বিএনপিকে
নিয়ে আলোচনার যেন শেষ নেই। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় বেগম জিয়ার
সাজা হবে_ এমন কথা বাজারে ভাসছে। গুজবের ডালপালা গজাচ্ছে! বেগম জিয়ার সাজা
হবে, কী হবে না কিংবা সাজা হলে দল কীভাবে পরিচালিত হবে, এসব নিয়ে এখন
রাজনৈতিক ময়দান সরগরম। একাদশ সংসদ নির্বাচনে বেগম জিয়া অংশ নিতে পারবেন
কিনা, কিংবা বেগম জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা_ এসব
প্রশ্ন এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার এই বিষয়টি নিয়ে
বিএনপির নেতারা যত বেশি না সোচ্চার তার চেয়ে বেশি সোচ্চার আওয়ামী লীগের
নেতারা। ওবায়দুল কাদেরের মতো আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও এ ব্যাপারে
মন্তব্য করেছেন। গত ৫ মার্চ এ প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়। গয়েশ্বর বাবু বিএনপির স্থায়ী পরিষদের সদস্য। সুতরাং
তার একটি মন্তব্য গুরুত্ব বহন করে বৈকি! তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে
বিএনপি নির্বাচন করবে না। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়াকে দলের অনেক নেতা
নানাভাবে স্বপ্ন দেখান। আমাদের মধ্যেও কিছু আইনজীবী ফর্মুলা দেন, জেল হবে,
জামিনও হবে, আবার নির্বাচনও হবে। তাদের বলব এসব ফর্মুলা দেয়া বন্ধ রাখেন।
কিসের জেল, কী কারণে জেল? (সমকাল, ৬ মার্চ)। গয়েশ্বর রায় কোনো নেতার নাম
উল্লেখ করেননি। স্পষ্টতই তিনি মওদুদ আহমেদকে এ কথা বলতে চেয়েছেন। কিছুদিন
আগে মওদুদ আহমেদ বলেছিলেন, 'সাজা হলেও খালেদা জিয়া নির্বাচনে অংশ নিতে
পারবেন।'
তিনি ভালো আইনজীবী। আইন তিনি ভালো বোঝেন। বেগম জিয়া হচ্ছেন দলের মূল কা-ারি। তার যদি সাজা হয়েই যায় (২), আগামী নির্বাচনে বেগম জিয়া অংশ নিতে পারবেন কিনা, সে প্রশ্ন থাকবেই। সেই সঙ্গে এসে যাবে মূল প্রশ্নটিও_ বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা? এক্ষেত্রে সরকারি দলের নেতাদের উৎসাহ অনেক বেশি। আকারে ইঙ্গিতে তারা বারবার বলে আসছেন বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। এখন বিএনপি কী করবে, তার দিকে শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীরাই নন, বরং গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি এখন এদিকে। গয়েশ্বর রায়ের পাশাপাশি রিজভী আহমদের বক্তব্যও অনেকটা তেমনি। একদিকে বিএনপি নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করছে, অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে রেখে তারা নির্বাচনে যেতে চান না। কিন্তু নির্বাচন হবে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায়। এক্ষেত্রে বিএনপি অংশ না নিলেও সরকার নির্দিষ্ট সময়েই নির্বাচনের আয়োজন করবে, যেমনটি করেছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। বিএনপি এখন একটি 'নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের' কথা বলছে। কিন্তু এর রূপরেখা এখন অবধি উপস্থাপন করেনি। তবে সেই রূপরেখা সরকার যে মানবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। মোটামুটিভাবে যেভাবেই হোক একটি নির্বাচনী আমেজ ফিরে এসেছে। টিভি টকশোতেও দেখলাম এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি নিজেও একাধিক টকশোতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না দিন যত যাচ্ছে বেগম জিয়ার সম্ভাব্য সাজার বিষয়টি অন্যতম আলোচিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজা নিয়ে মন্তব্য করেন তখন বুঝতে হবে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে। যদিও এটা আইনের বিষয়। আদালত ও উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ নিয়ে বিএনপির নেতারা আগাম মন্তব্য করে বিষয়টিকে উসকে দিলেন মাত্র। আসলে 'সব দলের অংশগ্রহণে' একটি নির্বাচন হোক, এটা আমার ধারণা প্রধানমন্ত্রী নিজেও চান। আরেকটি ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো নির্বাচন হোক_ আমরা তা কেউই চাই না।
৫ জানুয়ারি (২০১৪) আমাদের জন্য কোনো সুখকর দিন ছিল না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচন নিয়ে দুটো বিষয় ছিল। এক. সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, দুই. বাস্তবতা। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি নির্বাচন আয়োজন করার প্রয়োজন ছিল। এটা নিয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। তবে 'আস্থার সম্পর্ক' গড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল ২০১৪ পরবর্তী যে কোনো সময় একাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা, যেমনটি করেছিল বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ (যে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল) কিংবা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বারবার আলোচিত হতে থাকবে। ষষ্ঠ সংসদে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। আর দশম জাতীয় সংসদে বিএনপি অংশ নেয়নি। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় দুটি নির্বাচনেরই প্রয়োজন ছিল। তবে তুলনামূলক বিচারে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে বেশি। ১৫৪টি সংসদীয় আসনে (৩০০ আসনের মধ্যে, আওয়ামী লীগের ১২৮, ওয়ার্কার্স পার্টির ২, জাসদ ৩, জাপা-মঞ্জু ১, জাতীয় পার্টি-এরশাদ ২০) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া, ৫ জেলায় কোনো নির্বাচন না হওয়া কিংবা ৫২ ভাগ জনগোষ্ঠীর ভোট না দেয়ার সুযোগ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা নিয়ে যে যুক্তিই আমরা টিভির টকশোতে দেখাই না কেন, এতে দেশে কোনো আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে সাহায্য করেনি। অথচ গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক, পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। পঞ্চম সংসদে (১৯৯১) ওই 'আস্থার সম্পর্ক' ছিল বিধায় আমরা দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী এনে দেশে পুনরায় সংসদীয় রাজনীতির ধারা প্রবর্তন করেছিলাম। সেদিন বিএনপি সংসদীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ধারণা করেছিলাম ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে 'আস্থার ঘাটতি' সৃষ্টি হয়েছিল তা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু তা কাটিয়ে উঠতে পারছি বলে মনে হচ্ছে না।
এরপর এলো চলতি ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারির ঘটনা। বিএনপির 'কালো পতাকা' দিবসে পুলিশি হামলা প্রমাণ করল 'আস্থার সম্পর্ক' প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত সহজ নয়। আস্থার সম্পর্কের পূর্ব শর্ত হচ্ছে বিএনপিকে 'স্পেস' দেয়া। অর্থাৎ বিএনপিকে তার কর্মসূচি পালন করতে দেয়া। এটা তো সত্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল তার দায়ভার বিএনপি এড়াতে পারে না। বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারার সংস্কৃতি আর যাই হোক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য মানানসই নয়। ওই ঘটনায় বিএনপি তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল বিএনপি ও ১৪ দল। কিন্তু আন্দোলন তার লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারেনি। অর্থাৎ সরকারের পতন হয়নি। কিন্তু সহিংসতায় অনেক মানুষ মারা গেছে। অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের করুণ কাহিনী সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। টিভি পর্দায় তাদের আর্তি দেখে সাধারণ মানুষ কেঁদেছে। মানুষ বিএনপিকেই দোষারোপ করেছে। এটা থেকে বিএনপি বের হয়ে আসতে পারেনি। তারপরও কথা থেকে যায়। বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। এটা সরকারের জন্য একটা প্লাস পয়েন্টও বটে। সরকার বিএনপিকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এটাকে ধরে রাখতে হবে, যাতে করে বিএনপি ২০১৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি অংশ না নিলে জটিলতা থেকে যাবে। তাতে কেউই লাভবান হবে না। সরকারের জন্য তো নয়ই, বিএনপির জন্যও নয়। তাই সুস্থ নির্বাচনী পরিবেশের জন্য আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠা জরুরি।
এদেশে সুস্থ গণতন্ত্রচর্চার জন্য দুটো বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে এদেশে 'গণতন্ত্রের হাওয়া' বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো। যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরেই আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে।
আমরা 'সফটপাওয়ার' হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। 'নেক্সট ইলেভেন' এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে 'অর্জন', এই 'অর্জন' মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই 'আস্থার সম্পর্ক' শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এই প্রতিযোগিতা হতে হবে রাজনৈতিক ও কর্মসূচিভিত্তিক। বেগম জিয়ার সাজা হবে কী হবে না, এটা নিয়ে যত কম আলোচনা হবে ততই ভালো। এটা আদালতের বিষয়। এ নিয়ে 'জনমত' সৃষ্টি করারও দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে নির্বাচনী প্রচারণা একরকম শুরু করে দিয়েছেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি বগুড়ায় জনসভা করেছেন। সেখানে তিনি উন্নয়নের কথা বলেছেন। বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি বলেই বিবেচিত। সেখানে তিনি বলেছেন, উন্নয়নে কোনো বিশেষ এলাকা বিবেচ্য নয়। এর অর্থ উন্নয়ন কর্মকা-কে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়ে আসবেন। সামনে আছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের বিষয়টি, যা ২০১৮ সালে চালু হবার কথা। হয়ত পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেই তিনি নির্বাচনের তারিখ দেবেন। এক্ষেত্রে বিএনপি কী করবে? নিবন্ধনের বিষয়টি তো অনেক পরের বিষয়। এখন এটি কেন এলো? নির্বাচন হবার কথা ২০১৯ সালের জানুয়ারির তিন মাসের আগের যে কোনো এক সময়। এখনো হাতে আছে ২০ থেকে ২১ মাস। সময়টা একেবারে কম নয় এরই মধ্যে গত ৬ মার্চ বিএনপি আহূত অবরোধের সময় কুমিল্লায় বাসে পেট্রোল বোমা হামলার মামলায় খালেদা জিয়াসহ ৭৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এর অর্থ পরিষ্কার সরকার বেগম জিয়াকে চাপে রাখছেন। মামলার রায় দিয়ে বেগম জিয়াকে জেলে পাঠিয়ে (২) বিএনপিকে পুনরায় নির্বাচনের বাইরে রাখতে চায় সরকার। বিষয়টি স্পষ্ট নয়। ফলে গয়েশ্বর রায়ের বক্তব্য ও সরকারের নানা কর্মকা- আগামীতে গুঞ্জনের ডালপালাকে আরো বৃদ্ধি করবে। আমাদের শুধু দেখার পালা। Daily Jai Jai Din11.03.2017
তিনি ভালো আইনজীবী। আইন তিনি ভালো বোঝেন। বেগম জিয়া হচ্ছেন দলের মূল কা-ারি। তার যদি সাজা হয়েই যায় (২), আগামী নির্বাচনে বেগম জিয়া অংশ নিতে পারবেন কিনা, সে প্রশ্ন থাকবেই। সেই সঙ্গে এসে যাবে মূল প্রশ্নটিও_ বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা? এক্ষেত্রে সরকারি দলের নেতাদের উৎসাহ অনেক বেশি। আকারে ইঙ্গিতে তারা বারবার বলে আসছেন বিএনপি আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবে। এখন বিএনপি কী করবে, তার দিকে শুধু বিএনপির নেতা-কর্মীরাই নন, বরং গোটা দেশবাসীর দৃষ্টি এখন এদিকে। গয়েশ্বর রায়ের পাশাপাশি রিজভী আহমদের বক্তব্যও অনেকটা তেমনি। একদিকে বিএনপি নির্বাচন কমিশনকে বিতর্কিত করছে, অন্যদিকে শেখ হাসিনাকে রেখে তারা নির্বাচনে যেতে চান না। কিন্তু নির্বাচন হবে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায়। এক্ষেত্রে বিএনপি অংশ না নিলেও সরকার নির্দিষ্ট সময়েই নির্বাচনের আয়োজন করবে, যেমনটি করেছিল ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি। বিএনপি এখন একটি 'নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের' কথা বলছে। কিন্তু এর রূপরেখা এখন অবধি উপস্থাপন করেনি। তবে সেই রূপরেখা সরকার যে মানবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই। মোটামুটিভাবে যেভাবেই হোক একটি নির্বাচনী আমেজ ফিরে এসেছে। টিভি টকশোতেও দেখলাম এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আমি নিজেও একাধিক টকশোতে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে বলার অপেক্ষা রাখে না দিন যত যাচ্ছে বেগম জিয়ার সম্ভাব্য সাজার বিষয়টি অন্যতম আলোচিত একটি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন খালেদা জিয়ার সম্ভাব্য সাজা নিয়ে মন্তব্য করেন তখন বুঝতে হবে সরকারের নীতি-নির্ধারণী পর্যায়েও বিষয়টি বেশ আলোচিত হচ্ছে। যদিও এটা আইনের বিষয়। আদালত ও উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। এ নিয়ে বিএনপির নেতারা আগাম মন্তব্য করে বিষয়টিকে উসকে দিলেন মাত্র। আসলে 'সব দলের অংশগ্রহণে' একটি নির্বাচন হোক, এটা আমার ধারণা প্রধানমন্ত্রী নিজেও চান। আরেকটি ৫ জানুয়ারির (২০১৪) মতো নির্বাচন হোক_ আমরা তা কেউই চাই না।
৫ জানুয়ারি (২০১৪) আমাদের জন্য কোনো সুখকর দিন ছিল না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচন নিয়ে দুটো বিষয় ছিল। এক. সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা, দুই. বাস্তবতা। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কারণে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একটি নির্বাচন আয়োজন করার প্রয়োজন ছিল। এটা নিয়ে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। তবে 'আস্থার সম্পর্ক' গড়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল ২০১৪ পরবর্তী যে কোনো সময় একাদশ সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা, যেমনটি করেছিল বিএনপি ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে। ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ (যে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল) কিংবা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বারবার আলোচিত হতে থাকবে। ষষ্ঠ সংসদে আওয়ামী লীগ অংশ নেয়নি। আর দশম জাতীয় সংসদে বিএনপি অংশ নেয়নি। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় দুটি নির্বাচনেরই প্রয়োজন ছিল। তবে তুলনামূলক বিচারে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিতর্কিত হয়েছে বেশি। ১৫৪টি সংসদীয় আসনে (৩০০ আসনের মধ্যে, আওয়ামী লীগের ১২৮, ওয়ার্কার্স পার্টির ২, জাসদ ৩, জাপা-মঞ্জু ১, জাতীয় পার্টি-এরশাদ ২০) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া, ৫ জেলায় কোনো নির্বাচন না হওয়া কিংবা ৫২ ভাগ জনগোষ্ঠীর ভোট না দেয়ার সুযোগ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়। এটা নিয়ে যে যুক্তিই আমরা টিভির টকশোতে দেখাই না কেন, এতে দেশে কোনো আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠতে সাহায্য করেনি। অথচ গণতন্ত্রের মূল কথাই হচ্ছে আস্থার সম্পর্ক, পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস। পঞ্চম সংসদে (১৯৯১) ওই 'আস্থার সম্পর্ক' ছিল বিধায় আমরা দ্বাদশ সংবিধান সংশোধনী এনে দেশে পুনরায় সংসদীয় রাজনীতির ধারা প্রবর্তন করেছিলাম। সেদিন বিএনপি সংসদীয় সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। ধারণা করেছিলাম ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে 'আস্থার ঘাটতি' সৃষ্টি হয়েছিল তা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু তা কাটিয়ে উঠতে পারছি বলে মনে হচ্ছে না।
এরপর এলো চলতি ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারির ঘটনা। বিএনপির 'কালো পতাকা' দিবসে পুলিশি হামলা প্রমাণ করল 'আস্থার সম্পর্ক' প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অত সহজ নয়। আস্থার সম্পর্কের পূর্ব শর্ত হচ্ছে বিএনপিকে 'স্পেস' দেয়া। অর্থাৎ বিএনপিকে তার কর্মসূচি পালন করতে দেয়া। এটা তো সত্য ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছিল তার দায়ভার বিএনপি এড়াতে পারে না। বাসে আগুন দিয়ে মানুষ মারার সংস্কৃতি আর যাই হোক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য মানানসই নয়। ওই ঘটনায় বিএনপি তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল বিএনপি ও ১৪ দল। কিন্তু আন্দোলন তার লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারেনি। অর্থাৎ সরকারের পতন হয়নি। কিন্তু সহিংসতায় অনেক মানুষ মারা গেছে। অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। আগুনে পুড়ে যাওয়া মানুষের করুণ কাহিনী সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। টিভি পর্দায় তাদের আর্তি দেখে সাধারণ মানুষ কেঁদেছে। মানুষ বিএনপিকেই দোষারোপ করেছে। এটা থেকে বিএনপি বের হয়ে আসতে পারেনি। তারপরও কথা থেকে যায়। বিএনপি নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে থেকেছে। এটা সরকারের জন্য একটা প্লাস পয়েন্টও বটে। সরকার বিএনপিকে মূল ধারায় নিয়ে আসতে পেরেছে। এটাকে ধরে রাখতে হবে, যাতে করে বিএনপি ২০১৯ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। বিএনপি অংশ না নিলে জটিলতা থেকে যাবে। তাতে কেউই লাভবান হবে না। সরকারের জন্য তো নয়ই, বিএনপির জন্যও নয়। তাই সুস্থ নির্বাচনী পরিবেশের জন্য আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠা জরুরি।
এদেশে সুস্থ গণতন্ত্রচর্চার জন্য দুটো বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে তাহলে এদেশে 'গণতন্ত্রের হাওয়া' বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো। যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরেই আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাক শিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধ শিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে।
আমরা 'সফটপাওয়ার' হিসেবে ইতিমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। 'নেক্সট ইলেভেন' এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে 'অর্জন', এই 'অর্জন' মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মধ্যে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই 'আস্থার সম্পর্ক' শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এই প্রতিযোগিতা হতে হবে রাজনৈতিক ও কর্মসূচিভিত্তিক। বেগম জিয়ার সাজা হবে কী হবে না, এটা নিয়ে যত কম আলোচনা হবে ততই ভালো। এটা আদালতের বিষয়। এ নিয়ে 'জনমত' সৃষ্টি করারও দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে নির্বাচনী প্রচারণা একরকম শুরু করে দিয়েছেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি বগুড়ায় জনসভা করেছেন। সেখানে তিনি উন্নয়নের কথা বলেছেন। বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি বলেই বিবেচিত। সেখানে তিনি বলেছেন, উন্নয়নে কোনো বিশেষ এলাকা বিবেচ্য নয়। এর অর্থ উন্নয়ন কর্মকা-কে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়ে আসবেন। সামনে আছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের বিষয়টি, যা ২০১৮ সালে চালু হবার কথা। হয়ত পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেই তিনি নির্বাচনের তারিখ দেবেন। এক্ষেত্রে বিএনপি কী করবে? নিবন্ধনের বিষয়টি তো অনেক পরের বিষয়। এখন এটি কেন এলো? নির্বাচন হবার কথা ২০১৯ সালের জানুয়ারির তিন মাসের আগের যে কোনো এক সময়। এখনো হাতে আছে ২০ থেকে ২১ মাস। সময়টা একেবারে কম নয় এরই মধ্যে গত ৬ মার্চ বিএনপি আহূত অবরোধের সময় কুমিল্লায় বাসে পেট্রোল বোমা হামলার মামলায় খালেদা জিয়াসহ ৭৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। এর অর্থ পরিষ্কার সরকার বেগম জিয়াকে চাপে রাখছেন। মামলার রায় দিয়ে বেগম জিয়াকে জেলে পাঠিয়ে (২) বিএনপিকে পুনরায় নির্বাচনের বাইরে রাখতে চায় সরকার। বিষয়টি স্পষ্ট নয়। ফলে গয়েশ্বর রায়ের বক্তব্য ও সরকারের নানা কর্মকা- আগামীতে গুঞ্জনের ডালপালাকে আরো বৃদ্ধি করবে। আমাদের শুধু দেখার পালা। Daily Jai Jai Din11.03.2017
0 comments:
Post a Comment