রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

‘আমাদের সময়’ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা



নতুন ধারার সংবাদপত্র ‘আমাদের সময়’ ত্রয়োদশ বর্ষে পা রাখছে। বারো বছর ধরে নতুন ধারার এই দৈনিকটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা সংবাদপত্রের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে আসছে। বলা যেতে পারে, সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের সময় সংবাদপত্র কমিউনিটিকে এক করতে পেরেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর আমাদের সময় যেন পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যদি আমরা কথা বলি, তা হলে একটি কথা আমাদের বলতেই হয়, তুলনামূলক বিচারে অনেক উন্নয়নশীল বিশ্বের গণমাধ্যমের চেয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম বেশ স্বাধীন। সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণ এখানে তেমন একটা নেই বললেই চলে, যা কিনা মিসরের মতো দেশেও আছে। সরকারের সমালোচনা করে এখানে নিবন্ধ সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে নিয়মিত। টিভির ‘টক শো’গুলোয়ও সরকারের মৃদু সমালোচনা করা হয়। তবে এটা বলতেই হবে, গণমাধ্যমে করপোরেট হাউসগুলোর বিনিয়োগ বাড়ছে। বিনিয়োগ বাড়ার কারণে তাদের একটা ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকতে পারেÑ এটাই স্বাভাবিক। এটা ভালো কি মন্দ তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা একদমই ছাড় দেন না। তারা বলতে দেন। এমনটাই হওয়া উচিত। চীনের মহান নেতা মাও জে ডং একবার বলেছিলেন, ‘শত ফুল ফুটতে দাও।’ অর্থাৎ অনেক মত থাকুক। অনেক বক্তব্য থাকুক। মানুষ আসল সত্যটি সেখান থেকে বের করে নেবে। বাংলাদেশে এখন অনেক দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। প্রায় সতেরো কোটি জনসংখ্যার এই দেশে এখন প্রায় প্রতিটি জেলা শহর থেকে নিয়মিত দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। দেশে ইলেকট্রনিক টিভি চ্যানেলের সংখ্যা এখন ২৪টি। আগামীতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্রও আছে বেশ কয়েকটি। এসব অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্রের পাঠকপ্রিয়তাও আছে। যদিও সংবাদপত্রের পাঠক খুব বেড়েছে বলে মনে হয় না। নতুন নতুন সংবাদপত্র বাজারে এলেও নতুন পাঠকদের তারা আকৃষ্ট করতে পারছে না। তুলনামূলক বিচারে সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেলগুলোর আকর্ষণ বাড়ছে। সংবাদও যে বিনোদন দিতে পারে, তা টিভি চ্যানেলগুলো প্রমাণ করছে। আমাদের সংবিধানের ৩৯ (১) ও ৩৯ (২) ধারায় যে ‘ভাব প্রকাশের’ স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে টিভি টক শোগুলোয়। সাধারণ মানুষের অনেক কথা সেখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। টিভি টক শোগুলোর জনপ্রিয়তার একটা কারণ হচ্ছে, মানুষ ‘সত্য’ জানতে চায়। জাতীয় সংসদ যদি সত্যিকার অর্থে কার্যকর থাকত তা হলে মানুষ এই টক শোগুলোয় আকৃষ্ট হতো না। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে জাতীয় সংসদে কমই আলোচনা হয়। টিভি টক শোগুলোয় বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হয়। এখানে সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি সরকারের করণীয়ও উচ্চারিত হয়। অর্থাৎ এক ধরনের দিকনির্দেশনা থাকে, যে দিকনির্দেশনা বিটিভিতে খুঁজে পায় না দর্শক। সে কারণে বিটিভির জনপ্রিয়তা এখন সর্বনিম্নে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা অতীতে এবং বর্তমানে বিটিভিকে ব্যবহার করছেন একটি ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান’রূপে। একটি গণমাধ্যমের যে আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে তা বিটিভিতে নেই। ফলে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো এখন সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীন গণমাধ্যমের কথা শুধু আমাদের সংবিধানেই যে আছে, তা নয়। বরং আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্যও এটা প্রয়োজন। ডড়ষভমধহম ঝপযঁষু, চবমমু ঠধষপশব, কৎরংঃরহব ওৎরড়হ সম্পাদিত একটি গ্রন্থ রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বাধীন গণমাধ্যম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বইটির নাম হচ্ছে ঞযব ওহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ঃযব গবফরধ ধহফ রঃং জবমঁষধঃড়ৎু অমবহপরবং : ঝযবফফরহম ঘবি খরমযঃ ড়হ ঋড়ৎসধষ ড়ভ অপঃঁধষ ওহফবঢ়বহফবহপব অমধরহংঃ ঃযব ঘধঃরড়হধষ ঈড়হঃবীঃ (২০১৩). ওই গ্রন্থে সম্পাদকত্রয় স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘গবফরধ রহফবঢ়বহফবহপব রং ারঃধষ ভড়ৎ ফবসড়পৎধপু ধহফ ংড় রং ঃযব ৎবমঁষধঃড়ৎু নড়ফরবং মড়াবৎহরহম রঃ.’ এটাই আসল কথা। গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন গণমাধ্যম দরকার। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়েছিল, সেখানে একটি ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেখানে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতি’তে শোষণমুক্ত একটি সমাজের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার দীর্ঘ পথযাত্রায় গণতন্ত্রের ‘উত্থান-পতন’ হয়েছে। গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আবার ফিরে এসেছে ‘মূলধারায়’। তাই গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র যেমনি বিকশিত হবে না, ঠিক তেমনি সমাজে যে বৈষম্য, যে কূপম-ূকতা তা রোধ করা যাবে না। করপোরেট হাউসগুলো, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো মিডিয়ায় বিনিয়োগ করছেÑ এটা ভালো দিক। কিন্তু মিডিয়াগুলো যেন ব্যবসায়িক স্বার্থে পরিচালিত না হয় তা দেখা দরকার। এ ক্ষেত্রে যদি কোনো নীতিমালা না থাকে তা হলে নীতিমালা করা প্রয়োজন। মিডিয়া কোনো বিশেষ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হতে পারে। তার একটি ভালো দিকও আছে। মিডিয়ার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকাও কাম্য নয়। কিন্তু তাই বলে মিডিয়া ‘বিভ্রান্তকর, অসত্য সংবাদ’ পরিবেশন করে সরকারকে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করাবে, এটিও সমর্থনযোগ্য নয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, দেশরক্ষা বাহিনী সম্পর্কে যে কোনো সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে ‘বিশেষ সতর্কতা’ অবলম্বন করা প্রয়োজন। মিডিয়াকে হতে হবে সরকারের ‘বন্ধু’, সহযোগী কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। সরকারের ভেতরকার অদক্ষতা কিংবা ভুল নীতিগুলোকে শুদ্ধ করার দায়িত্ব মিডিয়ার। মিডিয়ার কর্মকর্তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন হবেন। কিন্তু তার ব্যক্তিগত মতাদর্শ মিডিয়ায় প্রতিফলিত হলে স্বাধীন মিডিয়ার জন্য তা হবে ক্ষতিকর। সরকারি ক্রয় আইন, বিজ্ঞাপন নীতিমালা না মেনেই সংবাদপত্রের জন্য দরপত্র, ক্রয় বিজ্ঞপ্তির বিজ্ঞাপনের আকার ক্ষুদ্রতর করা হচ্ছে। এর ফলে সংবাদপত্রের আয় নেমেছে সিকিভাগে। এটা ভালো নয় এবং তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য হুমকি। সংবাদপত্র যদি বেঁচে না থাকে তা হলে গণতন্ত্র থাকবে ঝুঁকির মাঝে। স্বাধীন গণমাধ্যম হচ্ছে ‘ছাঁকনি’র মতো, যারা সমাজ, রাষ্ট্রের খারাপ দিকগুলো পরিষ্কার করে সমাজ তথা রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে।
অস্ট্রেলিয়ার সমাজবিজ্ঞানী অষবী ঈধৎবু একুশ শতকের জন্য যে তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণতন্ত্রের বিকাশ। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে। যদিও প্রতিটি দেশেই নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে গণতন্ত্র বিনির্মাণে ভিন্নতা থাকলেও একটা মিল সর্বত্র খুঁজে পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সিঙ্গাপুরের মতো ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’র দেশেও সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রের স্বার্থেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তাই অত্যন্ত জরুরি। এই ‘স্বাধীনতা’ যদি নিশ্চিত না হয়, তা হলে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। সমাজে অসঙ্গতি বাড়বে। অপশক্তি শক্তিশালী হবে। গণতন্ত্রে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করাটা জরুরি। সমাজে বিভিন্ন মত থাকবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ দলগুলো লালন করবে। এ ক্ষেত্রে দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থান প্রয়োজন। আর গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে একটি ‘যোগসূত্র’ হিসেবে কাজ করতে পারে। একুশ শতকের শুরুতে যেখানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শুধু কাম্যই নয়, বরং উন্নত সমাজ গঠনের জন্য তা রক্ষাকবচও বটে।
আমাদের সময়-এর বর্ষপূর্তিতে এসে এই কথাগুলো বারবার মনে পড়ে গেল। আমাদের সময়ের দায়িত্বটি তাই বেশি। যেতে হবে অনেক দূর। সামনের সময়গুলো খুব মসৃণ নয়। অনেক সমস্যা, অনেক সংকট আমাদের যাত্রাপথে বিঘœ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা যেন থমকে না যাই। আমাদের সময় যেন আমাদের সাহস জোগায়। আমাদের সময় যেন আমাদের সাহসী করে। আমরা সাহসী মানুষ হতে চাই।
Daily Amader Somoy
29.03.2017

0 comments:

Post a Comment