রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ট্রাম্পের এক মাস ও নানা প্রশ্ন


যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ক্ষমতা গ্রহণের এক মাস পার করেছেন গত ২০ ফেব্রুয়ারি। এই এক মাসে তিনি নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন এবং এখনো সেই বিতর্ক জন্ম দিয়ে চলেছেন। বিতর্ক যেন তাঁকে ছাড়ছে না। সংবাদপত্রগুলোতে তাঁর ‘ইমেজ’ ভালো নয়। মাত্র এক মাসে তিনি যত বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন, বাকি দিনগুলো তিনি কিভাবে কাটাবেন, সে ব্যাপারেও সন্দিহান অনেকে। তাঁর ক্ষমতা পরিচালনা নিয়ে, তাঁর গৃহীত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে যেমন বিতর্ক আছে, বিক্ষোভ আছে, ঠিক তেমনি আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারের দেশগুলোতেও বিতর্ক আছে, ক্ষোভ আছে। সমসাময়িক যুক্তরাষ্ট্রে অতীতে এমন কোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি, যিনি ট্রাম্পের মতো এভাবে বিতর্কিত হয়ে ক্ষমতা পরিচালনা করেছেন। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই, ডোনাল্ড ট্রাম্প কম গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করেছিলেন। জানুয়ারিতে (২০১৭) তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল মাত্র ৪০ শতাংশ। অথচ ওবামা যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন (২০০৯) তখন তাঁর গ্রহণযোগ্যতা ছিল ৭৯ শতাংশ। আর বুশের (২০০১) ছিল ৬২ শতাংশ, ক্লিনটনের (১৯৯৩) ৬৮ শতাংশ। আর ফেব্রুয়ারি মাসে, অর্থাৎ দায়িত্ব নেওয়ার এক মাস পরও একটি পরিসংখ্যান আমরা দিতে পারি। পিউ রিসার্চের গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ৩৯ শতাংশ মার্কিন নাগরিক ট্রাম্পের কর্মকাণ্ড সমর্থন করছে, অন্যদিকে ৫৬ শতাংশ সমর্থন করছে না। নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন সত্য, কিন্তু তিনি এক মাস পরও তাঁর বিশ্বাসযোগ্যতার স্তর বাড়াতে পারেননি। পিউ রিসার্চের গবেষণায় উঠে এসেছে অতীত প্রেসিডেন্টদের ওপর আস্থা রাখার বিষয়টিও। প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন যখন দায়িত্ব নেন (১৯৯৩) তার এক মাস পর ৬৩ শতাংশ মানুষ তাঁর ওপর আস্থা রেখেছিল। বুশের (২০০১) ওপর ৬০ শতাংশ, ওবামার (২০০৯) ওপর ৭৬ শতাংশ মানুষের আস্থা ছিল (ট্রাম্পের মাত্র ৩৯ শতাংশ)। সাতটি মুসলমান দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা তিনি নির্বাহী আদেশবলে জারি করেছিলেন। আদালত সেই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প বিষয়টি নিয়ে গিয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্টে। সেখানেও তিনি হেরে যান। কিন্তু ট্রাম্প থেমে থাকেননি। ট্রাম্প প্রশাসন নতুন একটি অভিবাসন নীতিমালার ব্লুপ্রিন্ট প্রকাশ করেছে। ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটি থেকে ইস্যু করা দুটি মেমোতে উল্লেখ করা হয়েছে, অনথিভুক্ত অভিবাসীদের বের করে দেওয়া হবে এবং দ্রুততার সঙ্গে তাদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। নতুন এই অভিবাসনসংক্রান্ত নীতিমালা বা নির্দেশনামাকে দেখা হচ্ছে নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে। এর অর্থ হচ্ছে ট্রাম্প অভিবাসনসংক্রান্ত তাঁর অবস্থান থেকে এতটুকুও সরে আসছেন না। এরই মধ্যে তাঁর দুই মন্ত্রী মেক্সিকো গেছেন এবং অবৈধ মেক্সিকান অভিবাসীদের ফেরত পাঠানো নিয়ে কথা হয়েছে। ইউরোপে ট্রাম্পবিরোধী জনমত বাড়ছে। চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে এরই মধ্যে নানা প্রশ্ন উঠেছে। গেল জানুয়ারিতে ডাভোসে যে বিশ্ব-অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলন হয়ে গেল, চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং সেখানে একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন মডেলের সম্পর্ক শুরু করতে চায় পেইচিং। যদিও এই নয়া সম্পর্ক নিয়ে শি চিনপিং বিস্তারিত কিছু বলেননি। চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক যে ভবিষ্যতে অন্যতম আলোচিত বিষয় হয়ে থাকবে, সে ব্যাপারে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। এরই মধ্যে ট্রাম্প ইউরোপ, এমনকি জার্মানি সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা তাঁকে আরো বিতর্কিত করেছে। জার্মানিতে ১০ লাখ সিরীয় অভিবাসীকে আশ্রয় দেওয়ার ঘটনাকে ট্রাম্প আখ্যায়িত করেছিলেন সর্বনাশ হিসেবে। জার্মানরা এটা পছন্দ করেনি। জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল এর উত্তরে বলেছিলেন তাঁদের ভাগ্য তাঁদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ওলাঁদ এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, তাঁদের বাইরের দেশের উপদেশের প্রয়োজন নেই। ট্রাম্প ন্যাটোকে আখ্যায়িত করেন বোঝা হিসেবে। এটা নিয়ে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে এক ধরনের উষ্মা তৈরি হয়েছে। ট্রাম্প ব্রেক্সিটকে সমর্থন করেছিলেন। ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। অন্য ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ব্রিটেনকে অনুসরণ করুক, এটাও ট্রাম্প চান। ফলে ইংল্যান্ডের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে ট্র্যাডিশনাল সম্পর্ক, তাতে এক ধরনের অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। নির্বাচনে বিজয়ের পর তাইওয়ানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর ‘ফোনালাপ’ একটি সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্র এক চীন নীতি পরিত্যাগ করতে পারে! চীন বিষয়টিকে খুব সহজভাবে নেয়নি। চীন তার ‘টুইটার কূটনীতি’ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছে। আরো বিরূপ মন্তব্য করেছেন টিলারসন, যিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। টিলারসন বলেছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে চীন যে দ্বীপ বানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত সেখানে চীনাদের যাওয়ার পথ বন্ধ করে দেওয়া। এর প্রতিবাদে চীন বলছে যুক্তরাষ্ট্র যদি তা করে, তবে তা এক ভয়ংকর সংঘাতে রূপ নেবে। তবে রাশিয়া সম্পর্কে তিনি কিছুটা নরম মনোভাব দেখিয়ে আসছেন। যুক্তরাষ্ট্র ওবামার শাসনামলে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। এমনকি রাশিয়াকে জি-৮ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। রাশিয়া এখন চাইছে, সেই অবরোধ প্রত্যাহার হোক এবং জি-৮-এ আবার রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তিতে সমর্থন করুক যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ট্রাম্পের জন্য কাজটি খুব সহজ নয়। গত চার সপ্তাহে তিনি একের পর এক যেমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন ও তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছেন, তা তাঁর নিজ দল তথা বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতাকে একটি প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর ম্যাককেইন ট্রাম্পের ‘মুসলমান নিষিদ্ধ’ করার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করবেন বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে ওবামা প্রশাসনের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জন কেরি (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ও সুসান রাইস (জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা) সানফ্রান্সিসকোর আপিল কোর্টে একটি লিখিত বক্তব্যে জানিয়েছিলেন ট্রাম্পের ওই মুসলমান নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁদের ভাষায় এসব দেশের নাগরিকরা কোনো ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকিতেও ছিল না। ফলে বোঝাই যায় ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্ত খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। এটা এখনো স্পষ্ট নয় ট্রাম্প যে ১০০ দিনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, তাতে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করবেন। তবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কে তাঁর নিজের অজ্ঞতা ও তাঁর প্রশাসনে যথেষ্ট যোগ্য লোকের অভাব থাকায় আগামী দিনের যুক্তরাষ্ট্রের একটা ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাবে। উপরন্তু জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কপ-২১ চুক্তি (যা প্যারিস ও জাতিসংঘে স্বাক্ষরিত হয়েছে) সমর্থন না করা, কিউবার সঙ্গে সমঝোতাকে অস্বীকার করা, চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’, ন্যাটোতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশগ্রহণ কমিয়ে আনা, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা অস্বীকার, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল ইত্যাদি ভবিষ্যতে ট্রাম্পের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে না। তার গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পাবে। এখন আমাদের দেখতে হবে তাঁর এই রাজনীতি একুশ শতকের তৃতীয় দশকে যুক্তরাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যায়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো সিদ্ধান্ত বিশ্বে বড় পরিবর্তন ডেকে আনার জন্য যথেষ্ট। তাঁর বিষয়ে বিশ্বনেতাদের যে হতাশা এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, তা যেকোনো প্রেসিডেন্টের জন্য খারাপ খবর। মানসিকভাবে তিনি কতটুকু সুস্থ সে ব্যাপারে এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। বহুল প্রচারিত ইকোনমিস্ট পত্রিকা গত ৪ ফেব্রুয়ারি তাঁকে নিয়ে যে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন তৈরি করেছে An Insurgent in the white house শিরোনামে, তা শুধু লজ্জাজনকই নয়, বরং একটি আতঙ্কের কারণও বিশ্ববাসীর জন্য। প্রচ্ছদের ছবিতে দেখা যাচ্ছে ‘ট্রাম্প একটি মলোটোভ ককটেল’ নিক্ষেপ করছেন! এই ‘ছবি’ অনেক কিছুই বলে। সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের মন্তব্যও এখানে উল্লেখ করা যায়। সাময়িকীটি মন্তব্য করেছে এভাবে—‘It is not too late for him to conclude how much worse, to ditch his bomb-throwers and switch courses. The world should hope for that outcome. But it must prepare for trouble.’ বিশ্ব তৈরি থাকবে নতুন সংকটের জন্য। আমরা জানি না, এই ‘সংকট’টা নয়া বিশ্বব্যবস্থাকে কিভাবে প্রভাবিত করবে। তবে মাত্র চার সপ্তাহে তিনি যে একের পর এক বিতর্ক সৃষ্টি করে চলেছেন, তা আমাদের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন সিনিয়র এজেন্ট (সাবেক) জুরাল আভিভ। আভিভের মতে, ট্রাম্প আগামী তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে ‘বিশ্বাসঘাতকতার’ জন্য ‘ইমপিচ’ বা অভিশংসিত হতে পারেন! শুধু যে জুরাল আভিভের মুখ থেকে এ ধরনের কথা বেরিয়েছে, তা নয়। বরং অনেক পর্যবেক্ষকের লেখায় আমি এ ধরনের আভাস পেয়েছি। অভিশংসনের মূল কারণ হচ্ছে রাশিয়ার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তিনি নির্বাচনের আগে (নভেম্বর ২০১৬) রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন তথা রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। এই বিষয়টি এখন স্পষ্ট। ট্রাম্প ক্ষমতা নেওয়ার আগেই তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা, যাঁরা এখন প্রশাসনে আছেন, তাঁরা রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করতেন। তাঁদের সেই কল রেকর্ড মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের কাছে আছে। এর রেশ ধরেই ট্রাম্প প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ফ্লিন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। নিউ ইর্য়ক টাইমস আমাদের জানাচ্ছে, ট্রাম্প প্রশাসনের চার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নিয়মিত রাশিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। নির্বাচনের আগে রাশিয়া ট্রাম্পের দুর্বলতা বুঝে তাঁকে রাশিয়ার স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। বিশ্লেষকরা ওই ঘটনাকে এখন আখ্যায়িত করেছেন Russia Gate হিসেবে (Institute for policy studies) অনেকটা নিক্সনের watergate কেলেঙ্কারির মতো। ডেমোক্র্যাটরা তাঁর বিরুদ্ধে তখন উঠেপড়ে লেগেছেন। এদিকে নতুন করে অভিবাসনবিরোধী নতুন দুই ডিক্রি জারি, অন্যদিকে Russia Gate কেলেঙ্কারি ট্রাম্পকে এক মাসের মাথায় বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে গেছে। Russia Gate কেলেঙ্কারি থেকে তিনি মুক্তি পাবেন কি না, পেলে কিভাবে পাবেন, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
Daily Kalerkontho
01.03.2017

0 comments:

Post a Comment