলাদেশ সমর্থন করে। জাপানের বৈদেশিক নীতিতে গণতন্ত্রায়ণের ওপর এখন বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এমনকি সাহায্যের শর্ত হিসেবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার কথাও বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে জাপানের আগ্রহ রয়েছে। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন নিয়ে জাপানের কিছুটা ‘রিজার্ভেশন’ থাকলেও তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলেনি। এর বড় প্রমাণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম জাপান সফর এবং দীর্ঘ ১৪ বছর পর শিনজে আবের ঢাকা সফর। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে জাপানের মূল্যায়ন হচ্ছেÑ ‘সবার উচিত জনগণের ভোটদানের সুযোগ সৃষ্টি করা।’ জাপানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কুমি সাতোর মতে, ‘রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কোনো শঙ্কা নেই, এটা সরকারকে প্রমাণ করতে হবে।’ নির্বাচন নিয়ে তাই কিছুটা ‘রিজার্ভেশন’ থাকলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানুষ জাপানকে অন্যতম ‘বন্ধুদেশ’ হিসেবে মনে করে। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ৪৪ বছরে একাধিক সরকার জাপান ও বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু তাতে করে দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কখনোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে জাপানের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। এ ধারাবাহিকতায় আগামী দিনেও এ দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। তবে জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে জাপানের বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ এটাই প্রমাণ করে, জাপান সাগরবেষ্টিত দেশগুলোর ওপর, যারা পরিপূর্ণভাবে সমুদ্রপথের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনার আওতাতেই ইরম ই ওহরঃরধঃরাব-এর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। আমরা জাপানি সহযোগিতা নিয়ে আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারব।
বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক আসরে যেভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশে একটি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী রয়েছে। বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের উপরে ধরে রেখেছে। এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ ৭ ভাগের উপরে নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশের টার্গেট হচ্ছে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। এক্ষেত্রে জাপানের বিনিয়োগ আমাদের প্রয়োজন। আউটরিচ সম্মেলনে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছেÑ বিনিয়োগ, স্বাস্থ্যসেবা ও নারী উন্নয়ন। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা সর্বত্র পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটা সমস্যা রয়েছে। জাপানি সহযোগিতায় এ সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। একই কথা প্রযোজ্য নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রেও। যেখানে সমাজে জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী, সেখানে নারীদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় না রেখে সামগ্রিকভাবে একটা দেশের উন্নয়ন করা যায় না। জাপানের এ উদ্যোগের প্রতি প্রধানমন্ত্রীও সায় দিয়েছেন।
জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ একদিকে যেমন বাংলাদেশকে বিশ্ব আসরে নতুন করে পরিচিত করেছে, অন্যদিকে তেমনি বাংলাদেশও সুযোগ পেয়েছে তার অবস্থান তুলে ধরতে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য এটি একটি বড় সাফল্য। এ সাফল্য ধরে রাখতে হবে।
Daily Alokito Bangladesh
05.06.16
জাপান বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। বাংলাদেশের উন্নয়নে জাপানের অবদান রয়েছে যথেষ্ট। জাপান হচ্ছে বাংলাদেশের ১১তম রফতানি বাজার। জাপান বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে, তা উন্নয়নশীল বিশ্ব থেকে আমদানি করা পণ্যের শতকরা ২৬ ভাগ। বাংলাদেশের অবস্থান কম্বোডিয়ার পরে। কম্বোডিয়া আছে প্রথম অবস্থানে। পরিসংখ্যান বলে, ৫ বছরে জাপানে বাংলাদেশের পণ্যের রফতানি বেড়েছে আড়াই গুণ। তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে ২০ গুণ। যদি বাণিজ্য সম্পর্ক আলোচনা করা যায় তাহলে দেখা যাবে, বাণিজ্যে ঘাটতি রয়েছে। এ ঘাটতি জাপানের অনুকূলে। অঙ্কের হিসাবে এ ঘাটতির পরিমাণ ৬৪৬ মিলিয়ন ডলার। বর্তমান সরকার বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়ানোর আরও উদ্যোগ নিচ্ছে। জাপান তার বৈদেশিক বাণিজ্যের মাত্র ১ ভাগ সম্পন্ন করে বাংলাদেশের সঙ্গে। এটা বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে এবং এক্ষেত্রে নতুন নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করতে হবে, যেখানে বাংলাদেশী পণ্য তার বাজার সৃষ্টি করতে পারে। বিনিয়োগ পরিস্থিতিও তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর প্রথম জাপান সফর ও জাপানি প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের পর বিনিয়োগ পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। গঙ্গা ব্যারাজ তৈরি, যমুনা ব্রিজে রেললাইন নির্মাণ, ঢাকায় ইস্টার্ন বাইপাস নির্মাণ ও ঢাকার আশপাশে চারটি নদী দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে জাপানি সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে এসব প্রকল্পে জাপানি বিনিয়োগ বাড়তে পারে। জাপানের পক্ষ থেকে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার কথা বলা হয়েছে, তা যথেষ্ট যৌক্তিক। জাপান যখন কোনো প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, তখন তারা কতগুলো শর্ত জুড়ে দেয়। যেমন ৪ থেকে ৫ বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রকল্প দুর্নীতিমুক্ত ও মসৃণ বাস্তবায়ন হতে হবে। বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও একটা বড় সমস্যা। নিঃসন্দেহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম জাপান সফরের পর পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। জাপান তখন ৬ বিলিয়ন ডলার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই সঙ্গে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ প্রকল্পে আরও ১ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলারের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ব্যাপক আঞ্চলিক উন্নয়নের আলোকে জাপান এ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। জাপান বঙ্গোপসাগরের সম্পদ আহরণের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। ইধু ড়ভ ইবহমধষ ওহফঁংঃৎরধষ এৎড়ঃিয ইবষঃ (ইরম ই ওহরঃরধঃরাব) এর আওতায় জাপান তার আগ্রহ দেখিয়েছে। এতে করে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে নিয়ে জাপানের আলাদা পরিকল্পনা রয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে নিয়ে জাপান তার পরিকল্পনা প্রণয়ন করছে। এখন দেখতে হবে এ পরিকল্পনা চীনের ‘ওয়ান বেল্ট’ পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক কিনা! চীনের ‘ওয়ান বেল্ট’, যা কিনা পুরনো ‘সিল্ক রুট’ এর নব্য সংস্করণ এরই মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ভারতও তার প্রাচীন ‘কটন রুট’কে পুনরুজ্জীবিত করতে চায়। ফলে বঙ্গোপসাগর তথা ভারত মহাসাগর ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। এক্ষেত্রে জাপানের ভূমিকা লক্ষ্য করার মতো। জাপান-বাংলাদেশ সম্পর্ক তাই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অনেক আন্তর্জাতিক ইস্যুতে জাপান ও বাংলাদেশের অবস্থান এক। জাপান (একই সঙ্গে জার্মানিও) আগামীতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য পদের অন্যতম দাবিদার। জাতিসংঘ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় জাপানি নেতৃত্ব এখন স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষায় জাপানি সেনাবাহিনী এখন অংশ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাপানের ভূমিকাকে সমর্থন করে। নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য পদে জাপানের দাবিকেও বাংলাদেশ সমর্থন করে। জাপানের বৈদেশিক নীতিতে গণতন্ত্রায়ণের ওপর এখন বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এমনকি সাহায্যের শর্ত হিসেবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার কথাও বলা হচ্ছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিয়ে জাপানের আগ্রহ রয়েছে। ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন নিয়ে জাপানের কিছুটা ‘রিজার্ভেশন’ থাকলেও তা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আদৌ কোনো প্রভাব ফেলেনি। এর বড় প্রমাণ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রথম জাপান সফর এবং দীর্ঘ ১৪ বছর পর শিনজে আবের ঢাকা সফর। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন প্রসঙ্গে জাপানের মূল্যায়ন হচ্ছেÑ ‘সবার উচিত জনগণের ভোটদানের সুযোগ সৃষ্টি করা।’ জাপানি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র কুমি সাতোর মতে, ‘রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কোনো শঙ্কা নেই, এটা সরকারকে প্রমাণ করতে হবে।’ নির্বাচন নিয়ে তাই কিছুটা ‘রিজার্ভেশন’ থাকলেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭০ ভাগ মানুষ জাপানকে অন্যতম ‘বন্ধুদেশ’ হিসেবে মনে করে। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ৪৪ বছরে একাধিক সরকার জাপান ও বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু তাতে করে দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কখনোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে জাপানের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। এ ধারাবাহিকতায় আগামী দিনেও এ দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আরও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। তবে জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে জাপানের বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ এটাই প্রমাণ করে, জাপান সাগরবেষ্টিত দেশগুলোর ওপর, যারা পরিপূর্ণভাবে সমুদ্রপথের ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য বিশেষ পরিকল্পনা রয়েছে। এ পরিকল্পনার আওতাতেই ইরম ই ওহরঃরধঃরাব-এর পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। আমরা জাপানি সহযোগিতা নিয়ে আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে পারব।
বাংলাদেশ আজ আন্তর্জাতিক আসরে যেভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে। বাংলাদেশে একটি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী রয়েছে। বাংলাদেশ কয়েক বছর ধরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ ভাগের উপরে ধরে রেখেছে। এই প্রবৃদ্ধি বাংলাদেশ ৭ ভাগের উপরে নিয়ে যেতে চায়। বাংলাদেশের টার্গেট হচ্ছে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। এক্ষেত্রে জাপানের বিনিয়োগ আমাদের প্রয়োজন। আউটরিচ সম্মেলনে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছেÑ বিনিয়োগ, স্বাস্থ্যসেবা ও নারী উন্নয়ন। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবা সর্বত্র পৌঁছানোর ক্ষেত্রে একটা সমস্যা রয়েছে। জাপানি সহযোগিতায় এ সমস্যা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। একই কথা প্রযোজ্য নারী উন্নয়নের ক্ষেত্রেও। যেখানে সমাজে জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী, সেখানে নারীদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় না রেখে সামগ্রিকভাবে একটা দেশের উন্নয়ন করা যায় না। জাপানের এ উদ্যোগের প্রতি প্রধানমন্ত্রীও সায় দিয়েছেন।
জি-৭ আউটরিচ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণ একদিকে যেমন বাংলাদেশকে বিশ্ব আসরে নতুন করে পরিচিত করেছে, অন্যদিকে তেমনি বাংলাদেশও সুযোগ পেয়েছে তার অবস্থান তুলে ধরতে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির জন্য এটি একটি বড় সাফল্য। এ সাফল্য ধরে রাখতে হবে।
Daily Alokito Bangladesh
05.06.16
0 comments:
Post a Comment