রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

নয়া সিইসির আশাবাদ ও ইসির নানা চ্যালেঞ্জ


নয়া সিইসি কে এম নূরুল হুদা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন, তিনি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি তিনি এবং আরও চারজন কমিশনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণ করার প্রথম দিনই তিনি বিকালে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। একটি লিখিত বক্তব্যও দেন। এরপর দুই-একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরও দেন। প্রথম দিন তার পক্ষে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত দেয়া সম্ভব ছিল না। তিনি দেনওনি। তবে তিনি এটা জানাতে ভোলেননি, তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন। তিনি কারও দ্বারা প্রভাবিত হবেন না, এটাও জানিয়েছেন। তবে যে বিষয়টি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, তিনি সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে এ মুহূর্তে কোনো সংলাপে যাবেন কিনা, সে ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। সাংবাদিকরা এ ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন। তারা জানতে চেয়েছিলেন, বিএনপির সঙ্গে তিনি কোনো সংলাপের উদ্যোগ নেবেন কিনা? সিইসির জবাবটা ছিল এ রকমÑ ‘বিএনপি বলে কোনো কথা নয়। সবাইকে আস্থায় আনাই তার কাজ।’ এর অর্থ পরিষ্কার, তিনি বিএনপিকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন না। অথচ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে বিএনপির আস্থা অর্জন করা।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির কিছু ‘অবজারভেশন’ আছে। সিইসি সম্পর্কে তাদের আপত্তি আছে। এখন সবার চোখ যে বিএনপি-সিইসি সমঝোতার দিকে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার বিবেচনায় সিইসির প্রথম বক্তব্যে তিনি বিষয়টি খোলাসা করেননি। স্পষ্টতই তিনি বিএনপিকে তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নেননি। সিইসি আরও বলেছেন, শপথ নেয়ার পর থেকে কোনো দলের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এর অর্থ কী আমরা ধরে নেব, শপথ নেয়ার আগে তার সঙ্গে অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পর্ক ছিল! এটি ‘হাইপোথেটিক্যাল’Ñ কোনো দলের সঙ্গে তার সম্পর্ক থাকতেও পারে, আবার নাও পারে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। স্থানীয় পর্যায়ে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা কোনো বিচিত্র কিছু নয়। তবে যেহেতু নির্বাচন পরিচালনায় ‘নিরপেক্ষতা’র একটি প্রশ্ন আছে, সেহেতু তাকেই এখন বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমার আশঙ্কা অন্য একটি কারণে। নয়া নির্বাচন কমিশন নিয়ে মানুষের আগ্রহ যখন বাড়ছে, তখন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার শাস্তি হলে কোনো নির্বাচন হবে না। তার এ বক্তব্য এভাবেই পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মির্জা ফখরুল কি কোনো আগাম মেসেজ দিলেন? বাজারে গুজব তো আছেই। খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য জেলে আসার(?) বিষয়টি বহুল আলোচিত। তার অবর্তমানে কারা বিএনপির হাল ধরবেন, তাদের নামধামও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সুতরাং শঙ্কা তো একটা থাকলই। তাহলে কি বিএনপি বর্তমান সিইসির আওতায় কোনো নির্বাচনে যাবে না?
বিষয়টি অত সহজ নয়, যতটা আমরা ভাবছি। এর সঙ্গে অনেক প্রশ্ন জড়িত। সংগতকারণেই তাই প্রশ্ন একটাইÑ নয়া সিইসির সবার আস্থা অর্জন করা ও তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। এজন্য দায়িত্ব নেয়ার পরপরই তিনি সব দলের সঙ্গে একটা সংলাপ আহ্বান করতে পারেন। এ মুহূর্তে তার প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, নির্বাচনে ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ যাতে নিশ্চিত হয়, তার ব্যবস্থা করা। এজন্য সংলাপে তিনি সব দলের কাছে মতামত চাইতে পারেন। বিশেষ করে বিএনপির মতামতটা কমিশনের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ (৫ জানুয়ারি, ২০১৪) নির্বাচনে অংশ নেয়নি। এর ফলে মূল ধারার রাজনীতি থেকে বিএনপি ছিটকে পড়েছে। বিএনপিকে মূল ধারার রাজনীতিতে অর্থাৎ সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসা কিছুটা হলেও দায়িত্ব পালন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের নির্বাচনী সংস্কৃতির সাম্প্রতিককালে দুইটি মডেল আমরা দেখেছি। একটি ‘ফেনী মডেল’, যেখানে বিরোধী পক্ষকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেয়া হয়নি; কিংবা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে নিজেদের জয় নিশ্চিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় মডেলটি হচ্ছে ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল,’ যেখানে মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনে ‘সব দল’ অংশগ্রহণ করেছে এবং নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়েছে। কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকা- আমরা দেখেনি। বর্তমান কমিশনকে তাই দেখতে হবে আগামী নির্বাচনে তারা কীভাবে একটি ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’ উপহার দিতে পারেন এবং এ নিশ্চয়তাটুকু জাতিকে তাদের দিতে হবে। দায়িত্ব নেয়ার পরপরই নির্বাচন কমিশনকে দুইটি শূন্য আসনের উপনির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এ উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না, এটা বোঝাই যায়। তবে সমস্যা রয়েছে আরও। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব এখানে প্রায় প্রতিটি সংসদীয় আসনে রয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদি এ ব্যাপারে ‘শক্ত’ না হয়, তাহলে তাদের প্রতি অনাস্থা আরও বাড়বে।
আমরা চাই, নয়া নির্বাচন কমিশনের শুরুটা ভালো হোক। শুরুতেই যদি সিইসি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারেন, তাহলে তাদের প্রতি আস্থাটা বাড়বে বৈ কমবে না। আমরা জানি, সংবিধানের ১২১নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদের নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার একটি করিয়া ভোটার তালিকা থাকিবে এবং ধর্ম, জাত, বর্ণ ও নারী-পুরুষভেদের ভিত্তিতে ভোটারদের বিন্যস্ত করিয়া কোনো বিশেষ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা যাইবে না।’ এ ভোটার তালিকা নিয়ে অতীতে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। ভুয়া ভোটার তালিকার কথাও আমরা শুনেছি। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে যাতে কোনো ভোটার তালিকা তৈরি না হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। আবার সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন।’ বর্তমান কমিশনকে তাদের কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে তারা সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন। তারা এমন কোনো কাজ করবেন না, যাতে করে প্রশ্নের জন্ম হতে পারে এবং বিরোধী পক্ষ তাদের ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।
এরই মধ্যে সোস্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সিইসি নূরুল হুদা পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের ফুলের তোড়া গ্রহণ করছেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন। ছবিতে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়াউল হক আছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সিইসি কি এ ধরনের ফুলের মালা নিতে পারেন? এটা তো কোনো ‘রাজনৈতিক পদ’ নয়! এ ধরনের ‘ফুলের মালা’ যদি ১৫ ফেব্রুয়ারির পর তিনি নিতে থাকেন, তাতে বিতর্ক আরও বাড়বে বৈকি! এদিকে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘গত ১০ বছরে একটা সার্চ কমিটিও এমন কোনো নাম দিতে পারেনি, যেখান থেকে কমিশনে এমন কোনো সফল ব্যক্তিত্ব এসেছেন। যাদের আসা সম্ভব ছিল, তাদের নাম সার্চ কমিটি দিতে পারেনি। তাই সার্চ কমিটি এখনও সফল হয়নি। আকবর আলি পুরনো আমলা। মোটামুটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তিনি কথাবার্তা বলেন। তার এ বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি সার্চ কমিটির নিয়োগে খুশি হতে পারেননি।
নবনিযুক্ত সিইসিও সাবেক আমলা। সচিব হিসেবে তিনি ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন বটে; কিন্তু সচিব হিসেবে তিনি সচিবালয়ে ‘কাজ’ করেননি। তিনি আকবর আলিকে ভালো করে চেনেন। তিনি এখন ভালো করবেন যদি এ ধরনের কিছু নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে মাঝেমধ্যে ডেকে ‘চায়ের দাওয়াত’ দিয়ে তাদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। তিনি এটা করতে বাধ্য নন। কিন্তু তার এ ধরনের ‘অ্যাপ্রোচ’ তার অবস্থাকে আরও শক্তিশালী করবে। তিনি নিরপেক্ষ একটি ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারবেন। আরও একটা কথা।
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, সিইসি ও নির্বাচন কমিশনাররা টিভির পর্দায় নিজেদের দেখাতে উৎসাহিত হন বেশি। কারণে-অকারণে তারা টিভির পর্দায় আসছেন। সাংবাদিকদের তার রুমে ডেকে নিয়ে কথা বলছেন। এর কোনো প্রয়োজন নেই। ইসি একটি সাংবিধানিক পদ। সাংবিধানিক পদের অধিকারীরা এভাবে টিভির পর্দায় আসেন না। আসা উচিতও নয়। ইসির বক্তব্য থাকতেই পারে। সেক্ষেত্রে বক্তব্য দেবেন ইসির সচিব অথবা দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা। তাকে প্রতিদিন টিভিতে বলারও কিছু নেই। এ মুহূর্তে ইসির বড় দায়িত্ব হচ্ছে, (১৮ ফেব্রুয়ারি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি পৌরসভা নির্বাচনের পর) ৬ মার্চ ১৮ উপজেলা পরিষদের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। এরপর দ্রুতই তাদের গাইবান্ধা-১ এবং সুনামগঞ্জ-২ সংসদীয় আসনের নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে এবং সম্ভবত সংসদীয় আসনের নির্বাচনে অংশ নেবে না। এসব নির্বাচন ইসি যদি সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে এটা প্লাস পয়েন্ট, ইসির প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা তাতে বাড়বে। একজন নির্বাচন কমিশনার এর আগে ইসিতে কাজ করেছেন। তবে কমিশনার হিসেবে নন। ভোটার তালিকা প্রণয়নের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ইসি তার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারেন।
অন্যান্য কমিশনারের ব্যাপারে যত না বিতর্ক, তার চেয়ে বেশি বিতর্ক সিইসিকে নিয়ে। সুতরাং তার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ বটে। এ পরীক্ষায় তিনি কীভাবে এবং কতটুকু উত্তীর্ণ হন, তা আমরা বিচার করব আগামী দিনগুলোতে। সিইসি জানিয়েছেন, তিনি সংবিধান অনুযায়ী কাজ করবেন এবং ইসিতে সরকারের প্রভাব খাটানোর কোনো সুযোগ নেই। কথাটা শুরুতে ভালোই শোনায়। কিন্তু দেখার পালা, এর বাস্তব প্রতিফলন কতটুকু হয়। তিনি প্রথম দিনই যেসব কথা বলেছেন, তা ভালো এবং প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু মনে আছে, সাবেক সিইসি কাজী রকিবউদ্দীনও দায়িত্ব নেয়ার সময় এ ধরনের কথাই বলেছিলেন। কিন্তু তিনি যত বেশি বিতর্কিত হয়েছেন, অন্য কোনো সিইসি এভাবে বিতর্কিত হননি। আরেকজন কমিশনার কবিতা বেগম বলেছেন, তিনি বিচারিক জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাবেন। নির্বাচন কমিশনে ‘বিচারিক জীবনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর’ কিছু নেই! সংবিধান ইসিকে স্বাধীনতা দিয়েছে। এর সুষ্ঠু ব্যবহার, নিরপেক্ষ থাকা, শক্ত অবস্থানে থাকা, চাপের কাছে মাথা নত না করা, সরকারি ‘চাপ’ উপেক্ষা করা এবং সর্বোপরি সবার আস্থা অর্জন করার মধ্যেই রয়েছে সাফল্য। তারা কতটুকু সফল হলেন, তা বিচার হবে তাদের কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে। আগামী ৫ বছর একটি কঠিন সময় তাদের পার করতে হবে। কাজটি খুব সহজ নয়।
Daily Alokito Bangladesh
19.02.2017

0 comments:

Post a Comment