রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

চীন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা

এক সময় মার্কিন গবেষকরা একটি সম্ভাব্য চীন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা বলেছিলেন। জনাথন হোলসলাগ ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন লিখিত একটি প্রবন্ধে চীন-ভারত এর ধারণা দিয়েছিলেন। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের (২০১৪) পর ধারণা করা হয়েছিল যে দেশ দুটি আরো কাছাকাছি আসবে। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা, চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং সর্বশেষ চীনের আন্দামান-নিকোবর অঞ্চল দাবি দেখে মনে হয়েছে এই সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। নতুন আঙ্গিকে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ ধারণা আবার ফিরে এসেছে। এই ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ মনকো ডকট্রিনের দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কারো কর্তৃত্ব ভারত স্বীকার করে নেবে না। এক সময় এই এলাকা অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা ঘিরে ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ (২০০৭ সালে রচিত। শ্রীলঙ্কা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যকার ঐক্য)-এর যে ধারণা ছিল শ্রীলঙ্কায় সিরিসেনার বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ধারণা এখন আর কাজ করছে না। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী ধারণাকে আরো শক্তিশালী করতে বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীনের ইউনান রাজ্য, ভারতের সাতকোন, মিয়ানমার) যে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন, তাতে এখন শ্লথগতি আসতে পারে। সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত এখন আর বিসিআইএম ধারণাকে ‘প্রমোট’ করবে না। আর বাংলাদেশের একার পক্ষে চীন ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে ‘বিসিএম’ ধারণাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াও সম্ভব হবে না। ভারত এখন উপ-আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন জোটের কথা বলছে। ভারতের কর্তৃত্ব করার প্রবণতা এ অঞ্চলের দৃশ্যপটকে আগামী দিনে বদলে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাও লক্ষণীয়। ভারত বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। এখানে মার্কিন বিনিয়োগ বাড়ছে। ফলে এখানে মার্কিন স্বার্থ থাকবেই। এ অঞ্চলে মার্কিনি স্বার্থের আবার একটি কারণ হচ্ছে চীন। চীনকে ‘ঘিরে ফেলা’র একটি অপকৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একটি ‘কৌশলগত সম্পর্কে’ নিজেদের জড়িত করেছে। এই দুই দেশের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। তবে ভারত মহাসাগর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দুই দেশের মাঝে অবিশ্বাসের জš§ হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নৌ স্ট্র্যাটেজি এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরেই আবতিত হচ্ছে। অর্থাৎ এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের নৌ স্ট্র্যাটেজি শুধু প্যাসিফিক অঞ্চলকে ঘিরে রচিত হলেও এখন এর সম্প্রসারিত হয়েছে ভারত মহাসাগরে। একই স্ট্র্যাটেজির আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে ভারত মহাসাগরকে যাকে ওবামা আখ্যায়িত করেছেন ‘Pivot to ara’ হিসেবে। বাংলাদেশ এই স্ট্র্যাটেজির আওতায়। এই স্ট্র্যাটেজির অন্তর্ভুক্ত চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াও। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার অবস্থানকে শক্তিশালী করার জন্য এখানে মোতায়েনরত যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ ফ্লিটের ৬টি যুদ্ধজাহাজকে ভারত মহাসাগরে মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে গুরুত্ব আরো বেড়েছে। এতে চীনা নেতাদের উদ্বেগ ও শঙ্কা বাড়ছে। অতি সম্প্রতি ওয়াশিংটনে (১ এপ্রিল) যে চতুর্থ পারমাণবিক নিরাপত্তা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সেখানে ওবামার সঙ্গে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের আলাপচারিতায় চীনা নেতা তাদের উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এর কারণ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে Terminal High Altifude Area Defense (THAAD) আলোচনা শুরু করেছে। যদিও বলা হচ্ছে, THAAD এক ধরনের মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (৪০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় আগত শত্রুপক্ষের মিসাইল ধ্বংস করা। ঞঐঅঅউ ব্যাটারি প্রতিস্থাপনের খরচ পড়বে ৮২৭ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার)। কিন্তু চীন মনে করছে এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহƒত হবে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক দক্ষিণ চীন সাগরে যুদ্ধজাহাজ পাঠানোকে চীন মনে করছে তাদের ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি এক ধরনের হুমকিস্বরূপ। ওবামা-শি জিন পিং আলোচনায় এই প্রসঙ্গগুলো উত্থাপিত হয়েছে এবং শি জিন পিং এটা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, চীন এ ধরনের ‘কর্মকাণ্ড’ সহ্য করবে না। স্পষ্টতই এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ভূমিকা’ নানা প্রশ্নের জš§ দিয়েছে। এতে এটা স্পষ্ট, এই ভূমিকা এই অঞ্চলে চীনা স্বার্থকে আঘাত করবে। ফলে এ অঞ্চল অর্থাৎ ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চল আগামী দিনগুলোতে যে এক ধরনের প্রভাব বলয় বিস্তার করার প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতোমধ্যে মিয়ানমারে একটি নয়া সরকার গঠিত হয়েছে। অং সান সূচি আগামীতে মিয়ানমারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘ভূমিকা’ পালন করতে যাচ্ছেন। মিয়ানমারকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বাড়ছে। মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ, বিশেষ করে গভীর সমুদ্র গ্যাস ও তেল প্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে মিয়ামানরের আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের মাঝে এক ধরনের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে। এই জ্বালানি সম্পদের ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে ভারতেরও। যেখানে ভারতের বিনিয়োগ বাড়ছে। স্পষ্টতই ভারত মহাসাগরকে ঘিরে একদিকে ভারত, অন্যদিকে চীন এবং মাঝখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের নিজ নিজ স্ট্র্যাটেজি ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এই স্ট্র্যাটেজি এই দেশগুলোর স্বার্থে কত টুকু আঘাত করে কিংবা এই স্ট্র্যাটেজি আদৌ কোনো ‘সংঘর্ষের’ পর্যায়ে রূপ নেয় কিনা তা দেখার জন্য আমাদের আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো দক্ষিণ চীন সাগরের প্রশ্নটির। ফলে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনীতি আগামীতে আরো উত্তপ্ত হবে এবং ধীরে ধীরে চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব আরো প্রকট হতে পারে।
 - Daily Manobkontho 27.06.16

0 comments:

Post a Comment