রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ও কিছু মৌলিক প্রশ্ন


সমসাময়িক বিশ্ব রাজনীতিতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণা নতুন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণার ব্যাপক বিস্তার ঘটে এবং পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে একাধিক আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার জন্ম হয়। বলা হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতা হচ্ছে নয়া বিশ্ব ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধের ভয়াবহতা যেখানে কমে এসেছিল, সেখানে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে অঞ্চল ভিত্তিতে দেশগুলো নিজেদের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও বাণিজ্য বৃদ্ধির মাধ্যমে নিজেদের মাঝে দেশগুলো এমন এক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল, যা কিনা নয়া বিশ্ব ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল। একুশ শতকে এসে সেই ধারণায় কিছুটা পরিবর্তন আসে। জন্ম হয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ধারণাটি নতুন; কিন্তু এ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য বিপুল এক সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা মূলত গড়ে ওঠে পাশাপাশি দুইটি বা তিনটি রাষ্ট্রের কিছু অঞ্চলের সঙ্গে। সেখানে পুরো রাষ্ট্রটি জড়িত থাকে না, জড়িত থাকে কিছু অঞ্চল। আর অঞ্চল ভিত্তিতেই গড়ে ওঠে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা।
বাংলাদেশ সার্ক কিংবা বিমসটেকের মতো আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় জড়িত থাকলেও বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএমের মতো উপ-আঞ্চলিক সংস্থায় নিজেকে জড়িত করেছে। বিবিআইএন উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার কথা প্রথম জানা যায় ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়। ওই সময় দুই দেশের মধ্যে যে যৌথ ঘোষণাপত্রটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার ৪১ নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, উভয় প্রধানমন্ত্রী বিবিআইএনের আওতায় বিদ্যুৎ, পানিসম্পদ, বাণিজ্য, ট্রানজিট ও কানেকটিভিটি খাতে সহযোগিতার সুযোগ কাজে লাগাতে সম্মত হয়েছেন। এ বিবিআইএন হচ্ছে ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত (সাত বোন রাজ্য) ও নেপালকে নিয়ে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এরই মধ্যে ঢাকা-শিলং-গোহাটি এবং কলকাতা-ঢাকা-আগরতলা বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। আগামীতে খুলনা-কলকাতা এবং যশোর-কলকাতা বাস সার্ভিসও চালু হবে। কলকাতা-খুলনার মধ্যে দ্বিতীয় মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন চালুরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। রামগড়-সাবরুম সেতু নির্মাণ করছে ভারত। ফলে আগরতলার পণ্য পরিবহনে এখন এ সেতু ব্যবহার করে মাত্র ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করা যাবে। এর সবই হচ্ছে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে। ২০১৫ সালের ১৫ জুন বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর ভুটানের মধ্যে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে একটি চুক্তি হয়েছে। এ চুক্তির অধীনে এই চারটি দেশের মাঝে যাত্রীবাহী বাস, পণ্যবাহী ট্রাক-লরি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ি চলাচল করতে পারবে।
প্রসঙ্গক্রমেই আমরা প্রস্তাবিত বিসিআইএম জোট নিয়েও আলোচনা করতে পারি। বিসিআইএম হচ্ছে অপর একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা। এ জোটে আছে বাংলাদেশ, চীন (ইউনান প্রদেশ) ভারত (সাত বোন রাজ্যগুলো) ও মিয়ানমার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তার চীন সফরের সময় এ বিসিআইএম করিডোরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এটাকে একসময় ‘কুনমিং উদ্যোগ’ বলা হতো। চীন ২০০৩ সালে এ ধরনের একটি সহযোগিতার কথা প্রথম বলেছিল, যা পরবর্তী সময় বিসিআইএম নামে আত্মপ্রকাশ করে। এ জোটটি কার্যকর হলে কুনমিং (চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী) থেকে সড়কপথে বাংলাদেশ ও ভারতে আসা যাবে এবং পণ্য আনা-নেয়া করা যাবে। ফলে চীনা পণ্যের দাম কমে যাবে। দ্বিতীয়ত ২০২০ সালে আসিয়ানে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তবাজার, যার ফলে বাংলাদেশ ও ভারতের পণ্য প্রবেশাধিকারের পথ সহজ হবে। বিসিআইএমের আওতায় কুনমিং থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত সড়ক হবে। তিনটি রুটে ইউনান প্রদেশের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সংযুক্ত হবে। বিসিআইএম জোটের সম্ভাবনা বিশাল। কারণ এ চারটি দেশের রয়েছে বিপুল তেল ও গ্যাস সম্পদ (মিয়ানমার), রয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতি (চীন ও ভারত), রয়েছে শিল্প (চীন), শক্তিশালী সার্ভিস সেক্টর, রয়েছে বিশাল অব্যবহৃত জমি (মিয়ানমার) ও সমুদ্রবন্দর (বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার)। ফলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যেতে পারে আগামীতে, যদি বিসিআইএম জোটকে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়। আঞ্চলিক অর্থনীতি তো বটেই, বিশ্ব অর্থনীতিকে অনেকাংশে প্রভাবিত করতে পারে এ জোট। বলাই বাহুল্য, এ চারটি দেশের সম্মিলিত জিডিপির পরিমাণ ৫ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ ভাগ। ১৯৯১ সালে বিসিআইএমের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল যেখানে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার, সেখানে ২০১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৯০ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। ১ দশমিক ৬৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা আর ২৮৮ কোটি মানুষের বাস এ বিসিআইএম জোটভুক্ত দেশে। পূর্বে কুনমিং, আর পশ্চিমে কলকাতা। মাঝখানে মান্দালয় ও ঢাকা। ভারত এ জোটের ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছিল এই কারণে যে, এতে করে আগামী দিনে ভারতের আসিয়ানের সদস্যপদ পাওয়া সহজ হয় এবং তার পণ্য নিয়ে শুল্কমুক্ত সুবিধা গ্রহণ করে আসিয়ানের বাজারে প্রবেশ করতে পারে। আমরাও এ সুযোগটি নিতে পারি।
কানেকটিভিটি এ যুগের চাহিদা। যদি বিবিআইএন জোট সফল হয়, তাহলে জোটভুক্ত চারটি দেশের অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশের বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের অর্থনীতিকে বদলে দিতে পারে। সিলেট হয়ে উঠতে পারে অন্যতম একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র। একই কথা প্রযোজ্য বিসিআইএমের ক্ষেত্রেও। সড়কপথ যদি প্রশস্ত হয়, যদি শুল্কমুক্ত সুবিধা নিশ্চিত করা যায়, তাহলে মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ তথা কৃষি ও মৎস্য সম্পদ ব্যবহার করে তা বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে আমাদের অর্থনীতিতে। তাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করতে হবে আমাদের সবার স্বার্থে। আমরা দেখতে চাই আমাদের স্বার্থ। কানেকটিভিটি ব্যবহার করে কোনো একটি দেশ লাভবান হবে, তা হতে পারে না। আমরাও চাই কানেকটিভিটি ব্যবহার করে আমাদের পণ্য নেপাল ও ভুটান যাক। সড়কপথে আমরা যেতে চাই কুনমিংও। কিন্তু এজন্য যা দরকার, তা হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা। পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা যদি গড়ে ওঠে তাহলে এ অঞ্চলের অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন আসবে, এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে একটা বড় সমস্যা ভারতকে নিয়ে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতি এখনও দ্বিপাক্ষিকতার বেড়াজাল থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। অর্থাৎ ভারত উন্নয়ন ও সম্পর্ক রক্ষা করে দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে কিংবা নেপালের সঙ্গে ভারতের যে সমস্যা, তা ভারত সমাধান করতে চায় দ্বিপাক্ষিকতার আলোকে। কিন্তু বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, বহুপাক্ষিকতা। বিবিআইএন কিংবা বিসিআইএম বহুপাক্ষিকতার আলোকেই রচিত। ভারত এতে সম্মতি দিয়েছে বটে; কিন্তু এর বাস্তবায়ন তখনই সম্ভব হবে, যখন ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসবে। বাংলাদেশের সমস্যা এ মুহূর্তে দুইটি। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে এ সমস্যা দুইটির সমাধান সম্ভব। এ সমস্যা দুুইটি হচ্ছে, পানি ও জ্বালানি। জ্বালানি খাতে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা অর্থাৎ বিবিআইএনের আলোকে একটি ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে এ অঞ্চলে। ভুটান ও নেপালে বিপুল জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এ খাতে বিনিয়োগ করতে চায়; কিন্তু জলবিদ্যুৎ উৎপাদিত হলেও ভারতের সম্মতি পাওয়া না গেলে, তা বাংলাদেশে আনা যাবে না। সুতরাং বাংলাদেশের বিনিয়োগ তখনই কাজে লাগবে, যখন উৎপাদিত বিদ্যুৎ ভুটান কিংবা নেপাল থেকে বাংলাদেশে রফতানি করা যাবে। না হলে বিনিয়োগ হবে অর্থহীন। মোদির ঢাকা সফরের সময় এই সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে; কিন্তু দৃশ্যত তেমন কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে একটা শঙ্কা থেকেই গেল যৌথ বিবৃতির বিষয়বস্তু না আবার কাগজে-কলমে থেকে যায়! দ্বিতীয় সম্ভাবনা পানি। বাংলাদেশ বড় ধরনের পানি সংকটের মুখে রয়েছে। শুষ্ক মৌসুম শুরু হতে যাচ্ছে। তিস্তা ও পদ্মায় পানি নেই। তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না শুধু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে। তিনি তিস্তা চুক্তিতে সম্মতি দেবেন যদি কেন্দ্র আর্থিকভাবে পশ্চিমবঙ্গকে সহযোগিতা করে। সীমান্ত চুক্তি তিনি সমর্থন করেছিলেন যখন কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য অতিরিক্ত ৩ হাজার কোটি রুপি বরাদ্দ করেছিল। তিস্তা চুক্তির ব্যাপারেও কথা উঠেছে যে, এ ধরনের একটি আর্থিক সহযোগিতার আশ্বাস যদি মমতা পান, তাহলে তিনি তিস্তা চুক্তির প্রতি সমর্থন দেবেন। এখন অবধি এ ধরনের কোনো আশ্বাস পাওয়া যায়নি বিধায় আপাতত তিস্তা চুক্তিটি হচ্ছে না। সম্প্রতি ঢাকা ঘুরে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব সুব্রোমনিয়াম জয়শংকর। তিনি মূলত শেখ হাসিনার এপ্রিলে নয়াদিল্লি সফর চূড়ান্ত করতেই ঢাকা এসেছিলেন। তার ঢাকা সফরের সময়ই স্পষ্ট হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের সময়ও তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সমস্যা গঙ্গা ব্যারাজ নিয়ে। গঙ্গা ব্যারাজ বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট। বাংলাদেশ যদি এ ধরনের একটি ব্যারাজ তৈরি করে পানি ধরে রাখতে পারে, তাহলে শুষ্ক মৌসুমেও পানি ব্যবহার করা সম্ভব। বাস্তবতা হচ্ছে, বর্ষার সময় প্রচুর পানি হিমালয় থেকে নেমে আসে। ভাটির দেশ হিসেবে ওই সময় বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তলিয়ে যায় এবং সেই পানি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়।
বাংলাদেশে জমির পরিমাণ কম। জলাধারও নেই। ফলে সেই পানি ধরে রাখা যায় না। এজন্যই গঙ্গা ব্যারাজের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল; কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এটা করতে হলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। চীন একবার আগ্রহ দেখিয়েছিল। এখন যেহেতু চীনের সঙ্গেও আমরা উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতায় আবদ্ধ (বিসিআইএম), সেহেতু আমরা চীন ও ভারতের সহযোগিতা নিতে পারি। মোদ্দাকথা, উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা বাস্তবায়ন করতে হলে ভারতকে এগিয়ে আসতে হবে। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। তার সক্ষমতা বেশি। সুতরাং ভারত শুধু একপক্ষীয়ভাবে সব সুযোগ-সুবিধা নেবে, বাংলাদেশের বিষয়ে দৃষ্টি দেবে না, এটা হতে পারে না। এজন্যই ভারতের ভূমিকাটা বড়। আমাদের প্রত্যাশা, প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরের সময় এ বিষয়ে আমরা একটা সহযোগিতার আশ্বাস পাব। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা ভালো; কিন্তু তাতে করে যেন সবার স্বার্থই রক্ষিত হয়।
Daily Alokito Bangladesh
05.03.2017

0 comments:

Post a Comment