আমরা এখনও নিশ্চিত নই এবং কোনো পক্ষ থেকেই এটা স্পষ্ট করে বলা হয়নি ক’টি চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। তবে সংবাদপত্রে এসেছে প্রতিরক্ষাসহ ৪৯টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের যেখানে অগ্রাধিকার বেশি, সেই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে মমতা ব্যানার্জি কলকাতার এক টিভি চ্যানেলকে জানিয়েছেন, এবার তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। আগামীতে যদি তিস্তা চুক্তি হয়ও তাহলে পশ্চিম বাংলার স্বার্থ সেখানে থাকবে বেশি, এটা জানাতেও তিনি ভোলেননি। ফলে ধরেই নেয়া যায়, তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। বেশ ক’টি প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে বলে পত্রপত্রিকাগুলো আভাস দিচ্ছে। এর আওতায় ভারতে প্রশিক্ষণ ও ভারত থেকে অস্ত্র কেনার কথাও বলা হচ্ছে। সমুদ্রে যৌথ টহল, মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহায়তা, দুর্যোগ ও ত্রাণবিষয়ক প্রশিক্ষণ সহযোগিতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হবে। ফলে এসব ক্ষেত্রে সহযোগিতার ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। ভারত থেকে অস্ত্র ক্রয়ের বিষয়টি যদি সেনা নেতৃত্ব মেনে নেয়, এখানে সাধারণ মানুষের বলার কিছু থাকতে পারে না। আমাদের স্বার্থই হলো আসল। আমরা অনেক দেশ থেকেই অস্ত্র কিনি। ভারত থেকেও কিনতে পারি। তবে আমাদের দেখতে হবে, এতে আমাদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে এবং ভারতের উদ্দেশ্য এতে সৎ কিনা। ভারত আমাদের বড় প্রতিবেশী। আমাদের উন্নয়নে ভারতের প্রয়োজন রয়েছে।
তবে যারা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ সম্পর্কেও ধারণা রাখেন। এ ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা স্বীকার করে নিতে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে বাধ্য করা। এটা একটা ধারণামাত্র। এ ধারণা ভারতের নীতিনির্ধারকরা যেমনি মনে করেন, ঠিক তেমনি অনেক ভারতীয় বিশ্লেষকও তা মনে করেন। এক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তন হলেও, এ নীতি ও আদর্শের কোনো পরিবর্তন হয়নি। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে দুইটি সাবমেরিন সংযোজিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় বিশ্লেষকরা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে করে এ ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ কথাটিই আবার আমাদের মনে করিয়ে দিল। ভারতের বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া দেখে এটা মনে হয়েছে যে, তারা চান না বাংলাদেশ নৌবাহিনী শক্তিশালী হোক। কোনো কোনো বিশ্লেষক এমন কথাও বলেছেন, ভারতের উচিত এখন বাংলাদেশ সীমান্তে মিসাইল ব্যাটারি বসানো এবং নতুন নতুন নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা। এই সাবমেরিন সংগ্রহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া শুরু করলেও ভারতের বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এটাকে ‘অ্যাক্ট অব প্রোভোকেশন’ হিসেবে দেখছে। চীন এই সাবমেরিন সরবরাহ করে ‘ভারতকে ঘিরে ফেলার’ চিন্তা করছে, এমন মন্তব্যও আছে ভারতীয় বিশ্লেষকদের মধ্যে। অথচ এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বাংলাদেশের নৌবাহিনী ভারতীয় নৌবাহিনীকে, যাদের রয়েছে ১৫টি সাবমেরিন (যার মাঝে একটি আবার পারমাণবিক শক্তিচালিত), চ্যালেঞ্জ করার আদৌ কোনো ক্ষমতা রাখে না। সে কারণেই যে প্রশ্নটি এসে যায়, তা হচ্ছে ভারতীয় মানসিকতার। ভারতীয় নীতিনির্ধারক তথা বিশ্লেষকরা চান না পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সশস্ত্র বাহিনী শক্তিশালী হোক।
আসলেও জওহরলাল নেহরুও স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতকে একটি বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে দেখার। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের পরই চতুর্থ বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে কল্পনা করেছিলেন। পরে ভারতীয় বিশ্লেষকদের অনেকেই এ ধারণাটি শুধু এগিয়ে নিয়েই যাননি বরং সরাসরি মন্তব্য করেছিলেন এ অঞ্চলে অন্য কোনো শক্তির কর্তৃত্ব ভারত সহ্য করে নেবে না। এ অঞ্চলের দেশগুলোকে ভারতকে ‘মান্য’ করতে হবে। এখানে আমরা রক্ষণশীল বিশ্লেষক তথা স্ট্রাটেজিস্ট হিসেবে সুব্রামনিয়াম, বলদেব রাজ, ভবানী সেনগুপ্তের অথবা নিহাল সিংয়ের মন্তব্যগুলো উল্লেখ করতে পারি। সুব্রামনিয়াম তার একটি লেখায় ১৯৭২ সালেই উল্লেখ করেছিলেন, ‘বাংলাদেশে নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার প্রশ্নটি সরাসরি ভারতের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত।’ তার ভাষায় ভারতই এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে (Economic of Political weekly, 6 may 1972) ৬ সধু ১৯৭২)। ভবানী সেনগুপ্ত তার The India Doctrine (India Today, 31 August, 1983) নামে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত প্রবন্ধে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘এ অঞ্চলে অন্য কেউ কর্তৃত্ব করুক, এটা ভারত চাইবে না।’ এ অঞ্চলের সব ‘নিরাপত্তা’ দেবে ভারত। আমরা যদি ভারতীয় নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে রাজীব গান্ধী থেকে শুরু করে অতি সম্প্রতি সুষমা স্বরাজের বক্তব্য বিশ্লেষণ করি, তাতে একই সুর আমরা খুঁজে পাব। রাজীব গান্ধী শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন (জুলাই, ১৯৮৭)। উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ অন্য কোনো দেশ যাতে শ্রীলঙ্কায় ‘নাক’ গলাতে না পারে। পরে নির্বাচনে চীনাপন্থী প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে হেরে গিয়েছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন কিছুটা চীনঘেঁষা এবং অভিযোগ ছিল হাম্বানতোতা গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনা সাবমেরিন ঘাঁটি গেড়েছিল। ভুবনেশ্বরে (উড়িষ্যা) ইন্ডিয়ান ওসেন রিম’র এক সম্মেলন হয়েছিল ২০১৫ সালের মার্চে। ওই অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, ভারত এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি সহ্য করবে না। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ভারত চায় না চীন এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াক। বাংলাদেশের সাবমেরিন সংগ্রহের সঙ্গে এ প্রশ্নটি জড়িত। ভারতের উৎকণ্ঠা আছে। ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর এ সবামেরিন দুইটি বাংলাদেশের কাছে সরবরাহ করা হয়েছিল। এর ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেটা ছিল কোনো ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। তবে একটা বিষয় আমার কাছে এখনও অস্পষ্ট। বাংলাদেশ এই সাবমেরিন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সম্ভবত ২০১৪ সালে। প্রায় ১ বছরের ওপরে বাংলাদেশী নাবিক ও কমান্ডিং অফিসাররা চীনে প্রশিক্ষণে ছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তা অজানা নয়। এখন ভারতীয় সরকার কিংবা বিশ্লেষকরা যেভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা শুধু অনাকাক্সিক্ষতই নয়, বরং তা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের অনাস্থা সৃষ্টি করতে পারে। একজন ভারতীয় নেভির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদপত্রে এর প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ভারত প্রয়োজনে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্র সীমানাবর্তী ভারতীয় এলাকায় মিসাইল ব্যাটারি বসাবে! নতুন নৌঘাঁটি করার কথাও তিনি বলেছেন। বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আছে কিনা জানি না; কিন্তু এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত (?) দুই দেশেরর বন্ধুত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার শামিল। সংবাদপত্রে (ভারতীয়) বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক একজন হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর একটি বক্তব্য দেখলাম। তিনি এটাকে ‘অর্থের অপচয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ভারতীয় কর্মকর্তা তথা নীতিনির্ধারকদের মাঝে একধরনের ‘নিচু মানসিকতা’ কাজ করে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে ‘একধরনের কর্তৃত্বে’র মধ্যে রাখতে চায় ভারত, যাকেই কিনা বিশ্লেষকরা ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই যে মানসিকতা, তাতে কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বর্তমান বিজেপি সরকারের কোনো পার্থক্য নেই।
ভারত বড় অর্থনীতিতের দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে ভারতের অবস্থান ২ দশমিক ৮ ভাগ হলেও ২০৫০ সালে ভারত হবে দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ। তখন চীন থাকবে প্রথম অবস্থানে, আর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হবে তৃতীয়। আমাদের সৌভাগ্য যে দুইটি বড় অর্থনীতির দেশই আমাদের প্রতিবেশী। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশী হলেও ভারত আমাদের প্রতিবেশী। সুতরাং আমাদের উন্নয়নে এ দুইটি দেশের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতিতে তাই এ দুইটি দেশকেই তিনি প্রাধান্য দিচ্ছেন। তিনি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছেন। তিনি চীনে গিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৬ সালে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৫ সালে। এখন প্রধানমন্ত্রী ভারতে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। সুতরাং ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে তিনি ভারতের সহযোগিতা চাইবেন। চীনের দুইটি কোম্পানি এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন যদি ভারতের সম্মতি পাওয়া যায় আমরা পদ্মা সেতুর মতোই গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করতে পারব। আর এতে করে বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রাখতে পারব, যা আমরা শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করতে পারব। পানি সংকট রয়েছে ভারতেরও। তাই এ অঞ্চলের সব দেশের সমন্বয়ে যদি একটি পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায়, তা আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল। বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এ বিদ্যুৎ চাহিদা উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে সমাধান সম্ভব। এক্ষেত্রে ভুটান ও নেপালে বিপুল জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এ দুইটি দেশে এ খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আনতে হলে ভারতীয় এলাকার ওপর দিয়ে আনতে হবে। তখন প্রয়োজন হবে ভারতের সহযোগিতার। এক্ষেত্রে ভারত যদি রাজি না হয়, তাহলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
এজন্যই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। আমাদের উন্নয়নে ভারত আমাদের অংশীদার হোক, পরবর্তী ১১টি শিল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে ভারত আমাদের সাহায্য করুকÑ আমরা এমনটা চাই। কিন্তু ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা যদি নিজেদের স্বার্থে বিষয়গুলোকে দেখেন, তাহলে এ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
Daily Alokito Bangladesh
28.03.2017
0 comments:
Post a Comment