রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

হঠাৎ আলোচনায় খালেদা জিয়া


হঠাৎ করেই আলোচনায় এসেছেন খালেদা জিয়া এবং মজার ব্যাপার খালেদা জিয়াকে নিয়ে আলোচনা করেছেন বিএনপির দুজন সিনিয়র নেতা, যারা আবার স্থায়ী পরিষদের সদস্য। তবে বিএনপিকে নিয়ে ‘বোমা ফাটিয়েছিলেন’ কানাডার একটি আদালত। সেখানে বিএনপির এক রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীর আবেদন নাকচ করে দিয়ে আদালত তাদের পর্যবেক্ষণে বলেছিলেন, বিএনপি সন্ত্রাসে ছিল, আছে বা ভবিষ্যতেও থাকতে পারে, এমন ধারণা করার যৌক্তিক কারণও আছে। এটা নিয়ে বাংলদেশে কম বিতর্ক হয়নি। কিন্তু এটি বর্তমান নিবন্ধের আলোচনার বিষয় নয়। আলোচনার বিষয় খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার কারাদ- হতে পারে (জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল মামলা) এমন আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, ‘সাজা হলেও খালেদা জিয়া অংশ নিতে পারবেন।’ আর গয়েশ্বর রায় বলেছেন, ‘হাসিনার অধীনে নির্বাচনে গেলে ৫ বছর পর কেন?’ দুটি বক্তব্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, মওদুদ আহমদ এ ধরনের বক্তব্য কেন দিলেন? আদালত কী রায় দেবেন, তা তো আগাম কেউ বলতে পারে না? একজন আইনজ্ঞ মওদুদ আহমদ ‘সাজা’র কথা আগাম বলেন কীভাবে? বাজারে নানা গুঞ্জন। সেসব গুজবের সঙ্গে মওদুদ সাহেবের নামও আছে। তিনি কী কোনো মেসেজ দিতে চাচ্ছেন? তিনি কী চাচ্ছেন খালেদা জিয়ার সাজা হোক। এর পর খালেদা জিয়া আপিল করবেন। উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখবেন এবং আপিল বিভাগও হাইকোর্টের রায় বহাল রাখবেন। যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা মওদুদ আহমদের এ ধরনের বক্তব্যে এক ধরনের ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজতে পারেন। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, খালেদা জিয়া তার স্মৃতিবিজরিত ক্যান্টনমেন্টের বাড়িটি হারিয়েছিলেন সরাসরি বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে যাওয়ার কারণে। হাইকোর্টে ও আপিল বিভাগেও খালেদা জিয়া হেরে গিয়েছিলেন। হাইকোর্টে যাওয়ার পরামর্শটি দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। দ্বিতীয়ত, গয়েশ্বর রায় যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানেও আছে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। তিনি সরাসরি প্রশ্ন রেখেছেন, ‘শেখ হাসিনার অধীনে যদি নির্বাচনেই যাব তাহলে ২০১৪ সালেই নির্বাচনে যেতে পারতাম। তাহলে পাঁচ বছর পরে যাব কেন?’ এ থেকে একটা মেসেজ অন্তত পাওয়া যায়। তিনি মনে করেন নির্বাচনের আগে যে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হবে তার নেতৃত্বে যদি শেখ হাসিনা থাকেন, তাহলে বিএনপির একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (যা ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা।) অংশ নেওয়া উচিত নয়। অকাট্য যুক্তি। এখনো শেখ হাসিনা থাকবেন বিধায় তো ২০১৪ সালের নির্বাচনেই অংশ নেওয়া যেত। মির্জা ফখরুল এবং রিজভী আহমেদের বক্তব্য অনেকটা গয়েশ্বর রায়ের বক্তব্যের মতোইÑ তারা শেখ হাসিনাকে রেখে নির্বাচনে যেতে চান না। কিন্তু নির্বাচন হবে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায়। এ ক্ষেত্রে বিএনপি অংশ না নিলেও সরকার নির্দিষ্ট সময়েই নির্বাচনের আয়োজন করবে, যেমনটি করেছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। বিএনপি এখন একটি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা বলছে। কিন্তু এর রূপরেখা এখন অবধি উপস্থাপন করেনি। তবে সেই রূপরেখা সরকার যে মানবে, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। মোটামুটিভাবে যেভাবেই হোক একটি নির্বাচনী আমেজ ফিরে এসেছে। টিভি টক শোতে দেখলাম, এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি নিজেও একাধিক টক শোতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না, দিন যত যাচ্ছে খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজার বিষয়টি অন্যতম আলোচিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজা নিয়ে মন্তব্য করেন, তখন বুঝতে হবে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে। যদিও এটা আইনের বিষয়। আদালত ও উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ নিয়ে বিএনপির নেতারা আগাম মন্তব্য করে বিষয়টিকে উসকে দিলেন মাত্র। আসলে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হোক, এটা আমার ধারণা প্রধানমন্ত্রী নিজেও চান। আরেকটি ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো নির্বাচন হোকÑ আমরা তা কেউই চাই না।
৫ জানুয়ারি (২০১৪) আমাদের জন্য কোনো সুখকর দিন ছিল না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচন নিয়ে দুটো বিষয় ছিল। এক. সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, দুই. বাস্তবতা। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি নির্বাচন আয়োজন করার প্রয়োজন ছিল। এটা নিয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। তবে আস্থার সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল ২০১৪-পরবর্তী যে কোনো সময় একাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা, যেমনটি করেছিল বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ (যে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল) কিংবা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বারবার আলোচিত হতে থাকবে। ষষ্ঠ সংসদে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। আর দশম জাতীয় সংসদে বিএনপি অংশ নেয়নি। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় দুটি নির্বাচনেরই প্রয়োজন ছিল। তবে তুলনামূলক বিচারে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে বেশি। ১৫৪টি সংসদীয় আসনে (৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগের ১২৮, ওয়ার্কার্স পার্টি ২, জাসদ ৩, জাপা-মঞ্জু ১, জাতীয় পার্টি-এরশাদ ২০) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া, ৫ জেলায় কোনো নির্বাচন না হওয়া কিংবা ৫২ ভাগ জনগোষ্ঠীর ভোট না দেওয়ার সুযোগ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা নিয়ে যে যুক্তিই আমরা টিভির টক শোতে দেখাই না কেন, এতে করে দেশে কোনো আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে সাহায্য করেনি। অথচ গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক, পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। পঞ্চম সংসদে (১৯৯১) এই ‘আস্থার সম্পর্ক’ ছিল বিধায় আমরা দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী এনে দেশে পুনরায় সংসদীয় রাজনীতির ধারা প্রবর্তন করেছিলাম। সেদিন বিএনপি সংসদীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ধারণা করেছিলাম ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে আস্থার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছিল তা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু তা কাটিয়ে উঠতে পারছি বলে মনে হচ্ছে না।
এর পর এলো চলতি ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারির ঘটনা। বিএনপির ‘কালো পতাকা’ দিবসে পুলিশি হামলা প্রমাণ করল ‘আস্থার সম্পর্ক’ প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত সহজ নয়। আস্থার সম্পর্কের পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিএনপিকে ‘স্পেস’ দেওয়া। অর্থাৎ বিএনপিকে তার কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া। এটা তো সত্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল, তার দায়ভার বিএনপি এড়াতে পারে না। বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারার সংস্কৃতি আর যাই হোক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য মানানসই নয়। ওই ঘটনায় বিএনপি তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল বিএনপি ও ১৪ দল। কিন্তু আন্দোলন তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেনি। অর্থাৎ সরকারের পতন হয়নি। কিন্তু সহিংসতায় অনেক মানুষ মারা গেছে। অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের করুণ কাহিনি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। টিভি পর্দায় তাদের আর্তি দেখে সাধারণ মানুষ কেঁদেছে। মানুষ বিএনপিকেই দোষারোপ করেছে। এটা থেকে বিএনপি বের হয়ে আসতে পারেনি। তার পরও কথা থেকে যায়। বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। এটা সরকারের জন্য একটা প্লাস পয়েন্টও বটে। সরকার বিএনপিকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এটাকে ধরে রাখতে হবে, যাতে করে বিএনপি ২০১৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি অংশ না নিলে জটিলতা থেকে যাবে। তাতে করে কেউই লাভবান হবে না। সরকারের জন্য তো নয়ই, বিএনপির জন্যও নয়। তাই সুস্থ নির্বাচনী পরিবেশের জন্য আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠা জরুরি।
এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য দুটো বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে গণতন্ত্রের হাওয়া বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেকগুলো সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধশিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা সফটপাওয়ার হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেন’-এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই আস্থার সম্পর্ক শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এই প্রতিযোগিতা হতে হবে রাজনৈতিক ও কর্মসূচিভিত্তিক। খালেদা জিয়ার সাজা হবে কী হবে না, এটা নিয়ে যত কম আলোচনা হবে, ততই ভালো। এটা আদালতের বিষয়। এ নিয়ে ‘জনমত’ সৃষ্টি করারও দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে নির্বাচনী প্রচারণা এক রকম শুরু করে দিয়েছেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি বগুড়ায় জনসভা করেছেন। সেখানে তিনি উন্নয়নের কথা বলেছেন। বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি বলে বিবেচিত। সেখানে তিনি বলেছেন, উন্নয়নে কোনো বিশেষ এলাকা বিবেচ্য নয়। এর অর্থ উন্নয়ন কর্মকা-কে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়ে আসবেন। সামনে আছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের বিষয়টি, যা ২০১৮ সালে চালু হওয়ার কথা। হয়তো পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেই তিনি নির্বাচনের তারিখ দেবেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কী করবে? বিএনপির উচিত হবে ইস্যুভিত্তিকভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করা। সিনিয়র নেতাদের উচিত বিভাগীয় শহরগুলোয় যাওয়া। খালেদা জিয়া বিভাগীয় শহরে জনসভাও করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে সরকারের উচিত বিএনপিকে জনসভা করতে দেওয়া। আর এর মধ্য দিয়েই ধীরে ধীরে একটি নির্বাচনী পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে।
Daily Amader Somoy
28.02.2017

0 comments:

Post a Comment