রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাঘাইছড়ির নির্বাচন কি আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে


নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার তিন দিনের মাথায় পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি পৌরসভার একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল গত ১৮ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনে দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অংশগ্রহণ করেছে। এটা ছিল নয়া নির্বাচন কমিশনের জন্য একটি টেস্ট কেস। মোটামুটি নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়েছে। বিকেলের দিকে কিছু জাল ভোটের অভিযোগ পাওয়া গেলেও, নির্বাচন নিয়ে বড় ধরনের কোনো অভিযোগই উত্থাপন করেনি কোনো দল। পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী প্রায় এক হাজার ৫৭১ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন স্বতন্ত প্রার্থী। আর বিএনপি প্রার্থীর অবস্থান তৃতীয়। নিঃসন্দেহে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা নির্বাচন কমিশনের একটি সাফল্য। কিন্তু এই সাফল্য কি আমাদের সব প্রশ্নের জবাব দিয়েছে? যেখানে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বারবার বলে আসছেন একটি নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা, সেখানে একটি পৌরসভার নির্বাচন দিয়ে সবকিছু বিচার করা যাবে না। আস্থার যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। তা থেকে যদি বেরিয়ে আসা না যায়। তাহলে আগামী নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মূল প্রশ্ন হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন। পৌরসভা কিংবা উপনির্বাচন (জাতীয় সংসদের দুটি আসন) নিয়ে সব কিছু বিচার করা যাবে না। কিংবা আমাদের সব প্রশ্নের জবাবও দেবে না। কতগুলো সমস্যা তো এখানে আছেই। আওয়ামী লীগ বলে আসছে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবে। সিইসির আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়ে গেছে। তা তিনি কাটিয়ে উঠতে পারছেন বলে মনে হয় না। সিইসি সব দলের আস্থা অর্জন করার কথা বলেছেন বটে, কিন্তু তিনি তা কতটুকু পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সরকারি দলের নেতারা বিএনপিবিরোধী বক্তব্য অব্যাহত রেখেছেন। এই বিএনপিবিরোধী বক্তব্য আস্থার সার্থক গড়তে কোনো অবদান রাখবে না। পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, তা হচ্ছে বিএনপি যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে বিএনপি ভেঙ্গে যাবে। যদি সত্যি সত্যিই এরকম কিছু হয়। তাহলে এর দায় কী কিছুটা হলেও সিইসির ওপর বর্তাবে না? সত্তর বছর বয়সেও সিইসিকে শক্ত সামর্থ্য বলেই মনে হচ্ছে। শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। তবে প্রশ্ন তো একটা থাকলই_ সিইসি হিসেবে তার এই নিযুক্তি তাকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারবে কিনা? একটি কঠিন জায়গায় তিনি এসেছেন। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার অতীত সংশ্লিষ্টতা কতটুকু ছিল। তা তিনি জানেন। তখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে ব্যর্থ হলে, তার সম্মান আনো বাড়বে না, বরং আরও কমবে।

নির্বাচন ব্যবস্থাপনাকে আমরা খাদের কিনারে নিয়ে গেছি। অনেকটা 'ধাক্কা' দিলেই গভীর খাদে পরে যাবে। আমরা সে রকম একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিও (ষষ্ঠ সংসদ) কিন্তু সেরকম একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু সেই 'পরিস্থিতি' থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পেরেছিলাম। সপ্তম (১৯৯৬), অষ্টম (২০০১), কিংবা নবম (২০০৮) জাতীয় সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল এবং সব দলের অংশ গ্রহণ সেখানে নিশ্চিত হয়েছিল। যুক্তি হিসেবে এটা কলা হয় যে, বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচনে (৫ জানুয়ারি) অংশ না নেয়ায় নির্বাচন কমিশনের করার কিছুই ছিল না। সাবেক সিইসি তার শেষ সংবাদ সম্মেলনে এমন কথাই বলেছেন। এ নিয়ে গত ৫ বছরে অনেক কথাই হয়েছে। অনেক বিতর্ক হয়েছে। জাতিও অনেকটা দ্বিধাবিভক্ত। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথাটা যেমন সত্য, তেমনি সংবিধানের ১২৩ (৪) ধারায় যে কথাটা উল্লেখ আছে_ সে কথাটাও সত্য। এই ধারায় উল্লেখ আছে 'দৈব দুর্বিপাকের কারণে এই দফায় নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠান (যদি) সম্ভব না হয়, তাহা হইলে উক্ত মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে উক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে।' তবে এখানে 'প্রধান নির্বাচন কমিশনার' এর মতে কথাটা কলা হয়েছে। অর্থাৎ প্রধান নির্বাচন কমিশন যদি মনে করেন 'দৈব দুর্বিপাকের' কারণে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব না! সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকীবউদ্দিন আহম্মেদ এটা মনে করেনি। তাই ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হয়েছে, যা জাতিকে আরও 'বিভক্ত' করেছে এবং যা থেকে আমরা আজও বের হয়ে আসতে পারছি না। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতেই পারেন নির্বাচন বয়কট কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি দৈব দুর্বিপাকের আওতায় পড়ে কিনা? তবুও সিইসি উচ্চ আদালতের একটি ব্যাখ্যা চাইতে পারতেন। তিনি তা চাননি। তখন আমরা এটা নিয়ে যত কম বিতর্ক করব, সিইসি এ বিষয়ে যত কম কথা বলবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমরা চাই সামনের দিতে তাকাতে।
আমরা চাই সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক। বিএনপিসহ প্রতিটি নিবন্ধিত দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে_ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। তাই সংগত কারণেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের দায় দায়িত্বটি অনেক বেশি। ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো পরিস্থিতির যাতে সৃষ্টি না হয়, এ ব্যাপারে বর্তমান সিইসিকে পালন করতে হবে একটি বড় দায়িত্ব। আমরা সেই 'দায়িত্ব' সিইসি কিভাবে পালন করেন তার অপেক্ষায় থাকলাম। তবে একটা বিষয়ে বোধ হয় আমাদের সবার ঐকমত্যে উপনীত হওয়া প্রয়োজন_ আর তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার। সরকারের বহু মন্ত্রী বারবার বলছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে রেখেই নির্বাচন হবে। অর্থাৎ নির্বাচনের তিন মাস আগে যে সরকার থাকবে তার নেতৃত্ব দেবেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান সরকারপ্রধান থাকলে সেই সরকার নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। বিএনপি সেই প্রশ্নটিই তুলেছে। এটা ঠিক ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিকে তথাকথিত নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। বিএনপি ওই সরকারে যোগ দেয়নি। কিন্তু ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে কী বিএনপিকে সেরকম একটি মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হবে? কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? ২০১৪ সালে বিএনপি পার্লামেন্টে ছিল। কিন্তু এখন তো তারা পার্লামেন্টে নেই। তাহলে মন্ত্রিসভায় বিএনপি অন্তর্ভুক্ত হবে কিভাবে? নাকি বিএনপিকে বাদ দিয়েই একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হবে? বিএনপিকে যে আমন্ত্রণ জানানো হবে না, এ কথাটা আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন তোফায়েল আহমেদ। তোফায়েল আহমেদ জানিয়েছেন যেহেতু অতীতে বিএনপি এ ধরনের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল সুতরাং এখন আর সে সুযোগ নেই। যদিও আমি তোফায়েল আহমেদের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে চাই না। তিনি মন্ত্রী বটে। কিন্তু সরকারের নীতি-নির্ধারকদের কেউ নন। সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী। এক্ষেত্রে অন্য কারো কিছু বলার সুযোগ নেই।
আমার বিবেচনায় বিএনপি নির্বাচনে যাবে। না হলে তারা নিবন্ধন হারানোর ঝুঁকিতে থাকবে। উপরন্তু মূলধারার বিএনপিকে বাদ দিয়ে আরেকটি বিএনপি যদি গঠিত হয় এবং তারা যদি নির্বাচনে যায় তাহলে আমাদের অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। নতুন দলের নিবন্ধন পাওয়া ও তাদের সংসদে যাবার পথ তৈরি করে দেয়া কঠিন কিছু নয়। নাজমুল হুদা ইতিমধ্যে তৃণমূল বিএনপি গঠন করেছেন। বর্তমান সংসদে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্টের নামেও একটি দল আছে। ফলে ২০১৯ সালে বিএনপি যদি নির্বাচনে না যায়, তাহলে দল ভেঙে যাবে এবং ওইসব দলের ব্যানারে বিএনপির নেতাকর্মীরা অংশ নেবে। সুতরাং আমার ধারণা বিএনপি সিইসিকে যতই বিতর্কিত করুক না কেন, চূড়ান্ত বিচারে আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা নির্বাচনে যাবে।
এক্ষেত্রে বেগম জিয়া নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হলেও বিএনপিতে বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি হবে। একটি যৌথ নেতৃত্ব বিএনপিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে বেগম জিয়ার অবর্তমানে। এক কঠিন সময়ে সিইসি দায়িত্ব নিয়েছেন। তার নিরপেক্ষতা, তার প্রতি সব দলের আস্থা, বিশেষ করে বিএনপির আস্থা যদি নিশ্চিত হয়, তাহলেই সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন সম্ভব। এর ব্যত্যয় ঘটলে হুদা কমিশনেরও পরিণতি হবে রকিব কমিশনের মতো। সিইসি এ ব্যাপারে কতটুকু সচেতন আমি বলতে পারব না। কিন্তু তার 'বডি ল্যাংগুয়েজ' আমাকে এতটুকুও আশ্বস্ত করতে পারেনি। তিনি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো সংলাপ' করবেন এমন কোনো কথা তিনি বলেননি। তিনি বাধ্য নন, এটাও সত্য। কিন্তু বাস্তবতা বলে একটা সুযোগ আছে। বাস্তবতা হচ্ছে তার সঙ্গে 'জনতার মঞ্চ'-এর সংশ্লিষ্টতা ছিল কী ছিল না, এই বিতর্ক তাকে তার কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করতে হবে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে অনেক সময়। শুরুটা তার ভালো হওয়া দরকার। এ জন্য তিনি যা করতে পারেন তা হচ্ছে (১) একদিন সুশীল সমাজের সঙ্গে একটি 'গোল টেবিল' করে সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে তাদের মতামত আহ্বান করতে পারেন, (২) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও একদিন বসতে পারেন। তাদের কম কথা বলতে হবে। নিত্যদিন টিভি পর্দায় চেহারা দেখানোর প্রয়োজন নেই। ইসির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন কমিশনের সচিব, কোনো কমিশনার নয়। তাদের একমাত্র প্রায়োরিটি রয়েছে আস্থাটা অর্জন করা, যা হারিয়ে গেছে। তাই বাঘাইছড়ির নির্বাচনের 'সাফল্য' নিয়ে (বিএনপি অংশ নিয়েছে এই অর্থে) ইসি যত কম কথা বলবে ততই মঙ্গল।
Daily Jai Jai Din25.02.2017

0 comments:

Post a Comment