রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি


১ মার্চ বিকালে নৌপরিবহনমন্ত্রী ও শ্রমিক নেতা শাজাহান খানের ভাষ্যমতে, পরিবহন শ্রমিকরা ‘অবসর’ থেকে ফিরে ফের কাজে যোগ দিলেও অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের কোনো জবাব মেলেনি। দৈনিক যায়যায়দিন ৫ মার্চ এক প্রতিবেদনে আমাদের জানাচ্ছে, দেশে মোট নিবন্ধিত হালকা ও ভারি গাড়ির সংখ্যা ২৯ লাখ ২০ হাজার ৮৩৬টি। এসব গাড়ির চালক বা নিবন্ধিত ড্রাইভারের সংখ্যা ১৭ লাখ। হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে, ১২ লাখ গাড়ি রাস্তায় চলাচল করছে নিবন্ধনহীন বা অপেশাদার চালকের হাতে। আর এসব অপেশাদার চালকের হাতেই প্রতিদিনই মানুষ মারা যাচ্ছে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসেই সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৬ জন। প্রশ্নটা এখানেই। সড়ক-মহাসড়কে গাড়ি আবারও চলছে। চালাচ্ছেন অনেক অপেশাদার চালক। দেখার লোক এখানে নেই। এসব প্রশ্নের জবাব আমাদের কে দেবে? এদিকে ৫ মার্চ থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন রাজধানীতে চলাচলকারী ২০ বছরের বেশি পুরনো বাস-মিনিবাস অপসারণে অভিযান শুরু করেছে। আইনত ২০ বছরের বেশি পুরনো গাড়ি মেয়াদোত্তীর্ণ এবং সড়কে এগুলো চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। রাজধানী ঢাকায় এসব পরিবহন বন্ধে অভিযান পরিচালনা করা হলেও আন্তঃজেলায় চলাচলকারী পরিবহনগুলো এ অভিযানের বাইরে থাকছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মহাসড়কগুলোতেই তো দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি হয়। এখন যদি মহাসড়কগুলোতে ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিত্য চলাচল করে, আমরা দুর্ঘটনা রোধ করব কীভাবে? পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা এবং মন্ত্রীর বাসায় মিটিং করে এ ধর্মঘটে যাওয়ার সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত হয়েছিলেন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। ৪ মার্চ খুলনায় এক সভায় তিনি স্বীকার করেন, তিনি ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। সুতরাং তার বাসায় যে কোনো মিটিং হতেই পারে। তার পদত্যাগের দাবি তিনি নাকচও করে দিয়েছেন (সমকাল, ৫ মার্চ)। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে আয়োজিত এক সভায় বলেছেন, ধর্মঘট করেন এমন মন্ত্রীদের কারণেই সব মøান হচ্ছে। (যুগান্তর, ৫ মার্চ)। এখন পরিবহন ধর্মঘট শেষ হয়েছে বটে; কিন্তু রেখে গেছে নানা প্রশ্ন। এ ধরনের পরিবহন ধর্মঘট যে অন্য পেশাজীবীদের উদ্বুদ্ধ করবে, তার বড় প্রমাণ চার ইন্টার্ন ডাক্তারের শাস্তি বাতিলের দাবিতে ১১ মেডিকেল কলেজে কর্মবিরতি, যা এরই মধ্যে প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রতিটি পেশাজীবীরই নিজস্ব সংগঠন রয়েছে। সবারই নিজস্ব দাবিদাওয়া রয়েছে। তাহলে কি সব পেশাজীবীই তাদের নিজস্ব দাবিদাওয়া আদায়ে অবৈধ ধর্মঘট ডেকে বসবে? পরিস্থিতি তখন কোথায় যাবে? পরিবহন ধর্মঘটের অবসান হয়েছে বেশ ক’দিন; কিন্তু সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার কমেছে, এটা বলা যাবে না। সড়ক পরিবহন ধর্মঘটের অবসানের পরও দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। যেন অনেকটা হাল ছেড়ে দেয়ার মতো অবস্থা! কোনোভাবেই যেন মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যাচ্ছে না। তবে একটা ‘আনন্দের সংবাদ’ও আমরা দেখেছি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন যখন তার ‘অভিযান’ পরিচালনা করছেন, গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠাচ্ছেন, এবার আর ড্রাইভাররা ‘অবরোধ-হরতালের’ হুমকি দেননি। ড্রাইভাররা এ ‘অভিযান’ অনেকটা যেন মেনে নিয়েছেন! অন্য সময় হলে ড্রাইভাররা ও মালিকপক্ষ ‘হুমকি’ দিয়ে বসতেন! তাই সড়কে এ ধরনের ‘শুদ্ধি অভিযান’ অব্যাহত রাখতে হবে। সাঈদ খোকন ঢাকা দক্ষিণের সড়কগুলো হকারমুক্ত চান। এ উদ্যোগটি নিঃসন্দেহে ভালো ও সমর্থনযোগ্য। একদিকে সড়ক থেকে লক্কড় মার্কা গাড়ি অপসারণ করা, অবৈধ ড্রাইভারদের আইনের আশ্রয়ে নেয়া, অন্যদিকে সড়ক থেকে হকার উচ্ছেদ করে রাস্তা চলাচল তথা ফুটপাথ নির্বিঘœ রাখা নিঃসন্দেহে ঢাকা দক্ষিণের মেয়রের জন্য একট বড় চ্যালেঞ্জ। তিনি কতটুকু সফল হবেন, তা হয়তো ভবিষ্যতে আমরা দেখব। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে এক ধরনের নৈরাজ্য চলছে। এ ধরনের নৈরাজ্য আইনকে নিজ হাতে তুলে নেয়ার শামিল। রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করার শামিল।
আর এজন্যই মহাসড়কগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। তবে একটা প্রশ্ন তো আছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। তাহলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নীরব কেন? এতে করে কি লাইসেন্সবিহীন চালকরা একটা সুযোগ পাবেন না? আমরা চাই, যৌথভাবে এ অভিযান পরিচালিত হোক। এখানে আরও কিছু কথা। এক. ঢাকা উত্তরের মেয়র অতীতে গাবতলীতে মূল সড়কে অবৈধ গাড়ি পার্কিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছিলেন। সাধারণ মানুষ এর সুফল পেয়েছিল। মূল সড়ক থেকে গাড়ি ভেতরে চলে গিয়েছিল। এখন আবার গাড়িগুলো মূল সড়কে স্থান করে নিয়েছে। ফলে গাবতলী সড়কে এখন নিত্যদিন যানজট তৈরি হচ্ছে। ট্রাফিক সার্জেন্টরা এটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। তারা অসহায়। নিয়ন্ত্রণহীন গাড়িচালকদের কাছে ট্রাফিক পুলিশ ও সাধারণ মানুষ এখানে জিম্মি। এখানে ফের অভিযান পরিচালনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এখানে অবৈধভাবে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফাইন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে, যাতে গাড়ি দাঁড়ালেই ফাইন হয়ে যায়। দুই. গাবতলী থেকে বাসস্ট্যান্ড সরিয়ে নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। ঢাকা বড় হয়েছে। এই এলাকাটি বাসমুক্ত করে এখানে উত্তর সিটি করপোরেশন নানা কর্মসূচি হাতে নিতে পারে। বিকল্প ‘বাসস্ট্যান্ড’ হিসেবে পরিত্যক্ত মধুমতি হাউজিংয়ের এলাকা সরকার ব্যবহার করতে পারে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মধুমতি হাউজিং এখন পরিত্যক্ত। কিন্তু বিশাল একটি এলাকা এখানে গড়ে তোলা হয়েছে, যা এখন একরকম পরিত্যক্ত। এটা সরকার ‘জনস্বার্থে’ ব্যবহার করতে পারে। তিন. ঢাকার অভ্যন্তরীণ রুটে লেগুনা চলাচল করে। এরা যতটা না যাত্রী সেবা দেয়, তার চেয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে বেশি। লেগুনাচালকদের শতকরা ৯০ ভাগের কোনো লাইসেন্স নেই। এরা লাইসেন্স গ্রহণ করার ব্যাপারেও কোনো আগ্রহ দেখায় না। অভিযোগ আছে, ভুয়া নম্বরপ্লেটও এরা ব্যবহার করে। এখানে অভিযানটা জরুরি। এদের কারণে দুর্ঘটনা বাড়ছে। চার. যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং করা, রাস্তার মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী উঠানোÑ ঢাকা শহরে এসব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আরও অবাক করার বিষয়, রাত ৮টার পর দূরপাল্লার সব বাস মূল রাস্তায় এসে পার্কিং করে এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এতে সৃষ্টি হয় বিশাল যানজট। আমি লক্ষ করেছি, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের আশপাশের এলাকা ‘নিরাপত্তা বলয়ের’ অন্তর্ভুক্ত হলেও, এখানেও রাত ৮টার পর দূরপাল্লার গাড়িগুলো যাত্রী উঠানোর জন্য মূল রাস্তায় পার্কিং করা অবস্থায় থাকে। এতে করে কী প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে না? নিরাপত্তা কর্মকর্তারা এটি এড়িয়ে যান কীভাবে? মূল রাস্তায় এখন রিকশাও চলছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে ট্রাফিক (পশ্চিম) শাখার ডিসিকে বিষয়টি অবহিত করেও কোনো প্রতিকার পাইনি। রাত ৮টার পরই শ্যামলী ও মোহাম্মদপুর, রিং রোডের মূল সড়ক চলে যায় দূরপাল্লার বাসচালকদের দখলে। একসময় ছিল, যখন এখান থেকে কোনো যাত্রী উঠানো হতো না। ছোট ছোট গাড়িতে করে বাস কোম্পানিগুলো যাত্রীদের নিয়ে যেত গাবতলীর মূল কাউন্টারে। এখন আর তারা এ কাজটি করেন না। ফলে রাত ৮টা নামলেই এ অঞ্চলজুড়ে বিশাল যানজটের সৃষ্টি হয়। এমনকি রাত ১১টা পর্যন্ত এ এলাকায় দীর্ঘ যানজট থাকে। দেখার কেউ নেই। অভিযোগ আছে, এক ধরনের ‘সমঝোতায়’ গিয়েই বাসচালকরা এ কাজটি করেন। তাই সড়ক ব্যবস্থাপনায় এক ধরনের শৃঙ্খলা প্রয়োজন। পরিবহন ধর্মঘট শেষ হয়েছে। ২০ বছরের পুরনো গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনÑ এটি ভালো। তবে এ অভিযান অব্যাহত রাখতে হবে। অভিযান থেমে গেলেই পুরনো লক্কড় মার্কা গাড়ি আবার রাস্তায় নামবে। সাধারণ যাত্রীদের জিম্মি করে তারা আবারও অরাজকতা সৃষ্টির প্রয়াস নেবে। আমরা চাই, সড়ক ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক সংস্কার আসুক। মহাসড়কগুলো ঝুঁকিমুক্ত করা হোক। যাত্রী সাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হোক। যারা রাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হরতাল আহ্বান করেন, তাদের আইনের আশ্রয়ে আনা হোক।
Daily Alokito Bangladesh
12.03.2017

0 comments:

Post a Comment