রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অশনিসংকেত


তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছাপা হয়েছে গত ১৬ ফেব্রুয়ারির দৈনিকগুলোয়। প্রতিটি সংবাদ নির্বাচন কমিশন এবং আগামী ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। প্রথম সংবাদটি নয়া ইসি গঠন ও সিইসির বক্তব্যকে নিয়ে। ১৫ ফেব্রুয়ারি নয়া ইসির কমিশনাররা তাদের দায়িত্বগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ একজন নতুন প্রধান নির্বাচন কমিশনার পেয়েছে। তিনি কে এম নুরুল হুদা। ওইদিনই বিকালে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে মিলিত হন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘সব দলের আস্থা অর্জনই তার প্রথম কাজ।’ দ্বিতীয় সংবাদটি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের। ১৫ ফেব্রুয়ারি একটি আলোচনা সভায় তিনি বলেছেন, ‘খালেদা জিয়াকে সাজা দিয়ে নির্বাচন দেওয়া হলে দেশের মানুষ তা মেনে নেবে না এবং দেশপ্রেমিক কোনো দল এ নির্বাচনে অংশ নেবে না।’ তিনি ওই অনুষ্ঠানে সিইসিকে দলীয় ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং বলেছেন, বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যাবে কিনা, তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে ওই সময় কোনো ধরনের সরকার থাকে তার ওপর। তৃতীয় সংবাদটিও ১৬ ফেব্রুয়ারি ছাপা হয়েছে। এটিও একটি বক্তব্য। আর বক্তব্যটি দিয়েছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও খালেদা জিয়ার আস্থাভাজন। নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ে এক সমাবেশে তিনি বলেছেন, ‘এই সরকার চাচ্ছে ভূতের মতো একজন ব্যক্তিকে (সিইসি) রেখে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন করেই আবার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার।’ এভাবেই তার বক্তব্যটি ছাপা হয়েছে সংবাদপত্রে। এই তিনটি সংবাদ যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে কতগুলো মন্তব্য করা যায়। এক. নতুন সিইসি দায়িত্ব নিলেও তাকে বিশ্বাস করতে পারছে না বিএনপি। দুই. সিইসি আস্থা অর্জনের কথা বললেও, এই আস্থা অর্জনের বিষয়টি এখন প্রশ্নের মুখে থাকল। তিনি কীভাবে বিএনপির আস্থা অর্জন করবেন, এটা এখন বড় বিষয়। তিন. খালেদা জিয়ার সাজা হতে পারে, এমন আশঙ্কা করছে বিএনপি। প্রশ্ন হচ্ছে, খালেদা জিয়া যদি সত্যি সত্যিই দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হন এবং জেলে যান, তাহলে আইনগতভাবে তার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে কিনা? চার. বিএনপি চাচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকারের একটি রূপরেখা। দলীয় সরকারের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ইসির আদৌ কোনো ভূমিকা আছে কী না? পাঁচ. আওয়ামী লীগ ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো একটি নির্বাচন করতে চায়Ñ এ ধরনের একটি ‘অভিযোগ’ উত্থাপিত হয়েছে। এর সত্যতা কতটুকু আছে, তা হয়তো আগামী দিনগুলোয় আমরা বলতে পারব। কিন্তু ইসি পুনর্গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যখন এ ধরনের অভিযোগ ‘উত্থাপিত’ হয়, তখন একটা শঙ্কা তৈরি হয় বৈকি!
আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এমনই যে, আমরা যে কোনো সিদ্ধান্ত যদি আমাদের মনঃপূত না হয় তাহলে দ্রুত তাকে বিতর্কিত করে ফেলি। দোষারোপের রাজনীতির বৃত্ত থেকে আমরা এখনো বের হয়ে আসতে পারিনি। অথচ ৪৫ বছর আমরা পার করে এসেছি। প্রতিটি সিদ্ধান্তের পেছনে আমরা রাজনীতির ‘গন্ধ’ খুঁজে বেড়াই। গণতন্ত্রের স্বার্থে, নির্বাচনী সংস্কৃতির স্বার্থে একটি ‘কনফিডেন্স ফিল্ডিং মেজারস’-এর বড় অভাব এ দেশে। অর্থাৎ আস্থার সম্পর্কের বড় অভাব আমরা লক্ষ করি। সিইসির নির্বাচনের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটা লক্ষ করেছিলাম। একদিকে বিএনপি যেভাবে দায়িত্ব নেওয়ার আগেই সিইসিকে বিতর্কিত করেছিল, আবার সরকারি দলের লোকরা ও মন্ত্রীরা যেভাবে সিইসির পক্ষে বক্তব্য দিয়ে চলেছিলেন, তা ছিল অনাকাক্সিক্ষত। সিইসি একটি সাংবিধানিক পদ। সিইসির ‘অতীত’ যাই থাকুক না কেন, তিনি একটি ‘প্রক্রিয়ার’ মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি শপথ নিয়েছেন। তাই তাকে নিয়ে আমরা যত কম কথা বলব, ততই মঙ্গল। তাকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত। আগামী তিন সপ্তাহের মধ্যেই তাকে গাইবান্ধায় মনজুরুল ইসলাম ও সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দুটি আসনে উপনির্বাচন পরিচালনা করতে হবে। এখানে সরকারি দলের ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব আছে। আবার বিএনপির বাইরে অন্য ‘বিরোধী দলের’ অংশগ্রহণের একটা সম্ভাবনাও আছে। এই দুটি উপনির্বাচনে ‘ফেনী মডেল’ কিংবা ‘নারায়ণগঞ্জ মডেল’ আমরা টেস্ট করতে পারি। অর্থাৎ একদিকে সরকারি দলের পক্ষ থেকে ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত রাখার জন্য অন্য কোনো ‘যোগ্য’ প্রার্থীকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দেওয়া কিংবা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যেতে বাধা দেওয়াÑ এই যে সংস্কৃতি, তার প্রতিফলন ঘটে কিনা, তা দেখার বিষয়। আবার নারায়াণগঞ্জ মডেলের মতো একটি নির্বাচন ইসি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে যদি সরকার ও বিরোধী পক্ষ সবাই নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতা করে। এই দুই আসনে বিএনপি তথা জামায়াত সমর্থকদের ‘ভোট’ আছে। তারা কী করবেন? তারা কী ভোট দিতে যাবেন? নাকি আদৌ ভোট দেওয়ার ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাবেন না? এই বিষয়টি ‘মনিটর’ করা দরকার। কেননা এতে করেই বোঝা যাবে নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক সাফল্য।
নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে আমরা ‘খাদের কিনারে’ নিয়ে গেছি। অনেকটা ‘ধাক্কা’ দিলেই গভীর খাদে পড়ে যাবে! আমরা সে রকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেও (৬ষ্ঠ সংসদ) কিন্তু সে রকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই ‘পরিস্থিতি’ থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১) কিংবা নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ সেখানে নিশ্চিত হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে এটা বলা হয়, বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে (৫ জানুয়ারি) অংশ না নেয়ায় নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই ছিল না। সাবেক সিইসি তার শেষ সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাই বলেছেন। এ নিয়ে গত ৫ বছরে অনেক কথাই হয়েছে। অনেক বিতর্ক হয়েছে। জাতিও অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সংবিধানের ১২৩(৪) ধারায় যে কথাটা উল্লেখ আছে, সে কথাটাও সত্য। এই ধারায় উল্লেখ আছে, ‘দৈব-দুর্বিপাকের কারণে এই দফায় নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান (যদি) সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।’ তবে এখানে ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার’-এর মতো কথাটা বলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশনার যদি মনে করেন ‘দৈব-দুর্বিপাকের’ কারণে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব নয়! সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ এটা মনে করেননি। তাই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে, যা জাতিকে আরও ‘বিভক্ত’ করেছে এবং যা থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারছি না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ‘নির্বাচন বয়কট’ কিংবা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ দাবি দৈব-দুর্বিপাকের সংজ্ঞার আওতায় পড়ে কিনা? এর জন্য সিইসি উচ্চ আদালতের একটি ব্যাখ্যা চাইতে পারতেন। তিনি তা চাননি। এখন আমরা এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, সিইসি এ বিষয়ে যত কম কথা বলবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমরা চাই সামনের দিকে তাকাতে। আমরা চাই ‘সকল দলের অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। তাই সঙ্গত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনারের দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতি যাতে সৃষ্টি না হয়, এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। আমরা সেই ‘দায়িত্ব’ সিইস কীভাবে পালন করেন, তার অপেক্ষায় থাকলাম। তবে একটা বিষয়ে বোধহয় আমাদের সবার ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজনÑ আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের বহু মন্ত্রী বারবার বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের তিন মাস আগে যে সরকার থাকবে, তার নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকারপ্রধান থাকলে, সেই সরকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিএনপি সেই প্রশ্নটিই তুলেছে। এটা ঠিক ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারের অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ওই সরকারে যোগ দেয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কী বিএনপিকে সে রকম একটি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ২০১৪ সালে বিএনপি পার্লামেন্টে ছিল। কিন্তু এখন তো তারা পার্লামেন্টে নেই। তাহলে মন্ত্রিসভায় বিএনপি অন্তর্ভুক্ত হবে কীভাবে? নাকি বিএনপিকে বাদ দিয়েই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে? বিএনপিকে যে আমন্ত্রণ জানানো হবে না, এ কথাটা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন, যেহেতু অতীতে বিএনপি এ ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, তাই এখন আর সে সুযোগ নেই। যদিও আমি তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চাই না। তিনি মন্ত্রী বটে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের কেউ নন। সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে অন্য কারো কিছু বলার সুযোগ নেই।
আমার বিবেচনায় বিএনপি নির্বাচনে যাবে। না হলে তারা নিবন্ধন হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। উপরন্তু মূল ধারার বিএনপিকে বাদ দিয়ে আরেকটি বিএনপি যদি গঠিত হয় এবং তারা যদি নির্বাচনে যায়, তাহলে আমার অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নতুন দলের নিবন্ধন পাওয়া ও তাদের সংসদে যাওয়ার পথ ‘তৈরি’ করে দেওয়া কঠিন কিছু নয়। নাজমুল হুদা ইতোমধ্যে তৃণমূল বিএনপি গঠন করেছেন। বর্তমান সংসদে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের নামেও একটি দল আছে। ফলে ২০১৯ সালে বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে দল ভেঙে যাবে! এবং ওইসব দলের ব্যানারে বিএনপির নেতাকর্মীরা অংশ নেবে। তাই আমার ধারণা বিএনপি সিইসিকে যতই বিতর্কিত করুক না কেন, চূড়ান্ত বিচারে ‘আন্দোলনের অংশ’ হিসেবেই তারা নির্বাচনে যাবে। এ ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত (?) হলেও বিএনপিতে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হবে। একটি যৌথ নেতৃত্ব বিএনপিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে খালেদা জিয়ার অবর্তমানে। এক কঠিন সময়ে সিইসি দায়িত্ব নিয়েছেন। তার নিরপেক্ষতা, তার প্রতি সব দলের আস্থা, বিশেষ করে বিএনপির আস্থা যদি নিশ্চিত হয়, তাহলেই ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ একটি নির্বাচন সম্ভব। এর ব্যত্যয় ঘটলে হুদা কমিশনেরও পরিণতি হবে রকিব কমিশনের মতো।
Daily Amader Somoy
18.02.2017

0 comments:

Post a Comment