এখনই এ সফরের মূল্যায়ন করা যাবে না। কেননা এখনও স্পষ্ট হয়নি প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে কয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। এ সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে বটে; কিন্তু প্রশ্ন যে থাকবে না, তা নয়। তবে শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য এখানেই, তিনি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন।
শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি হয়েছিল। যদিও তার আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তার আমলে সার্কের ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, যদিও তা কার্যকর হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য আমদানি বাড়ে ৩ গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পরপর কয়েকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা প্রশংসিত হয়। তার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিও (হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিসটেন্স নিড্স অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তিনি তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ এ সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও বাংলাদেশ এই বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ দুটি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমসটেকে যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে (ইসলামবাদ, মার্চ, ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এবং ২০১৪ সালের সবশেষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি এখনও সরকার পরিচালনা করছেন।
শেখ হাসিনা সরকারের সময় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ‘ফি’ নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেছে, ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে- এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশী পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খেতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘সাতবোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এই ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছিল তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি।
গত ৭ বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর (২০১৫) করে দু’দেশের সম্পর্ককে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার আমলে ঐতিহাসিক ছিটহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত (ভারতের ১১১টি, বাংলাদেশের ৫১টি) নাগরিকরা স্বেচ্ছায় নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যে সমস্যা তা রয়ে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ থাকলেও শুধু মমতা ব্যানার্জির কারণে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। মোদির ঢাকা সফরের সময় নতুন আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল) আত্মপ্রকাশ করলেও এ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। সার্ক কার্যত অকার্যকর হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না। ট্যারিফ-প্যারাট্যারিফ কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে বটে; কিন্তু আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বিবিআইএন জোটের একটি বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও অভিযোগ উঠেছে ভারত এটিকে দেখছে তার স্বার্থে। ফলে বাংলাদেশে ভারতকে নিয়ে বিদ্যমান উদ্বেগ কমছে না। প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর এ উদ্বেগ কতটুকু কমাতে পারে সেটা দেখার বিষয়।
প্রতিটি দেশই তার জাতীয় স্বার্থের আলোকে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। ভারতও তাই করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করতে পারি না। সুতরাং ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশ অনেকগুলো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে পারে। এক. যেহেতু ভারতেও পানি সংকট আছে, সে কারণে অববাহিকার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। এতে করে পানির সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আগামীতে পানি সমস্যা একটা ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। চীন ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি তিব্বতে। ব্রহ্মপুত্র নদটি তিব্বত থেকে অরুণাচল ও আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ব্রহ্মপুত্রের চীনা নাম হচ্ছে Yarlung Zangbo। এই নদীর উপশাখা Xiabuquতে চীন Lalho Hydroelectric Project করেছে। এতে চীন সরকার ব্যয় করছে ৭৪০ মিলিন ডলার। এই প্রজেক্টে বিশাল এক এলাকা নিয়ে একটি রিজার্ভিয়ার গড়ে তোলা হচ্ছে, যা শেষ হবে ২০১৯ সালে। এই রিজার্ভিয়ারে ২৯৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি ধরে রাখা হবে। এর মাধ্যমে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ কাজ করা হবে। একইসঙ্গে বছরে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও রয়েছে ভারতের। ফলে ভারতের জন্যও একটি সংকট তৈরি হচ্ছে। এটা সমাধানের জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে পানি নিয়ে এশিয়ায় যুদ্ধ হতে পারে- এমন আশংকাও ব্যক্ত করা হচ্ছে।
দুই. সাফটার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে গেছে। সফটা বা দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। এখন ট্রেড লিবারেলাইজেশন প্রোগ্রামের কার্যকারিতার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কার্যত সাফটা এখন অকার্যকর। বাংলাদেশী পণ্যের ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে এটা কোনো ভালো খবর নয়।
তিন. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তার চীন সফরের সময় বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) অর্থনৈতিক করিডোরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এই অর্থনৈতিক করিডোর চীনের ইউনান রাজ্যের কুনমিংয়ের সঙ্গে কক্সবাজারকে সংযুক্ত করবে। চীন যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তাতে যে ৬টি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে, বিসিআইএম করিডোর তার একটি। ক্রমবর্ধমান ভারত-চীন দ্বন্দ্বে প্রস্তাবিত বিসিআইএম করিডোর এখন কাগজ-কলমে থেকে যেতে পারে! এতে করে বাংলাদেশের স্বার্থও ক্ষুণ্ণ হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। এই বিসিআইএম করিডোরের সঙ্গে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রশ্নটিও পরোক্ষভাবে জড়িত। একসময় বাংলাদেশ উদ্যোগ নিলেও তা এখন পরিত্যক্ত। বাংলাদেশ এখন পটুয়াখালীর পায়রাতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। ভারতীয় একটি কোম্পানি এটি করছে। চীন এ প্রকল্পেও জড়িত হতে চায়। এতে ভারতের সম্মতি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
চার. ভারতের দুটি মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে বাংলাদেশের উদ্বেগ রয়েছে। এই দুটি মহাপরিকল্পনা হচ্ছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ। মোদির ঢাকা সফরের সময় যৌথ ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। অথচ গত ১৬ জুলাই (২০১৬) বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় বিবিসি বাংলার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতে নদী সংযোগের বিতর্কিত পরিকল্পনার আওতায় এবার মানস-সংকোস-তিস্তা-গঙ্গাকে যুক্ত করার প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাবে বলে ঘোষণা করেছে সেদেশের সরকার। এটা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের পানিশূন্যতার মধ্যে পড়বে। অথচ এই সিদ্ধান্ত যৌথ ঘোষণার ২১ দফার পরিপন্থী। একই কথা প্রযোজ্য টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারেও। ভারত এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এ ধরনের মহাপরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫নং অনুচ্ছেদ, ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতি এবং রামসার কনভেনশনের বরখেলাপ। এমনকি ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদেরও বরখেলাপের শামিল। বাংলাদেশের জনগণের এ সংক্রান্ত উৎকণ্ঠা প্রধানমন্ত্রী তার নয়াদিল্লি সফরে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন।
ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে ভারতের অবস্থান ২ দশমিক ৮ ভাগ হলেও (২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার) ২০৫০ সালে ভারত হবে দ্বিতীয় অর্থনীতির (চীন প্রথম, যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয়) দেশ। প্রাইসওয়াটারহাউস কুপার্স তাদের এক গবেষণায় আমাদের এ তথ্য দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স বা ইতালির অবস্থান হবে ভারতের অনেক নিচে। তাই সঙ্গত কারণেই ভারতের অর্থনীতি থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। কিন্তু সম্পর্ক যেন হয় সমতার ভিত্তিতে, যা জাতিসংঘের চার্টারে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর সফল হোক, আমাদের প্রত্যাশা এটাই।
Daily Jugantor
30.03.2017
0 comments:
Post a Comment