রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কেমন হবে নির্বাচনকালীন সরকার


সংবিধান অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে বিশ মাসের মতো। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয়ে যাবে বর্তমান সংসদের মেয়াদ। সরকার মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেও নির্বাচন দিতে পারে। তবে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অথবা ২০১৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এর আগেই একটি নির্বাচনী আমেজ যেন আমরা পাচ্ছি। আর তাতে ঘুরেফিরে আসছে একটা কথাÑ নির্বাচনকালীন সরকার। কেমন হবে এই সরকার? এক সময় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আমরা সংবিধানে সংশোধনী এনে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। উচ্চ আদালত ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছিলেন। অতীতে আওয়ামী লীগই সোচ্চার ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে এবং বিএনপি ‘বাধ্য’ হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে। আর এখন আওয়ামী লীগই এর বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগই এখন বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে নেই। সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে। সংবিধানের কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই নির্বাচনকালীন একটি সরকারের কথা। তবে ৫৭(৩)-এ বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’ এর অর্থ পরিষ্কার, যিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনি নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকবেন। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই থাকছেন এবং তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে। বিএনপির আপত্তিটা এখানেই। বিএনপি মনে করে, যেহেতু শেখ হাসিনা একটি দলের প্রধান তাই একজন দলীয় প্রধানকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এই যুক্তি একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, সংবিধানে ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন থাকবে, এ কথা বলা হলেও নির্বাচন কমিশন কখনই স্বাধীন ছিল না। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা, ডিসি তথা টিএনওদের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর তাদের নিয়ন্ত্রণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও সংবিধানের ১২৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ বাস্তবক্ষেত্রে এটা শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। ‘নির্বাহী কর্তৃপক্ষ’ নির্বাচন কমিশনের কথায় চলে না এবং নির্বাচন কমিশনও তাদের ‘কর্তব্য পালনে’ বাধ্য করতে পারে না। ফলে সরকার যা চায় তাই হয়। নির্বাচন কমিশন এখানে ঠুঁটো জগন্নাথ। ফলে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্নে সরকারের আন্তরিকতাই আসল। এখন বিএনপি বলছে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা’র কথা। এই ‘রূপরেখা’ তো সরকার দেবে না। দিতে হবে বিএনপিকে। গত ৯ মার্চ একটি আলোচনা সভায় বিএনপির সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমাদের জানিয়েছেন, শিগগিরই খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবেন। আমরা জানি না, সেই সরকারের রূপরেখা কী হবে? দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে (২০১৪) প্রধানমন্ত্রী একটি ছোট আকারের মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। ওই মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিএনপিকে, যা বিএনপি গ্রহণ করেনি। এখন কি প্রধানমন্ত্রী সে রকম একটি আমন্ত্রণ জানাবেন? তবে ২০১৪-পূর্ববর্তী পরিস্থিতি ও আজকের পরিস্থিতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। নবম জাতীয় সংসদে বিএনপি ছিল এবং সংসদ সদস্যদের সমন্বয়েই ওই সময় একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল। এখন তো বিএনপি সংসদে নেই? তাহলে বিএনপি ‘নির্বাচনকালীন সরকারে’ থাকবে কী করে? এখানেই প্রশ্ন এসে যায় সরকারের আন্তরিকতার। বিএনপি সংসদের বাইরে বড় দল। দেশে ও বিদেশে দলটির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে। দাতাগোষ্ঠী বারবার ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ যে নির্বাচনের কথা বলছে, তাতে তারা পরোক্ষভাবে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার কথাই বলে আসছে। এখন সেটি সম্ভব হবে কীভাবে? নির্বাচন প্রস্তুতিকালীন শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। এটাই সংবিধানের কথা। সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। এখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে হলে তাকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় শুধু নির্বাচন প্রস্তুতিকালীন তিন মাস সময়ের জন্য। সরকার নীতিগতভাবে এ ক্ষেত্রে কতগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এগুলো অনেকটা এ রকম : ১. শুধু সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠিত হবে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ১০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা থাকবে। ২. তিনটি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এই মন্ত্রিসভায় থাকবে। ৩. প্রধানমন্ত্রী ব্যতিরেকে যারা মন্ত্রিসভায় থাকবেন, তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। ৪. মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনটি উপনির্বাচনে তিনজন বিএনপি প্রার্থীকে ‘বিজয়ী’ করে সংসদে আনা যায়। তারা আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। ৫. জনপ্রশাসন অথবা স্বরাষ্ট্র যে কোনো একটা মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দেওয়া যেতে পারে। ৬. ওই সরকার নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ৭. নির্বাচনের সময় ডিসি, টিএনও এবং ওসিদের বদলি করতে হবে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় নতুন লোক দিতে হবে। বিকল্প হিসেবে স্পিকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হতে পারেন, অথবা আওয়ামী লীগের যে কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা এই দায়িত্বটি নিতে পারেন। তবে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে এরা কেউই (অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যরা) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। তিনটি দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এ কারণে যে, বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এই তিনটি দলের বরাবরই প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এর বাইরে যেসব দল দশম কিংবা নবম জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে, তারা দুটো বড় দলের ব্যানারে এবং ওই দলের প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন (যেমন জাসদ। দলীয় প্রতীক মশাল। বিজয়ী হয়েছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে)। তাই অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় ওই সব দলের প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজন নেই।
অনেক কারণের জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন প্রয়োজন। এ জন্য বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে হবে। আমার ধারণা, বর্তমান সরকারও চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিক। পরপর দুটো নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ না নেয়, তাতে সরকারের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হবে না সত্য, কিন্তু বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি একটা প্রশ্নের মুখে থাকবে। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। মামলার রায়ও হবে চলতি বছরে। এতে করে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার একটা প্রশ্ন আছে। খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না এমন কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টি একান্তই আইনগত। তাই আদালতের কাছেই বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে আমরা যত কম কথা বলব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। তৃতীয়ত, জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে আবার সরকারে রেখে সরকার খুব লাভবান হয়েছে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে মেনে নেয়নি। বিএনপি সংসদে বিরোধী দলে থাকলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিকচর্চার জন্য দুটো বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে গণতন্ত্রের হাওয়া বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধশিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফটপাওয়ার’ হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেন’-এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই আস্থার সম্পর্ক শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এই প্রতিযোগিতা হতে হবে রাজনৈতিক ও কর্মসূচিভিত্তিক। খালেদা জিয়ার সাজা হবে কী হবে না, এটা নিয়ে যত কম আলোচনা হবে, ততই ভালো। এটা আদালতের বিষয়। এ নিয়ে জনমত সৃষ্টি করারও দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে ‘নির্বাচনী প্রচারণা’ এক রকম শুরু করে দিয়েছেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি বগুড়ায় জনসভা করেছেন। সেখানে তিনি উন্নয়নের কথা বলেছেন। বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি বলেই বিবেচিত। সেখানে তিনি বলেছেন, উন্নয়নের কোনো বিশেষ এলাকা বিবেচ্য নয়। এর অর্থ উন্নয়ন কর্মকা-কে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়ে আসবেন। সামনে আছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের বিষয়টি, যা ২০১৮ সালে চালু হওয়ার কথা। হয়তো পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেই তিনি নির্বাচনের তারিখ দেবেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কী করবে? বিএনপি নির্বাচনে যাবে। বিএনপি নিশ্চিত হতে চায় নির্বাচনে কারচুপি হবে না। নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে। ইসির ব্যাপারে বিএনপির রিজার্ভেশন আছে। সিইসিকে বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। তার পরও কথা থেকে যায়। একটি গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেও সম্ভব, বিএনপির আস্থা অর্জন করতে পারে এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে
Daily Amader Somoy
14.03.2017

0 comments:

Post a Comment