রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

মোদির বার্তা স্পষ্ট


উত্তর প্রদেশের বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির বিজয় এবং কট্টরপন্থী ও মুসলমানবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটা স্পষ্ট মেসেজ দিলেন। আর তা হচ্ছে ২০১৯ সালের পরবর্তী লোকসভার নির্বাচনে তিনি হিন্দুত্ববাদের ট্রাম্প কার্ডটি ব্যবহার করবেন। যোগী আদিত্যনাথ গত ১৯ মার্চ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে ভারতের সবচেয়ে বড় ও জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ নতুন করে ‘গেরুয়া বিপ্লবের’ সূচনা করলেন। যোগী আদিত্যনাথের বয়স মাত্র ৪৪ বছর। তিনি পাঁচ-পাঁচবার বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বটে, কিন্তু রাজ্যের বিজেপির রাজনীতিতে তাঁর তেমন কোনো ভূমিকা নেই। উপরন্তু তিনি রাজ্য বা কেন্দ্রীয় বিজেপির নেতাও নন। তাই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর নিযুক্তি সবাইকে অবাক করলেও মোদি জানেন তিনি কী করতে যাচ্ছেন। এর পেছনে সুস্পষ্ট একটি রাজনীতি আছে। তিনি হিন্দুত্ববাদ তথা ধর্মীয় রাজনীতিকে সামনে নিয়ে এলেন। যোগী আদিত্যনাথ কট্টরপন্থী হিন্দু পুরোহিত। তিনি গোরক্ষপুরের মন্দিরের অধ্যক্ষ। একাধিকবার তিনি তাঁর বক্তব্যের জন্য সমালোচিত হয়েছিলেন। রাম জন্মভূমি আন্দোলনের তিনি নেপথ্য নায়কদের একজন। বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণের ঘোষণা তিনি আগেই দিয়েছিলেন। গোরক্ষপুরের তাঁর নির্বাচনী এলাকার মধ্যে অবস্থিত আলিনগরকে তিনি নামকরণ করেছিলেন আর্যনগর হিসেবে। উর্দু বাজারকে করেছিলেন হিন্দুবাজার। তাঁর বিশ্বাস, আগ্রার তাজমহল ছিল একসময় তেজো মহালয় নামে এক রামমন্দির। গুজরাট দাঙ্গার পর মুসলমানদের শরণার্থী ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল। ওই ক্যাম্পগুলোকে যোগী আদিত্যনাথ আখ্যায়িত করেছিলেন মুসলমান সন্তান উত্পাদন কারখানা হিসেবে। প্রচণ্ড মুসলমানবিরোধী এই যোগী তখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। খুব সংগত কারণেই বলা হয়, আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করার মোদির সিদ্ধান্তটি সৎ নয়; যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং কিংবা বিজেপির সিনিয়র নেতা মনোজ সিনহার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মোদি প্রশাসন একেবারে আনকোরা যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বেছে নিয়েছে। বলা হয়, এ ক্ষেত্রে আরএসএস তথা সংঘ পরিবারের একটা ‘চাপ’ ছিল। সংঘ পরিবার ধীরে ধীরে ভারতকে একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। আর এর অংশ হিসেবেই মোদি ২০ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত উত্তর প্রদেশে একজন কট্টরপন্থী ধর্মীয় নেতাকে মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসালেন। ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা এটা বলার চেষ্টা করছেন যে গুজরাটে মোদির উত্থানটিও ছিল অনেকটা তেমনই। আজ উত্তর প্রদেশে, যেখানে অতীতে জাত-পাতের হিসাব বিধানসভার নির্বাচনে বড় প্রভাব ফেলেছিল, মোদি এবার তা উল্টে দিলেন। জাত-পাতের হিসাব এবার বড় ভূমিকা পালন করেনি। উত্তরবঙ্গে দলিত ও নিম্নবর্ণের সঙ্গে উচ্চবর্ণের যে বিরোধ তা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। চৈতন্য দেবের ভক্তি আন্দোলনে বৈষ্ণব ধর্মের বিকাশ পশ্চিমবঙ্গে শ্রেণিবিভেদ কমিয়েছিল। এমন ধরনের একটি স্ট্র্যাটেজি মোদি নিয়েছিলেন উত্তর প্রদেশে। তাতে সফল হয়েছেন। বিপুল ভোটে বিজেপি বিজয়ী হয়েছে এবং যেসব দল দলিতদের নিয়ে রাজনীতি করে (সমাজবাদী দল, বহুজন সমাজবাদী দল), হিন্দুত্ববাদের কাছে তাদের পরাজয় ঘটেছে।
যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ কি কোনো মেসেজ দিল এখন? প্রথমত, মুখ্যমন্ত্রীর মুসলমানবিরোধী নানা বক্তব্যের কারণে মুসলমানরা এখন সেখানে এক ধরনের অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে থাকবে। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মায়াবতীর বহুজন সমাজবাদী পার্টির নেতা ও সাবেক বিধানসভার সদস্য মোহাম্মদ গাজী খুন হয়েছেন। এটা একটা স্পষ্ট বার্তা। কট্টরপন্থীদের টার্গেটে পরিণত হতে পারেন মুসলমান নেতারা। বলা ভালো, উত্তর প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ হচ্ছে মুসলমান। এবার ৪০৩টি আসনের বিধানসভায় ২৫ জন হচ্ছেন মুসলমান বিধায়ক। বিজেপি ৩১২টি আসনে বিজয়ী হয়েছে। বিজেপি একজন মুসলমানকেও প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করায়নি। তবে মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ একজন মুসলমান বিজেপি নেতাকে প্রতিমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি হচ্ছেন সাবেক ক্রিকেটার মহসিন রেজা। দ্বিতীয়ত, বিশ্বজুড়েই এক ধরনের উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম হয়েছে। ইউরোপে মুসলমান তথা ইসলামবিদ্বেষী একটি মনোভাব সেখানকার নির্বাচনী রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প স্বয়ং এই ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবকে উসকে দিয়ে এক ধরনের ‘শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়েছেন। মোদির ভারতে আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকেই তিনি উসকে দিলেন। এই হিন্দুত্ববাদ হবে তাঁর ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ট্রাম্প কার্ড। এটা স্পষ্ট, তিনি যোগী আদিত্যনাথকে ভবিষ্যতে ব্যবহার করবেন। চলতি বছরই ছত্তিশগড়, গুজরাট, রাজস্থান, হিমাচল ও মধ্য প্রদেশে বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নিশ্চিত করেই বলা যায়, এসব নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি যোগী আদিত্যনাথকে ব্যবহার করবেন। মোদি-অমিত শাহ-আদিত্যনাথ নামগুলো ভবিষ্যতে বারবার আলোচিত হতে থাকবে।
তৃতীয়ত, আদিত্যনাথের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাম জন্মভূমি আন্দোলন নতুন একটি মাত্রা পাবে। দায়িত্ব গ্রহণের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি অযোধ্যায় রামায়ণ মিউজিয়াম গড়তে ২০ একর জমি বরাদ্দ করেছেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় আদিত্যনাথ বলেছিলেন, ‘রাজ্যের সমাজবাদী পার্টি সরকার উন্নয়ন করেছে শুধু কবরস্থানগুলোর। কিন্তু বিজেপি সরকার এসে রামমন্দিরও প্রতিষ্ঠা করবে। ’ গত জুন মাসে তিনি রামমন্দিরের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘যেখানে অযোধ্যার বিতর্কিত স্থাপনা ভেঙে ফেলা থেকে কেউ আটকাতে পারেনি, তো মন্দির তৈরি কে আটকাবে। ’ একজন কট্টরপন্থী হিন্দু নেতা যখন ক্ষমতায় থাকার আগেই রামমন্দির প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন এবং তিনি ও তাঁর দল যখন ক্ষমতায় যায় তখন একটা আশঙ্কা থাকেই। উত্তর প্রদেশ সরকার যদি বিতর্কিত স্থানে রামমন্দির প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, তা বিতর্ক শুধু বাড়াবেই না, বরং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করবে। চতুর্থত, ভারতের রাজনীতিতে বহুত্ববাদের চর্চা দীর্ঘদিন ধরেই স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, ভারত এই বহুত্ববাদের চর্চা থেকে বেরিয়ে আসছে। হিন্দুত্ববাদ ও যোগী আদিত্যনাথের ‘পুরো পৃথিবীতে গেরুয়া ঝাণ্ডা ওড়ানোর’ সিদ্ধান্ত পর্শ্ববর্তী দেশগুলোতে কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলতে পারে। আদিত্যনাথ ধর্মীয় জাতীয়তাবাদকে তখন উসকে দিতে পারেন। কট্টরপন্থী চিন্তাচেতনা আরো বাড়তে পারে। পঞ্চমত, উত্তর প্রদেশে বিজেপির বিজয় কংগ্রেসের নেতৃত্বকে একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছে। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব এখন প্রশ্নের মুখে। তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস রাজ্যগুলোর বিধানসভার নির্বাচনে তেমন ভালো করতে পারছে না। ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের জন্য এটা এক ধরনের ‘অশনিসংকেত’। ঘুরেফিরে আবারও প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে নেতৃত্বের গাড়িতে আনার প্রশ্ন উঠতে পারে। প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীর ‘কার্বন কপি’ তাঁর নাতনি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। মা ও ভাইয়ের নির্বাচনী এলাকার প্রচারাভিযানের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিজ্ঞতা তাঁর আছে। ব্যক্তি ইমেজও ভাই রাহুল গান্ধীর চেয়ে বেশি। কিন্তু বোধ হয় মা সোনিয়া গান্ধীই চাচ্ছেন না প্রিয়াঙ্কা আসুক। সোনিয়া গান্ধীর স্বপ্ন ছেলে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে। তাঁর স্বপ্ন রাহুল একদিন বাবা রাজীব গান্ধী কিংবা দাদি ইন্দিরা গান্ধীর মতো ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু পরিস্থিতি বোধ হয় এখন ভিন্ন। গান্ধী পরিবারের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেতে পারে!
সাম্প্রতিক সময়ে কংগ্রেস জনপ্রিয়তা বাড়াতে পেরেছে বলে মনে হয় না। তারুণ্যের প্রতীক প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা রয়েছে—এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু তাঁর সমস্যা স্বামী রবার্ট ভদ্রকে নিয়ে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে রবার্ট ভদ্রের নাম। সুতরাং প্রিয়াঙ্কা যদি রাজনীতিতে আসেন, বিজেপি তাঁর স্বামীর নানা কেলেঙ্কারিকে সামনে নিয়ে আসবে। বোধ হয় এটা বিবেচনায় নিয়ে প্রিয়াঙ্কা নিজেই আসতে চাচ্ছেন না। তবে রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব কংগ্রেসকে বিজেপির বিকল্প হিসেবে তুলে ধরতে পারেনি। উত্তর প্রদেশে কংগ্রেস মৈত্রী গড়ে তুলেছিল সমাজবাদী পার্টির সঙ্গে। তিনি নিজে সেখানে নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন; কিন্তু মানুষ তা গ্রহণ করেনি। সুতরাং ২০১৯ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে কংগ্রেসের হাইকমান্ড যদি ‘বিকল্প’ কিছু ভেবে থাকে, তাহলে তারা ভুল করবে না। ষষ্ঠত, টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক বিশ্লেষকের লেখায় আমি একটি ইঙ্গিত পেলাম। আর তা হচ্ছে যোগী আদিত্যনাথকে ‘পুশ’ করার পেছনে আরএসএসের একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে—আর তা হচ্ছে মোদির বিকল্প হিসেবে তাঁকে তৈরি করা। ২০১৯ সালের নির্বাচনের পর ২০২৪ সালে যে নির্বাচন হবে, তখন যদি বিজেপি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে, তাহলে আদিত্যনাথ হবেন ভারতের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী; যদিও সময়টা অনেক লম্বা, আরো সাত বছর বাকি। ওই সময় আদিত্যনাথের বয়স হবে মাত্র ৫১। এরই মধ্যে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জন করবেন। ৫১ বছর বয়স ভারতীয় রাজনীতির জন্য খুব বেশি বয়স নয়। মোদি এভাবেই উঠে এসেছিলেন আঞ্চলিক রাজনীতি থেকে, গুজরাট থেকে নয়াদিল্লি। আদিত্যনাথের শুরুটা হলো উত্তর প্রদেশ থেকে। ওই সময় ভারতের পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে কিংবা ভারতের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি আদৌ বদলে যাবে কি না, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু যোগী আদিত্যনাথের উত্থান উত্তর প্রদেশে ও মণিপুরে বিজেপির সরকার গঠন ভারতে নতুন করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থানের কথা স্মরণ করিয়ে দিল। এরই মধ্যে আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশে ‘গোরক্ষা’ কর্মসূচির আওতায় রামপুরে দুটি কসাইয়ের দোকান বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশের অযোধ্যায় বিতর্কিত বাবরি মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণের ঘোষণা দিলেও দেশটির সুপ্রিম কোর্ট গত ২১ মার্চ বলেছেন, দুই পক্ষ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করুক। উচ্চ আদালতে ছয় বছর ধরে রামমন্দির সমস্যার সমাধানে একটি মামলা বিচারাধীন। বিজেপি নেতা সুব্রামনিয়াম স্বামীর দায়ের করা একটি পিটিশনে শুনানি শেষে সুপ্রিম কোর্ট এ মন্তব্য করলেন। কিন্তু উত্তর প্রদেশে একজন কট্টরপন্থী ও মুসলমানবিদ্বেষী যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের মতামত কতটুকু গ্রাহ্যের মধ্যে নেবেন, এটা এখন বড় প্রশ্ন। তিনি জনমতকে উসকে দিতে পারেন তখন। তাঁর কাছে ভারতীয় সংবিধানের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় চেতনা।
এক ‘নতুন ভারতের’ জন্ম হতে যাচ্ছে। মোদি উন্নয়নের কথা বলে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। তাঁর সেই বিখ্যাত স্লোগান ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়ন—এই তত্ত্ব উত্তর প্রদেশেও বড় প্রভাব ফেলেছে। দলিত ও উচ্চবর্ণের মধ্যে বিভেদ কমিয়ে আনা, সুকৌশলে ‘মন্দির রাজনীতি’কে সামনে নিয়ে এসে মোদি এখন নতুন এক ভারতকে গড়তে চাচ্ছেন! এ ক্ষেত্রে উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথকে বেছে নিলেন তাঁর অন্যতম সঙ্গী হিসেবে। বলা হয়, উত্তর প্রদেশ হচ্ছে ক্ষমতার ‘কেন্দ্রীয় মঞ্চ’। এখানে যে রাজনৈতিক দল জয়লাভ করে, দিল্লি তার দখলে চলে আসে। উত্তর প্রদেশ ‘দখল’ করে মোদি সেই মেসেজটিই দিলেন।
Daily Kalerkontho
30.03.2017

ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্কে উদ্বেগ থাকতে নেই


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ৭ এপ্রিল ভারত সফরে যাচ্ছেন। এ সফর নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে যথেষ্ট আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। এই সফর অনেক আগেই অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দু’দুবার তারিখ নির্ধারিত হলেও তা পিছিয়ে গিয়েছিল। এটা হবে মূলত প্রধানমন্ত্রীর ফিরতি ভারত সফর। ২০১৫ সালের মে মাসে ভাতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এসেছিলেন। এখন ফিরতি সফরে প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লি যাচ্ছেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির আলোকে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে দু’দেশের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হয়েছে খুব বেশি।

এবারে শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফর নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। তিনি নয়াদিল্লি সফরে যাচ্ছেন এমন একটি সময়ে যখন বাংলাদেশ তার নৌবাহিনীতে দুটি সাবমেরিন সংযাজন করেছে। এই সাবমেরিন সংযোজন নিয়ে ভারতে এক ধরনের ‘অসন্তোষ’ আছে। বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের সময় ভারত থেকে অস্ত্র ক্রয় ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সম্পর্কে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে। যদিও কোনো পক্ষ থেকেই বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়নি। অতিসম্প্রতি ভারতের হাইকমিশনার পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সফরসূচি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, এই সফরে ‘কানেকটিভিটি’ প্রাধান্য পাবে। কিন্তু প্রতিরক্ষা সহযোগিতা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের ব্যাপারে তিনি কোনো কথা বলেননি। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রাধিকার তালিকায় থাকলেও এবার তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না- এটা মোটামুটি নিশ্চিত হওয়া গেছে। একটি পারমাণবিক সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিও স্বাক্ষরিত হবে। এতে করে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে ভারতের কারিগরি সহযোগিতা নিশ্চিত হবে। বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পটিও আছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি ধরে রাখার জন্য এই গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্পটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে দুটি চীনা কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলারের এ প্রকল্পে জাপানও আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে ভারতের সম্মতি ও আর্থিক সহযোগিতা না পেলে গঙ্গা ব্যারাজ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না।

এখনই এ সফরের মূল্যায়ন করা যাবে না। কেননা এখনও স্পষ্ট হয়নি প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে কয়টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। এ সফরের মধ্য দিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে বটে; কিন্তু প্রশ্ন যে থাকবে না, তা নয়। তবে শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য এখানেই, তিনি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন।

শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানি বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি হয়েছিল। যদিও তার আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তার আমলে সার্কের ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, যদিও তা কার্যকর হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য আমদানি বাড়ে ৩ গুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পরপর কয়েকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা প্রশংসিত হয়। তার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিবিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একই সঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিও (হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাসিসটেন্স নিড্স অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তিনি তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ এ সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে ৮টি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও বাংলাদেশ এই বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ দুটি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমসটেকে যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে (ইসলামবাদ, মার্চ, ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামী বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এবং ২০১৪ সালের সবশেষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি এখনও সরকার পরিচালনা করছেন।

শেখ হাসিনা সরকারের সময় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং ইতিমধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে, যদিও ট্রানজিট ‘ফি’ নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপাক্ষিকতার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেছে, ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করছে, ভুটান বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারতের এ দুটো দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু ইতিমধ্যে এই সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে- এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তাও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে করে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশী পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খেতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘সাতবোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে তাও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এই ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছিল তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি।

গত ৭ বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর (২০১৫) করে দু’দেশের সম্পর্ককে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার আমলে ঐতিহাসিক ছিটহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। ছিটমহলগুলোতে বসবাসরত (ভারতের ১১১টি, বাংলাদেশের ৫১টি) নাগরিকরা স্বেচ্ছায় নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছেন। কিন্তু তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে যে সমস্যা তা রয়ে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ থাকলেও শুধু মমতা ব্যানার্জির কারণে এই চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। মোদির ঢাকা সফরের সময় নতুন আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, নেপাল) আত্মপ্রকাশ করলেও এ নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। সার্ক কার্যত অকার্যকর হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না। ট্যারিফ-প্যারাট্যারিফ কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে বটে; কিন্তু আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। বিবিআইএন জোটের একটি বিশাল সম্ভাবনা থাকলেও অভিযোগ উঠেছে ভারত এটিকে দেখছে তার স্বার্থে। ফলে বাংলাদেশে ভারতকে নিয়ে বিদ্যমান উদ্বেগ কমছে না। প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর এ উদ্বেগ কতটুকু কমাতে পারে সেটা দেখার বিষয়।

প্রতিটি দেশই তার জাতীয় স্বার্থের আলোকে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। ভারতও তাই করবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করতে পারি না। সুতরাং ভারতের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বাংলাদেশ অনেকগুলো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে পারে। এক. যেহেতু ভারতেও পানি সংকট আছে, সে কারণে অববাহিকার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। এতে করে পানির সুষ্ঠু ব্যবহার সম্ভব হবে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, আগামীতে পানি সমস্যা একটা ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। চীন ব্রহ্মপুত্রের উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি তিব্বতে। ব্রহ্মপুত্র নদটি তিব্বত থেকে অরুণাচল ও আসাম হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ব্রহ্মপুত্রের চীনা নাম হচ্ছে Yarlung Zangbo। এই নদীর উপশাখা Xiabuquতে চীন Lalho Hydroelectric Project করেছে। এতে চীন সরকার ব্যয় করছে ৭৪০ মিলিন ডলার। এই প্রজেক্টে বিশাল এক এলাকা নিয়ে একটি রিজার্ভিয়ার গড়ে তোলা হচ্ছে, যা শেষ হবে ২০১৯ সালে। এই রিজার্ভিয়ারে ২৯৫ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি ধরে রাখা হবে। এর মাধ্যমে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ কাজ করা হবে। একইসঙ্গে বছরে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনাও রয়েছে ভারতের। ফলে ভারতের জন্যও একটি সংকট তৈরি হচ্ছে। এটা সমাধানের জন্য এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। মনে রাখতে হবে পানি নিয়ে এশিয়ায় যুদ্ধ হতে পারে- এমন আশংকাও ব্যক্ত করা হচ্ছে।

দুই. সাফটার কার্যকারিতা স্থগিত হয়ে গেছে। সফটা বা দক্ষিণ এশিয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০০৬ সালে। এখন ট্রেড লিবারেলাইজেশন প্রোগ্রামের কার্যকারিতার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় কার্যত সাফটা এখন অকার্যকর। বাংলাদেশী পণ্যের ভারতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে এটা কোনো ভালো খবর নয়।

তিন. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে তার চীন সফরের সময় বিসিআইএম (বাংলাদেশ, চীন, ভারত, মিয়ানমার) অর্থনৈতিক করিডোরের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এই অর্থনৈতিক করিডোর চীনের ইউনান রাজ্যের কুনমিংয়ের সঙ্গে কক্সবাজারকে সংযুক্ত করবে। চীন যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে, তাতে যে ৬টি অর্থনৈতিক করিডোর রয়েছে, বিসিআইএম করিডোর তার একটি। ক্রমবর্ধমান ভারত-চীন দ্বন্দ্বে প্রস্তাবিত বিসিআইএম করিডোর এখন কাগজ-কলমে থেকে যেতে পারে! এতে করে বাংলাদেশের স্বার্থও ক্ষুণ্ণ হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় বিষয়টি আলোচিত হতে পারে। এই বিসিআইএম করিডোরের সঙ্গে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের প্রশ্নটিও পরোক্ষভাবে জড়িত। একসময় বাংলাদেশ উদ্যোগ নিলেও তা এখন পরিত্যক্ত। বাংলাদেশ এখন পটুয়াখালীর পায়রাতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। ভারতীয় একটি কোম্পানি এটি করছে। চীন এ প্রকল্পেও জড়িত হতে চায়। এতে ভারতের সম্মতি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

চার. ভারতের দুটি মহাপরিকল্পনার ব্যাপারে বাংলাদেশের উদ্বেগ রয়েছে। এই দুটি মহাপরিকল্পনা হচ্ছে আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প ও টিপাইমুখ বাঁধ। মোদির ঢাকা সফরের সময় যৌথ ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল, ভারত এমন কিছু করবে না যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। অথচ গত ১৬ জুলাই (২০১৬) বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকায় বিবিসি বাংলার উদ্ধৃতি দিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, ভারতে নদী সংযোগের বিতর্কিত পরিকল্পনার আওতায় এবার মানস-সংকোস-তিস্তা-গঙ্গাকে যুক্ত করার প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাবে বলে ঘোষণা করেছে সেদেশের সরকার। এটা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের পানিশূন্যতার মধ্যে পড়বে। অথচ এই সিদ্ধান্ত যৌথ ঘোষণার ২১ দফার পরিপন্থী। একই কথা প্রযোজ্য টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের ব্যাপারেও। ভারত এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। এ ধরনের মহাপরিকল্পনা আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫নং অনুচ্ছেদ, ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতি এবং রামসার কনভেনশনের বরখেলাপ। এমনকি ১৯৯৬ সালের গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির ৯ অনুচ্ছেদেরও বরখেলাপের শামিল। বাংলাদেশের জনগণের এ সংক্রান্ত উৎকণ্ঠা প্রধানমন্ত্রী তার নয়াদিল্লি সফরে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে শেয়ার করতে পারেন।

ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে ভারতের অবস্থান ২ দশমিক ৮ ভাগ হলেও (২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলার) ২০৫০ সালে ভারত হবে দ্বিতীয় অর্থনীতির (চীন প্রথম, যুক্তরাষ্ট্র তৃতীয়) দেশ। প্রাইসওয়াটারহাউস কুপার্স তাদের এক গবেষণায় আমাদের এ তথ্য দিয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স বা ইতালির অবস্থান হবে ভারতের অনেক নিচে। তাই সঙ্গত কারণেই ভারতের অর্থনীতি থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। কিন্তু সম্পর্ক যেন হয় সমতার ভিত্তিতে, যা জাতিসংঘের চার্টারে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর সফল হোক, আমাদের প্রত্যাশা এটাই।
Daily Jugantor
30.03.2017

‘আমাদের সময়’ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা



নতুন ধারার সংবাদপত্র ‘আমাদের সময়’ ত্রয়োদশ বর্ষে পা রাখছে। বারো বছর ধরে নতুন ধারার এই দৈনিকটি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা তথা সংবাদপত্রের উন্নয়নে নিরলসভাবে কাজ করে আসছে। বলা যেতে পারে, সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের সময় সংবাদপত্র কমিউনিটিকে এক করতে পেরেছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর আমাদের সময় যেন পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে যদি আমরা কথা বলি, তা হলে একটি কথা আমাদের বলতেই হয়, তুলনামূলক বিচারে অনেক উন্নয়নশীল বিশ্বের গণমাধ্যমের চেয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যম বেশ স্বাধীন। সরাসরি সরকারি নিয়ন্ত্রণ এখানে তেমন একটা নেই বললেই চলে, যা কিনা মিসরের মতো দেশেও আছে। সরকারের সমালোচনা করে এখানে নিবন্ধ সংবাদপত্রে ছাপা হচ্ছে নিয়মিত। টিভির ‘টক শো’গুলোয়ও সরকারের মৃদু সমালোচনা করা হয়। তবে এটা বলতেই হবে, গণমাধ্যমে করপোরেট হাউসগুলোর বিনিয়োগ বাড়ছে। বিনিয়োগ বাড়ার কারণে তাদের একটা ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকতে পারেÑ এটাই স্বাভাবিক। এটা ভালো কি মন্দ তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে মিডিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মীরা একদমই ছাড় দেন না। তারা বলতে দেন। এমনটাই হওয়া উচিত। চীনের মহান নেতা মাও জে ডং একবার বলেছিলেন, ‘শত ফুল ফুটতে দাও।’ অর্থাৎ অনেক মত থাকুক। অনেক বক্তব্য থাকুক। মানুষ আসল সত্যটি সেখান থেকে বের করে নেবে। বাংলাদেশে এখন অনেক দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। প্রায় সতেরো কোটি জনসংখ্যার এই দেশে এখন প্রায় প্রতিটি জেলা শহর থেকে নিয়মিত দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হচ্ছে। দেশে ইলেকট্রনিক টিভি চ্যানেলের সংখ্যা এখন ২৪টি। আগামীতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে। অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্রও আছে বেশ কয়েকটি। এসব অনলাইনভিত্তিক সংবাদপত্রের পাঠকপ্রিয়তাও আছে। যদিও সংবাদপত্রের পাঠক খুব বেড়েছে বলে মনে হয় না। নতুন নতুন সংবাদপত্র বাজারে এলেও নতুন পাঠকদের তারা আকৃষ্ট করতে পারছে না। তুলনামূলক বিচারে সংবাদভিত্তিক টিভি চ্যানেলগুলোর আকর্ষণ বাড়ছে। সংবাদও যে বিনোদন দিতে পারে, তা টিভি চ্যানেলগুলো প্রমাণ করছে। আমাদের সংবিধানের ৩৯ (১) ও ৩৯ (২) ধারায় যে ‘ভাব প্রকাশের’ স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে, তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটেছে টিভি টক শোগুলোয়। সাধারণ মানুষের অনেক কথা সেখানে প্রতিফলিত হচ্ছে। টিভি টক শোগুলোর জনপ্রিয়তার একটা কারণ হচ্ছে, মানুষ ‘সত্য’ জানতে চায়। জাতীয় সংসদ যদি সত্যিকার অর্থে কার্যকর থাকত তা হলে মানুষ এই টক শোগুলোয় আকৃষ্ট হতো না। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে জাতীয় সংসদে কমই আলোচনা হয়। টিভি টক শোগুলোয় বিষয়ভিত্তিক আলোচনা হয়। এখানে সরকারের সমালোচনার পাশাপাশি সরকারের করণীয়ও উচ্চারিত হয়। অর্থাৎ এক ধরনের দিকনির্দেশনা থাকে, যে দিকনির্দেশনা বিটিভিতে খুঁজে পায় না দর্শক। সে কারণে বিটিভির জনপ্রিয়তা এখন সর্বনিম্নে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা অতীতে এবং বর্তমানে বিটিভিকে ব্যবহার করছেন একটি ‘সরকারি প্রতিষ্ঠান’রূপে। একটি গণমাধ্যমের যে আলাদা বৈশিষ্ট্য থাকে তা বিটিভিতে নেই। ফলে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো এখন সব আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
স্বাধীন গণমাধ্যমের কথা শুধু আমাদের সংবিধানেই যে আছে, তা নয়। বরং আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্যও এটা প্রয়োজন। ডড়ষভমধহম ঝপযঁষু, চবমমু ঠধষপশব, কৎরংঃরহব ওৎরড়হ সম্পাদিত একটি গ্রন্থ রয়েছে, যেখানে বিভিন্ন প্রসঙ্গে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, স্বাধীন গণমাধ্যম ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বইটির নাম হচ্ছে ঞযব ওহফবঢ়বহফবহপব ড়ভ ঃযব গবফরধ ধহফ রঃং জবমঁষধঃড়ৎু অমবহপরবং : ঝযবফফরহম ঘবি খরমযঃ ড়হ ঋড়ৎসধষ ড়ভ অপঃঁধষ ওহফবঢ়বহফবহপব অমধরহংঃ ঃযব ঘধঃরড়হধষ ঈড়হঃবীঃ (২০১৩). ওই গ্রন্থে সম্পাদকত্রয় স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘গবফরধ রহফবঢ়বহফবহপব রং ারঃধষ ভড়ৎ ফবসড়পৎধপু ধহফ ংড় রং ঃযব ৎবমঁষধঃড়ৎু নড়ফরবং মড়াবৎহরহম রঃ.’ এটাই আসল কথা। গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন গণমাধ্যম দরকার। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়েছিল, সেখানে একটি ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল। সেখানে সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতি’তে শোষণমুক্ত একটি সমাজের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার দীর্ঘ পথযাত্রায় গণতন্ত্রের ‘উত্থান-পতন’ হয়েছে। গণতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আবার ফিরে এসেছে ‘মূলধারায়’। তাই গণতন্ত্রকে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতাটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই স্বাধীনতা না থাকলে গণতন্ত্র যেমনি বিকশিত হবে না, ঠিক তেমনি সমাজে যে বৈষম্য, যে কূপম-ূকতা তা রোধ করা যাবে না। করপোরেট হাউসগুলো, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো মিডিয়ায় বিনিয়োগ করছেÑ এটা ভালো দিক। কিন্তু মিডিয়াগুলো যেন ব্যবসায়িক স্বার্থে পরিচালিত না হয় তা দেখা দরকার। এ ক্ষেত্রে যদি কোনো নীতিমালা না থাকে তা হলে নীতিমালা করা প্রয়োজন। মিডিয়া কোনো বিশেষ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের হতে পারে। তার একটি ভালো দিকও আছে। মিডিয়ার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ থাকাও কাম্য নয়। কিন্তু তাই বলে মিডিয়া ‘বিভ্রান্তকর, অসত্য সংবাদ’ পরিবেশন করে সরকারকে একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করাবে, এটিও সমর্থনযোগ্য নয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, দেশরক্ষা বাহিনী সম্পর্কে যে কোনো সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে ‘বিশেষ সতর্কতা’ অবলম্বন করা প্রয়োজন। মিডিয়াকে হতে হবে সরকারের ‘বন্ধু’, সহযোগী কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। সরকারের ভেতরকার অদক্ষতা কিংবা ভুল নীতিগুলোকে শুদ্ধ করার দায়িত্ব মিডিয়ার। মিডিয়ার কর্মকর্তারা রাজনৈতিকভাবে সচেতন হবেন। কিন্তু তার ব্যক্তিগত মতাদর্শ মিডিয়ায় প্রতিফলিত হলে স্বাধীন মিডিয়ার জন্য তা হবে ক্ষতিকর। সরকারি ক্রয় আইন, বিজ্ঞাপন নীতিমালা না মেনেই সংবাদপত্রের জন্য দরপত্র, ক্রয় বিজ্ঞপ্তির বিজ্ঞাপনের আকার ক্ষুদ্রতর করা হচ্ছে। এর ফলে সংবাদপত্রের আয় নেমেছে সিকিভাগে। এটা ভালো নয় এবং তা সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য হুমকি। সংবাদপত্র যদি বেঁচে না থাকে তা হলে গণতন্ত্র থাকবে ঝুঁকির মাঝে। স্বাধীন গণমাধ্যম হচ্ছে ‘ছাঁকনি’র মতো, যারা সমাজ, রাষ্ট্রের খারাপ দিকগুলো পরিষ্কার করে সমাজ তথা রাষ্ট্রকে সঠিক পথে চলতে সাহায্য করে।
অস্ট্রেলিয়ার সমাজবিজ্ঞানী অষবী ঈধৎবু একুশ শতকের জন্য যে তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে গণতন্ত্রের বিকাশ। অর্থাৎ পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশই ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে। যদিও প্রতিটি দেশেই নিজস্ব সংস্কৃতির আলোকে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে গণতন্ত্র বিনির্মাণে ভিন্নতা থাকলেও একটা মিল সর্বত্র খুঁজে পাওয়া যায়। আর তা হচ্ছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। সিঙ্গাপুরের মতো ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’র দেশেও সংবাদপত্র স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে। বাংলাদেশে বিকাশমান গণতন্ত্রের স্বার্থেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা তাই অত্যন্ত জরুরি। এই ‘স্বাধীনতা’ যদি নিশ্চিত না হয়, তা হলে গণতন্ত্রের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। সমাজে অসঙ্গতি বাড়বে। অপশক্তি শক্তিশালী হবে। গণতন্ত্রে ‘কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস’ বা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করাটা জরুরি। সমাজে বিভিন্ন মত থাকবে, বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ দলগুলো লালন করবে। এ ক্ষেত্রে দলগুলোর মধ্যে সহাবস্থান প্রয়োজন। আর গণমাধ্যম এ ক্ষেত্রে একটি ‘যোগসূত্র’ হিসেবে কাজ করতে পারে। একুশ শতকের শুরুতে যেখানে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে, সেখানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শুধু কাম্যই নয়, বরং উন্নত সমাজ গঠনের জন্য তা রক্ষাকবচও বটে।
আমাদের সময়-এর বর্ষপূর্তিতে এসে এই কথাগুলো বারবার মনে পড়ে গেল। আমাদের সময়ের দায়িত্বটি তাই বেশি। যেতে হবে অনেক দূর। সামনের সময়গুলো খুব মসৃণ নয়। অনেক সমস্যা, অনেক সংকট আমাদের যাত্রাপথে বিঘœ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা যেন থমকে না যাই। আমাদের সময় যেন আমাদের সাহস জোগায়। আমাদের সময় যেন আমাদের সাহসী করে। আমরা সাহসী মানুষ হতে চাই।
Daily Amader Somoy
29.03.2017

ভারতীয় নীতিতে পরিবর্তন আসবে কতটুকু?


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর প্রাক্কালে যে বিষয়টি এখন বেশি করে আলোচিত হচ্ছে তা হচ্ছে, এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতীয় নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা? ৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তার সফর শুরু করবেন। থাকবেন চার দিন। দুইটি দেশের মাঝে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পররাষ্ট্রনীতির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ অর্থাৎ পার্শ্ববর্তী দেশই হচ্ছে তার প্রথম অগ্রাধিকার। তিনি তার শাসনকাল শুরু করেছিলেন ভুটান সফর করে। এরপর পর্যায়ক্রমে তিনি প্রতিটি সার্কভুক্ত দেশ সফর করেছেন। তবে বাংলাদেশে এসেছিলেন অনেক পরে ২০১৫ সালে। তবে দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ কিছু অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তালিকায় যেসব বিষয় রয়েছে, তার সমাধান হয়নি। এক্ষেত্রে ভারতের নীতিনির্ধারকদের মানসিকতাকে দায়ী করা হয়। অভিযোগ উঠেছে, সমমর্যাদার ভিত্তিতে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক গড়ে উঠছে না। এক্ষেত্রে ভারতের প্রাপ্তিটা বেশি, বাংলাদেশের কম।
আমরা এখনও নিশ্চিত নই এবং কোনো পক্ষ থেকেই এটা স্পষ্ট করে বলা হয়নি ক’টি চুক্তি বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে। তবে সংবাদপত্রে এসেছে প্রতিরক্ষাসহ ৪৯টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের কথা। কিন্তু বাংলাদেশের যেখানে অগ্রাধিকার বেশি, সেই তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের আগে মমতা ব্যানার্জি কলকাতার এক টিভি চ্যানেলকে জানিয়েছেন, এবার তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। আগামীতে যদি তিস্তা চুক্তি হয়ও তাহলে পশ্চিম বাংলার স্বার্থ সেখানে থাকবে বেশি, এটা জানাতেও তিনি ভোলেননি। ফলে ধরেই নেয়া যায়, তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না। বেশ ক’টি প্রতিরক্ষা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হবে বলে পত্রপত্রিকাগুলো আভাস দিচ্ছে। এর আওতায় ভারতে প্রশিক্ষণ ও ভারত থেকে অস্ত্র কেনার কথাও বলা হচ্ছে। সমুদ্রে যৌথ টহল, মহাকাশ প্রযুক্তিতে সহায়তা, দুর্যোগ ও ত্রাণবিষয়ক প্রশিক্ষণ সহযোগিতা স্মারকও স্বাক্ষরিত হবে। ফলে এসব ক্ষেত্রে সহযোগিতার ধরন নিয়ে প্রশ্ন তোলা অর্থহীন। ভারত থেকে অস্ত্র ক্রয়ের বিষয়টি যদি সেনা নেতৃত্ব মেনে নেয়, এখানে সাধারণ মানুষের বলার কিছু থাকতে পারে না। আমাদের স্বার্থই হলো আসল। আমরা অনেক দেশ থেকেই অস্ত্র কিনি। ভারত থেকেও কিনতে পারি। তবে আমাদের দেখতে হবে, এতে আমাদের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে এবং ভারতের উদ্দেশ্য এতে সৎ কিনা। ভারত আমাদের বড় প্রতিবেশী। আমাদের উন্নয়নে ভারতের প্রয়োজন রয়েছে।
তবে যারা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ সম্পর্কেও ধারণা রাখেন। এ ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, এ অঞ্চলে ভারতের ভূমিকা স্বীকার করে নিতে এ অঞ্চলের দেশগুলোকে বাধ্য করা। এটা একটা ধারণামাত্র। এ ধারণা ভারতের নীতিনির্ধারকরা যেমনি মনে করেন, ঠিক তেমনি অনেক ভারতীয় বিশ্লেষকও তা মনে করেন। এক্ষেত্রে ভারতের কেন্দ্রে সরকার পরিবর্তন হলেও, এ নীতি ও আদর্শের কোনো পরিবর্তন হয়নি। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে দুইটি সাবমেরিন সংযোজিত হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় বিশ্লেষকরা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে করে এ ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ কথাটিই আবার আমাদের মনে করিয়ে দিল। ভারতের বিশ্লেষকদের প্রতিক্রিয়া দেখে এটা মনে হয়েছে যে, তারা চান না বাংলাদেশ নৌবাহিনী শক্তিশালী হোক। কোনো কোনো বিশ্লেষক এমন কথাও বলেছেন, ভারতের উচিত এখন বাংলাদেশ সীমান্তে মিসাইল ব্যাটারি বসানো এবং নতুন নতুন নৌঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করা। এই সাবমেরিন সংগ্রহের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী তাদের আধুনিকায়ন প্রক্রিয়া শুরু করলেও ভারতের বিশ্লেষকদের কেউ কেউ এটাকে ‘অ্যাক্ট অব প্রোভোকেশন’ হিসেবে দেখছে। চীন এই সাবমেরিন সরবরাহ করে ‘ভারতকে ঘিরে ফেলার’ চিন্তা করছে, এমন মন্তব্যও আছে ভারতীয় বিশ্লেষকদের মধ্যে। অথচ এর সঙ্গে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। বাংলাদেশের নৌবাহিনী ভারতীয় নৌবাহিনীকে, যাদের রয়েছে ১৫টি সাবমেরিন (যার মাঝে একটি আবার পারমাণবিক শক্তিচালিত), চ্যালেঞ্জ করার আদৌ কোনো ক্ষমতা রাখে না। সে কারণেই যে প্রশ্নটি এসে যায়, তা হচ্ছে ভারতীয় মানসিকতার। ভারতীয় নীতিনির্ধারক তথা বিশ্লেষকরা চান না পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সশস্ত্র বাহিনী শক্তিশালী হোক।
আসলেও জওহরলাল নেহরুও স্বপ্ন দেখেছিলেন ভারতকে একটি বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে দেখার। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের পরই চতুর্থ বৃহৎ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতকে কল্পনা করেছিলেন। পরে ভারতীয় বিশ্লেষকদের অনেকেই এ ধারণাটি শুধু এগিয়ে নিয়েই যাননি বরং সরাসরি মন্তব্য করেছিলেন এ অঞ্চলে অন্য কোনো শক্তির কর্তৃত্ব ভারত সহ্য করে নেবে না। এ অঞ্চলের দেশগুলোকে ভারতকে ‘মান্য’ করতে হবে। এখানে আমরা রক্ষণশীল বিশ্লেষক তথা স্ট্রাটেজিস্ট হিসেবে সুব্রামনিয়াম, বলদেব রাজ, ভবানী সেনগুপ্তের অথবা নিহাল সিংয়ের মন্তব্যগুলো উল্লেখ করতে পারি। সুব্রামনিয়াম তার একটি লেখায় ১৯৭২ সালেই উল্লেখ করেছিলেন, ‘বাংলাদেশে নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার প্রশ্নটি সরাসরি ভারতের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত।’ তার ভাষায় ভারতই এ অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে (Economic of Political weekly, 6 may 1972) ৬ সধু ১৯৭২)। ভবানী সেনগুপ্ত তার The India Doctrine (India Today, 31 August, 1983) নামে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত প্রবন্ধে স্পষ্ট করেই বলেছিলেন, ‘এ অঞ্চলে অন্য কেউ কর্তৃত্ব করুক, এটা ভারত চাইবে না।’ এ অঞ্চলের সব ‘নিরাপত্তা’ দেবে ভারত। আমরা যদি ভারতীয় নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে রাজীব গান্ধী থেকে শুরু করে অতি সম্প্রতি সুষমা স্বরাজের বক্তব্য বিশ্লেষণ করি, তাতে একই সুর আমরা খুঁজে পাব। রাজীব গান্ধী শ্রীলঙ্কার সঙ্গে চুক্তি করেছিলেন (জুলাই, ১৯৮৭)। উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ অন্য কোনো দেশ যাতে শ্রীলঙ্কায় ‘নাক’ গলাতে না পারে। পরে নির্বাচনে চীনাপন্থী প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে হেরে গিয়েছিলেন, কারণ তিনি ছিলেন কিছুটা চীনঘেঁষা এবং অভিযোগ ছিল হাম্বানতোতা গভীর সমুদ্রবন্দরে চীনা সাবমেরিন ঘাঁটি গেড়েছিল। ভুবনেশ্বরে (উড়িষ্যা) ইন্ডিয়ান ওসেন রিম’র এক সম্মেলন হয়েছিল ২০১৫ সালের মার্চে। ওই অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বলেছিলেন, ভারত এ অঞ্চলে চীনের উপস্থিতি সহ্য করবে না। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। ভারত চায় না চীন এ অঞ্চলে তার প্রভাব বাড়াক। বাংলাদেশের সাবমেরিন সংগ্রহের সঙ্গে এ প্রশ্নটি জড়িত। ভারতের উৎকণ্ঠা আছে। ২০১৬ সালের ১৪ নভেম্বর এ সবামেরিন দুইটি বাংলাদেশের কাছে সরবরাহ করা হয়েছিল। এর ঠিক দুই সপ্তাহের মাথায় ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিকর বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেটা ছিল কোনো ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। তবে একটা বিষয় আমার কাছে এখনও অস্পষ্ট। বাংলাদেশ এই সাবমেরিন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সম্ভবত ২০১৪ সালে। প্রায় ১ বছরের ওপরে বাংলাদেশী নাবিক ও কমান্ডিং অফিসাররা চীনে প্রশিক্ষণে ছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তা অজানা নয়। এখন ভারতীয় সরকার কিংবা বিশ্লেষকরা যেভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা শুধু অনাকাক্সিক্ষতই নয়, বরং তা দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের অনাস্থা সৃষ্টি করতে পারে। একজন ভারতীয় নেভির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদপত্রে এর প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ভারত প্রয়োজনে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্র সীমানাবর্তী ভারতীয় এলাকায় মিসাইল ব্যাটারি বসাবে! নতুন নৌঘাঁটি করার কথাও তিনি বলেছেন। বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আছে কিনা জানি না; কিন্তু এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত (?) দুই দেশেরর বন্ধুত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার শামিল। সংবাদপত্রে (ভারতীয়) বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক একজন হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর একটি বক্তব্য দেখলাম। তিনি এটাকে ‘অর্থের অপচয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ভারতীয় কর্মকর্তা তথা নীতিনির্ধারকদের মাঝে একধরনের ‘নিচু মানসিকতা’ কাজ করে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে ‘একধরনের কর্তৃত্বে’র মধ্যে রাখতে চায় ভারত, যাকেই কিনা বিশ্লেষকরা ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই যে মানসিকতা, তাতে কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বর্তমান বিজেপি সরকারের কোনো পার্থক্য নেই।
ভারত বড় অর্থনীতিতের দেশ। বিশ্ব অর্থনীতিতে বর্তমানে ভারতের অবস্থান ২ দশমিক ৮ ভাগ হলেও ২০৫০ সালে ভারত হবে দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশ। তখন চীন থাকবে প্রথম অবস্থানে, আর যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হবে তৃতীয়। আমাদের সৌভাগ্য যে দুইটি বড় অর্থনীতির দেশই আমাদের প্রতিবেশী। চীন আমাদের নিকট প্রতিবেশী হলেও ভারত আমাদের প্রতিবেশী। সুতরাং আমাদের উন্নয়নে এ দুইটি দেশের সাহায্য ও সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পররাষ্ট্রনীতিতে তাই এ দুইটি দেশকেই তিনি প্রাধান্য দিচ্ছেন। তিনি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছেন। তিনি চীনে গিয়েছিলেন ২০১৪ সালে। চীনা প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৬ সালে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০১৫ সালে। এখন প্রধানমন্ত্রী ভারতে যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন। সুতরাং ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে তিনি ভারতের সহযোগিতা চাইবেন। চীনের দুইটি কোম্পানি এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন যদি ভারতের সম্মতি পাওয়া যায় আমরা পদ্মা সেতুর মতোই গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করতে পারব। আর এতে করে বর্ষা মৌসুমে পানি ধরে রাখতে পারব, যা আমরা শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহার করতে পারব। পানি সংকট রয়েছে ভারতেরও। তাই এ অঞ্চলের সব দেশের সমন্বয়ে যদি একটি পানি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা যায়, তা আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল। বাংলাদেশে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। এ বিদ্যুৎ চাহিদা উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে সমাধান সম্ভব। এক্ষেত্রে ভুটান ও নেপালে বিপুল জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ এ দুইটি দেশে এ খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আনতে হলে ভারতীয় এলাকার ওপর দিয়ে আনতে হবে। তখন প্রয়োজন হবে ভারতের সহযোগিতার। এক্ষেত্রে ভারত যদি রাজি না হয়, তাহলে সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে।
এজন্যই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। আমাদের উন্নয়নে ভারত আমাদের অংশীদার হোক, পরবর্তী ১১টি শিল্পোন্নত দেশের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে ভারত আমাদের সাহায্য করুকÑ আমরা এমনটা চাই। কিন্তু ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা যদি নিজেদের স্বার্থে বিষয়গুলোকে দেখেন, তাহলে এ সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
Daily Alokito Bangladesh
28.03.2017

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর ও আমাদের জাতীয় স্বার্থ

প্রধানমন্ত্রী ভারতে যাচ্ছেন আগামী ৭ এপ্রিল। কিন্তু ইতোমধ্যে এই সফর নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশে ব্যাপক আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে। এই আগ্রহের কারণ প্রধানত দুটি। প্রথমত, বাংলাদেশ চীন থেকে দুটো সাবমেরিন পেয়েছে এবং তা বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে সংযোজিত হয়েছে। এই সাবমেরিন সংযোজন নিয়ে ভারতের উদ্বেগ আছে। গেল নভেম্বরে বাংলাদেশে এসেছিলেন ভারতের সাবেক দেশরক্ষামন্ত্রী মনোহর পরিক্কর। তার বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে ভারত তার অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছিল। এখন প্রধানমন্ত্রীর এই সফর ভারতের অসন্তুষ্টি কতটুকু কমাতে পারবে, সেটি একটা প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে একটি প্রতিরক্ষা সহযোগিতা-সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করবে। এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। এর আওতায় ভারত থেকে ৫০ কোটি ডলারের অস্ত্র ক্রয়ও থাকবে। ভারত থেকে এ খাতে ঋণও পাওয়া যাবে। প্রতিরক্ষা খাতে ভারতের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক ও অস্ত্র ক্রয় বাংলাদেশে ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের স্বার্থ এতে করে কতটুকু রক্ষিত হবে, সেটিই বড় প্রশ্ন এখন। এখানে এটা নিয়ে নানা মত আছে। বাংলাদেশ তার প্রতিরক্ষা বাহিনীর আধুনিকীকরণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র ক্রয় করে। অতীতে চীন ও রাশিয়া থেকে আমরা অস্ত্র ক্রয় করেছি। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ভারতীয় অস্ত্র নিয়ে। আন্তর্জাতিক আসরে অস্ত্র বিক্রিতে ভারতের তেমন নাম নেই। একটি পরিসংখ্যান দিচ্ছি। ২০১০-১৪ সালের যে পরিসংখ্যান পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, বিশ্বে অস্ত্র বিক্রিতে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র (বিশ্বে যা রপ্তানি হয় তার ৩১ ভাগ)। এর পরের অবস্থান রাশিয়ার (শতকরা ২৭ ভাগ)। তৃতীয় অবস্থানে চীন (শতকরা ৫ ভাগ)। জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালি, ইউক্রেন ও ইসরায়েল রয়েছে যথাক্রমে চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম স্থানে। এখানে ভারতের কোনো অবস্থান নেই। অন্যদিকে ভারত নিজে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানি করে (শতকরা ১৫ ভাগ বিশ্বের)। এর পরের অবস্থান সৌদি আরবের, শতকরা ৫ ভাগ। পাকিস্তানের অবস্থান অস্ত্র আমদানিতে পঞ্চম। ভারত যেখানে নিজে অস্ত্র আমদানি করে, সেখানে ভারতীয় অস্ত্র কেনা, অস্ত্রের গুণগতমান ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন থাকা স্বাভাবিক। তবে ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। আমাদের উন্নয়নের জন্য ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের জাতীয় স্বার্থের নিরিখে এই সহযোগিতা প্রয়োজন। আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি, যা নিয়ে প্রশ্নের কোনো শেষ নেই। এই বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন, তাহলে এ দেশ, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানিপ্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তি বা সমর্থনÑ এটা আমাদের বিষয় নয়। আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর গাড়িবাড়ীর কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্দা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত ও ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো চুক্তি হয়নি। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুই দেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এরপর যুক্ত হয়েছিল মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই অতীতে মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি। এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিন দিন। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচকাজের জন্য তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা বরাবরই মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক ইস্যু’। তাই মমতা তিস্তাচুক্তি করে বাংলাদেশের পানিপ্রাপ্তি নিশ্চিত করবেনÑ এটা আমার কখনোই বিশ্বাস হয়নি। তাই মমতায় আস্থা রাখা যায় না। এ ক্ষেত্রে আমাদের যা করণীয়, তা হচ্ছে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে ভারতের ওপর ‘চাপ’ অব্যাহত রাখা। আমরা ভারতের অনেক ‘দাবি’ পূরণ করেছি। মোদির আমলে সীমানা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে দুই দেশের সীমানা এখন চিহ্নিত। দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এটা একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এ ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতির পরও মমতা যদি তার ওপর রাখা আস্থার প্রতিদান না দেন, তাহলে তা যে দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে একটা অবিশ্বাসের জন্ম দেবেÑ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে রুদ্র কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নিতে পারেন, যেখানে পশ্চিমবঙ্গের এই পানি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশকে শতকরা ৫০ ভাগ পানি দেওয়া সম্ভব বলে সুপারিশ করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রণব কুমার রায়ও এই সুপারিশ সমর্থন করেছিলেন। এর ভিত্তিতেই মমতা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে মমতাকে আস্থায় নেওয়া সত্যিকার অর্থেই কঠিন। ঢাকায় আসার আগে আত্রাই প্রসঙ্গটি তুলে তিনি একটি ‘জট’ লাগিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থাৎ আত্রাইয়ের সঙ্গে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি এক করে দেখেছেন। এটি একটি ভিন্ন বিষয়। আত্রাই নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু তিস্তার পানিপ্রাপ্তি আমাদের অগ্রাধিকার। এর সঙ্গে অন্য কোনো ইস্যুকে তুলনা করা যাবে না। বাংলাদেশ সরকারকে দ্রুত তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি সামনে রেখে ভারতের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে। সমুদ্রসীমাও নির্ধারিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক আসরে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমুদ্রসীমা নির্ধারত হয়নি। আজকে প্রয়োজনে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরতে হবে। মমতা ব্যানার্জির ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপর আমাদের দেশের কোটি কোটি মানুষের বেঁচে থাকার বিষয়টি ঝুলে থাকতে পারে না। লাখ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। মমতা ব্যানার্জির দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর বিষয়টি নির্ভর করে না। ভাটির দেশ হিসেবে তিস্তার পানির ন্যায্য অধিকার আমাদের রয়েছে। মমতা ব্যানার্জি এককভাবে পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারেন না। যদি তিনি তা করেন, তাহলে তা হবে আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ক্ষেত্রে মমতাকে নয়, বরং ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর আমাদের চাপ অব্যাহত রাখতে হবে। তবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মমতা বারবার তার ‘অবস্থান’ পরিবর্তন করছেন। সীমান্ত চুক্তিটি তিনি সমর্থন দিয়েছিলেন কেন্দ্র তাকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার পর। এখন তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে একদিকে তিনি ‘রাজনীতি’ করছেন, অন্যদিকে মোদি সরকারকে চাপের মুখে রেখেছেন।
শুধু তিস্তার পানিবণ্টন নিয়েই নয়, বরং টিপাইমুখ বাঁধ, ফুলেরতল বারাজ, শুল্ক ও অশুল্ক বাধা দূর, নাফটা কার্যকর, ভারতগামী বাংলাদেশিদের ভিসা সহজীকরণ, ভারতে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার উন্মুক্ত করা ইত্যাদি নানা সমস্যা রয়েছেÑ যার একটা সুষ্ঠু ‘সমাধান’ প্রয়োজন। তবে অগ্রাধিকার তালিকায় এই মুহূর্তে প্রথমেই রয়েছে তিস্তা। তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমরা চাই এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বারবার ভারতীয় নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, তিস্তাচুক্তি আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা আমাদের ন্যায্য হিস্যা চাই। বর্তমান সরকারের সময় বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। দীর্ঘ ৪০ বছর ছিটমহল সমস্যা দুই দেশের মধ্যে আস্থার সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় জটিলতা সৃষ্টি করেছিল। এখন তা অতীত। ছিটমহল সমস্যার সমাধান হয়েছে। বাংলাদেশ ভারতকে ‘ট্রানজিট’ দিয়েছে। ভারত থেকে আমরা বিদ্যুৎ পাচ্ছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় (২৭ মে ২০১৫) একটি চার দেশীয় উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা (বিবিআইএন) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এখন শুধু তিস্তাচুক্তির কারণে এই সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া যাবে নাÑ এটা হতে পারে না। তাই আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় বাংলাদেশ তিস্তাচুক্তির প্রসঙ্গটি উত্থাপন করবে। এ ব্যাপারে ভারতে একটি জনমত সৃষ্টি করাও জরুরি। ভারতের অগ্রাধিকারের তালিকায় অস্ত্র বিক্রির বিষয়টি থাকতে পারে। এতে করে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে যদি আরও আধুনিকীকরণ করা সম্ভব হয়, তাহলে এ খাতে বাধা থাকার কথা নয়। কিন্তু আমরা চাই আমাদের দাবিগুলোর ব্যাপারে ভারতীয় নেতারা আরও আন্তরিক হবেন। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবস্থান ৭ম। ২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন ডলারের যে অর্থনীতি, তা বিশ্ব জিডিপির ২ দশমিক ৮ ভাগ। কিন্তু ২০৫০ সালের আগেই ভারত বিশ্বে দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে (চীন ১ এবং যুক্তরাষ্ট্র ৩ নম্বরে)। তাই ভারতের এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থেকে আমরাও লাভবান হতে পারি। তবে ভারতকেও এগিয়ে আসতে হবে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য।
Daily Amader Somoy
21.03.2017

গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ছাত্রীদের আন্দোলন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা


ঢাকার গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ছাত্রীরা ঢাকায় একটি মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে গত ১৫ মার্চ। টানা তিনদিন সড়ক অবরোধের পর তারা ওই মহাসমাবেশের ডাক দিল। তাদের দাবি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেককে একটি ইনস্টিটিউট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর আগেও তারা আন্দোলন করেছে। এবারও করল। ছাত্রীদের এই আন্দোলনের একটি বিপক্ষ 'শক্তি' এবার তৈরি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানিয়েছে, আর নিলক্ষেত এলাকার হকাররা এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। যদিও এই দু'পক্ষের অভিমত এক নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা চায় না গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হোক। আর হকারদের অভিমত এতে করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ছাত্রীদের এই আন্দোলন একটি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এলো এখন। যে কোনো 'কলেজ' চাইলেই কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে? আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই বা কেন? ইতিমধ্যে সরকারের অপর একটি সিদ্ধান্তও নানা জটিলতা তৈরি করেছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকার ৭টি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্তির। ইতিমধ্যে গেজেটও প্রকাশিত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এর প্রতিবাদ করেছে। বিষয়গুলো দেখে মনে হচ্ছে সবাই যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চায়। বলতে গেলে আরও স্পষ্ট করে বলা যায় তাদের সবার দরকার একখানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট। আমরা তো ধীরে ধীরে একটি সার্টিফিকেটসর্বস্ব জাতিতে পরিণত হয়েছি। এখানে শিক্ষার, মেধা অর্জন করার প্রচেষ্টা কম। দরকার একখানা সার্টিফিকেট। গার্হস্থ্য অর্থনীতির ছাত্রীদের তো এর প্রয়োজন ছিল না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্তর্ভুক্তি কেন? তারা তো নিজেরাই তাদের কলেজের নামে পরিচিতি পেতে পারে? আমি একজন বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতকে চিনি, যিনি একজন নারী এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ছাত্রী হিসেবে বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের ক্যাডার হিসেবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়েছিলেন এবং রাষ্ট্রদূত হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে অবসর নিয়েছিলেন। তাহলে ওই কলেজের ছাত্রীরা পারবে না কেন? এ জন্য তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হওয়ার প্রয়োজন নেই। এ ধরনের সিদ্ধান্ত ভালো নয় এবং তা নানা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। ইতিমধ্যে সরকারি একটি সিদ্ধান্ত নানা জটিলতা সৃষ্টি করেছে। সিদ্ধান্তটি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সিদ্ধান্তের কথা সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল গত ১৭ ফেব্রুয়ারি। তাতে বলা হয়েছিল রাজধানী ঢাকার সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে। এই কলেজগুলো হচ্ছে ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। গত বৃহস্পতিবার বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে ওই কলেজগুলোর অধ্যক্ষদের একটি যৌথ সভাও হয়। প্রশ্ন হচ্ছে এই অধিভুক্তটি কতটুকু যৌক্তিক? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের একটি বক্তব্যও ছাপা হয়েছে। তাতে তিনি বলেছেন, উচ্চ শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু এতে করে কী আদৌ শিক্ষার মান বৃদ্ধি হবে?
এই সিদ্ধান্তটি ভালো নয় এবং তা শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে আদৌ কোনো সাহায্য করবে না। যতদূর জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য অধ্যাপক মহব্বত খানের নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করেছিল। আর উক্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্তটি নিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অধ্যাপক খান অত্যন্ত গুণী ব্যক্তি। ভালো শিক্ষক। আমরা যখন তার ছাত্র ছিলাম, শিক্ষার মান নিয়ে তিনি কখনো 'কম্প্রোমাইজ' করেননি। কিন্তু যে সিদ্ধান্তটি তিনি দিলেন, তার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের একজন সাবেক সদস্য হিসেবে আমার ধারণা এ সিদ্ধান্ত নানা জটিলতা তৈরি করবে। প্রথমত, ওই সাতটি কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আগামীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয় দেবে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ব্যবহার করবে। এতে করে কী মূল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি করবে না? কেননা ওইসব কলেজে যারা অনার্স বা মাস্টার্স পর্যায়ে পড়াশোনা করছে তাদের অনেকেই এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তারা ভর্তি হতে না পেরে কলেজে ভর্তি হয়েছিল। এখন কীনা তারাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট ব্যবহার করবে। এতে করে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে দু'ধরনের ছাত্র তৈরি হবে এবং ছাত্রদের মেধার ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে। এতে উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধি হবে না। দ্বিতীয়ত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর কলেজগুলোতে পড়াবেন কারা? নিশ্চয়ই ওই কলেজের শিক্ষকরা? পরীক্ষা হবে কোন প্রশ্নপত্রে? নিশ্চয়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৈরি করা প্রশ্নপত্রে এবং পরীক্ষার উত্তরপত্রের মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও একটা সমস্যা তৈরি হবে। কেননা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ছাত্রদের যেভাবে পড়ান, সেভাবেই তারা প্রশ্নপত্র তৈরি করেন। প্রশ্নপত্র মডারেশন হয়। তাতে নিশ্চয়ই ওই কলেজগুলোর শিক্ষকদের অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে না। তাতে করে কী কলেজগুলোর ছাত্ররা এক ধরনের মেধা সংকটের মুখোমুখি হবে না? তারা কী ওই প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়বে না? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র যথেষ্ট মানসম্মত। কলেজগুলোর ছাত্ররা ওই মানসম্মত প্রশ্নে উত্তর দিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়তে পারে। এতে করে তাদের উত্তরপত্রগুলো সঠিকভাবে মূল্যায়িত হবে না। তৃতীয়ত, ওইসব কলেজে কর্মরত শিক্ষকরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির পর তারা কী নিজেদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে দাবি করবেন? যদি করেন, কোন যুক্তিতে তাদের তা প্রত্যাখ্যান করা হবে? শিক্ষকরা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন। তারা কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বিষয়ের ছাত্রছাত্রীদের উত্তরপত্রও মূল্যায়ন করবেন? যদি তারা নিজেদের ছাত্রদের উত্তরপত্র নিজেরা মূল্যায়ন করেন, তাহলে এক ধরনের 'বৈষম্য' তৈরি হবে। নিজেদের ছাত্রদের 'বেশি নাম্বার পাইয়ে দেয়ার' অভিযোগ উঠবে। এতে করে তৈরি হবে অবিশ্বাস। চতুর্থত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির এ ব্যাপারে একটি বক্তব্য থাকা উচিত ছিল। কিন্তু আমার চোখে এ ধরনের কোনো মন্তব্য আমি দেখিনি। একটি সরকারি সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। শিক্ষকদের সাধারণ সভায় বিষয়টি আলোচনা করা উচিত। পঞ্চমত, কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলে সেখানে কর্মরত শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৫তে উন্নীত করতে হবে। এখন তারা সরকারি নিয়মে ৫৯ বছর বয়সে অবসরে যান। এখন এই সাতটি কলেজের শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৬৫তে উন্নীত করলে তা অন্যান্য কলেজগুলোর শিক্ষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েছে? ষষ্ঠত, খুব সঙ্গতকারণেই কলেজগুলোতে বিজ্ঞানবিষয়ক বিষয়গুলোতে 'ল্যাব ফেসিলিটি' কম থাকে। একটি ল্যাব বা বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয় সব সময় বরাদ্দ দিতে পারে না। এখন অধিভুক্তির পর কলেজগুলোর ছাত্ররা যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের 'ল্যাব' সুবিধা চায় তাদের কী এই সুবিধা দেওয়া সম্ভব হবে? যদি দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা কী তা থেকে বঞ্চিত হবে না? উপরন্তু কলেজগুলোর ছাত্রদের এত বেশি সুযোগ-সুবিধা কী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিতে পারবে? সপ্তমত, কলেজগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলে, ওইসব কলেজের অধ্যক্ষদের ভূমিকা কী হবে? তারা কী একাডেমিক কাউন্সিল তথা সিন্ডিকেটের সদস্য হবেন? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তা কী মানবেন? যদি অধ্যক্ষদের কোনো 'ভূমিকা' না থাকে তাহলে একদিকে তাদের মাঝে অসন্তোষ তৈরি হবে, অন্যদিকে প্রশ্ন উঠবে অধ্যক্ষদের রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে। অষ্টমত, ওই সাতটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তের পর, বাকি সরকারি কলেজগুলোতেও মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে। যতদূর জানি প্রায় প্রতিটি সরকারি কলেজকে ধীরে ধীরে এক একটি একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আওতায় নিয়ে আসা হবে। এটি কখনো ভালো সিদ্ধান্ত হতে পারে না। এতে করে নানা জটিলতা তৈরি হবে, যা শিক্ষা মন্ত্রণালয় সামাল দিতে পারবে না।
প্রশ্নটা হচ্ছে শিক্ষার মানোন্নয়ন। যতদূর জানি প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহেই এ ধরনের সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন, এটা আমাদের জন্য ভালো খবর। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক তথ্যটি দেয়া হয়নি বলেই আমার ধারণা। দুঃখ লাগে যখন দেখি শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যে প্রতিষ্ঠানটি, অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, তার কোনো 'ভূমিকা' নেই। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান, আমার অতি প্রিয়জন, তিনি ব্যস্ত আছেন পত্রিকায় কলাম লিখে, তাও আবার অধিকাংশ সময় বিএনপিকে গালাগাল করে। আমি খুশি হতাম যদি তার একটি লেখাও থাকত শিক্ষার মানোন্নয়ন নিয়ে। তিনি তো কিছু উপদেশ বা 'সাজেশন' দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেনি।
শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য তিনি ইতিমধ্যে অনেক দেশ সফর করেছেন। কিন্তু এই অভিন্নতা আমরা কোন কাজে ব্যবহার করতে পারি, তা তিনি আমাদের জানাননি। প্রধানমন্ত্রী উচ্চ শিক্ষা নিয়ে চিন্তা করেন বিধায়, এই সিদ্ধান্তটি হয়েছে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিকগুলো সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীকে অবগত করানো হয়নি। শিক্ষার মানোন্নয়ন দরকার। শিক্ষা বাস্তবায়নের বিবেচনার জন্য তাই কতগুলো প্রস্তাব রাখছি। শিক্ষামন্ত্রী বিষয়গুলো নিয়ে 'উচ্চ মহলের' সঙ্গে কথাবার্তা বলতে পারেন। এক. সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত বাতিল করে ওই কলেজগুলোকে নিয়ে একটি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজেকে এর সাথে সংপৃক্ত করা। দুই. এর বিকল্প হিসেবে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজকে কেন্দ্র করে স্বতন্ত্র আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে বিষয়ভিত্তিক আরও কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। তিন. জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সয়ং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সুতরাং উচ্চ শিক্ষার স্বার্থে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে ভেঙে ৭টি বিভাগে ৭টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হোক, যেখানে সাধারণ শিক্ষার পরিবর্তে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেয়া হবে।
প্রয়োজনে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজকে এর যে কোনো একটি প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। উচ্চ শিক্ষা বিষয়ে ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে। আন্দোলন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্তির যে প্রচেষ্টা, তা কোনো ভালো সংবাদ আমাদের জন্য বয়ে আনবে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সমস্যাগুলোর সমাধানে ব্যস্ত। মঞ্জুরি কমিশনেও যোগ্য লোকের অভাব রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে ভেঙে উচ্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয় গড়ার সময় বোধহয় এসে গেছে।
Daily jai Jai Din21.03.2017

সাবমেরিন ক্রয় নিয়ে এত হৈচৈ কেন?



বাংলাদেশের নৌবাহিনীতে দুটি সাবমেরিন সংযোজিত হয়েছে। ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’ নামে এ দুটি সাবমেরিন সংযোজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নৌবাহিনী একটি ত্রিমাত্রিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হল। এ সাবমেরিন সংযোজন শুধু নৌবাহিনীর জন্যই নয়, বরং আমাদের সবার জন্য একটি গর্বের প্রতীক। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নৌবাহিনী বিশ্বের সেরা নৌশক্তির মাঝে নিজেদের নাম সংযোজন করল। বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তে তিনি যে শুধু দূরদর্শিতারই পরিচয় দিয়েছিলেন তেমনটি নয়, বরং তিনি যে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করতে চান এবং এই বাহিনীকে আরও অনেক দূরে নিয়ে যেতে চান, এটাও প্রমাণ করলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ সিদ্ধান্ত প্রশংসার দাবি রাখে; কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে সাবমেরিন সংযোজনের বিষয়টি ভারতীয় নেতৃত্ব তথা ভারতের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী খুব ভালো চোখে দেখেনি। বাংলাদেশ তার সিদ্ধান্ত নিজেই নেবে। অন্য দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে বাংলাদেশ কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি, নেবেও না। ফলে সাবমেরিন সংযোজনের বিষয়টি একান্তভাবেই আমাদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত। ভারত কেন, চীন বা যুক্তরাষ্ট্রেরও এ ক্ষেত্রে বলার কিছু নেই। আমি ভারতের অনেক বিশ্লেষকের মন্তব্য দেখেছি। ওইসব মন্তব্য একপেশে এবং যার সঙ্গে সত্যের এতটুকু মিল নেই। তারা যেসব আশংকা করছেন, তা সত্য বলে ধরে নেয়া যায় না। ভিভেক রসুভানসি ‘ডিফেন্স নিউজ’-এ একটি প্রবন্ধে (২৩ নভেম্বর, ২০১৬) মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ চীন থেকে যে সাবমেরিন সংগ্রহ করেছে, এর মধ্য দিয়ে চীন বাংলাদেশের মাটিতে শক্ত অবস্থান নেবে এবং বাংলাদেশে তার প্রভাব বাড়াবে। তিনি এমন একটি সম্ভাবনাও দেখছেন যে, এটা ভারতকে ‘ঘিরে ফেলার’ চীনের এক ধরনের পরিকল্পনাও (?) হতে পারে। একজন অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় অ্যাডমিরাল অরুণ প্রকাশ এই সাবমেরিন সংগ্রহকে ‘Act of Provocation’ বা প্ররোচনা বলে অভিহিত করেছেন। এটা ভারতের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ফেলবে এটা তার মত। চীন ভারতকে ঘিরে ফেলার যে স্ট্র্যাটেজি তৈরি করছে, এটা তারই অংশ বলে অ্যাডমিরাল অরুণ বিশ্বাস করেন। ভারতের ন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের পরিচালক নেভির ক্যাপ্টেন গুরপ্রিত খুরানা প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ কেন এ সাবমেরিন সংগ্রহ করল। অন্যদিকে জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরণ সিং আশংকা করছেন, বাংলাদেশের সাবমেরিন সংগ্রহের ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় এক ধরনের ‘অস্ত্র প্রতিযোগিতা’ শুরু হতে পারে। সেন্টার ফর পলিসি রিসার্সের অধ্যাপক ভারত কনরাড এ ধরনের মন্তব্যের সঙ্গে পুরোপুরি একমত না হলেও তিনি বলেছেন, মোদি সরকারকে এখন নিশ্চিত করতে হবে চীন এ থেকে কোনো কৌশলগত সুবিধা নেবে না। বিশ্লেষকদের পাশাপাশি আমি ভারতীয় মিডিয়াতেও নেতিবাচক মন্তব্য দেখেছি। সেখানে যেসব প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে, তার একটির সঙ্গেও বাস্তবতার কোনো মিল নেই। প্রথমত, ভারতকে ‘ঘিরে ফেলার’ তথাকথিত চীনের স্ট্র্যাটেজি সম্পর্কে যে আশংকার কথা বলা হয়েছে, তার পেছনে আদৌ কোনো সত্যতা নেই। কেননা চীনের সঙ্গে মোদি সরকারের সম্পর্ক অনেক ভালো। দেশ দুটো বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের প্রভাব খর্ব করতে ব্রিকস ব্যাংক গঠন করেছে। উপরন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আগ্রাসী নীতির কারণে চীন, ভারত এবং রাশিয়ার অবস্থান এখন এক। সুতরাং চীন ও ভারতের মাঝে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার কোনো কারণ নেই। তবে উভয় দেশেরই নিজস্ব স্বার্থ রয়েছে। সেসব স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়েই দেশ দুটো কাজ করে। উপরন্তু বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় চীনের যে নীতি, তা হচ্ছে আর্থিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। ভারতে চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে। চীনের কোনো দেশকে ‘ঘিরে ফেলার’ নীতি নেই। দ্বিতীয়ত, ‘Act of Provocation’-এর যে কথা বলা হচ্ছে, তা সর্বৈব মিথ্যা। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতা নেই যে ভারতীয় নেভিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। উপরন্তু গত ৪৫ বছরের বৈদেশিক নীতিতে এই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এমন একটি সরকার আছে, যা ‘ভারতবান্ধব’ হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ভারতকে অনেক কিছু দিয়েছে। সেই তুলনায় বাংলাদেশের প্রাপ্তি অনেকটা শূন্য। সুতরাং সাবমেরিন সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে ‘Act of Provocation’-এর কোনো ঘটনা ঘটেনি বা ঘটার সম্ভাবনাও নেই। তৃতীয়ত, কোনো কোনো বিশ্লেষক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এটাও মিথ্যা প্রচারণা। বাংলাদেশের রিজার্ভ, পরবর্তী ১১টি দেশের মাঝে অন্যতম একটি দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়া, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ ভাগের ওপরে রাখা, দারিদ্র্য কমিয়ে আনা প্রমাণ করে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যথেষ্ট স্থিতিশীল। ফলে ২০৩ মিলিয়ন ডলার দিয়ে দুটো সাবমেরিন কেনা বাংলাদেশের জন্য কঠিন কিছু নয়। বাংলাদেশের সেই সক্ষমতা আছে। চতুর্থত, বাংলাদেশে চীনের ঘাঁটি (?) হবে কিংবা চীন বাংলাদেশে ‘শক্ত’ অবস্থানে থাকবে, এটাও অমূলক। বাংলাদেশ আজ নয়, অনেক আগে থেকেই চীন থেকে সামরিক অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনী আধুনিকীরণে এসব অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজন ছিল। এখন এই কাতারে নৌবাহিনী শরিক হল। এটা নতুন কিছু নয়। এতে করে ভারতের সংশয় থাকারও কোনো কারণ নেই। পঞ্চমত, দক্ষিণ এশিয়ায় অস্ত্র প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাবে, এই আশংকাও সত্য নয়। বঙ্গোপসাগরে কিংবা ভারত মহাসাগরে ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। প্রায় ৭৯০২৩ নৌসেনা, ২৯৫টি ছোট-বড় মিলিয়ে যুদ্ধজাহাজ, একটি বিমানবাহী যুদ্ধ জাহাজ, প্রায় ১৫টি সাবমেরিন (যার মাঝে ১টি হচ্ছে পারমাণবিক শক্তিচালিত) নিয়ে ভারতের যে নৌবাহিনী, তা বিশ্বের ৫ম। শুধু তাই নয়, সিসিলি, মরিশাস ও মাদাগাস্কারে রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর ঘাঁটি। সুতরাং বাংলাদেশের নৌবাহিনীর শক্তির সঙ্গে তা কোনোভাবেই তুলনা করা যাবে না। বাংলাদেশের নৌবাহিনী সেই শক্তি রাখেও না। সুতরাং ভারতের যে উৎকণ্ঠা, তার কোনো ভিত্তি নেই। এ কারণেই রাশিয়ান সামরিক বিশ্লেষক ভেসিলি কাসিন মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশের এই সাবমেরিন সংগ্রহ কোনো অবস্থাতেই ভারতের জন্য কোনো ‘হুমকি’ সৃষ্টি করবে না (স্পুটনিক, ৬ ডিসেম্বর ২০১৬)।

তবে ভারতের পক্ষ থেকে এক ধরনের উৎকণ্ঠা যে আছে, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। কেননা গেল বছর ১৪ নভেম্বর এই সাবমেরিন দুটি বাংলাদেশের কাছে সরবরাহ করা হয়েছিল। এর ঠিক দু’সপ্তাহের মাথায় ভারতের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পানিক্কর বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেটা ছিল কোনো ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। তবে একটা বিষয় আমার কাছে এখনও অস্পষ্ট। বাংলাদেশ এই সাবমেরিন কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সম্ভবত ২০১৪ সালে। গত প্রায় এক বছরের ওপরে বাংলাদেশী নাবিক ও কমান্ডিং অফিসাররা চীনে প্রশিক্ষণে ছিলেন। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তা অজানা নয়। এখন ভারতীয় সরকার কিংবা বিশ্লেষকরা যেভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, তা শুধু অনাকাক্সিক্ষতই নয়, বরং তা দু’দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক ধরনের অনাস্থা সৃষ্টি করতে পারে। একজন ভারতীয় নেভির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সংবাদপত্রে প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, ভারত প্রয়োজনে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্র সীমান্তবর্তী ভারতীয় এলাকায় মিসাইল ব্যাটারি বসাবে। নতুন নৌঘাঁটি করার কথাও তিনি বলেছেন। বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য আছে কিনা জানি না; কিন্তু এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত (?) দু’দেশের বন্ধুত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়ার শামিল। সংবাদপত্রে (ভারতীয়) বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক একজন হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তীর একটি বক্তব্য দেখলাম। তিনি এটাকে অর্থের অপচয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ভারতীয় কর্মকর্তা তথা নীতিনির্ধারকদের মাঝে এক ধরনের উন্নাসিকতা কাজ করে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোকে ‘এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের’ মধ্যে রাখতে চায় ভারত, যা কিনা বিশ্লেষকরা ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এই যে মানসিকতা, তাতে কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে বর্তমান বিজেপি সরকারের কোনো পার্থক্য নেই।

বাংলাদেশ তার নৌবাহিনীর জন্য সাবমেরিন সংগ্রহ করেছে, তা শুধু একটাই কারণে। আর তা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, সমুদ্রে আমাদের সম্পদের গ্যারান্টি দেয়া এবং সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আসরে নৌবাহিনীর গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। একই সঙ্গে আরও একটি বিষয় আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিবেচনায় নিয়েছেন, তা হচ্ছে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের কাছেই এখন সাবমেরিন আছে। বাংলাদেশ এখন এই কাতারে শরিক হল মাত্র। ২০১৫ সালে মিয়ানমার রাশিয়া থেকে সাবমেরিন সংগ্রহ করার চেষ্টা করেছিল। শেষ পর্যন্ত আর্থিক বিষয়টির সমাধান না হওয়ায় সেই পরিকল্পনা পরিত্যক্ত নয়। তবে পাকিস্তান নেভি মিয়ানমারের ক্রুদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে, এমন খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। পাকিস্তান তাদের পুরনো টাইপের দুটো সাবমেরিন মিয়ানমারের কাছে বিক্রি করতে চেয়েছিল। ২০১৬ সালে ভিয়েতনাম তাদের নৌবাহিনীতে ৬টি সাবমেরিন সংযোজন করেছে। মালয়েশিয়ার নেভি ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার খরচ করে ফ্রান্সের কাছ থেকে সাবমেরিন ক্রয় করেছে। ইন্দোনেশিয়ার অনেক আগে থেকেই সাবমেরিন ছিল। ২০২০ সালের মধ্যে তাদের বহরে মোট ১২টি সাবমেরিন সংযোজিত হবে। ইতিমধ্যে পুরনো টাইপের দুটো সাবমেরিনের বদলে নতুন দুটো সাবমেরিন বহরে যুক্ত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলোর কেউই পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না, এবং পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে না। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা এখন নির্ধারিত। সমুদ্রে এখন আমাদের সীমান্ত আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের রায় আমাদের পক্ষে। এতে বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার বেশি টেরিটোরিয়াল সি, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশের সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর অধিকার পেয়েছে। এই সম্পদকে রক্ষা করতে হলে দরকার শক্তিশালী নৌবাহিনী।

পাঠক, ২০০৮ সালের একটি পরিস্থিতির কথা আমরা স্মরণ করতে পারি। ওই সময় গভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের নৌবাহিনী ও মিয়ানমারের নৌবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। মিয়ানমার তার গভীর সমুদ্রে এ-৩ ও এ-১ ব্লকে গ্যাস অনুসন্ধানে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইও কোম্পানিকে ব্যবহার করেছিল। দাইও কোম্পানি বাংলাদেশের সীমানার ভেতরেও ঢুকে অনুসন্ধান কাজ চালাচ্ছিল। বাংলাদেশের নৌবাহিনী তখন চ্যালেঞ্জ করেছিল। এক পর্যায়ে সংঘর্ষের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। পরে মিয়ানমারের নৌবাহিনী সরে গেলে ও দাইও তাদের কাজ বন্ধ করে দিলে উত্তেজনার অবসান ঘটেছিল। মিয়ানমারের এ-৩ ও এ-১ ব্লকের পাশাপাশি আমাদের রয়েছে ব্লক-১২, যেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার দাইও’র সহযোগী অপর একটি সংস্থার সঙ্গে পেট্রোবাংলা একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এক্ষেত্রে ‘বড় জটিলতা’ এড়াতে হলে আমাদের শক্তিশালী নৌবাহিনী দরকার। সাবমেরিন এক্ষেত্রে যুদ্ধ করবে না, বরং যে কোনো সম্ভাব্য আক্রমণকে ‘নিউট্রাল’ করতে পারবে। আমাদের নৌবাহিনী ও তাদের অফিসাররা দক্ষতা প্রমাণ করেছেন অতীতে। বিএনএস ওসমান ও বিএনএস মধুমতি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় লেবাননে মোতায়েন করা হয়েছিল। এখন সাবমেরিন সংযোজনের ফলে তাদের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়ল। এটা বাংলাদেশের জন্য আরও সম্মান বয়ে আনবে। বাংলাদেশের এই গর্বের জয়টাকে আমরা ধরে রাখতে চাই। শুধু নৌবাহিনী কেন, এখন সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকেও আরও শক্তিশালী করা দরকার। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘কেউ যদি আক্রমণ করে, তাহলে যেন তার সমুচিত জবাব দিতে পারি, সে প্রস্তুতি আমাদের থাকবে, এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। আমরা শক্তিশালী দেশ। আমরা শান্তি চাই। কিন্তু যে কোনো অনাকাক্সিক্ষত আক্রমণ চ্যালেঞ্জ ও রোধ করার সক্ষমতা আমাদের আছে ও থাকবে।
Daily Jugantor
21.03.2017

সাড়ে চার দশকে বাংলাদেশের অর্জন


চলতি মার্চে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার করবে। একটি রাষ্ট্রের জন্য এ ৪৬ বছর একেবারে কম সময় নয়। সাম্প্রতিক বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ একটি শক্ত অবস্থানে আছে। জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে ধরে রাখা, পরবর্তী শিল্পোন্নত ১১টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকা, বিশ্বের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবস্থান ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশ তার অবস্থান শীর্ষে ধরে রাখতে পেরেছে। এ ৪৬ বছরের বৈদেশিক নীতি যদি পর্যালোচনা করা যায়, তাহলে মূলত তিনটি ধারা আমরা লক্ষ করব।
এক. স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট পর্যন্ত একটি ধারা। দ্বিতীয় ধারার সূচনা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের আগস্টের পর, যা অব্যাহত থাকে ২০০৯ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত। তৃতীয় ধারার সূচনা হয়েছে পুনরায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে। এ তিনটি ধারায় কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি আমরা লক্ষ করি। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ যে বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেছিল, তা ছিল স্বাভাবিক; বিশেষ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ছিল আমাদের বৈদেশিক নীতির উল্লেখযোগ্য দিক। আন্তর্জাতিক আসরে চীনের বিরোধিতা ও নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থেই বৃহৎ শক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ‘ভালো সম্পর্ক’ স্থাপন করেছিল বাংলাদেশ। একই সঙ্গে ১৯৭২ সালে ভারতের সঙ্গে একটি ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। তবে বাংলাদেশ যে তার জোট নিরাপত্তা (যা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল) ও ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়, তার প্রমাণ হিসেবেই ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু আলজিয়ার্সে ন্যাম সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৪ সালে লাহোরে ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরপরই চীন দুই-দুইবার জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করলেও বঙ্গবন্ধু চীনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে বড় পরিবর্তন আসে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। চীন ও সৌদি আরব ১৯৭৫ সালের আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ওই সময় বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিতে চীন ও সৌদি আরবের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায় এবং সেই সঙ্গে ভারতের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এ প্রবণতা জিয়াউর রহমান থেকে শুরু করে শেখ হাসিনার প্রথম শাসনকাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। অর্থাৎ সম্পর্কের প্রশ্নে চীন ও সৌদি আরবকে গুরুত্ব দেয়া। জিয়া মনে করতেন, বাংলদেশ হচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ইসলামের ব্রিজস্বরূপ। জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশ ইসলামিক সলিডারিটি ফান্ডের স্থায়ী কাউন্সিলের সদস্যপদ লাভ করে। আল-কুদ কমিটি, ইরান-ইরাক যুদ্ধের মধ্যস্থতাকারী কমিটির (১৯৮১) সদস্যও ছিল বাংলাদেশ। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য পদে বিজয়ী হয়। চীনের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী এক ‘সামরিক সম্পর্কে’ বাংলাদেশ জড়িয়ে যায় ওই সময়। গঙ্গায় পানি প্রত্যাহার নিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের কিছুটা অবনতি হলেও ১৯৭৭ সালেই বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানিবণ্টনের প্রশ্নে একটি চুক্তিতে উপনীত হয়েছিল। এ সময় (১৯৭৮) সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগান আগ্রাসনের ব্যাপারে কঠোর হয়েছিল বাংলাদেশ। এমনকি প্রায় একই সময় ভিয়েতনাম কর্তৃক কম্পুচিয়া ‘দখলের’ও সমর্থন দেয়নি বাংলাদেশ, বরং কম্পুচিয়ার প্রবাসী সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। এরশাদের সময়সীমায় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে এবং ঢাকায় অবস্থিত ১৪ সোভিয়েত কূটনীতিককে বাংলাদেশে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছিল। বাংলাদেশের উদ্যোগেই ১৯৮৫ সালে সার্ক আত্মপ্রকাশ করে। চীনের ওপর ‘সামরিক নির্ভরতা’ (প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র ক্রয়) এরশাদের আমলেও অব্যাহত থাকে।
খালেদা জিয়া দুই-দুইবার সরকার পরিচালনা করেন (১৯৯১-১৯৯৬, ২০০১-২০০৬)। তিনি মূলত জিয়া-এরশাদের সময়সীমায় অনুসৃত বৈদেশিক নীতির ধারাবাহিকতা (চীনের সঙ্গে সম্পর্ক, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি, সার্ককে গুরুত্ব দেয়া, সৌদি আরবের সঙ্গে ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ইত্যাদি) অনুসরণ করেন। তিনি ‘নিবারক কূটনীতি’ প্রয়োগ করে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন। তার আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশ নেয়। তিনি তার দ্বিতীয় টার্মে ‘পূর্বমুখী বৈদেশিক’ নীতি গ্রহণ করেন। তার শাসনামলেই চীনের ‘কুনমিং উদ্যোগ’ (যার পরিবর্তিত নাম বিসিআইএম)-এর কথা শোনা যায়। মিয়ানমার আমাদের সীমান্তবর্তী একটি দেশ। আমাদের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। ১৯৭২ সালেই মিয়ানমার আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার আমাদের বৈদেশিক নীতিতে উপেক্ষিত ছিল। খালেদা জিয়ার শাসনামলে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়।
শেখ হাসিনা তিন টার্মের জন্য ক্ষমতাসীন হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ব্যাপারটিকে বেশ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে গঙ্গার পানিবণ্টনের ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি হয়েছিল; যদিও তার আমলে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তিটি তিনি আর নবায়ন করেননি। ভারতে আশ্রিত পাহাড়ি শরণার্থীদের তিনি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। তার আমলে সার্কের ভেতরে একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার সিদ্ধান্ত (SAGQ) গৃহীত হয়েছিল; যদিও তা কার্যকর হয়নি। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য আমদানি বাড়ে তিনগুণ। ১৯৯৮ সালে ভারত ও পাকিস্তান পর পর কয়েকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটালে তিনি শান্তি স্থাপনের একটি উদ্যোগ নেন, যা প্রশংসিত হয়। তার সময় সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসেন। তার শাসনামলে বাংলাদেশ সিটিপিটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। একইসঙ্গে ‘হানা’ চুক্তিও (হিউম্যানিটোরিয়ান অ্যাসিস্ট্যান্স নিডস অ্যাসেসমেন্ট) স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তিনি ১৯৯৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত প্রথম বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন। তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নিলেও সামরিক ক্ষেত্রে চীনের ওপর থেকে পরিপূর্ণ নির্ভরশীলতা তিনি কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তার আমলে ঢাকায় রাশিয়ার অস্ত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। বাংলাদেশ ওই সময় চীনের বদলে রাশিয়া থেকে আটটি মিগ-২৯ যুদ্ধবিমান ক্রয় করেছিল (মূল্য ১২৪ মিলিয়ন ডলার)। চীন মিগ-২৯ বিমান সরবরাহ করতে রাজি হলেও বাংলাদেশ ওই বিমান রাশিয়া থেকে সংগ্রহ করেছিল। শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ দুইটি আঞ্চলিক জোট ডি-৮ ও বিমসটেকে যোগ দেয়। তিনি ওআইসির শীর্ষ সম্মেলনে (ইসলামাবাদ, মার্চ ১৯৯৭) যোগ দিয়ে ইসলামিক বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ওই সময় তিনি একটি অভিন্ন বাজার প্রতিষ্ঠারও দাবি জানিয়েছিলেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে এবং ২০১৪ সালের সব শেষ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি এখনও সরকার পরিচালনা করছেন।
তার সরকারের সময় অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। ট্রানজিট (ট্রান্সশিপমেন্ট অথবা করিডোর) নিয়ে বাংলাদেশে বড় বিতর্ক থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভারত সফরের সময় এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে তা কার্যকরও হয়েছে; যদিও ট্রানজিট ‘ফি’ নিয়ে একটি বিতর্ক আছে। বলা হচ্ছে, ট্রানজিটের বিষয়টি বহুপক্ষীয়তার আলোকে দেখা হবে। কিন্তু দেখা গেছে, ভারত একপক্ষীয়ভাবে তা ব্যবহার করেছে, ভুটান বা নেপাল এখনও ট্রানজিট পায়নি। ভারত এ দুইটি দেশকে ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার কথা। কিন্তু এরই মধ্যে এ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছেÑ এ তথ্য আমাদের জানা নেই। এমনকি ভারতের ‘সাতবোন’ রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা-ও বাংলাদেশের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি যেভাবে বাড়ছে, তাতে আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশী পণ্য খালাস করতেই হিমশিম খাবে। এক্ষেত্রে ‘সাতবোন’ রাজ্যের পণ্য বড় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। ভারত অবকাঠামো খাতে যে ঋণ দিয়েছে, তা-ও বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীর ঋণের মতোই এ ঋণ দিয়ে ভারতীয় পণ্য ও সেবা কিনতে আমরা বাধ্য। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ‘ভাষা’ ব্যবহার করা হয়েছিল, তাতে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে বেশি করে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। ৭ বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফর (২০১৫) করে দুই দেশের সম্পর্ককে অনেক উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তার আমলে ঐতিহাসিক ছিটমহল বিনিময় চুক্তি বাস্তবায়িত হয়েছে। ছিটমহলগুলোয় বসবাসরত (ভারতের ১১১টি, বাংলাদেশের ৫১টি) নাগরিকরা তাদের স্বইচ্ছায় নিজ নিজ দেশে ফিরে গেছে। কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে যে সমস্যা তা রয়ে গেছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ থাকলেও শুধু মমতা ব্যানার্জির কারণে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হচ্ছে না। সীমান্ত হত্যাও বন্ধ হয়নি। মোদির ঢাকা সফরের সময় নতুন আঞ্চলিক জোট বিবিআইএন (বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল) আত্মপ্রকাশ করলেও নানা প্রশ্ন আছে। সার্ক অকার্যকর হয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমছে না। ট্যারিফ-প্যারাট্যারিফ কমানোর কোনো উদ্যোগ নেই। ভারত থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া গেছে বটে; কিন্তু আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না।
মহাজোট সরকারের আমলে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে ওই সফর গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের প্রাপ্তি ছিল কম। যৌথ অংশীদারি সংলাপ নামের একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধবোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছিল। তবে ধারণা করা হচ্ছে এবং বিভিন্ন বিশ্লেষকের লেখনীতে এটা বেরিয়ে এসেছে, এ ধরনের চুক্তি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে একটি জোট গড়ে তোলার কাজে ব্যবহৃত হতে পারে! দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমবর্ধমান মার্কিন প্রভাব, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ গড়ে ওঠার আলোকেই হিলারির ওই সফরকে বিশ্লেষণ করা যায়; যদিও হিলারির ওই সফরে বাংলাদেশের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। বাংলাদেশ তার সব পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে দাবি, তা এখন বাতিল হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ‘টিফা’র বদলে এখন ‘টিকফা’ চুক্তি (ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাগ্রিমেন্ট) করেছে। এতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশ ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন’ (এমসিসি) থেকে ভবিষ্যতে সাহায্য পাবেÑ এমন কোনো প্রতিশ্রুতিও আমরা পাইনি। তবে হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরে তার একটি বক্তব্যে আমি আশাবাদী। তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় তিনি বাংলাদেশকে একটি Soft Power হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। যে কোনো বিবেচনায় এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বিশ্ব শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিয়ে কিংবা আরএমজি সেক্টরে বিশ্ব আসরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি ‘শক্তি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে, বাংলাদেশের এ অর্জনকে ধরে রাখা। বিশেষ করে ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের সঙ্গে দ্রুত একটি সম্পর্ক স্থাপন জরুরি। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত ভারতীয় ‘লবি’ আমাদের সাহায্য করতে পারে। শেখ হাসিনার সরকারের একটি বড় প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন নিয়ে বহির্বিশ্বে যে নেতিবাচক ধারণার জন্ম হয়েছিল, তা তিনি কাটিয়ে উঠেছেন। বড় শক্তিগুলো তার সরকারের ওপর আস্থা রেখেছে। তিনি চীন ও জাপান সফর করেছেন। চীনের প্রেসিডেন্ট ঐতিহাসিক সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন, এমনকি প্রধানমন্ত্রী গোয়ায় ব্রিকস-বিমসটেক আউটরিচ সম্মেলনেও যোগ দিয়েছিলেন (২০১৬)। এর মধ্য দিয়ে তার সরকারের প্রতি এবং তার বৈদেশিক নীতির প্রতি বহিঃসমর্থন আরও বাড়ল। বাংলাদেশকে এখন উঠতি শিল্পোন্নত ১১টি দেশের একটি হিসেবে ধরা হচ্ছে। এটা তার জন্য একটি প্লাস পয়েন্ট। তার চীন ও জাপান সফর আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। জাপান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক মূলত আর্থিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট। জাপানের কাছ থেকে আমরা বড় ধরনের সাহায্য পেয়ে থাকি এবং প্রধানমন্ত্রীর জাপান সফরের সময়ও এ সাহায্যের ধারা অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। চীনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। চীনের পররাষ্ট্রনীতি এখন ব্যবসানির্ভর। ‘আইডোলজি’ এখানে প্রাধান্য পায় না। ফলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে আগ্রহÑ সব কিছুই আবর্তিত হচ্ছে চীনের ব্যবসায়িক দৃষ্টিকোণের আলোকে। বাংলাদেশ উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বিসিআইএমের (বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার) ব্যাপারে যথেষ্ট উৎসাহী এবং এ লক্ষ্যে একটি টিম কাজ করে যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে আরও একধাপ এগিয়ে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে বিশাল মুক্তবাণিজ্য এলাকা গড়ে উঠছে, সেই বাজারে প্রবেশ করতে পারবে।
৪৬ বছর একটি রাষ্ট্রের জন্য কম সময় নয়। এ সময়সীমায় বৈদেশিক নীতিতে যেমন সফলতা এসেছে, ঠিক তেমনি ব্যর্থতাও একেবারে কম নয়। তবে বাংলাদেশকে এখন তাকাতে হবে ২০৫০ সালের দিকে। সনাতন বৈদেশিক নীতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। অর্থনৈতিক কূটনীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে। দক্ষ কূটনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আঞ্চলিক সহযোগিতার ভিত্তি বাড়াতে হবে। আমাদের জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলেই বৈদেশিক নীতিতে সফলতা আসবে।
Daily Alokito Bangladesh
19.03.2017
 

কেমন হবে নির্বাচনকালীন সরকার


সংবিধান অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে বিশ মাসের মতো। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শেষ হয়ে যাবে বর্তমান সংসদের মেয়াদ। সরকার মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগেও নির্বাচন দিতে পারে। তবে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অথবা ২০১৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু এর আগেই একটি নির্বাচনী আমেজ যেন আমরা পাচ্ছি। আর তাতে ঘুরেফিরে আসছে একটা কথাÑ নির্বাচনকালীন সরকার। কেমন হবে এই সরকার? এক সময় নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে আমরা সংবিধানে সংশোধনী এনে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলাম। উচ্চ আদালত ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছিলেন। অতীতে আওয়ামী লীগই সোচ্চার ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে এবং বিএনপি ‘বাধ্য’ হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে। আর এখন আওয়ামী লীগই এর বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগই এখন বলছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানে নেই। সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে। সংবিধানের কোথাও স্পষ্ট করে বলা নেই নির্বাচনকালীন একটি সরকারের কথা। তবে ৫৭(৩)-এ বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোনো কিছুই অযোগ্য করিবে না।’ এর অর্থ পরিষ্কার, যিনি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তিনি নতুন একজন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বপদে বহাল থাকবেন। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই থাকছেন এবং তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে বহাল রেখেই নির্বাচন কমিশন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে। বিএনপির আপত্তিটা এখানেই। বিএনপি মনে করে, যেহেতু শেখ হাসিনা একটি দলের প্রধান তাই একজন দলীয় প্রধানকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। এই যুক্তি একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, সংবিধানে ১১৮(৪) অনুচ্ছেদে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন থাকবে, এ কথা বলা হলেও নির্বাচন কমিশন কখনই স্বাধীন ছিল না। নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন পরিচালনার জন্য প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। স্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তা, ডিসি তথা টিএনওদের ওপর নির্ভর করতে হয়। আর তাদের নিয়ন্ত্রণ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। যদিও সংবিধানের ১২৬নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ বাস্তবক্ষেত্রে এটা শুধু কাগজ-কলমেই সীমাবদ্ধ। ‘নির্বাহী কর্তৃপক্ষ’ নির্বাচন কমিশনের কথায় চলে না এবং নির্বাচন কমিশনও তাদের ‘কর্তব্য পালনে’ বাধ্য করতে পারে না। ফলে সরকার যা চায় তাই হয়। নির্বাচন কমিশন এখানে ঠুঁটো জগন্নাথ। ফলে একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের প্রশ্নে সরকারের আন্তরিকতাই আসল। এখন বিএনপি বলছে একটি ‘নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা’র কথা। এই ‘রূপরেখা’ তো সরকার দেবে না। দিতে হবে বিএনপিকে। গত ৯ মার্চ একটি আলোচনা সভায় বিএনপির সিনিয়র নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন আমাদের জানিয়েছেন, শিগগিরই খালেদা জিয়া নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা দেবেন। আমরা জানি না, সেই সরকারের রূপরেখা কী হবে? দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে (২০১৪) প্রধানমন্ত্রী একটি ছোট আকারের মন্ত্রিসভা গঠন করেছিলেন। ওই মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বিএনপিকে, যা বিএনপি গ্রহণ করেনি। এখন কি প্রধানমন্ত্রী সে রকম একটি আমন্ত্রণ জানাবেন? তবে ২০১৪-পূর্ববর্তী পরিস্থিতি ও আজকের পরিস্থিতির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য রয়েছে। নবম জাতীয় সংসদে বিএনপি ছিল এবং সংসদ সদস্যদের সমন্বয়েই ওই সময় একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল। এখন তো বিএনপি সংসদে নেই? তাহলে বিএনপি ‘নির্বাচনকালীন সরকারে’ থাকবে কী করে? এখানেই প্রশ্ন এসে যায় সরকারের আন্তরিকতার। বিএনপি সংসদের বাইরে বড় দল। দেশে ও বিদেশে দলটির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা আছে। দাতাগোষ্ঠী বারবার ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ যে নির্বাচনের কথা বলছে, তাতে তারা পরোক্ষভাবে বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসার কথাই বলে আসছে। এখন সেটি সম্ভব হবে কীভাবে? নির্বাচন প্রস্তুতিকালীন শেখ হাসিনাই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। এটাই সংবিধানের কথা। সংবিধানের বাইরে যাওয়া যাবে না। এখন বিএনপিকে আস্থায় নিতে হলে তাকে একটি অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা যায় শুধু নির্বাচন প্রস্তুতিকালীন তিন মাস সময়ের জন্য। সরকার নীতিগতভাবে এ ক্ষেত্রে কতগুলো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এগুলো অনেকটা এ রকম : ১. শুধু সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে একটি সরকার গঠিত হবে নির্বাচনকালীন সময়ের জন্য। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি ১০ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা থাকবে। ২. তিনটি দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি এই মন্ত্রিসভায় থাকবে। ৩. প্রধানমন্ত্রী ব্যতিরেকে যারা মন্ত্রিসভায় থাকবেন, তারা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। ৪. মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্তির জন্য তিনটি উপনির্বাচনে তিনজন বিএনপি প্রার্থীকে ‘বিজয়ী’ করে সংসদে আনা যায়। তারা আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। ৫. জনপ্রশাসন অথবা স্বরাষ্ট্র যে কোনো একটা মন্ত্রণালয় বিএনপিকে দেওয়া যেতে পারে। ৬. ওই সরকার নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ৭. নির্বাচনের সময় ডিসি, টিএনও এবং ওসিদের বদলি করতে হবে। প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় নতুন লোক দিতে হবে। বিকল্প হিসেবে স্পিকার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হতে পারেন, অথবা আওয়ামী লীগের যে কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা এই দায়িত্বটি নিতে পারেন। তবে নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বার্থে এরা কেউই (অর্থাৎ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সদস্যরা) একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। তিনটি দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে এ কারণে যে, বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে এই তিনটি দলের বরাবরই প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। এর বাইরে যেসব দল দশম কিংবা নবম জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে, তারা দুটো বড় দলের ব্যানারে এবং ওই দলের প্রতীক নিয়ে বিজয়ী হয়েছেন (যেমন জাসদ। দলীয় প্রতীক মশাল। বিজয়ী হয়েছেন নৌকা প্রতীক নিয়ে)। তাই অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভায় ওই সব দলের প্রতিনিধিত্বের প্রয়োজন নেই।
অনেক কারণের জন্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন প্রয়োজন। এ জন্য বিএনপিকে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে হবে। আমার ধারণা, বর্তমান সরকারও চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিক। পরপর দুটো নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশ না নেয়, তাতে সরকারের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন হবে না সত্য, কিন্তু বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি একটা প্রশ্নের মুখে থাকবে। দ্বিতীয়ত, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অনেক মামলা রয়েছে। মামলার রায়ও হবে চলতি বছরে। এতে করে খালেদা জিয়াকে বাদ দিয়ে বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার একটা প্রশ্ন আছে। খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না এমন কথা বলা হচ্ছে। বিষয়টি একান্তই আইনগত। তাই আদালতের কাছেই বিষয়টি ছেড়ে দিতে হবে। এ বিষয়ে আমরা যত কম কথা বলব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। তৃতীয়ত, জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে আবার সরকারে রেখে সরকার খুব লাভবান হয়েছে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষ জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলের আসনে মেনে নেয়নি। বিএনপি সংসদে বিরোধী দলে থাকলে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।
এ দেশে সুস্থ গণতান্ত্রিকচর্চার জন্য দুটো বড় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে এ দেশে গণতন্ত্রের হাওয়া বইবে না। আর বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে যদি বিভেদ-অসন্তোষ থাকে, তাহলে এ থেকে ফায়দা নেবে অসাংবিধানিক শক্তিগুলো, যা গণতন্ত্রের জন্য মঙ্গল নয়। দীর্ঘ ৪৫ বছর আমরা পার করেছি। আমাদের অনেক অর্জন আছে। অনেক সেক্টরে আমরা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বাহিনীতে আমাদের সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ, তৈরি পোশাকশিল্পে আমাদের সক্ষমতা, ওষুধশিল্পের গ্রহণযোগ্যতা ইত্যাদি নানা কারণে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের একটা পরিচিতি আছে। আমরা ‘সফটপাওয়ার’ হিসেবে ইতোমধ্যে পরিচিতি পেয়েছি। ‘নেক্সট ইলেভেন’-এ বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি ৭-এর ঘরে থাকবে বলে আন্তর্জাতিক মহল থেকে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এখন এই যে ‘অর্জন’, এই অর্জন মুখ থুবড়ে পড়বে যদি রাজনৈতিক দল, বিশেষ করে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত না হয়। এই আস্থার সম্পর্ক শুধু দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রের জন্যই মঙ্গল নয়, বরং দেশের স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন, উপরন্তু জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্যও প্রয়োজন। জনগণ এমনটি দেখতে চায়। সাধারণ মানুষ চায় দুটি বড় দলের নেতারা পরস্পর পরস্পরকে আক্রমণ করে কোনো বক্তব্য রাখবেন না। পরস্পরকে শ্রদ্ধা করবেন। দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে। এই প্রতিযোগিতা হতে হবে রাজনৈতিক ও কর্মসূচিভিত্তিক। খালেদা জিয়ার সাজা হবে কী হবে না, এটা নিয়ে যত কম আলোচনা হবে, ততই ভালো। এটা আদালতের বিষয়। এ নিয়ে জনমত সৃষ্টি করারও দরকার নেই। প্রধানমন্ত্রী পরোক্ষভাবে ‘নির্বাচনী প্রচারণা’ এক রকম শুরু করে দিয়েছেন। গত ২৬ ফেব্রুয়ারি তিনি বগুড়ায় জনসভা করেছেন। সেখানে তিনি উন্নয়নের কথা বলেছেন। বগুড়া বিএনপির ঘাঁটি বলেই বিবেচিত। সেখানে তিনি বলেছেন, উন্নয়নের কোনো বিশেষ এলাকা বিবেচ্য নয়। এর অর্থ উন্নয়ন কর্মকা-কে তিনি নির্বাচনী প্রচারণায় নিয়ে আসবেন। সামনে আছে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনের বিষয়টি, যা ২০১৮ সালে চালু হওয়ার কথা। হয়তো পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেই তিনি নির্বাচনের তারিখ দেবেন। এ ক্ষেত্রে বিএনপি কী করবে? বিএনপি নির্বাচনে যাবে। বিএনপি নিশ্চিত হতে চায় নির্বাচনে কারচুপি হবে না। নির্বাচনটি সুষ্ঠু হবে। ইসির ব্যাপারে বিএনপির রিজার্ভেশন আছে। সিইসিকে বিএনপি প্রত্যাখ্যান করেছে। তার পরও কথা থেকে যায়। একটি গ্রহণযোগ্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বেও সম্ভব, বিএনপির আস্থা অর্জন করতে পারে এবং একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারে
Daily Amader Somoy
14.03.2017

এ দুঃখ আমি রাখব কোথায়!



এ দুঃখ আমি রাখব কোথায়! ভিসির বাড়িতে বিউটি পার্লার! ছবিসহ এ সংবাদটি ছাপা হয়েছে যুগান্তরে গত ৫ মার্চ। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে এর চেয়ে আর লজ্জাজনক কিছু হতে পারে না। একজন ভিসি, যিনি শিক্ষকও বটে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মান-মর্যাদা কোথায় নিয়ে গেলেন? সরকারি বাসভবনে তিনি বিউটি পার্লার দেবেন? ভদ্রলোক গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি। নাম তার খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। ভদ্রলোক নাকি এক সময় ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। সেখানে নাকি তিনি বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত শিক্ষক প্যানেল সোনালী দলের সাবেক যুগ্ম-সম্পাদকও ছিলেন! সত্য-মিথ্যা জানি না, যুগান্তরের গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি আমাদের এই তথ্যটিই দিয়েছেন। এই উপ-সম্পাদকীয় লেখার সময় পর্যন্ত ভিসি মহোদয় এর কোনো জবাবও দেননি। সুতরাং ধরে নিচ্ছি, এর পেছনে সত্যতা আছে। কেননা, ছবি তো আর মিথ্যা কথা বলে না। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ভিসি তার বাসভবনে প্রতিষ্ঠিত বিউটি পার্লারের সিরিয়াল নিজেই নিয়ন্ত্রণ করছেন। একজন ভিসি, অর্থাৎ উপাচার্য, তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিউটি পার্লার কেন, আলু-পটলের ব্যবসা করতেই পারেন। এটা তার অধিকার। কিন্তু তিনি তো এর জন্য ভিসি ভবন ব্যবহার করতে পারেন না! খোঁজ নিলে দেখা যাবে, ওই বিউটি পার্লারের জন্য যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে, তাও নেয়া হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, তা থেকে। দুঃখ লাগে, এ ধরনের ‘লোককেও’ আমরা ভিসি বানিয়েছি! তিনি তো শিক্ষক সমাজের কলংক।

তিনি গোপালগঞ্জের মানুষ হতে পারেন। কিন্তু গোপালগঞ্জে প্রতিষ্ঠিত একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ওই এলাকার একজন শিক্ষককেই নিয়োগ দিতে হবে কেন? এ প্রবণতা তো আঞ্চলিকতার জন্ম দেবে। দিয়েছেও। যুগান্তর প্রতিনিধির কাছে তিনি প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করেছেন। এটা তিনি করতে পারেন না। দুদকে তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও আর্থিক কেলেংকারির অভিযোগ রয়েছে। তাকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, দুদকের চিঠির কোনো জবাব দিতে হবে না। কেননা, তিনি ওপর থেকে ম্যানেজ করে ফেলেছেন। কী সাংঘাতিক কথা! যেখানে দুদক রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি’র আর্থিক কেলেংকারি তদন্ত করছে, তাকে নোটিশ দিয়েছে, সেখানে তিনি কী করে বলেন, ‘দুদককে ম্যানেজ’ করে ফেলেছেন? দুদক বিষয়টি কীভাবে দেখবে, আমি জানি না। কিন্তু এ ঘটনা (যদি সত্যি হয়ে থাকে) দুদকের ভাবমূর্তি নষ্ট করবে। উপরন্তু এটা দুদকের কর্মকাণ্ডকে একরকম চ্যালেঞ্জ করার শামিল। সাম্প্রতিক সময়ে দুদকের অনেক কর্মকাণ্ড আমাদের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। আমরা আশাবাদী হয়েছি। একজন নাসির উদ্দিন, হতে পারেন তিনি ভিসি, হতে পারেন তিনি গোপালগঞ্জের মানুষ, তিনি যদি অন্যায় করে থাকেন, যদি দুর্নীতি করে থাকেন, প্রচলিত আইনেই তার বিচার হওয়া উচিত। ভিসি হিসেবে তিনি মাফ পেতে পারেন না। একই কথা প্রযোজ্য রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি’র ব্যাপারেও, যিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেছিলেন। আমি জানি না, যুগান্তরে প্রকাশিত সংবাদটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরে পড়েছে কী না! আমি মনে করি, দ্রুত এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। কেননা এর সঙ্গে গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তির প্রশ্নটি জড়িত। গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’র কর্মকাণ্ড অনেকগুলো প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, দেশের ৩৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তাদের অনেকে শুধু অযোগ্যই নয়, বরং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছেন। শিক্ষক সমাজকে জাতির কাছে ‘ছোট’ করেছেন। দুই. দলীয় পরিচয়ে কিংবা আঞ্চলিকতা বিবেচনায় যাদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, তারা যে ব্যর্থ এবং ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান যে তারা আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারেন না, গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কর্মকাণ্ডে আবারও তা প্রমাণিত হল। তিন. ভিসিরা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েই অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টিকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন। নিজের আত্মীয়-স্বজন, ভাই, স্ত্রী, এদের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেন নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি এর বড় প্রমাণ। এ ধরনের ঘটনা আরও অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন একটি আইন করতে পারে, যেখানে বলা থাকবে- বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ ব্যক্তিদের সন্তান বা আত্মীয়-স্বজনরা প্রথমে একই বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি নিয়োগ পাবেন না। তাদের অন্য যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা অর্জন করে পরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকরা প্রথমে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে পরে যদি চান, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কর্মজীবন শুরু করেন। এটা করা না হলে অচিরেই প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একেকটি ‘পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পরিণত হবে। আমার নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে এই প্রবণতা আমি প্রত্যক্ষ করছি। এটা ভালো নয়। উচ্চশিক্ষার জন্য তা মঙ্গলজনকও নয়। চার. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর মঞ্জুরি কমিশনের নজরদারি অনেক কম। চেয়ারম্যান ও সদস্যরা আছেন বটে, কিন্তু তাদের কোনো শক্ত কর্মকাণ্ড আমার চোখে ধরা পড়ছে না। এখন ইউজিসির নাম পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। তাতে করে উচ্চশিক্ষায় কতটুকু পরিবর্তন আসবে, আমি নিশ্চিত নই। অতি সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এসডিজিবিষয়ক প্রধান সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে।’ জনাব আজাদ সাবেক আমলা। সিনিয়র সচিব ছিলেন। অবসরে গেছেন। তিনি কথাটা মিথ্যা বলেননি। সাবেক শিক্ষা সচিব নজরুল ইসলাম খানও একাধিকবার এ ধরনের কথা বলেছেন। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মানের যে অবনতি ঘটেছে, এটা তো হাজারটা দৃষ্টান্ত দিয়ে দেখানো যায়। ১৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর (যেগুলো সব বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়) টিআইবি যে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল, তাতে তথ্য-উপাত্তসহ উল্লেখ করা হয়েছিল ব্যক্তির ইচ্ছায়, দলীয় বিবেচনায়, টাকার বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এদের অনেকেই যোগ্য নন। ফলে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে তারা অবদান রাখতে পারছেন না। আমার ধারণা ছিল, ওই প্রতিবেদনের পর ইউজিসি একটি বড়সড় অনুসন্ধান চালাবে। কিন্তু তারা তা করেনি। শুধু প্রতিবাদ করেই দায়িত্ব শেষ করেছে। দুদকও বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে পারে। টাকার বিনিময়ে যদি শিক্ষক নিয়োগ হয়, তাহলে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন হবে কীভাবে? একটা হতাশাজনক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি। দেশে অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। এর প্রয়োজনীয়তা নিশ্চয়ই অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যে কাজটি করা দরকার, তা হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে যাদের ওপর এই দায়িত্বটি বর্তিয়েছে, তারা দায়িত্ব পালন না করে ব্যস্ত থাকছেন অন্য কাজে। তাই যোগ্য ও দক্ষ লোকদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন। উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য সরকার একটি কমিশন গঠন করতে পারে। ইউজিসি এ কাজটি করতে পারছে না।

দুই.

ভিসিদের কাহিনী নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিক সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। সেখানে অনেক ভিসি কী করে প্রচুর অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছেন, তা উল্লেখ করা হয়েছিল। ভিসি হচ্ছেন একটা প্রতিষ্ঠান। তিনি যদি বিতর্কিত হন, দুর্নীতি করেন, তাহলে আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। শুধু আর্থিক কেলেংকারি নয়, কোনো কোনো ভিসি আবার নিজের অনুপযুক্ত ছেলেকে নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক বানিয়ে ‘সুবিধা’ নেয়ার চেষ্টা করেছেন। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ অতি সম্প্রতি ছাপা হয়েছে। যে ‘ছাত্র’ কোনোদিন যোগ্যতা বলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারেনি, সে এখন কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক! যে ছাত্রটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছে, তার তো ‘ভালো ছাত্র হলে’ ওই সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করার কথা। বাবা ভিসি। তাই বলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে তাকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হবে! তার নিয়োগ প্রক্রিয়া যে সিন্ডিকেটে অনুমোদিত হয়েছিল, ওই সিন্ডিকেট সভায় ভিসি কি উপস্থিত ছিলেন? নিজে উপস্থিত থেকে ছেলের নিয়োগ প্রক্রিয়া তিনি কি অনুমোদন করতে পারেন? আইনগতভাবে এবং নৈতিকভাবে তিনি তা পারেন না। ইউজিসি কী বিষয়টি তলিয়ে দেখেছে? শিক্ষামন্ত্রী ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অতি সম্প্রতি বলেছেন, ‘শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য অব্যাহত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।’ কথাটা শুনতে ভালোই শোনায়। কিন্তু খুব জানতে ইচ্ছে করে, মান বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী কী উদ্যোগ নিয়েছে? অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ কী শিক্ষার মানোন্নয়নের কোনো নির্দেশনা দেয়? ব্যক্তির ইচ্ছায় এবং ব্যক্তিকে সামনে রেখে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নতুন নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে, যার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। দক্ষ জনশক্তি গড়ার ক্ষেত্রেও তা কোনো অবদান রাখবে না। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাকটিক্যাল কেমেস্ট্রি নামে নতুন একটি বিভাগ খোলা ও সেখানে জনবল নিয়োগে যে অনিয়ম হয়েছে, তার রেশ ধরে ইউজিসির এক কর্মকর্তাকে স্ট্যান্ড রিলিজ করা হয়েছে। এজন্য ইউজিসির চেয়ারম্যান ধন্যবাদ পেতেই পারেন। কিন্তু অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সন্তানদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ তথা বৃত্তি প্রদান ইত্যাদি বন্ধে ইউজিসি যদি উদ্যোগ নেয়, তাহলে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তা বড় অবদান রাখবে।

ভিসিদের অনিয়ম এই প্রথম নয়। গোপালগঞ্জের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি’র ‘বিউটি পার্লার’ দেয়ার খবর ছাপা হয়েছে বটে, কিন্তু অনেক ভিসি’র ‘কাহিনী’ কোনোদিনই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়নি। হয়তো হবেও না। তবে তাদের সম্পদের হিসাব যদি নেয়া যায় ‘থলের বেড়াল’ বেরিয়ে এলেও আসতে পারে। মনে আছে, বিএনপি জামানায় এক ভিসি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ক্রয়কৃত ইট-সিমেন্ট ঢাকায় নিজের বাড়ি নির্মাণের কাজে ব্যবহার করেছিলেন। আরেক ভিসি ভিসি’র জন্য নির্ধারিত বাসভবনে না থেকে নিজ বাড়িতে থেকে বাসা ভাড়া গ্রহণ করেছিলেন (সে টাকা ফেরত দিতে আমি বাধ্য করেছিলাম আমার তদন্ত শেষে)। আরেক ভিসি নিজের বোনকে বিয়ের বিনিময়ে একজনকে চাকরি দিয়েছিলেন। তদন্তে তা প্রমাণিত হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে তার দুর্নীতি সংক্রান্ত ফাইল হারিয়ে গিয়েছিল। কোনো বিচার হয়নি। আর তাই গোপালগঞ্জের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ‘বিউটি পার্লার’ দেয়ার কাহিনী শুধু সংবাদপত্রেই থেকে যাবে বলে আমার আশংকা। অন্যদিকে, শিক্ষামন্ত্রী আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যাবেন এবং গতানুগতিকভাবে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নের আহ্বান জানাবেন। সংবাদপত্রে সে খবর ছাপা হবে। আমরা উৎসাহিত হব। শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে, আমরা তা আশা করতেই থাকব। এ ‘কাহিনীর’ যেন শেষ নেই। সরকার একটু ভাবুন, কাদের ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে? কী তাদের যোগ্যতা? ‘বিউটি পার্লার’ দেয়া যার মানসিকতা, তিনি কি ভিসি হতে পারেন? যোগ্য লোককে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদগুলোয় নিয়োগ না দিলে যা হয়, তাই হয়েছে গোপালগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির ক্ষেত্রে। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিক, তাকে ওই পদে রাখা কতটুকু যৌক্তিক হবে? আমরা শুধু আশা করতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়টি ঠিকমতো চলুক। দক্ষ জনবল তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবদান রাখুক।
Daily Jugantor
13.03.2017