একটি ‘ফেনী মডেল’, যেখানে বিরোধীপক্ষকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি কিংবা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে নিজেদের জয় নিশ্চিত করা হয়েছে। দ্বিতীয় মডেলটি হচ্ছে ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’, যেখানে মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচনে ‘সব দল’ অংশগ্রহণ করেছে। এবং নির্বাচনটি সুষ্ঠু হয়েছে। কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আমরা দেখিনি। বর্তমান কমিশনকে তাই দেখাতে হবে আগামী নির্বাচনে তারা কিভাবে একটি ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’ উপহার দিতে পারে এবং এই নিশ্চয়তাটুকু জাতিকে তাদের দিতে হবে। চতুর্থত, দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নির্বাচন কমিশনকে দুটি শূন্য আসনের উপনির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। এই উপনির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না, এটা বোঝাই যায়। তবে সমস্যা রয়েছে অন্যত্র। সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মাঝে অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই অন্তর্দ্বন্দ্ব এখানে প্রায় প্রতিটি সংসদীয় আসনে রয়েছে। নির্বাচন কমিশন যদি এ ব্যাপারে ‘শক্ত’ না হয়, তাহলে তাদের প্রতি অনাস্থা আরো বাড়বে। আমরা চাই নয়া নির্বাচন কমিশনের শুরুটা ভালো হোক। শুরুতেই যদি সিইসি বিতর্কের ঊর্ধ্বে থেকে একটি সুষুম নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারেন, তাহলে তাঁদের প্রতি আস্থাটা বাড়বে বৈ কমবে না। পঞ্চমত, সংবিধানের ১২১ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সংসদের নির্বাচনের জন্য প্রত্যেক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার একটি করিয়া ভোটার তালিকা থাকিবে এবং ধর্ম, জাত, বর্ণ ও নারী-পুরুষভেদের ভিত্তিতে ভোটারদের বিন্যস্ত করিয়া কোন বিশেষ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা যাইবে না। ’ এ ভোটার তালিকা নিয়ে অতীতে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। ভুয়া ভোটার তালিকার কথাও আমরা শুনেছি। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে যাতে কোনো ভোটার তালিকা তৈরি না হয়, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। ষষ্ঠত, সংবিধানের ১১৮(৪) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন। ’ বর্তমান কমিশনকে তাদের কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে তারা সত্যিকার অর্থেই স্বাধীন। তারা এমন কোনো কাজ করবে না যাতে প্রশ্নের জন্ম হতে পারে এবং বিরোধীপক্ষ তাদের ‘স্বাধীনতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। সপ্তমত, সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ছবি ভাইরাল হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, সিইসি নুরুল হুদা পটুয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের ফুলের তোড়া গ্রহণ করছেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা তাঁকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন। ছবিতে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়াউল হক আছেন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সিইসি কি এ ধরনের ফুলের মালা নিতে পারেন? এটা তো কোনো ‘রাজনৈতিক পদ’ নয়। এ ধরনের ‘ফুলের মালা’ যদি তিনি নিতে থাকেন, তাতে বিতর্ক আরো বাড়বে বৈকি! অষ্টমত, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘গত ১০ বছরে একটা সার্চ কমিটিও এমন কোনো নাম দিতে পারেনি, যেখান থেকে কমিশনে এমন কোনো সফল ব্যক্তিত্ব এসেছেন। যাঁদের আসা সম্ভব ছিল তাঁদের নাম সার্চ কমিটি দিতে পারেনি। তাই সার্চ কমিটি এখনো সফল হয়নি। ’ আকবর আলি পুরনো আমলা। মোটামুটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তিনি কথাবার্তা বলেন। তাঁর এই বক্তব্য প্রমাণ করে তিনি সার্চ কমিটির নিয়োগে খুশি হতে পারেননি। নবনিযুক্ত সিইসিও সাবেক আমলা। সচিব হিসেবে তিনি ভূতাপেক্ষভাবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন বটে; কিন্তু সচিব হিসেবে তিনি সচিবালয়ে ‘কাজ’ করেননি। তিনি আকবর আলিকে ভালো করে চেনেন। তিনি এখন ভালো করবেন যদি এ ধরনের কিছু নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে মাঝেমধ্যে ডেকে ‘চায়ের দাওয়াত’ দিয়ে তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করেন। তিনি এটা করতে বাধ্য নন। কিন্তু এ ধরনের ‘অ্যাপ্রোচ’ তাঁর অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে। তিনি নিরপেক্ষ একটি ভাবমূর্তি তৈরি করতে পারবেন।
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে আমরা যেকোনো সিদ্ধান্ত যদি আমাদের মনঃপূত না হয়, তাহলে দ্রুত তাকে বিতর্কিত করে ফেলি। দোষারোপের রাজনীতির বৃত্ত থেকে আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারিনি। অথচ ৪৫ বছর আমরা পার করে এসেছি। প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে আমরা রাজনীতির ‘গন্ধ’ খুঁজে বেড়াই। গণতন্ত্রের স্বার্থে, নির্বাচনী সংস্কৃতির স্বার্থে একটি ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’-এর বড় অভাব এ দেশে। অর্থাৎ আস্থার সম্পর্কের বড় অভাব আমরা লক্ষ করি। সিইসির নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটা লক্ষ করলাম। একদিকে বিএনপি যেভাবে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই সিইসিকে বিতর্কিত করে চলেছে, আবার সরকারের দলের লোকেরা, মন্ত্রীরা যেভাবে সিইসির পক্ষে বক্তব্য দিয়ে চলছেন, তা অনাকাঙ্ক্ষিত। সিইসি একটি সাংবিধানিক পদ। তাঁর ‘অতীত’ যা-ই থাকুক না কেন, তিনি একটি ‘প্রক্রিয়ার’ মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁকে নিয়ে আমরা যত কম কথা বলব ততই মঙ্গল। তাঁকে কাজে সুযোগ দেওয়া উচিত। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যেই তাঁকে গাইবান্ধায় মঞ্জুরুল ইসলাম এবং পরে সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের আসনে উপনির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। এখানে সরকারি দলের ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। আবার বিএনপির বাইরে অন্য ‘বিরোধী দলের’ অংশগ্রহণের একটা সম্ভাবনাও আছে। এ দুটি উপনির্বাচনে ‘ফেনী মডেল’ কিংবা ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’ আমরা টেস্ট করতে পারি। অর্থাৎ একদিকে সরকারি দলের পক্ষ থেকে ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত রাখার জন্য অন্য কোনো ‘যোগ্য’ প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া কিংবা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়া—এই যে সংস্কৃতি, তার প্রতিফলন ঘটে কি না, তা দেখার বিষয়। আবার ‘নারায়ণগঞ্জ মডেলের’ মতো নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচনটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে যদি সরকার ও বিরোধী পক্ষ সবাই নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করে। এ দুই আসনে বিএনপি তথা জামায়াত সমর্থকদের ‘ভোট’ আছে। তাঁরা কী করবেন? তাঁরা কি ভোট দিতে যাবেন, নাকি আদৌ ভোট দেওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবেন না? বিষয়টি ‘মনিটর’ করা দরকার। কেননা এতেই বোঝা যাবে নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক সাফল্য।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে আমরা ‘খাদের কিনারে’ নিয়ে গেছি। অনেকটা ‘ধাক্কা’ দিলেই গভীর খাদে পড়ে যাবে! আমরা সে রকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেও (ষষ্ঠ সংসদ) কিন্তু সে রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই ‘পরিস্থিতি’ থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) কিংবা নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং ‘সব দলের অংশগ্রহণ’ সেখানে নিশ্চিত হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে এটা বলা হয় যে বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে (৫ জানুয়ারি) অংশ না নেওয়ায় নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই ছিল না। সাবেক সিইসি তাঁর শেষ সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাই বলেছেন। এ নিয়ে গত পাঁচ বছরে অনেক কথাই হয়েছে। অনেক বিতর্ক হয়েছে। জাতিও অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সংবিধানের ১২৩(৪) ধারায় যে কথাটি উল্লেখ আছে, সে কথাটিও সত্য। এ ধারায় উল্লেখ আছে, ‘দৈবদুর্বিপাকের কারণে এ দফায় নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান (যদি) সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে। ’ তবে এখানে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’-এর মতে কথাটি বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি মনে করেন ‘দৈবদুর্বিপাকের’ কারণে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব না! সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এটা মনে করেননি। তাই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে, যা জাতিকে আরো ‘বিভক্ত’ করেছে এবং যা থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারছি না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ‘নির্বাচন বয়কট’ কিংবা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি ‘দৈবদুর্বিপাকের’ সংজ্ঞার আওতায় পড়ে কি না? এর জন্য সিইসি উচ্চ আদালতের একটি ব্যাখ্যা চাইতে পারতেন। তিনি তা চাননি। এখন আমরা এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, সিইসি এ বিষয়ে যত কম কথা বলবেন ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমরা চাই সামনের দিকে তাকাতে।
আমরা চাই সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তাই সংগত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্বটি অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয় এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। আমরা সেই ‘দায়িত্ব’ সিইসি কিভাবে পালন করেন তার অপেক্ষায় থাকলাম
Daily Kaler Kontho
16.02.2017
0 comments:
Post a Comment