রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

ট্রাম্পের এক মাস ও নানা প্রশ্ন


যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের এক মাস পার করেছেন গত ২০ ফেব্রুয়ারি। এই এক মাসে তিনি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন এবং এখনো সেই বিতর্ক জন্ম দিয়ে চলেছেন। বিতর্ক যেন তাঁকে ছাড়ছে না। সংবাদপত্রগুলোতে তাঁর ‘ইমেজ’ ভালো নয়। মাত্র এক মাসে তিনি যত বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, বাকি দিনগুলো তিনি কিভাবে কাটাবেন, সে ব্যাপারেও সন্দিহান অনেকে। তাঁর ক্ষমতা পরিচালনা নিয়ে, তাঁর গৃহীত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে যেমন বিতর্ক আছে, বিক্ষোভ আছে, ঠিক তেমনি আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারের দেশগুলোতেও বিতর্ক আছে, ক্ষোভ আছে। সমসাময়িক যুক্তরাষ্ট্রে অতীতে এমন কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি, যিনি ট্রাম্পের মতো এভাবে বিতর্কিত হয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করেছেন। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই, ডোনাল্ড ট্রাম্প কম গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেছিলেন। জানুয়ারিতে (২০১৭) তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল মাত্র ৪০ শতাংশ। অথচ ওবামা যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন (২০০৯) তখন তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল ৭৯ শতাংশ। আর বুশের (২০০১) ছিল ৬২ শতাংশ, ক্লিনটনের (১৯৯৩) ৬৮ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারি মাসে, অর্থাৎ দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পরও একটি পরিসংখ্যান আমরা দিতে পারি। পিউ রিসার্চের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ৩৯ শতাংশ মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড সমর্থন করছে, অন্যদিকে ৫৬ শতাংশ সমর্থন করছে না। নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু তিনি এক মাস পরও তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতার স্তর বাড়াতে পারেননি। পিউ রিসার্চের গবেষণায় উঠে এসেছে অতীত প্রেসিডেন্টদের ওপর আস্থা রাখার বিষয়টিও। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন যখন দায়িত্ব নেন (১৯৯৩) তার এক মাস পর ৬৩ শতাংশ মানুষ তাঁর ওপর আস্থা রেখেছিল। বুশের (২০০১) ওপর ৬০ শতাংশ, ওবামার (২০০৯) ওপর ৭৬ শতাংশ মানুষের আস্থা ছিল (ট্রাম্পের মাত্র ৩৯ শতাংশ)। সাতটি মুসলমান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা তিনি নির্বাহী আদেশবলে জারি করেছিলেন। আদালত সেই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প বিষয়টি নিয়ে গিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। সেখানেও তিনি হেরে যান। কিন্তু ট্রাম্প থেমে থাকেননি। ট্রাম্প প্রশাসন নতুন একটি অভিবাসন নীতিমালার ব্লুপ্রিন্ট প্রকাশ করেছে। ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি থেকে ইস্যু করা দুটি মেমোতে উল্লেখ করা হয়েছে, অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বের করে দেওয়া হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। নতুন এই অভিবাসনসংক্রান্ত নীতিমালা বা নির্দেশনামাকে দেখা হচ্ছে নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। এর অর্থ হচ্ছে ট্রাম্প অভিবাসনসংক্রান্ত তাঁর অবস্থান থেকে এতটুকুও সরে আসছেন না। এরই মধ্যে তাঁর দুই মন্ত্রী মেক্সিকো গেছেন এবং অবৈধ মেক্সিকান অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো নিয়ে কথা হয়েছে। ইউরোপে ট্রাম্পবিরোধী জনমত বাড়ছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে। গেল জানুয়ারিতে ডাভোসে যে বিশ্ব-অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলন হয়ে গেল, চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং সেখানে একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন মডেলের সম্পর্ক শুরু করতে চায় পেইচিং। যদিও এই নয়া সম্পর্ক নিয়ে শি চিনপিং বিস্তারিত কিছু বলেননি। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যে ভবিষ্যতে অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে থাকবে, সে ব্যাপারে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। এরই মধ্যে ট্রাম্প ইউরোপ, এমনকি জার্মানি সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা তাঁকে আরো বিতর্কিত করেছে। জার্মানিতে ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘটনাকে ট্রাম্প আখ্যায়িত করেছিলেন সর্বনাশ হিসেবে। জার্মানরা এটা পছন্দ করেনি। জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল এর উত্তরে বলেছিলেন তাঁদের ভাগ্য তাঁদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, তাঁদের বাইরের দেশের উপদেশের প্রয়োজন নেই। ট্রাম্প ন্যাটোকে আখ্যায়িত করেন বোঝা হিসেবে। এটা নিয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে এক ধরনের উষ্মা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প ব্রেক্সিটকে সমর্থন করেছিলেন। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। অন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ব্রিটেনকে অনুসরণ করুক, এটাও ট্রাম্প চান। ফলে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ট্র্যাডিশনাল সম্পর্ক, তাতে এক ধরনের অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ের পর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর ‘ফোনালাপ’ একটি সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্র এক চীন নীতি পরিত্যাগ করতে পারে! চীন বিষয়টিকে খুব সহজভাবে নেয়নি। চীন তার ‘টুইটার কূটনীতি’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। আরো বিরূপ মন্তব্য করেছেন টিলারসন, যিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। টিলারসন বলেছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীন যে দ্বীপ বানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সেখানে চীনাদের যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া। এর প্রতিবাদে চীন বলছে যুক্তরাষ্ট্র যদি তা করে, তবে তা এক ভয়ংকর সংঘাতে রূপ নেবে। তবে রাশিয়া সম্পর্কে তিনি কিছুটা নরম মনোভাব দেখিয়ে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্র ওবামার শাসনামলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এমনকি রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। রাশিয়া এখন চাইছে, সেই অবরোধ প্রত্যাহার হোক এবং জি-৮-এ আবার রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন করুক যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্পের জন্য কাজটি খুব সহজ নয়। গত চার সপ্তাহে তিনি একের পর এক যেমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা তাঁর নিজ দল তথা বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে একটি প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর ম্যাককেইন ট্রাম্পের ‘মুসলমান নিষিদ্ধ’ করার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করবেন বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে ওবামা প্রশাসনের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জন কেরি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ও সুসান রাইস (জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা) সানফ্রান্সিসকোর আপিল কোর্টে একটি লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছিলেন ট্রাম্পের ওই মুসলমান নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁদের ভাষায় এসব দেশের নাগরিকরা কোনো ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকিতেও ছিল না। ফলে বোঝাই যায় ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্ত খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এটা এখনো স্পষ্ট নয় ট্রাম্প যে ১০০ দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, তাতে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করবেন। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তাঁর নিজের অজ্ঞতা ও তাঁর প্রশাসনে যথেষ্ট যোগ্য লোকের অভাব থাকায় আগামী দিনের যুক্তরাষ্ট্রের একটা ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কপ-২১ চুক্তি (যা প্যারিস ও জাতিসংঘে স্বাক্ষরিত হয়েছে) সমর্থন না করা, কিউবার সঙ্গে সমঝোতাকে অস্বীকার করা, চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’, ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কমিয়ে আনা, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা অস্বীকার, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল ইত্যাদি ভবিষ্যতে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে না। তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে। এখন আমাদের দেখতে হবে তাঁর এই রাজনীতি একুশ শতকের তৃতীয় দশকে যুক্তরাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সিদ্ধান্ত বিশ্বে বড় পরিবর্তন ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট। তাঁর বিষয়ে বিশ্বনেতাদের যে হতাশা এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তা যেকোনো প্রেসিডেন্টের জন্য খারাপ খবর। মানসিকভাবে তিনি কতটুকু সুস্থ সে ব্যাপারে এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। বহুল প্রচারিত ইকোনমিস্ট পত্রিকা গত ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁকে নিয়ে যে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে An Insurgent in the white house শিরোনামে, তা শুধু লজ্জাজনকই নয়, বরং একটি আতঙ্কের কারণও বিশ্ববাসীর জন্য। প্রচ্ছদের ছবিতে দেখা যাচ্ছে ‘ট্রাম্প একটি মলোটোভ ককটেল’ নিক্ষেপ করছেন! এই ‘ছবি’ অনেক কিছুই বলে। সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের মন্তব্যও এখানে উল্লেখ করা যায়। সাময়িকীটি মন্তব্য করেছে এভাবে—‘It is not too late for him to conclude how much worse, to ditch his bomb-throwers and switch courses. The world should hope for that outcome. But it must prepare for trouble.’ বিশ্ব তৈরি থাকবে নতুন সংকটের জন্য। আমরা জানি না, এই ‘সংকট’টা নয়া বিশ্বব্যবস্থাকে কিভাবে প্রভাবিত করবে। তবে মাত্র চার সপ্তাহে তিনি যে একের পর এক বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছেন, তা আমাদের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন সিনিয়র এজেন্ট (সাবেক) জুরাল আভিভ। আভিভের মতে, ট্রাম্প আগামী তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ জন্য ‘ইমপিচ’ বা অভিশংসিত হতে পারেন! শুধু যে জুরাল আভিভের মুখ থেকে এ ধরনের কথা বেরিয়েছে, তা নয়। বরং অনেক পর্যবেক্ষকের লেখায় আমি এ ধরনের আভাস পেয়েছি। অভিশংসনের মূল কারণ হচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি নির্বাচনের আগে (নভেম্বর ২০১৬) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তথা রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এই বিষয়টি এখন স্পষ্ট। ট্রাম্প ক্ষমতা নেওয়ার আগেই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, যাঁরা এখন প্রশাসনে আছেন, তাঁরা রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। তাঁদের সেই কল রেকর্ড মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের কাছে আছে। এর রেশ ধরেই ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নিউ ইর্য়ক টাইমস আমাদের জানাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসনের চার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিয়মিত রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। নির্বাচনের আগে রাশিয়া ট্রাম্পের দুর্বলতা বুঝে তাঁকে রাশিয়ার স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। বিশ্লেষকরা ওই ঘটনাকে এখন আখ্যায়িত করেছেন Russia Gate হিসেবে (Institute for policy studies) অনেকটা নিক্সনের watergate কেলেঙ্কারির মতো। ডেমোক্র্যাটরা তাঁর বিরুদ্ধে তখন উঠেপড়ে লেগেছেন। এদিকে নতুন করে অভিবাসনবিরোধী নতুন দুই ডিক্রি জারি, অন্যদিকে Russia Gate কেলেঙ্কারি ট্রাম্পকে এক মাসের মাথায় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে গেছে। Russia Gate কেলেঙ্কারি থেকে তিনি মুক্তি পাবেন কি না, পেলে কিভাবে পাবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
Daily Kalerkontho
01.03.2017

হঠাৎ আলোচনায় খালেদা জিয়া


হঠাৎ করেই আলোচনায় এসেছেন খালেদা জিয়া এবং মজার ব্যাপার খালেদা জিয়াকে নিয়ে আলোচনা করেছেন বিএনপির দুজন সিনিয়র নেতা, যারা আবার স্থায়ী পরিষদের সদস্য। তবে বিএনপিকে নিয়ে ‘বোমা ফাটিয়েছিলেন’ কানাডার একটি আদালত। সেখানে বিএনপির এক রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীর আবেদন নাকচ করে দিয়ে আদালত তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, বিএনপি সন্ত্রাসে ছিল, আছে বা ভবিষ্যতেও থাকতে পারে, এমন ধারণা করার যৌক্তিক কারণও আছে। এটা নিয়ে বাংলদেশে কম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু এটি বর্তমান নিবন্ধের আলোচনার বিষয় নয়। আলোচনার বিষয় খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার কারাদ- হতে পারে (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল মামলা) এমন আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘সাজা হলেও খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারবেন।’ আর গয়েশ্বর রায় বলেছেন, ‘হাসিনার অধীনে নির্বাচনে গেলে ৫ বছর পর কেন?’ দুটি বক্তব্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, মওদুদ আহমদ এ ধরনের বক্তব্য কেন দিলেন? আদালত কী রায় দেবেন, তা তো আগাম কেউ বলতে পারে না? একজন আইনজ্ঞ মওদুদ আহমদ ‘সাজা’র কথা আগাম বলেন কীভাবে? বাজারে নানা গুঞ্জন। সেসব গুজবের সঙ্গে মওদুদ সাহেবের নামও আছে। তিনি কী কোনো মেসেজ দিতে চাচ্ছেন? তিনি কী চাচ্ছেন খালেদা জিয়ার সাজা হোক। এর পর খালেদা জিয়া আপিল করবেন। উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখবেন এবং আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখবেন। যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা মওদুদ আহমদের এ ধরনের বক্তব্যে এক ধরনের ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজতে পারেন। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, খালেদা জিয়া তার স্মৃতিবিজরিত ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি হারিয়েছিলেন সরাসরি বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে যাওয়ার কারণে। হাইকোর্টে ও আপিল বিভাগেও খালেদা জিয়া হেরে গিয়েছিলেন। হাইকোর্টে যাওয়ার পরামর্শটি দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। দ্বিতীয়ত, গয়েশ্বর রায় যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানেও আছে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। তিনি সরাসরি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘শেখ হাসিনার অধীনে যদি নির্বাচনেই যাব তাহলে ২০১৪ সালেই নির্বাচনে যেতে পারতাম। তাহলে পাঁচ বছর পরে যাব কেন?’ এ থেকে একটা মেসেজ অন্তত পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন নির্বাচনের আগে যে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে তার নেতৃত্বে যদি শেখ হাসিনা থাকেন, তাহলে বিএনপির একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (যা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।) অংশ নেওয়া উচিত নয়। অকাট্য যুক্তি। এখনো শেখ হাসিনা থাকবেন বিধায় তো ২০১৪ সালের নির্বাচনেই অংশ নেওয়া যেত। মির্জা ফখরুল এবং রিজভী আহমেদের বক্তব্য অনেকটা গয়েশ্বর রায়ের বক্তব্যের মতোইÑ তারা শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচনে যেতে চান না। কিন্তু নির্বাচন হবে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায়। এ ক্ষেত্রে বিএনপি অংশ না নিলেও সরকার নির্দিষ্ট সময়েই নির্বাচনের আয়োজন করবে, যেমনটি করেছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। বিএনপি এখন একটি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বলছে। কিন্তু এর রূপরেখা এখন অবধি উপস্থাপন করেনি। তবে সেই রূপরেখা সরকার যে মানবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। মোটামুটিভাবে যেভাবেই হোক একটি নির্বাচনী আমেজ ফিরে এসেছে। টিভি টক শোতে দেখলাম, এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি নিজেও একাধিক টক শোতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, দিন যত যাচ্ছে খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজার বিষয়টি অন্যতম আলোচিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজা নিয়ে মন্তব্য করেন, তখন বুঝতে হবে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে। যদিও এটা আইনের বিষয়। আদালত ও উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ নিয়ে বিএনপির নেতারা আগাম মন্তব্য করে বিষয়টিকে উসকে দিলেন মাত্র। আসলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হোক, এটা আমার ধারণা প্রধানমন্ত্রী নিজেও চান। আরেকটি ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো নির্বাচন হোকÑ আমরা তা কেউই চাই না।
৫ জানুয়ারি (২০১৪) আমাদের জন্য কোনো সুখকর দিন ছিল না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচন নিয়ে দুটো বিষয় ছিল। এক. সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, দুই. বাস্তবতা। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি নির্বাচন আয়োজন করার প্রয়োজন ছিল। এটা নিয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। তবে আস্থার সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল ২০১৪-পরবর্তী যে কোনো সময় একাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা, যেমনটি করেছিল বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ (যে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল) কিংবা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বারবার আলোচিত হতে থাকবে। ষষ্ঠ সংসদে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। আর দশম জাতীয় সংসদে বিএনপি অংশ নেয়নি। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় দুটি নির্বাচনেরই প্রয়োজন ছিল। তবে তুলনামূলক বিচারে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে বেশি। ১৫৪টি সংসদীয় আসনে (৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১২৮, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, জাসদ ৩, জাপা-মঞ্জু ১, জাতীয় পার্টি-এরশাদ ২০) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া, ৫ জেলায় কোনো নির্বাচন না হওয়া কিংবা ৫২ ভাগ জনগোষ্ঠীর ভোট না দেওয়ার সুযোগ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা নিয়ে যে যুক্তিই আমরা টিভির টক শোতে দেখাই না কেন, এতে করে দেশে কোনো আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে সাহায্য করেনি। অথচ গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক, পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। পঞ্চম সংসদে (১৯৯১) এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ ছিল বিধায় আমরা দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী এনে দেশে পুনরায় সংসদীয় রাজনীতির ধারা প্রবর্তন করেছিলাম। সেদিন বিএনপি সংসদীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ধারণা করেছিলাম ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে আস্থার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল তা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু তা কাটিয়ে উঠতে পারছি বলে মনে হচ্ছে না।
এর পর এলো চলতি ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারির ঘটনা। বিএনপির ‘কালো পতাকা’ দিবসে পুলিশি হামলা প্রমাণ করল ‘আস্থার সম্পর্ক’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত সহজ নয়। আস্থার সম্পর্কের পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিএনপিকে ‘স্পেস’ দেওয়া। অর্থাৎ বিএনপিকে তার কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া। এটা তো সত্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল, তার দায়ভার বিএনপি এড়াতে পারে না। বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারার সংস্কৃতি আর যাই হোক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য মানানসই নয়। ওই ঘটনায় বিএনপি তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল বিএনপি ও ১৪ দল। কিন্তু আন্দোলন তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। অর্থাৎ সরকারের পতন হয়নি। কিন্তু সহিংসতায় অনেক মানুষ মারা গেছে। অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের করুণ কাহিনি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। টিভি পর্দায় তাদের আর্তি দেখে সাধারণ মানুষ কেঁদেছে। মানুষ বিএনপিকেই দোষারোপ করেছে। এটা থেকে বিএনপি বের হয়ে আসতে পারেনি। তার পরও কথা থেকে যায়। বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। এটা সরকারের জন্য একটা প্লাস পয়েন্টও বটে। সরকার বিএনপিকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এটাকে ধরে রাখতে হবে, যাতে করে বিএনপি ২০১৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি অংশ না নিলে জটিলতা থেকে যাবে। তাতে করে কেউই লাভবান হবে না। সরকারের জন্য তো নয়ই, বিএনপির জন্যও নয়। তাই সুস্থ নির্বাচনী পরিবেশের জন্য আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠা জরুরি।
এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য দুটো বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে গণতন্ত্রের হাওয়া বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেকগুলো সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধশিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা সফটপাওয়ার হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেন’-এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই আস্থার সম্পর্ক শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এই প্রতিযোগিতা হতে হবে রাজনৈতিক ও কর্মসূচিভিত্তিক। খালেদা জিয়ার সাজা হবে কী হবে না, এটা নিয়ে যত কম আলোচনা হবে, ততই ভালো। এটা আদালতের বিষয়। এ নিয়ে ‘জনমত’ সৃষ্টি করারও দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে নির্বাচনী প্রচারণা এক রকম শুরু করে দিয়েছেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি বগুড়ায় জনসভা করেছেন। সেখানে তিনি উন্নয়নের কথা বলেছেন। বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি বলে বিবেচিত। সেখানে তিনি বলেছেন, উন্নয়নে কোনো বিশেষ এলাকা বিবেচ্য নয়। এর অর্থ উন্নয়ন কর্মকা-কে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়ে আসবেন। সামনে আছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের বিষয়টি, যা ২০১৮ সালে চালু হওয়ার কথা। হয়তো পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেই তিনি নির্বাচনের তারিখ দেবেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কী করবে? বিএনপির উচিত হবে ইস্যুভিত্তিকভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা। সিনিয়র নেতাদের উচিত বিভাগীয় শহরগুলোয় যাওয়া। খালেদা জিয়া বিভাগীয় শহরে জনসভাও করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত বিএনপিকে জনসভা করতে দেওয়া। আর এর মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে একটি নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে।
Daily Amader Somoy
28.02.2017

একজন শ্রাবণ ও একগাদা ভূতের বই


বাচ্চা মেয়েটির বয়স কত হবে ১৪ থেকে ১৫ বছর। কিশোরী। আমাকে সে চেনে না। চেনার কথাও নয়। বইমেলায় শোভা প্রকাশ স্টলে এসে আমার সদ্য প্রকাশিত দুটি বই সম্পর্কে খোঁজ করল। মাঝে-মধ্যে আমি বইমেলায় যাই। অনেক শুভাকাক্সক্ষী, আমার অনেক ছাত্র আসে বইমেলায় আমার হাত থেকে বই দুটি নেয়ার জন্য। কিশোরীটি যখন বিক্রয়কর্মীকে বই দুটির নাম জিজ্ঞেস করছিল, আমি স্টলে ছিলাম। ও জানাল পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে বই দুটি কিনতে এসেছে। সঙ্গে ওর কাজিন। ডাক্তার। ওর নাম শ্রাবণ। মতিঝিল আইডিয়ালের ছাত্রী। সম্ভবত নবম কিংবা দশম শ্রেণীর ছাত্রী। এ বয়সে তো ওর ভূত-প্রেত বা রাক্ষস-খোক্কসের বই পড়ার কথা! হঠাৎ করে ‘বিশ্ব রাজনীতির ১০০ বছর’ কিংবা ‘নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা ও সমকালীন আন্তর্জাতিক রাজনীতি’র প্রতি ওর আগ্রহ বাড়ল কেন? প্রায় প্রতি বছরই আমার একটি-দুটি বই প্রকাশিত হয়। মেলায় গেলে অনেক পাঠকের সাক্ষাৎ হয়। এরা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, সরকারি চাকুরে কিংবা ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। ওরা সবাই সিরিয়াস পাঠক। শ্রাবণের মতো ‘ক্ষুদে’ পাঠক, পড়–য়া আমি পাইনি কখনও। আমার পরিচয় না দিয়েই আমি যখন ওর সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলাম, আমাকে অবাক করে দিয়ে ও জানাল বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে ও জানতে আগ্রহী। কী অবাক কাণ্ড! একটা বাচ্চা মেয়ে, যার এখন বয়স হুমায়ূন আহমেদের কিশোর উপন্যাস পড়া, নিদেনপক্ষে অবাস্তব ভৌতিক, সায়েন্স ফিকশন পড়া, সে কিনা এ বয়সে বিশ্ব রাজনীতি পড়বে? এটা তো ওর সিলেবাসেও নেই? কিংবা ওকে জি-৫ পেতেও সাহায্য করবে না? তাহলে? গত দু’সপ্তাহ আগে ক্লাসে যখন পড়াচ্ছিলাম বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতি, তখন আমি লক্ষ করলাম প্রথম বেঞ্চে বসা আমার এক ছাত্রীর কাছে একটি গাইড বই, যেখানে একটি ছোট্ট প্রবন্ধ রয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্ক নিয়ে। চতুর্থ বর্ষের এক ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে গাইড বই পড়বে! এ ব্যর্থতা তো আমার। আমি আমার ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতে পারিনি মূল বই পড়তে। সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিও ওদের অনেকের অজানা। ক্লাসে একদিন ‘ব্ল– ইকোনমি’ নিয়ে আলাপ করছিলাম। দেখলাম দু-একজনের এ সম্পর্কেও কোনো ধারণা নেই। আমি কোথায় যাব? কোন প্রজন্ম আমরা তৈরি করছি? আমরা সার্টিফিকেটসর্বস্ব একটা জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের প্রয়োজন জিপিএ৫। এটাই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলাম। এখন খোদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান নিয়ে চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে। গাইড বই যদি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্পর্শ করে, ছাত্ররা যদি গাইড বইনির্ভর হয়ে যায়, এ দোষ তো আমার। সারাটা বছর এখানে একদিনের জন্যও ক্লাস না করেও পরীক্ষা দেয়া যায়। ভিসিরা তাদের অনুমতি দেন পরীক্ষা দেয়ার। আর এটা উচ্চশিক্ষার জন্য গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়! আমাদের শিক্ষামন্ত্রী এটা নিয়ে গর্ব করেন। বলেন, উচ্চ শিক্ষায় আমাদের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে! গাইড বই পড়া আর জিপিএ ৫-এর ‘বিস্ফোরণ’ যদি আমাদের ‘মানদণ্ড’ হয়, তাহলে আমরা উচ্চশিক্ষায় উন্নতি করেছি বৈকি! তবে একজন শ্রাবণ আমার জন্য অনেক আশার জায়গা। আগামীতে আমরা যখন আর শিক্ষকতায় থাকব না, তখন হয়তো এই শ্রাবণরাই আমাদের জন্য আশার আলো জ্বালিয়ে রাখবে।

দুই.

বইমেলায় ভূতের ওপর একটি বই নাড়াচাড়া করছিলাম। প্রতি বছর এ ধরনের প্রচুর বই মেলায় আসে। এ যুগে কিশোরদের ভূত-পেত্নীদের গল্প শুনিয়ে কি তাকে আধুনিকমনস্ক হিসেবে গড়ে তোলা যাবে? ভূত-পেত্নীদের গল্প শুনিয়ে আমরা কি সমাজকে, তরুণ প্রজন্মকে পেছনের দিকে ঠেলে দিচ্ছি না? এটা না করে তরুণ সমাজকে যদি বিশ্বে যেসব পরিবর্তন এসেছে, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারতাম, তাতে করে তরুণ প্রজন্ম শুধু উৎসাহিতই হতো না, বরং তাদের আরও বেশি করে বিজ্ঞানমনস্ক করে গড়ে তুলতে পারতাম। আমরা তরুণ প্রজন্মকে নিয়ে গর্ব করি। এ তরুণ প্রজন্মই আগামীতে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে। এক সময় যেসব গুণী ব্যক্তি আন্তর্জাতিক আসরে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারা হারিয়ে যাচ্ছেন। এটাই বাস্তবতা। এটাই চরম সত্য। এখন আমরা যদি প্রতি বছর এসব ভূতমার্কা বই প্রকাশ করতে থাকি, তাহলে গুণী, মেধাবী, আন্তর্জাতিক মানের বিজ্ঞানী আমরা তৈরি করতে পারব না। আমার কাছে এ মুহূর্তে কোনো পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু কিশোরদের জন্য যেসব গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, তার একটা বড় অংশই ওইসব ভূত-পেত্নী সংক্রান্ত। কিশোরদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের বই বের হয়েছে এটা ভালো কথা। সেই সঙ্গে খুব সহজ ভাষায় বাংলাদেশের ইতিহাস, বাংলাদেশের সংস্কৃতি, বাংলাদেশের পরিবেশ, ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের পরিচিতি যদি তুলে ধরা যেত, আমার ধারণা একটি জ্ঞাননির্ভর তরুণ প্রজন্ম আমরা তৈরি করতে পারতাম। আমাদের লেখকদের একটা বড় অংশই এ কাজটি করেন না।

ভূত-পেত্নীদের নিয়ে লেখা বই যে এবার প্রথম বের হল, তেমনটি নয়। প্রতি বছরই বের হচ্ছে। শত শত প্রকাশক আছেন, তারা বই বের করছেন। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। হয়তো স্বস্তা জনপ্রিয়তার জন্য লেখকরা এটি করে থাকেন। কিন্তু একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কেন এমনটি করবেন? তাহলে তার সঙ্গে সাধারণ একজন লেখকের পার্থক্য থাকল কোথায়?

তিন.

পত্রপত্রিকা থেকে দেখলাম এবার প্রায় তিন হাজারের মতো বই প্রকাশিত হবে। আগামী ২৮ তারিখ পর্যন্ত বই প্রকাশ অব্যাহত থাকবে বলে প্রকাশকরা আমাকে জানিয়েছেন। এ তিন হাজার বইয়ের মধ্যে ক’টি বই মানসম্মত? ক’টি বইকে আমরা রেফারেন্স বই হিসেবে গ্রহণ করতে পারব? ভালো রেফারেন্স বই একশ’টি পাব কিনা, তাতে রয়েছে সন্দেহ। বইমেলা থেকে আমার যা অভিজ্ঞতা, তা অনেকটা এরকম- এক. ভালো হোক মন্দ হোক প্রচুর বই বের হচ্ছে। মানুষ বই কিনছে, তা সে পড়ার জন্যই হোক কিংবা নিজের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালার জন্য হলেও হোক, বই বিক্রি প্রতি বছর বাড়ছে। প্রকাশনা একটি শক্তিশালী ‘শিল্প’ হিসেবে এটি গড়ে উঠছে। শত শত লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রকাশনার মান উন্নত হচ্ছে। তবে সমস্যাও আছে। প্রচুর বানান ভুল থাকে। ঠিকমতো সম্পাদনা হয় না। সম্পাদনা সহকারীদের তেমন প্রশিক্ষণ নেই। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তাদের সম্মানীও কম। ফলে শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত সম্পদনা সহকারী বের হয়ে আসছে না। বাংলা একাডেমি তাদের কর্মের পরিধি বাড়িয়ে ‘সম্পাদনা সহকারী তৈরি প্রকল্প’ হাতে নিতে পারত, যার মাধ্যমে শত শত দক্ষ সম্পাদনা সহকারী আমরা পেতাম। ফলে মানসম্মত বই আমরা বাজারে পেতাম। দুই. হাজার হাজার বই প্রকাশিত হওয়ার ফলে কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইয়ের আগ্রাসন আমরা রোধ করতে পেরেছি। এটা ভালো লক্ষণ। আমার ধারণা ধীরে ধীরে আমরা আরও দক্ষ ও ভালো লেখক পাব। তিন. কিছু কিছু বই আমার চোখে পড়েছে, যেসব বই নিয়ে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় প্রচুর গ্রন্থ ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে (যেমন প্লেটো ও অ্যারিস্টটলকে নিয়ে বই)। এর প্রয়োজন ছিল না। আধুনিক সমাজে অ্যারিস্টটল কতটুকু গ্রহণযোগ্য, তা আমি খুঁজে পাইনি। উপরন্তু কলকাতা থেকে প্রকাশিত বইয়ের সঙ্গে কোথায় যেন একটা ‘মিল’ আমি খুঁজে পেয়েছি। চার. সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে প্রচুর ইংরেজি বই প্রকাশিত হয়েছে। ওইসব বইয়ের কোনো অনুবাদ আমার চোখে ধরা পড়েনি। কয়েক বছর আগে অধ্যাপক রশীদ (উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়) কয়েকটি বইয়ের অনুবাদ করেছিলেন (একটি ছিল হানটিংটনের সভ্যতার দ্বন্দ্ব)। আর কাউকে আমি এগিয়ে আসতে দেখলাম না। বাংলা একাডেমির উদ্যোগও এতে নেই। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা ভাষায় পড়ানো হয়। ছাত্ররা (প্রায় ৯৫ ভাগ) বাংলা ভাষাতে উত্তরপত্র লেখে। এমনকি পিএইচডি ডিগ্রিও হচ্ছে বাংলা ভাষাতে। এতে দোষের কিছু নেই। ছাত্ররা বাংলা ভাষাতে ক্ল্যাসিকাল বইগুলোর বাংলা অনুবাদ পায় না বিধায় গাইড বই পড়ে। পড়তে বাধ্য হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিষয়ভিত্তিকভাবে ক্ল্যাসিকাল বইগুলোর বাংলা অনুবাদের দায়িত্ব নিতে পারে। অথবা বিষয়ভিত্তিকভাবে বই প্রকাশের দায়িত্ব নিতে পারে, যা প্রকারান্তরে ছাত্রদের সাহায্য করবে। বাংলা একাডেমিও এ কাজটি পারে। কিন্তু করছে না। একই সঙ্গে যদি স্পন্সরের ব্যবস্থা করা যায়, আমার ধারণা তাতে করে লেখকরা ভূতের বই না লিখে সিরিয়াস পাঠ্যবই লিখতে উৎসাহিত হবেন। একজন ঔপন্যাসিক একটি বই লিখে যা পান, বা হুমায়ূন আহমেদ যা পেতেন, তাতে করে তাকে অন্য কিছু করতে হতো না। বিদেশে একজন লেখক শুধুই লেখেন। অন্য কোনো পেশা তাদের নেই বা থাকে না। বাংলাদেশে একমাত্র হুমায়ূন আহমেদ বাদে অন্য কেউই এভাবে নিজেকে তৈরি করতে পারেননি। অনেকেই বই লিখে অর্থ আয়ের একমাত্র পথ করতে পারেননি। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি প্রকাশকরা যে সম্মানী দেন (কেউ আবার দিতেও চান না), তা নিয়ে ‘সংসার চালানো’ যায় না। এ ক্ষেত্রে যদি স্পন্সর পাওয়া যায় ক্ষতি কী। অনেক ইংরেজি বইয়ের অনুবাদ হতে পারে, যা কোনো কোম্পানির সৌজন্যে প্রকাশিত হতে পারে। এতে করে অনুবাদক বা লেখকরা একটা ভালো সম্মানী পাবেন। তারা তাতে উৎসাহিত হবেন, উজ্জীবিত হবেন। প্রকাশকদের আর্থিক ঝুঁকিও কিছুটা কম হতে পারে এতে করে। অনেক সৃজনশীল কাজে এখন স্পন্সররা যুক্ত হচ্ছেন। তাহলে বই প্রকাশনার সঙ্গে কেন নয়? পাঁচ. প্রতিবছরই একটি কথা শুনি। এবারও শুনলাম- সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনের দাবি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা অনেক আগেই চালু হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় গ্রন্থ কোথায়? এখন শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে নতুন একটি নীতিমালা থাকা উচিত, যেখানে একজন শিক্ষকের একটি টেকসই বই থাকতে হবে। না হলে তিনি পদোন্নতির যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন না। প্রয়োজনে একজন শিক্ষককে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়ে বিষয়ভিত্তিক টেকসই বই প্রণয়ন করার উদ্যোগ নিতে হবে। একজন শিক্ষক যেন উপলব্ধি করেন তার পদোন্নতি হবে না যদি না তিনি ন্যূনতম একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এ ধরনের একটি প্রস্তাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে পারে। ছয়. কিছু কিছু বইয়ে তথ্য বিভ্রাট রয়েছে। ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে। একটা শক্তিশালী সম্পাদনা পরিষদ নেই বিধায় এমনটি হচ্ছে। সৃজনশীল প্রকাশকরা নিজেদের উদ্যোগে বিষয়ভিত্তিক সম্পাদনা পরিষদ গঠন করতে পারেন।

চার.

ভূতের বই বাংলা ভাষার মানোন্নয়ন কিংবা বৃদ্ধির জন্য আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে না। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের জন্য আরও অনেক বিষয় যেমন- সৌরজগৎ, সোলার জগৎ, পরিবেশ, ‘ব্লাক হোল’ ইত্যাদি নিয়ে সিরিজ গ্রন্থ প্রণয়ন করা যায়। যিনি ভূত-পেত্নী নিয়ে লিখেছেন, তাকে উৎসাহিত করা যায় এসব বিষয় নিয়ে লিখতে। একুশ শতকে এসে আমাদের কিশোরদের মনোজগতে কেন আমরা ভূত-পেত্নীর কল্পকাহিনী ঢুকিয়ে দেব? এটা আমাদের জন্য হতাশার। আমার আশার জায়গায় একজন শ্রাবণকে আমি পেয়েছি যে এই কিশোর বয়সে বিশ্বকে জানতে চায়। তার এই জানার আগ্রহ আমাকে আরও বেশি উৎসাহিত করল কিশোরদের জন্য আগামী বইমেলায় ‘নতুন কিছু’ উপহার দেয়ার।
Daily Jugantor
27.02.2017

ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন সব সমস্যার সমাধান নয়

রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন নিয়ে অতিসম্প্রতি দুইটি সংবাদ ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গেল সপ্তাহে জার্মানির মিউনিখে একটি নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মরকেলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে জার্মানির সহযোগিতা চেয়েছেন। অপর সংবাদটিও রোহিঙ্গা পুনর্বাসন সংক্রান্ত। বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ প্রধান শিনজি কুবো জানিয়েছেন, ১ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ভিন্ন কোনো দেশে পুনর্বাসনের জন্য তারা বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি চেয়েছেন। তবে নতুন যে ১০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের মধ্য থেকে এ ১ হাজার রোহিঙ্গাকে বেছে নেয়া হবে বলে মনে হয় না। কুবো জানিয়েছেন, বাংলাদেশের দুইটি শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় ৩৪ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। সেখান থেকেই এ ১ হাজার রোহিঙ্গাকে বাছাই করা হবে। এ দুইটি সংবাদই রোহিঙ্গা শরণার্থী পুনর্বাসন প্রশ্নে একটি বড় সংবাদ। কিন্তু এতে করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশ সরকার কক্সবাজারে অবৈধভাবে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের হাতিয়া উপজেলার একটি বিরান চর ঠেঙ্গারচরে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে স্পষ্ট করে বলা হয়নি কবে নাগাদ সেখানে পুনর্বাসনের কাজ শুরু হবে। এরই মধ্যে সেনাবাহিনীকে একটি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেখানে অবকাঠামো গড়ে তুলতে। ঠেঙ্গারচরে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনের প্রশ্নে কিছু কিছু দ্বিমত থাকলেও বাস্তবতা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। কেননা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার কক্সবাজারে উপস্থিতি শুধু পরিবেশগত সমস্যাই বাড়িয়ে দিচ্ছে না, বরং নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাকে ঝুঁকির মাঝে ফেলে দিয়েছে।
রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে এ ধরনের সংবাদ প্রমাণ করে, রোহিঙ্গা সমস্যাটি ধীরে ধীরে একটি আন্তর্জাতিক রূপ পেতে যাচ্ছে। সংগতকারণেই তাই প্রশ্নটি উঠেছে, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন পথে? বাংলাদেশও এক্ষেত্রে কী করতে পারে? দুই সপ্তাহ আগে একটি টিভি চ্যানেলে রোহিঙ্গা নিয়ে এক আলোচনায় আমি অংশ নিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. মোমেন, যিনি অর্থমন্ত্রীর ছোট ভাই। সেখানেও ওই প্রশ্নটি উঠেছিলÑ বাংলাদেশ এখন কী করবে? বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সমস্যাটি বিবেচনা করে সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এতে করে কি সমস্যাটির সমাধান হবে? আমার বিবেচনায় এতে করে সমস্যার সমাধান হবে না। বরং সমস্যার গভীরতা আরও বাড়বে। বাংলাদেশ শুধু রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ‘বসে’ থাকতে পারে না। বাংলাদেশের অনেক কিছু করার আছে। এক. বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যাটির আরও আন্তর্জাতিককরণ করার উদ্যোগ নিতে পারে। এক্ষেত্রে ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে পারে বাংলাদেশ।
দুই. দ্বিপক্ষীয় আলোচনার (বাংলাদেশ-মিয়ানমার) পাশাপাশি বাংলাদেশ চীন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং তাদের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করতে পারে।
তিন. মিয়ানমারের ভেতরেই একটি ‘সেফ হ্যাভেন’ প্রতিষ্ঠা করে আন্তর্জাতিক তদারকিতে সেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার কথা বলতে পারে বাংলাদেশ।
চার. যেহেতু জাতিসংঘ রোহিঙ্গা নির্যাতনকে গণহত্যা বলছে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে এ গণহত্যার বিষয়টি তুলতে পারে।
পাঁচ. এটা সত্য, মিয়ানমারে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। আমাদের পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির আলোকে এ সম্পর্কের গুরুত্ব অনেক। ন্যূনতম দুই আঞ্চলিক সংস্থায় (বিসিআইএন ও বিমসটেক) বাংলাদেশ ও মিয়ানমার একসঙ্গে কাজ করছে; কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যাটিকে এ সম্পর্কের বাইরে রাখা যাবে না। এজন্য দরকার ‘স্মার্ট ডিপ্লোম্যাসি’। সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়েই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে।
ছয়. রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য মিয়ানমারের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। বলা ভালো, রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে অং সান সু চি’র কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। দুঃখজনক হলেও সত্য, ২০১২ সালের পর থেকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যার ব্যাপকতা পেলে এবং শত শত রোহিঙ্গাকে নৌকাযোগে মালয়েশিয়া যাওয়ার ব্যাপারেও ওই সময় সু চি’র কোনো বক্তব্য ছিল না। মিয়ানমারের বর্তমান সরকার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। মিয়ানমার সরকার মনে করে, রোহিঙ্গারা মূলত বাংলাদেশের নাগরিক! অথচ ইতিহাস বলে, শত বছর ধরেই রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছে। সু চি এ প্রক্রিয়ার পুরোপুরি বাইরে নন। তিনি জানেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য তার উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সমর্থনের প্রয়োজন আছে। তাই উপ্রপন্থীরা যখন মুসলমানদের হত্যা করছে, তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে, তাদের বাধ্য করছে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করতে, তখন তিনি নিশ্চুপ। মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারেও তার কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি যে স্ট্র্যাটেজি বহন করেছেন, তা সুবিধাবাদিতায় ভরা। সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন নেত্রী তিনি, এ কথাটা বলা যাবে না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে একদিকে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক ধরনের ‘সহাবস্থানে’ গিয়েছিলেন, অন্যদিকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ থেকে তিনি উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের অবস্থানকেই সমর্থন করেছিলেন। এতে করে তিনি ‘বিজয়ী’ হয়েছেন, এটা সত্য। কিন্তু সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি সমাজ ব্যবস্থা সেখানে কতটুকু প্রতিষ্ঠিত হবে, সে প্রশ্ন আছে। একটি জনগোষ্ঠী যখন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার হয়, তখন সেই সমাজকে একটি গণতান্ত্রিক সরকারও বলা যায় না। বিপুল ভোটে মিয়ানমারের জনগণ সু চি’কে নির্বাচিত করেছে; কিন্তু তিনি বাহ্যত একটি শ্রেণীর স্বার্থেই কাজ করছেন। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ন্যূনতম অধিকার তিনি নিশ্চিত করেননি।
এখন যে অভিযোগটি মিয়ানমারের কোনো কোনো মহল থেকে উচ্চারিত হয়, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নন, এর পেছনে আদৌ কোনো সত্যতা নেই। ইতিহাস বলে, রোহিঙ্গারা অষ্টম শতাব্দী থেকেই আরাকান অঞ্চলে বসবাস করে আসছেন। ১৪৩০ সালের দিকে তৎকালীন আরাকান শাসক বৌদ্ধরাজা নারামাইখলা (Narameikhla), যিনি মিন স মুন (Min Saw mun) নামেও পরিচিত ছিলেন, তার শাসনামলে তিনি রোহিঙ্গা মুসলমানদের এ অঞ্চলে নিয়ে এসেছিলেন এবং আরাকানে বসবাস করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। সেই থেকে রোহিঙ্গারা সেখানে বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছেন। সুতরাং আজ নতুন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন এবং তা গ্রহণযোগ্য নয়।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে দুই ভাগে বাংলাদেশকে এখন এগোতে হবে। প্রথমত, আন্তর্জাতিক আসরে রোহিঙ্গা সমস্যাটা তুলে ধরা এবং দ্বিতীয়ত, রোহিঙ্গাদের সীমিত সময়ের জন্য ‘নিজস্ব একটি বাসস্থান’ তৈরি করা। উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ একটি ‘পজেটিভ’ অবস্থান নিয়েছে। জার্মানি সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মরকেলের সঙ্গে বৈঠকে বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশ একটি বড় পরিসরে রোহিঙ্গা সমস্যাটি তুলে ধরল। এটা প্রশংসাযোগ্য। জার্মানি নিজেও জানে অভিবাসী সমস্যার গভীরতা। জার্মানি সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় ১০ লাখ সিরীয় ও ইরাকি অভিবাসীকে তার দেশে আশ্রয় দিয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্য থেকে এসব শরণার্থী জার্মানিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। এরা যুদ্ধ শরণার্থী। মানবিক দিকটি বিবেচনা করে জার্মানি এদের আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থাও অনেকটা তেমনি। রোহিঙ্গারা নিজ দেশ থেকে উৎখাত হয়েছেন। সেখানে এক ধরনের ‘এথনিক ক্লিনসিং’ হচ্ছে। অর্থাৎ জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান। এ ধরনের ‘এথনিক ক্লিনসিং’ আমরা প্রত্যক্ষ করেছিলাম বসনিয়ায়, যেখানে সার্বরা মুসলমানদের নিজ বাসভূম থেকে উৎখাত করেছিল। হাজার হাজার মুসলমানকে নিজ বাসভূমিতে হত্যা করা হয়েছিল। সেই গণহত্যাকারী সার্ব জেনারেলদের হেগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচার পর্যন্ত হয়েছিল। মিয়ানমারে আজ রোহিঙ্গারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের দ্বারা ‘এথনিক ক্লিনসিং’ এর শিকার হয়েছেন। বাধ্য হয়ে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন। বাংলাদেশ মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশ একটি ছোট্ট দেশ। এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার ‘স্থায়ী আবাস’এর নিশ্চয়তা দিতে পারে না বাংলাদেশ। এর আগেও ১৯৭৯ সালের পর থেকে যেসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়েছিলেন মিয়ানমার তাদের অনেককেই ফিরিয়ে নেয়নি। একমাত্র মিয়ানমার সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ করেই সম্ভব রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন। এ কাজটি বাংলাদেশ শুরু করেছে। এখন বিষয়টি ওআইসি ও জাতিসংঘেও তুলতে হবে। আমরা ইইউর সহযোগিতাও নিতে পারি। এরই মধ্যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান বন্ধের কথা বলেছে সে দেশের সরকার এবং কিছু রোহিঙ্গা ফিরে গেছে বলে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছে। আমার ধারণা, এটি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটি কৌশল হতে পারে, যাতে করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো যায়। কিছু রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিয়ে ওই প্রত্যাবাসন আবার বন্ধ করে দেবে মিয়ানমার সরকার। জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াং হি সম্প্রতি বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। তিনি রোহিঙ্গাদের অবস্থান জানতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তিনি লেদা, নয়াপাড়া শরণার্থী শিবির, শামলাপুর অস্থায়ী রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। সাংবাদিকদের তিনি জানিয়েছেন আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট জাতিসংঘের মহাসচিবকে দেবেন। এটা বিবেচনায় নিয়েই মিয়ানমার সরকার কিছু রোহিঙ্গাকে নিজ দেশে ফিরে আসতে সুযোগ করে দিয়েছে। তবে যারা এরই মধ্যে বাংলাদেশে এসে গেছেন, তাদের দ্রুত ঠেঙ্গারচরে পুনর্বাসন প্রয়োজন। ঠেঙ্গারচরটি বর্তমানে নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার অন্তর্ভুক্ত। হাতিয়ার মূল ভূখ- থেকে পূর্ব দিকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার এবং নলচিরা ঘাট থেকে পূর্বদিকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে জেগে ওঠা একটি চর। প্রায় ১০ হাজার একর জমি রয়েছে এখানে। বন বিভাগ এখানে বিশাল একটি বনাঞ্চল তৈরি করেছে। বিরান এ জনপদে দ্রুত অবকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন। প্রয়োজন রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করাও। ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষার জন্য শেল্টার হোম তৈরি করারও প্রয়োজন। এ চরাঞ্চলে গো-চাষের বিশাল এক সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ ইইউর কাছ থেকে এ ব্যাপারে সাহায্য ও সহযোগিতা পেতে পারে। এজন্য দরকার ‘দক্ষ কূটনীতি’। আমরা যেন এটা ভুলে না যাই, রোহিঙ্গাদের একটা অংশ এখন নানা ধরনের অসামাজিক কাজে লিপ্ত রয়েছে। অবৈধ অভিবাসীরা ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়োজিত রয়েছে, এমন সংবাদও ছাপা হয়েছে পত্রপত্রিকায়। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে। ফলে যত দ্রুত আমরা রোহিঙ্গাদের সাময়িকভাবে পুনর্বাসন করতে পারব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল।
Daily Alokito Bangladesh
26.02.2017

বাঘাইছড়ির নির্বাচন কি আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে


নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার তিন দিনের মাথায় পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি পৌরসভার একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে। এটা ছিল নয়া নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি টেস্ট কেস। মোটামুটি নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়েছে। বিকেলের দিকে কিছু জাল ভোটের অভিযোগ পাওয়া গেলেও, নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের কোনো অভিযোগই উত্থাপন করেনি কোনো দল। পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রায় এক হাজার ৫৭১ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন স্বতন্ত প্রার্থী। আর বিএনপি প্রার্থীর অবস্থান তৃতীয়। নিঃসন্দেহে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের একটি সাফল্য। কিন্তু এই সাফল্য কি আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে? যেখানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলে আসছেন একটি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা, সেখানে একটি পৌরসভার নির্বাচন দিয়ে সবকিছু বিচার করা যাবে না। আস্থার যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। তা থেকে যদি বেরিয়ে আসা না যায়। তাহলে আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মূল প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। পৌরসভা কিংবা উপনির্বাচন (জাতীয় সংসদের দুটি আসন) নিয়ে সব কিছু বিচার করা যাবে না। কিংবা আমাদের সব প্রশ্নের জবাবও দেবে না। কতগুলো সমস্যা তো এখানে আছেই। আওয়ামী লীগ বলে আসছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। সিইসির আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়ে গেছে। তা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারছেন বলে মনে হয় না। সিইসি সব দলের আস্থা অর্জন করার কথা বলেছেন বটে, কিন্তু তিনি তা কতটুকু পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকারি দলের নেতারা বিএনপিবিরোধী বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। এই বিএনপিবিরোধী বক্তব্য আস্থার সার্থক গড়তে কোনো অবদান রাখবে না। পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, তা হচ্ছে বিএনপি যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে বিএনপি ভেঙ্গে যাবে। যদি সত্যি সত্যিই এরকম কিছু হয়। তাহলে এর দায় কী কিছুটা হলেও সিইসির ওপর বর্তাবে না? সত্তর বছর বয়সেও সিইসিকে শক্ত সামর্থ্য বলেই মনে হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে প্রশ্ন তো একটা থাকলই_ সিইসি হিসেবে তার এই নিযুক্তি তাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে কিনা? একটি কঠিন জায়গায় তিনি এসেছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার অতীত সংশ্লিষ্টতা কতটুকু ছিল। তা তিনি জানেন। তখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে ব্যর্থ হলে, তার সম্মান আনো বাড়বে না, বরং আরও কমবে।

নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে আমরা খাদের কিনারে নিয়ে গেছি। অনেকটা 'ধাক্কা' দিলেই গভীর খাদে পরে যাবে। আমরা সে রকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিও (ষষ্ঠ সংসদ) কিন্তু সেরকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই 'পরিস্থিতি' থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১), কিংবা নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং সব দলের অংশ গ্রহণ সেখানে নিশ্চিত হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে এটা কলা হয় যে, বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে (৫ জানুয়ারি) অংশ না নেয়ায় নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই ছিল না। সাবেক সিইসি তার শেষ সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাই বলেছেন। এ নিয়ে গত ৫ বছরে অনেক কথাই হয়েছে। অনেক বিতর্ক হয়েছে। জাতিও অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সংবিধানের ১২৩ (৪) ধারায় যে কথাটা উল্লেখ আছে_ সে কথাটাও সত্য। এই ধারায় উল্লেখ আছে 'দৈব দুর্বিপাকের কারণে এই দফায় নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান (যদি) সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।' তবে এখানে 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার' এর মতে কথাটা কলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশন যদি মনে করেন 'দৈব দুর্বিপাকের' কারণে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব না! সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীবউদ্দিন আহম্মেদ এটা মনে করেনি। তাই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে, যা জাতিকে আরও 'বিভক্ত' করেছে এবং যা থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারছি না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন নির্বাচন বয়কট কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি দৈব দুর্বিপাকের আওতায় পড়ে কিনা? তবুও সিইসি উচ্চ আদালতের একটি ব্যাখ্যা চাইতে পারতেন। তিনি তা চাননি। তখন আমরা এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, সিইসি এ বিষয়ে যত কম কথা বলবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমরা চাই সামনের দিতে তাকাতে।
আমরা চাই সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে_ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তাই সংগত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায় দায়িত্বটি অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতির যাতে সৃষ্টি না হয়, এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। আমরা সেই 'দায়িত্ব' সিইসি কিভাবে পালন করেন তার অপেক্ষায় থাকলাম। তবে একটা বিষয়ে বোধ হয় আমাদের সবার ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন_ আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের বহু মন্ত্রী বারবার বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের তিন মাস আগে যে সরকার থাকবে তার নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকারপ্রধান থাকলে সেই সরকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিএনপি সেই প্রশ্নটিই তুলেছে। এটা ঠিক ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ওই সরকারে যোগ দেয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কী বিএনপিকে সেরকম একটি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ২০১৪ সালে বিএনপি পার্লামেন্টে ছিল। কিন্তু এখন তো তারা পার্লামেন্টে নেই। তাহলে মন্ত্রিসভায় বিএনপি অন্তর্ভুক্ত হবে কিভাবে? নাকি বিএনপিকে বাদ দিয়েই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে? বিএনপিকে যে আমন্ত্রণ জানানো হবে না, এ কথাটা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন যেহেতু অতীতে বিএনপি এ ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল সুতরাং এখন আর সে সুযোগ নেই। যদিও আমি তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চাই না। তিনি মন্ত্রী বটে। কিন্তু সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কেউ নন। সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে অন্য কারো কিছু বলার সুযোগ নেই।
আমার বিবেচনায় বিএনপি নির্বাচনে যাবে। না হলে তারা নিবন্ধন হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। উপরন্তু মূলধারার বিএনপিকে বাদ দিয়ে আরেকটি বিএনপি যদি গঠিত হয় এবং তারা যদি নির্বাচনে যায় তাহলে আমাদের অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নতুন দলের নিবন্ধন পাওয়া ও তাদের সংসদে যাবার পথ তৈরি করে দেয়া কঠিন কিছু নয়। নাজমুল হুদা ইতিমধ্যে তৃণমূল বিএনপি গঠন করেছেন। বর্তমান সংসদে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের নামেও একটি দল আছে। ফলে ২০১৯ সালে বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে দল ভেঙে যাবে এবং ওইসব দলের ব্যানারে বিএনপির নেতাকর্মীরা অংশ নেবে। সুতরাং আমার ধারণা বিএনপি সিইসিকে যতই বিতর্কিত করুক না কেন, চূড়ান্ত বিচারে আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা নির্বাচনে যাবে।
এক্ষেত্রে বেগম জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হলেও বিএনপিতে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হবে। একটি যৌথ নেতৃত্ব বিএনপিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বেগম জিয়ার অবর্তমানে। এক কঠিন সময়ে সিইসি দায়িত্ব নিয়েছেন। তার নিরপেক্ষতা, তার প্রতি সব দলের আস্থা, বিশেষ করে বিএনপির আস্থা যদি নিশ্চিত হয়, তাহলেই সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন সম্ভব। এর ব্যত্যয় ঘটলে হুদা কমিশনেরও পরিণতি হবে রকিব কমিশনের মতো। সিইসি এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন আমি বলতে পারব না। কিন্তু তার 'বডি ল্যাংগুয়েজ' আমাকে এতটুকুও আশ্বস্ত করতে পারেনি। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো সংলাপ' করবেন এমন কোনো কথা তিনি বলেননি। তিনি বাধ্য নন, এটাও সত্য। কিন্তু বাস্তবতা বলে একটা সুযোগ আছে। বাস্তবতা হচ্ছে তার সঙ্গে 'জনতার মঞ্চ'-এর সংশ্লিষ্টতা ছিল কী ছিল না, এই বিতর্ক তাকে তার কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করতে হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে অনেক সময়। শুরুটা তার ভালো হওয়া দরকার। এ জন্য তিনি যা করতে পারেন তা হচ্ছে (১) একদিন সুশীল সমাজের সঙ্গে একটি 'গোল টেবিল' করে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তাদের মতামত আহ্বান করতে পারেন, (২) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও একদিন বসতে পারেন। তাদের কম কথা বলতে হবে। নিত্যদিন টিভি পর্দায় চেহারা দেখানোর প্রয়োজন নেই। ইসির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন কমিশনের সচিব, কোনো কমিশনার নয়। তাদের একমাত্র প্রায়োরিটি রয়েছে আস্থাটা অর্জন করা, যা হারিয়ে গেছে। তাই বাঘাইছড়ির নির্বাচনের 'সাফল্য' নিয়ে (বিএনপি অংশ নিয়েছে এই অর্থে) ইসি যত কম কথা বলবে ততই মঙ্গল।
Daily Jai Jai Din25.02.2017

সিদ্ধান্ত একটি, প্রশ্ন অনেক

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সিদ্ধান্তের কথা সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে গত ১৭ ফেব্রুয়ারি। তাতে বলা হয়েছে রাজধানী ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে। এ কলেজগুলো হচ্ছে- ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। গত বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সঙ্গে ওই কলেজগুলোর অধ্যক্ষের একটি যৌথ সভাও হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এ অধিভুক্তিটি কতটুকু যৌক্তিক? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির একটি বক্তব্যও ছাপা হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন, উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এতে করে কি আদৌ শিক্ষার মান বৃদ্ধি হবে?

এ সিদ্ধান্তটি ভালো নয়। এবং তা শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। যতদূর জানি, বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য অধ্যাপক মহব্বত খানের নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছিল। আর ওই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই এ সিদ্ধান্তটি নিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অধ্যাপক খান অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি। ভালো শিক্ষক। আমরা যখন তার ছাত্র ছিলাম, শিক্ষার মান নিয়ে তিনি কখনও ‘কম্প্রোমাইজ’ করেননি। কিন্তু যে সিদ্ধান্তটি তিনি দিলেন, তার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একজন সাবেক সদস্য হিসেবে আমার ধারণা এ সিদ্ধান্ত নানা জটিলতা তৈরি করবে। প্রথমত, ওই ৭টি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আগামীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় দেবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ব্যবহার করবে। এটা কি মূল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মাঝে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি করবে না? কেননা ওইসব কলেজে যারা অনার্স বা মাস্টার্স পর্যায়ে পড়াশোনা করবে, তাদের অনেকেই এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করবে। কিন্তু তারা ভর্তি হতে না পেরে কলেজে ভর্তি হবে। এখন কিনা তারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ব্যবহার করবে। এতে করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে দু’ধরনের ছাত্র তৈরি হবে এবং ছাত্রদের মেধার ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে। এতে উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধি হবে না। দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর কলেজগুলোতে পড়াবেন কারা? নিশ্চয়ই ওই কলেজের শিক্ষকরা? পরীক্ষা হবে কোন প্রশ্নপত্রে? নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা প্রশ্নপত্রে। এবং পরীক্ষার উত্তরপত্রের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও একটা সমস্যা তৈরি হবে। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রদের যেভাবে পড়ান, সেভাবেই তারা প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। প্রশ্নপত্র ‘মডারেশন’ হয়। তাতে নিশ্চয়ই ওই কলেজগুলোর শিক্ষকদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে না। তাতে করে কি কলেজগুলোর ছাত্ররা এক ধরনের ‘মেধা সংকট’-এর মুখোমুখি হবে না? তারা কি ওই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়বে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র যথেষ্ট মানসম্মত। কলেজগুলোর ছাত্ররা এ মানসম্মত প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে পারে। এতে করে তাদের উত্তরপত্রগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়িত হবে না। তৃতীয়ত, ওইসব কলেজে কর্মরত শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর কি নিজেদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসবে দাবি করবেন? যদি করেন, কোন যুক্তিতে তাদের তা প্রত্যাখ্যান করা হবে? শিক্ষকরা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন। তারা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বিষয়ের ছাত্রছাত্রীদের উত্তরপত্রও মূল্যায়ন করবেন? যদি তারা নিজেদের ছাত্রদের উত্তরপত্র নিজেরা মূল্যায়ন করেন, তাহলে এক ধরনের ‘বৈষম্য’ তৈরি হবে। নিজেদের ছাত্রদের ‘বেশি নম্বর পাইয়ে দেয়ার’ অভিযোগ উঠবে। এতে করে তৈরি হবে অবিশ্বাস। চতুর্থত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির এ ব্যাপারে একটি বক্তব্য থাকা উচিত ছিল। কিন্তু আমার চোখে এ ধরনের কোনো মন্তব্য আমি দেখিনি। একটি সরকারি সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। শিক্ষকদের সাধারণ সভায় বিষয়টি আলোচনা করা উচিত। পঞ্চমত, কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলে সেখানে কর্মরত শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫-তে উন্নীত করতে হবে। এখন তারা ৫৯ বছর বয়সে অবসরে যান। এখন এ ৭টি কলেজের শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫-তে উন্নীত করলে তা অন্য কলেজগুলোর শিক্ষকদের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে? ষষ্ঠত, খুব সঙ্গতকারণেই কলেজগুলোতে বিজ্ঞানবিষয়ক বিষয়গুলোতে ‘ল্যাব ফেসিলিটি’ কম থাকে। একটি ল্যাব বা বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয় সব সময় বরাদ্দ দিতে পারে না। এখন অধিভুক্তির পর কলেজগুলোর ছাত্ররা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ‘ল্যাব’ সুবিধা চায়, তাদের কি সে সুবিধা দেয়া সম্ভব হবে? যদি দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা কি তা থেকে বঞ্চিত হবে না? উপরন্তু কলেজগুলোর ছাত্রদের এত বেশি সুযোগ-সুবিধা কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারবে? সপ্তমত, কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলে, ওইসব কলেজের অধ্যক্ষদের ভূমিকা কী হবে? তারা কি একাডেমিক কাউন্সিল তথা সিন্ডিকেটের সদস্য হবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা কি মানবেন? যদি অধ্যক্ষদের কোনো ‘ভূমিকা’ না থাকে, তাহলে একদিকে তাদের মাঝে অসন্তোষ তৈরি হবে, অন্যদিকে প্রশ্ন উঠবে অধ্যক্ষদের রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে। অষ্টমত, এ সাতটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তের পর, বাকি সরকারি কলেজগুলোতেও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। যতদূর জানি প্রায় প্রতিটি সরকারি কলেজকে ধীরে ধীরে এক একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত করা হবে। এটি কখনও ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এতে করে নানা জটিলতা তৈরি হবে, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয় সামাল দিতে পারবে না।

প্রশ্নটা হচ্ছে শিক্ষার মানোন্নয়ন। যতদূর জানি প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহেই এ ধরনের সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন, এটা আমাদের জন্য ভালো খবর। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক তথ্যটি দেয়া হয়নি বলেই আমার ধারণা। দুঃখ লাগে যখন দেখি শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, তার কোনো ‘ভূমিকা’ নেই। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, আমার অতি প্রিয়জন, তিনি ব্যস্ত আছেন পত্রিকায় কলাম লিখে, তাও আবার অধিকাংশ সময় বিএনপিকে গালাগাল করে। আমি খুশি হতাম যদি তার একটি লেখাও থাকত শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে। তিনি তো কিছু উপদেশ বা ‘সাজেশন’ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের’ জন্য তিনি ইতোমধ্যে অনেক দেশ সফর করেছেন। কিন্তু সেই ‘অভিজ্ঞতা’ আমরা কোন কাজে ব্যবহার করতে পারি, তা তিনি আমাদের জানাননি।

প্রধানমন্ত্রী উচ্চশিক্ষা নিয়ে চিন্তা করেন বিধায় এ সিদ্ধান্তটি হয়েছে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিকগুলো সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করানো হয়নি। শিক্ষার মান্নোয়ন দরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিবেচনার জন্য তাই কতগুলো প্রস্তাব রাখছি। শিক্ষামন্ত্রী বিষয়গুলো নিয়ে ‘উচ্চ মহলের’ সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারেন। এক. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সীমিত পরিসরে দুই ‘শিফট’ চালু করা হোক। দ্বিতীয় শিফট বা বৈকালিক ‘শিফট’-এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরে যাওয়া এবং কর্মক্ষম শিক্ষকদের ‘চুক্তিভিত্তিক’ নিয়োগ দেয়া হোক। প্রয়োজনে কলেজ থেকে অবসরে যাওয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী শিক্ষকদের এ ক্ষেত্রে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। দুই. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো ভেঙে দেয়া হোক। ২২৫৪টি সরকারি কলেজ নিয়ন্ত্রণ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এটি মূলত একটি সার্টিফিকেট বিতরণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলেজগুলোতে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করা হয়েছে। সেখানে শিক্ষক নেই। নিয়মিত ক্লাস হয় না। ছাত্ররা ঢাকার ‘বাকুসা মার্কেটে’ এসে গাইড বই কিনে নিয়ে যায়। আর ওই গাইড বই পড়েই তারা অনার্স পাস করছে। কলেজগুলোতে আদৌ কোনো ক্লাস হয় না। শিক্ষকরা সেখানে বাসায় ব্যাচের পর ব্যাচ প্রাইভেট পড়ান (আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা)। এটা দেখার কেউ নেই। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবার ‘শিক্ষক’ আছেন। এরা কোনো ক্লাস নেন না। তাদের কাজ হচ্ছে উত্তরপত্র দেখা ও বিভিন্ন কলেজে মৌখিক পরীক্ষার জন্য যাওয়া। এই যে পরিস্থিতি, তা ‘শিক্ষার মানোন্নয়নের’ কথা বলে না। তিন. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে ৭টি বিভাগীয় শহরে ৭টি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। জাতীয় নেতাদের নামে এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামকরণ করা যেতে পারে। চার. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গাজীপুর ক্যাম্পাসে একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক। যেহেতু অবকাঠামো আছে, সেহেতু ওই অবকাঠামো ব্যবহার করে একটি নয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

আমরা ক্রমেই একটি সার্টিফিকেটসর্বস্ব জাতিতে পরিণত হয়েছি। একশ’র ওপরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমরা শিক্ষার মানোন্নয়ন করিনি, বরং শিক্ষিত বেকার তৈরি করেছি। এমবিএ ডিগ্রিধারী কেরানি তৈরি করেছি। সার্টিফিকেটধারী বেকারদের দিয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন হয় না। মঞ্জুরি কমিশনকে ভেঙে উচ্চতর শিক্ষা কমিশন গঠন করতে যাচ্ছে সরকার। এ সিদ্ধান্তটি ভালো। কিন্তু দলীয় বিবেচনায় ও অযোগ্যদের এখানে নিয়োগ দিলে সরকারের উদ্দেশ্য সফল হবে না। শিক্ষার মানোন্নয়ন চাই। এর জন্য দরকার যোগ্য নেতৃত্ব। একমাত্র যোগ্য নেতৃত্বই পারে শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি ভূমিকা রাখতে। পত্রিকায় কলাম লিখে, রাজনৈতিক বক্তব্য রেখে আর যাই হোক শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে না। যে ৭টি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে, এটা হয়তো পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু ঢাকায় অবস্থিত কলেজগুলোকে নিয়ে আলাদা একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব। অবকাঠামোও আছে। প্রয়োজন সিদ্ধান্তের। আমার ধারণা এ ধরনের কোনো প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া হয়নি। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী সজ্জন ব্যক্তি বটে, কিন্তু উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে তার অবদান কতটা? সাংবাদিক ও সম্পাদক গোলাম মর্তুজা এক টিভি অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে খারাপ শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছেন আমাদের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী! তার সঙ্গে দ্বিমতের সুযোগ হয়তো আছে। কিন্তু একজন শিক্ষামন্ত্রীর কাছ থেকে মানুষ আরও বেশি কিছু আশা করে। ইউজিসির কাছ থেকে মানুষ আরও বেশি কিছু আশা করে। আমাদের দুর্ভাগ্য এখানেই, সবকিছুর জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ‘সিদ্ধান্ত’টি নিয়ে আরও আলোচনা হোক- এটাই চাই।
Daily Jugantor
20.02.2017
 
 

নয়া সিইসির আশাবাদ ও ইসির নানা চ্যালেঞ্জ


নয়া সিইসি কে এম নূরুল হুদা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তিনি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি এবং আরও চারজন কমিশনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করার প্রথম দিনই তিনি বিকালে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। একটি লিখিত বক্তব্যও দেন। এরপর দুই-একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরও দেন। প্রথম দিন তার পক্ষে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব ছিল না। তিনি দেনওনি। তবে তিনি এটা জানাতে ভোলেননি, তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন। তিনি কারও দ্বারা প্রভাবিত হবেন না, এটাও জানিয়েছেন। তবে যে বিষয়টি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ মুহূর্তে কোনো সংলাপে যাবেন কিনা, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তারা জানতে চেয়েছিলেন, বিএনপির সঙ্গে তিনি কোনো সংলাপের উদ্যোগ নেবেন কিনা? সিইসির জবাবটা ছিল এ রকমÑ ‘বিএনপি বলে কোনো কথা নয়। সবাইকে আস্থায় আনাই তার কাজ।’ এর অর্থ পরিষ্কার, তিনি বিএনপিকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না। অথচ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিএনপির আস্থা অর্জন করা।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কিছু ‘অবজারভেশন’ আছে। সিইসি সম্পর্কে তাদের আপত্তি আছে। এখন সবার চোখ যে বিএনপি-সিইসি সমঝোতার দিকে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার বিবেচনায় সিইসির প্রথম বক্তব্যে তিনি বিষয়টি খোলাসা করেননি। স্পষ্টতই তিনি বিএনপিকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। সিইসি আরও বলেছেন, শপথ নেয়ার পর থেকে কোনো দলের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এর অর্থ কী আমরা ধরে নেব, শপথ নেয়ার আগে তার সঙ্গে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পর্ক ছিল! এটি ‘হাইপোথেটিক্যাল’Ñ কোনো দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকতেও পারে, আবার নাও পারে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। স্থানীয় পর্যায়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা কোনো বিচিত্র কিছু নয়। তবে যেহেতু নির্বাচন পরিচালনায় ‘নিরপেক্ষতা’র একটি প্রশ্ন আছে, সেহেতু তাকেই এখন বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমার আশঙ্কা অন্য একটি কারণে। নয়া নির্বাচন কমিশন নিয়ে মানুষের আগ্রহ যখন বাড়ছে, তখন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার শাস্তি হলে কোনো নির্বাচন হবে না। তার এ বক্তব্য এভাবেই পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মির্জা ফখরুল কি কোনো আগাম মেসেজ দিলেন? বাজারে গুজব তো আছেই। খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য জেলে আসার(?) বিষয়টি বহুল আলোচিত। তার অবর্তমানে কারা বিএনপির হাল ধরবেন, তাদের নামধামও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সুতরাং শঙ্কা তো একটা থাকলই। তাহলে কি বিএনপি বর্তমান সিইসির আওতায় কোনো নির্বাচনে যাবে না?
বিষয়টি অত সহজ নয়, যতটা আমরা ভাবছি। এর সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত। সংগতকারণেই তাই প্রশ্ন একটাইÑ নয়া সিইসির সবার আস্থা অর্জন করা ও তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। এজন্য দায়িত্ব নেয়ার পরপরই তিনি সব দলের সঙ্গে একটা সংলাপ আহ্বান করতে পারেন। এ মুহূর্তে তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, নির্বাচনে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ যাতে নিশ্চিত হয়, তার ব্যবস্থা করা। এজন্য সংলাপে তিনি সব দলের কাছে মতামত চাইতে পারেন। বিশেষ করে বিএনপির মতামতটা কমিশনের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ (৫ জানুয়ারি, ২০১৪) নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এর ফলে মূল ধারার রাজনীতি থেকে বিএনপি ছিটকে পড়েছে। বিএনপিকে মূল ধারার রাজনীতিতে অর্থাৎ সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা কিছুটা হলেও দায়িত্ব পালন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতির সাম্প্রতিককালে দুইটি মডেল আমরা দেখেছি। একটি ‘ফেনী মডেল’, যেখানে বিরোধী পক্ষকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি; কিংবা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে নিজেদের জয় নিশ্চিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় মডেলটি হচ্ছে ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল,’ যেখানে মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনে ‘সব দল’ অংশগ্রহণ করেছে এবং নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়েছে। কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- আমরা দেখেনি। বর্তমান কমিশনকে তাই দেখতে হবে আগামী নির্বাচনে তারা কীভাবে একটি ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’ উপহার দিতে পারেন এবং এ নিশ্চয়তাটুকু জাতিকে তাদের দিতে হবে। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই নির্বাচন কমিশনকে দুইটি শূন্য আসনের উপনির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এ উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না, এটা বোঝাই যায়। তবে সমস্যা রয়েছে আরও। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব এখানে প্রায় প্রতিটি সংসদীয় আসনে রয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদি এ ব্যাপারে ‘শক্ত’ না হয়, তাহলে তাদের প্রতি অনাস্থা আরও বাড়বে।
আমরা চাই, নয়া নির্বাচন কমিশনের শুরুটা ভালো হোক। শুরুতেই যদি সিইসি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারেন, তাহলে তাদের প্রতি আস্থাটা বাড়বে বৈ কমবে না। আমরা জানি, সংবিধানের ১২১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদের নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার একটি করিয়া ভোটার তালিকা থাকিবে এবং ধর্ম, জাত, বর্ণ ও নারী-পুরুষভেদের ভিত্তিতে ভোটারদের বিন্যস্ত করিয়া কোনো বিশেষ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা যাইবে না।’ এ ভোটার তালিকা নিয়ে অতীতে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। ভুয়া ভোটার তালিকার কথাও আমরা শুনেছি। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে যাতে কোনো ভোটার তালিকা তৈরি না হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। আবার সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ বর্তমান কমিশনকে তাদের কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে তারা সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন। তারা এমন কোনো কাজ করবেন না, যাতে করে প্রশ্নের জন্ম হতে পারে এবং বিরোধী পক্ষ তাদের ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।
এরই মধ্যে সোস্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সিইসি নূরুল হুদা পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের ফুলের তোড়া গ্রহণ করছেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন। ছবিতে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়াউল হক আছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সিইসি কি এ ধরনের ফুলের মালা নিতে পারেন? এটা তো কোনো ‘রাজনৈতিক পদ’ নয়! এ ধরনের ‘ফুলের মালা’ যদি ১৫ ফেব্রুয়ারির পর তিনি নিতে থাকেন, তাতে বিতর্ক আরও বাড়বে বৈকি! এদিকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘গত ১০ বছরে একটা সার্চ কমিটিও এমন কোনো নাম দিতে পারেনি, যেখান থেকে কমিশনে এমন কোনো সফল ব্যক্তিত্ব এসেছেন। যাদের আসা সম্ভব ছিল, তাদের নাম সার্চ কমিটি দিতে পারেনি। তাই সার্চ কমিটি এখনও সফল হয়নি। আকবর আলি পুরনো আমলা। মোটামুটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তিনি কথাবার্তা বলেন। তার এ বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি সার্চ কমিটির নিয়োগে খুশি হতে পারেননি।
নবনিযুক্ত সিইসিও সাবেক আমলা। সচিব হিসেবে তিনি ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন বটে; কিন্তু সচিব হিসেবে তিনি সচিবালয়ে ‘কাজ’ করেননি। তিনি আকবর আলিকে ভালো করে চেনেন। তিনি এখন ভালো করবেন যদি এ ধরনের কিছু নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে মাঝেমধ্যে ডেকে ‘চায়ের দাওয়াত’ দিয়ে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। তিনি এটা করতে বাধ্য নন। কিন্তু তার এ ধরনের ‘অ্যাপ্রোচ’ তার অবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে। তিনি নিরপেক্ষ একটি ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারবেন। আরও একটা কথা।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা টিভির পর্দায় নিজেদের দেখাতে উৎসাহিত হন বেশি। কারণে-অকারণে তারা টিভির পর্দায় আসছেন। সাংবাদিকদের তার রুমে ডেকে নিয়ে কথা বলছেন। এর কোনো প্রয়োজন নেই। ইসি একটি সাংবিধানিক পদ। সাংবিধানিক পদের অধিকারীরা এভাবে টিভির পর্দায় আসেন না। আসা উচিতও নয়। ইসির বক্তব্য থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে বক্তব্য দেবেন ইসির সচিব অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা। তাকে প্রতিদিন টিভিতে বলারও কিছু নেই। এ মুহূর্তে ইসির বড় দায়িত্ব হচ্ছে, (১৮ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি পৌরসভা নির্বাচনের পর) ৬ মার্চ ১৮ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। এরপর দ্রুতই তাদের গাইবান্ধা-১ এবং সুনামগঞ্জ-২ সংসদীয় আসনের নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে এবং সম্ভবত সংসদীয় আসনের নির্বাচনে অংশ নেবে না। এসব নির্বাচন ইসি যদি সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে এটা প্লাস পয়েন্ট, ইসির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা তাতে বাড়বে। একজন নির্বাচন কমিশনার এর আগে ইসিতে কাজ করেছেন। তবে কমিশনার হিসেবে নন। ভোটার তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ইসি তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারেন।
অন্যান্য কমিশনারের ব্যাপারে যত না বিতর্ক, তার চেয়ে বেশি বিতর্ক সিইসিকে নিয়ে। সুতরাং তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ বটে। এ পরীক্ষায় তিনি কীভাবে এবং কতটুকু উত্তীর্ণ হন, তা আমরা বিচার করব আগামী দিনগুলোতে। সিইসি জানিয়েছেন, তিনি সংবিধান অনুযায়ী কাজ করবেন এবং ইসিতে সরকারের প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ নেই। কথাটা শুরুতে ভালোই শোনায়। কিন্তু দেখার পালা, এর বাস্তব প্রতিফলন কতটুকু হয়। তিনি প্রথম দিনই যেসব কথা বলেছেন, তা ভালো এবং প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু মনে আছে, সাবেক সিইসি কাজী রকিবউদ্দীনও দায়িত্ব নেয়ার সময় এ ধরনের কথাই বলেছিলেন। কিন্তু তিনি যত বেশি বিতর্কিত হয়েছেন, অন্য কোনো সিইসি এভাবে বিতর্কিত হননি। আরেকজন কমিশনার কবিতা বেগম বলেছেন, তিনি বিচারিক জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবেন। নির্বাচন কমিশনে ‘বিচারিক জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর’ কিছু নেই! সংবিধান ইসিকে স্বাধীনতা দিয়েছে। এর সুষ্ঠু ব্যবহার, নিরপেক্ষ থাকা, শক্ত অবস্থানে থাকা, চাপের কাছে মাথা নত না করা, সরকারি ‘চাপ’ উপেক্ষা করা এবং সর্বোপরি সবার আস্থা অর্জন করার মধ্যেই রয়েছে সাফল্য। তারা কতটুকু সফল হলেন, তা বিচার হবে তাদের কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে। আগামী ৫ বছর একটি কঠিন সময় তাদের পার করতে হবে। কাজটি খুব সহজ নয়।
Daily Alokito Bangladesh
19.02.2017

অশনিসংকেত


তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয়েছে গত ১৬ ফেব্রুয়ারির দৈনিকগুলোয়। প্রতিটি সংবাদ নির্বাচন কমিশন এবং আগামী ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। প্রথম সংবাদটি নয়া ইসি গঠন ও সিইসির বক্তব্যকে নিয়ে। ১৫ ফেব্রুয়ারি নয়া ইসির কমিশনাররা তাদের দায়িত্বগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ একজন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার পেয়েছে। তিনি কে এম নুরুল হুদা। ওইদিনই বিকালে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘সব দলের আস্থা অর্জনই তার প্রথম কাজ।’ দ্বিতীয় সংবাদটি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি আলোচনা সভায় তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে নির্বাচন দেওয়া হলে দেশের মানুষ তা মেনে নেবে না এবং দেশপ্রেমিক কোনো দল এ নির্বাচনে অংশ নেবে না।’ তিনি ওই অনুষ্ঠানে সিইসিকে দলীয় ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং বলেছেন, বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে কিনা, তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে ওই সময় কোনো ধরনের সরকার থাকে তার ওপর। তৃতীয় সংবাদটিও ১৬ ফেব্রুয়ারি ছাপা হয়েছে। এটিও একটি বক্তব্য। আর বক্তব্যটি দিয়েছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন। নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘এই সরকার চাচ্ছে ভূতের মতো একজন ব্যক্তিকে (সিইসি) রেখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করেই আবার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার।’ এভাবেই তার বক্তব্যটি ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। এই তিনটি সংবাদ যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে কতগুলো মন্তব্য করা যায়। এক. নতুন সিইসি দায়িত্ব নিলেও তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না বিএনপি। দুই. সিইসি আস্থা অর্জনের কথা বললেও, এই আস্থা অর্জনের বিষয়টি এখন প্রশ্নের মুখে থাকল। তিনি কীভাবে বিএনপির আস্থা অর্জন করবেন, এটা এখন বড় বিষয়। তিন. খালেদা জিয়ার সাজা হতে পারে, এমন আশঙ্কা করছে বিএনপি। প্রশ্ন হচ্ছে, খালেদা জিয়া যদি সত্যি সত্যিই দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হন এবং জেলে যান, তাহলে আইনগতভাবে তার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে কিনা? চার. বিএনপি চাচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখা। দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ইসির আদৌ কোনো ভূমিকা আছে কী না? পাঁচ. আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো একটি নির্বাচন করতে চায়Ñ এ ধরনের একটি ‘অভিযোগ’ উত্থাপিত হয়েছে। এর সত্যতা কতটুকু আছে, তা হয়তো আগামী দিনগুলোয় আমরা বলতে পারব। কিন্তু ইসি পুনর্গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন এ ধরনের অভিযোগ ‘উত্থাপিত’ হয়, তখন একটা শঙ্কা তৈরি হয় বৈকি!
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে, আমরা যে কোনো সিদ্ধান্ত যদি আমাদের মনঃপূত না হয় তাহলে দ্রুত তাকে বিতর্কিত করে ফেলি। দোষারোপের রাজনীতির বৃত্ত থেকে আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারিনি। অথচ ৪৫ বছর আমরা পার করে এসেছি। প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে আমরা রাজনীতির ‘গন্ধ’ খুঁজে বেড়াই। গণতন্ত্রের স্বার্থে, নির্বাচনী সংস্কৃতির স্বার্থে একটি ‘কনফিডেন্স ফিল্ডিং মেজারস’-এর বড় অভাব এ দেশে। অর্থাৎ আস্থার সম্পর্কের বড় অভাব আমরা লক্ষ করি। সিইসির নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটা লক্ষ করেছিলাম। একদিকে বিএনপি যেভাবে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই সিইসিকে বিতর্কিত করেছিল, আবার সরকারি দলের লোকরা ও মন্ত্রীরা যেভাবে সিইসির পক্ষে বক্তব্য দিয়ে চলেছিলেন, তা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। সিইসি একটি সাংবিধানিক পদ। সিইসির ‘অতীত’ যাই থাকুক না কেন, তিনি একটি ‘প্রক্রিয়ার’ মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি শপথ নিয়েছেন। তাই তাকে নিয়ে আমরা যত কম কথা বলব, ততই মঙ্গল। তাকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যেই তাকে গাইবান্ধায় মনজুরুল ইসলাম ও সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুটি আসনে উপনির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। এখানে সরকারি দলের ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। আবার বিএনপির বাইরে অন্য ‘বিরোধী দলের’ অংশগ্রহণের একটা সম্ভাবনাও আছে। এই দুটি উপনির্বাচনে ‘ফেনী মডেল’ কিংবা ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’ আমরা টেস্ট করতে পারি। অর্থাৎ একদিকে সরকারি দলের পক্ষ থেকে ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত রাখার জন্য অন্য কোনো ‘যোগ্য’ প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া কিংবা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়াÑ এই যে সংস্কৃতি, তার প্রতিফলন ঘটে কিনা, তা দেখার বিষয়। আবার নারায়াণগঞ্জ মডেলের মতো একটি নির্বাচন ইসি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে যদি সরকার ও বিরোধী পক্ষ সবাই নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করে। এই দুই আসনে বিএনপি তথা জামায়াত সমর্থকদের ‘ভোট’ আছে। তারা কী করবেন? তারা কী ভোট দিতে যাবেন? নাকি আদৌ ভোট দেওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবেন না? এই বিষয়টি ‘মনিটর’ করা দরকার। কেননা এতে করেই বোঝা যাবে নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক সাফল্য।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে আমরা ‘খাদের কিনারে’ নিয়ে গেছি। অনেকটা ‘ধাক্কা’ দিলেই গভীর খাদে পড়ে যাবে! আমরা সে রকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেও (৬ষ্ঠ সংসদ) কিন্তু সে রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই ‘পরিস্থিতি’ থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) কিংবা নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ সেখানে নিশ্চিত হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে এটা বলা হয়, বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে (৫ জানুয়ারি) অংশ না নেয়ায় নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই ছিল না। সাবেক সিইসি তার শেষ সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাই বলেছেন। এ নিয়ে গত ৫ বছরে অনেক কথাই হয়েছে। অনেক বিতর্ক হয়েছে। জাতিও অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সংবিধানের ১২৩(৪) ধারায় যে কথাটা উল্লেখ আছে, সে কথাটাও সত্য। এই ধারায় উল্লেখ আছে, ‘দৈব-দুর্বিপাকের কারণে এই দফায় নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান (যদি) সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ তবে এখানে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’-এর মতো কথাটা বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি মনে করেন ‘দৈব-দুর্বিপাকের’ কারণে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়! সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এটা মনে করেননি। তাই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে, যা জাতিকে আরও ‘বিভক্ত’ করেছে এবং যা থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারছি না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ‘নির্বাচন বয়কট’ কিংবা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি দৈব-দুর্বিপাকের সংজ্ঞার আওতায় পড়ে কিনা? এর জন্য সিইসি উচ্চ আদালতের একটি ব্যাখ্যা চাইতে পারতেন। তিনি তা চাননি। এখন আমরা এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, সিইসি এ বিষয়ে যত কম কথা বলবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমরা চাই সামনের দিকে তাকাতে। আমরা চাই ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তাই সঙ্গত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনারের দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। আমরা সেই ‘দায়িত্ব’ সিইস কীভাবে পালন করেন, তার অপেক্ষায় থাকলাম। তবে একটা বিষয়ে বোধহয় আমাদের সবার ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজনÑ আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের বহু মন্ত্রী বারবার বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের তিন মাস আগে যে সরকার থাকবে, তার নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকারপ্রধান থাকলে, সেই সরকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিএনপি সেই প্রশ্নটিই তুলেছে। এটা ঠিক ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারের অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ওই সরকারে যোগ দেয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কী বিএনপিকে সে রকম একটি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ২০১৪ সালে বিএনপি পার্লামেন্টে ছিল। কিন্তু এখন তো তারা পার্লামেন্টে নেই। তাহলে মন্ত্রিসভায় বিএনপি অন্তর্ভুক্ত হবে কীভাবে? নাকি বিএনপিকে বাদ দিয়েই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে? বিএনপিকে যে আমন্ত্রণ জানানো হবে না, এ কথাটা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, যেহেতু অতীতে বিএনপি এ ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, তাই এখন আর সে সুযোগ নেই। যদিও আমি তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চাই না। তিনি মন্ত্রী বটে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ নন। সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে অন্য কারো কিছু বলার সুযোগ নেই।
আমার বিবেচনায় বিএনপি নির্বাচনে যাবে। না হলে তারা নিবন্ধন হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। উপরন্তু মূল ধারার বিএনপিকে বাদ দিয়ে আরেকটি বিএনপি যদি গঠিত হয় এবং তারা যদি নির্বাচনে যায়, তাহলে আমার অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নতুন দলের নিবন্ধন পাওয়া ও তাদের সংসদে যাওয়ার পথ ‘তৈরি’ করে দেওয়া কঠিন কিছু নয়। নাজমুল হুদা ইতোমধ্যে তৃণমূল বিএনপি গঠন করেছেন। বর্তমান সংসদে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের নামেও একটি দল আছে। ফলে ২০১৯ সালে বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে দল ভেঙে যাবে! এবং ওইসব দলের ব্যানারে বিএনপির নেতাকর্মীরা অংশ নেবে। তাই আমার ধারণা বিএনপি সিইসিকে যতই বিতর্কিত করুক না কেন, চূড়ান্ত বিচারে ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবেই তারা নির্বাচনে যাবে। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত (?) হলেও বিএনপিতে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হবে। একটি যৌথ নেতৃত্ব বিএনপিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে খালেদা জিয়ার অবর্তমানে। এক কঠিন সময়ে সিইসি দায়িত্ব নিয়েছেন। তার নিরপেক্ষতা, তার প্রতি সব দলের আস্থা, বিশেষ করে বিএনপির আস্থা যদি নিশ্চিত হয়, তাহলেই ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচন সম্ভব। এর ব্যত্যয় ঘটলে হুদা কমিশনেরও পরিণতি হবে রকিব কমিশনের মতো।
Daily Amader Somoy
18.02.2017

নতুন নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রত্যাশা


রাষ্ট্রপতি একটি নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। কমিশন গতকাল দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এ কমিশনই ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। ফলে খুব সংগত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি। প্রথমত, নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) সবার বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থা অর্জন করতে হবে। একটি বড় দল বিএনপি এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছে। তবে এ কমিশনকে তারা প্রত্যাখ্যান করেনি। সিইসি এখন তাঁর সম্পর্কে আনীত অভিযোগগুলো যদি গুরুত্বের সঙ্গে না নেন, তাহলে তিনি ভালো করবেন। তাঁর প্রধান কাজ এখন সবার আস্থা অর্জন করা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। এ জন্য তিনি সব দলের সঙ্গে একটা সংলাপ আহ্বান করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে নির্বাচনে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ যাতে নিশ্চিত হয় তার ব্যবস্থা করা। এ জন্য সংলাপে তিনি সব দলের কাছে মতামত চাইতে পারেন। বিশেষ করে বিএনপির মতামতটা কমিশনের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ (৫ জানুয়ারি ২০১৪) নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এর ফলে মূলধারার রাজনীতি থেকে বিএনপি ছিটকে পড়েছে। বিএনপিকে মূলধারার রাজনীতিতে অর্থাৎ সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে কিছুটা হলেও দায়িত্ব পালন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতিতে সাম্প্রতিককালে দুটি মডেল আমরা দেখেছি।
একটি ‘ফেনী মডেল’, যেখানে বিরোধীপক্ষকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি কিংবা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে নিজেদের জয় নিশ্চিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় মডেলটি হচ্ছে ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’, যেখানে মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনে ‘সব দল’ অংশগ্রহণ করেছে। এবং নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়েছে। কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমরা দেখিনি। বর্তমান কমিশনকে তাই দেখাতে হবে আগামী নির্বাচনে তারা কিভাবে একটি ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’ উপহার দিতে পারে এবং এই নিশ্চয়তাটুকু জাতিকে তাদের দিতে হবে। চতুর্থত, দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নির্বাচন কমিশনকে দুটি শূন্য আসনের উপনির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এই উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না, এটা বোঝাই যায়। তবে সমস্যা রয়েছে অন্যত্র। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব এখানে প্রায় প্রতিটি সংসদীয় আসনে রয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদি এ ব্যাপারে ‘শক্ত’ না হয়, তাহলে তাদের প্রতি অনাস্থা আরো বাড়বে। আমরা চাই নয়া নির্বাচন কমিশনের শুরুটা ভালো হোক। শুরুতেই যদি সিইসি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে একটি সুষুম নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারেন, তাহলে তাঁদের প্রতি আস্থাটা বাড়বে বৈ কমবে না। পঞ্চমত, সংবিধানের ১২১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদের নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার একটি করিয়া ভোটার তালিকা থাকিবে এবং ধর্ম, জাত, বর্ণ ও নারী-পুরুষভেদের ভিত্তিতে ভোটারদের বিন্যস্ত করিয়া কোন বিশেষ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা যাইবে না। ’ এ ভোটার তালিকা নিয়ে অতীতে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। ভুয়া ভোটার তালিকার কথাও আমরা শুনেছি। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে যাতে কোনো ভোটার তালিকা তৈরি না হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। ষষ্ঠত, সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন। ’ বর্তমান কমিশনকে তাদের কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে তারা সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন। তারা এমন কোনো কাজ করবে না যাতে  প্রশ্নের জন্ম হতে পারে এবং বিরোধীপক্ষ তাদের ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। সপ্তমত, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সিইসি নুরুল হুদা পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের ফুলের তোড়া গ্রহণ করছেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন। ছবিতে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়াউল হক আছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সিইসি কি এ ধরনের ফুলের মালা নিতে পারেন? এটা তো কোনো ‘রাজনৈতিক পদ’ নয়। এ ধরনের ‘ফুলের মালা’ যদি তিনি নিতে থাকেন, তাতে বিতর্ক আরো বাড়বে বৈকি! অষ্টমত, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘গত ১০ বছরে একটা সার্চ কমিটিও এমন কোনো নাম দিতে পারেনি, যেখান থেকে কমিশনে এমন কোনো সফল ব্যক্তিত্ব এসেছেন। যাঁদের আসা সম্ভব ছিল তাঁদের নাম সার্চ কমিটি দিতে পারেনি। তাই সার্চ কমিটি এখনো সফল হয়নি। ’ আকবর আলি পুরনো আমলা। মোটামুটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তিনি কথাবার্তা বলেন। তাঁর এই বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি সার্চ কমিটির নিয়োগে খুশি হতে পারেননি। নবনিযুক্ত সিইসিও সাবেক আমলা। সচিব হিসেবে তিনি ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন বটে; কিন্তু সচিব হিসেবে তিনি সচিবালয়ে ‘কাজ’ করেননি। তিনি আকবর আলিকে ভালো করে চেনেন। তিনি এখন ভালো করবেন যদি এ ধরনের কিছু নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে মাঝেমধ্যে ডেকে ‘চায়ের দাওয়াত’ দিয়ে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। তিনি এটা করতে বাধ্য নন। কিন্তু এ ধরনের ‘অ্যাপ্রোচ’ তাঁর অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে। তিনি নিরপেক্ষ একটি ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারবেন।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে আমরা যেকোনো সিদ্ধান্ত যদি আমাদের মনঃপূত না হয়, তাহলে দ্রুত তাকে বিতর্কিত করে ফেলি। দোষারোপের রাজনীতির বৃত্ত থেকে আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারিনি। অথচ ৪৫ বছর আমরা পার করে এসেছি। প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে আমরা রাজনীতির ‘গন্ধ’ খুঁজে বেড়াই। গণতন্ত্রের স্বার্থে, নির্বাচনী সংস্কৃতির স্বার্থে একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’-এর বড় অভাব এ দেশে। অর্থাৎ আস্থার সম্পর্কের বড় অভাব আমরা লক্ষ করি। সিইসির নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটা লক্ষ করলাম। একদিকে বিএনপি যেভাবে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই সিইসিকে বিতর্কিত করে চলেছে, আবার সরকারের দলের লোকেরা, মন্ত্রীরা যেভাবে সিইসির পক্ষে বক্তব্য দিয়ে চলছেন, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। সিইসি একটি সাংবিধানিক পদ। তাঁর ‘অতীত’ যা-ই থাকুক না কেন, তিনি একটি ‘প্রক্রিয়ার’ মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে আমরা যত কম কথা বলব ততই মঙ্গল। তাঁকে কাজে সুযোগ দেওয়া উচিত। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যেই তাঁকে গাইবান্ধায় মঞ্জুরুল ইসলাম এবং পরে সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আসনে উপনির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। এখানে সরকারি দলের ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। আবার বিএনপির বাইরে অন্য ‘বিরোধী দলের’ অংশগ্রহণের একটা সম্ভাবনাও আছে। এ দুটি উপনির্বাচনে ‘ফেনী মডেল’ কিংবা ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’ আমরা টেস্ট করতে পারি। অর্থাৎ একদিকে সরকারি দলের পক্ষ থেকে ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত রাখার জন্য অন্য কোনো ‘যোগ্য’ প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া কিংবা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া—এই যে সংস্কৃতি, তার প্রতিফলন ঘটে কি না, তা দেখার বিষয়। আবার ‘নারায়ণগঞ্জ মডেলের’ মতো নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে যদি সরকার ও বিরোধী পক্ষ সবাই নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করে। এ দুই আসনে বিএনপি তথা জামায়াত সমর্থকদের ‘ভোট’ আছে। তাঁরা কী করবেন? তাঁরা কি ভোট দিতে যাবেন, নাকি আদৌ ভোট দেওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবেন না? বিষয়টি ‘মনিটর’ করা দরকার। কেননা এতেই বোঝা যাবে নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক সাফল্য।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে আমরা ‘খাদের কিনারে’ নিয়ে গেছি। অনেকটা ‘ধাক্কা’ দিলেই গভীর খাদে পড়ে যাবে! আমরা সে রকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেও (ষষ্ঠ সংসদ) কিন্তু সে রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই ‘পরিস্থিতি’ থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) কিংবা নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ সেখানে নিশ্চিত হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে এটা বলা হয় যে বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে (৫ জানুয়ারি) অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই ছিল না। সাবেক সিইসি তাঁর শেষ সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাই বলেছেন। এ নিয়ে গত পাঁচ বছরে অনেক কথাই হয়েছে। অনেক বিতর্ক হয়েছে। জাতিও অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সংবিধানের ১২৩(৪) ধারায় যে কথাটি উল্লেখ আছে, সে কথাটিও সত্য। এ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘দৈবদুর্বিপাকের কারণে এ দফায় নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান (যদি) সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। ’ তবে এখানে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’-এর মতে কথাটি বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি মনে করেন ‘দৈবদুর্বিপাকের’ কারণে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব না! সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এটা মনে করেননি। তাই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে, যা জাতিকে আরো ‘বিভক্ত’ করেছে এবং যা থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারছি না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ‘নির্বাচন বয়কট’ কিংবা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি ‘দৈবদুর্বিপাকের’ সংজ্ঞার আওতায় পড়ে কি না? এর জন্য সিইসি উচ্চ আদালতের একটি ব্যাখ্যা চাইতে পারতেন। তিনি তা চাননি। এখন আমরা এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, সিইসি এ বিষয়ে যত কম কথা বলবেন ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমরা চাই সামনের দিকে তাকাতে।
আমরা চাই সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তাই সংগত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বটি অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। আমরা সেই ‘দায়িত্ব’ সিইসি কিভাবে পালন করেন তার অপেক্ষায় থাকলাম
Daily Kaler Kontho
16.02.2017