রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

কতটা বদলাবে জার্মানি?

জার্মানিতে গত ২৪ সেপ্টেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের পর প্রশ্ন উঠেছে- এখন কোন পথে যাবে জার্মানিঅ্যাঙ্গেলা মার্কেল চতুর্থবারের জন্য চ্যান্সেলর হতে যাচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচনে তার দল এক অর্থে পরাজিতও হয়েছে। আসন সংখ্যা আগের চেয়ে কমেছেকমেছে ভোটপ্রাপ্তির হার। একই কথা প্রযোজ্য দ্বিতীয় বড় দল সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এসপিডি) ক্ষেত্রেও। তাদেরও আসন কমেছে। ভোটও কম পেয়েছে তারা। গেলবারের সঙ্গে এবারের পার্থক্যটা হচ্ছে- গত নির্বাচনের পর (২০১৩) একটি গ্রান্ড কোয়ালিশন হয়েছিল। সেই কোয়ালিশনে মার্কেলের নিজের দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি (সিডিইউ) আর এসপিডি এবং সেই সঙ্গে গ্রিন পার্টি মিলে একটি ঐকমত্যের সরকার গঠিত হয়েছিল। এবারে বদলে যাচ্ছে সেই দৃশ্যপট। কোয়ালিশনে থাকছে না এসপিডি। তারপরও একটি কোয়ালিশন সরকার হবেআর তাতে যোগ দেবে ফ্রি ডেমোক্রেটিক পার্টি (এফডিপি) এবং গ্রিন পার্টি। একটি ত্রিদলীয় ঐক্যজোট হবেযাদের মোট আসন ৩৯৩। সরকার গঠনের জন্য দরকার ৩৫৪ আসন। সরকার হয়তো গঠিত হবেকিন্তু প্রশ্ন থাকবে অনেক। যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জার্মান নেতারা এতদিন নিশ্চিত করেছিলেনতা কি বজায় থাকবেশরণার্থী সমস্যাজলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী অবস্থান এফডিপি আর গ্রিন পার্টির। তাহলে এদের মাঝে সহাবস্থান হবে কীভাবেজার্মানিতে নব্য নাৎসি দল হিসেবে পরিচিত প্রথমবারের মতো পার্লামেন্টে যাওয়া অলটারনেটিভ ফর জার্মানি (এএফডি) পার্টিকেই বা মের্কেল মোকাবেলা করবেন কীভাবে?

মোট ৭০৯ আসনের সংসদে সিডিইউ-সিএসইউর আসন সংখ্যা ২৪৬এসপিডির ১৫৩এফডিপির ৮০এএফডির ৯৪গ্রিন পার্টির ৬৭ এবং দি লেফটের ৬৯। সিডিইউ-সিএসইউ পেয়েছে ৩৩ ভাগ ভোট (কমেছে ৮ দশমিক ৫ ভাগ)আর এসপিডি পেয়েছে ২০ দশমিক ৫ ভাগ ভোট (আসন কমেছে ৫ দশমিক ২ ভাগ)। তৃতীয় দল হিসেবে আবির্ভূত নব্য নাৎসি হিসেবে পরিচিত এএফডি পেয়েছে ১২ দশমিক ৬ ভাগ ভোটএফডিপি ১০ দশমিক ৭ ভাগ ভোট (আসন বেড়েছে ৫ দশমিক ৯ ভাগ)দি লেফট ৯ দশমিক ২ ভাগ ভোট (আসন বেড়েছে শূন্য দশমিক ৬ ভাগ)আর গ্রিন পার্টি পেয়েছে ৮ দশমিক ৯ ভাগ ভোট (আসন বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫ ভাগ)।
বলা ভালোজার্মানিতে নির্বাচনে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেনটেশন প্রথা চালু রয়েছে। একজন ভোট দেন প্রার্থীকে এবং একইসঙ্গে দলকেও। চূড়ান্ত বিচারে কোন দল শতকরা কত ভোট পায়তার ওপর নির্ভর করে ওই দল সংসদে কত আসন পাবে। এখন যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছেএকটি কোয়ালিশন সরকার হবে বটেকিন্তু তাতে কোন কোন দল থাকবেসরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ৩৫৪ আসন প্রাপ্তি সম্ভব হবে যদি এফডিপি ও গ্রিন পার্টি এতে যোগ দেয়। কেননা দ্বিতীয় বৃহত্তম পার্টি ও সাবেক কোয়ালিশন পার্টনার এসপিডি জানিয়ে দিয়েছেতারা সরকারে যোগ দেবে না। তারা বিরোধী দলেই থাকতে চায়। এ ক্ষেত্রে মের্কেলের এফডিপি ও গ্রিন পার্টি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। নব্য নাৎসি হিসেবে পরিচিত এএফডির উত্থান শুধু মের্কেলকে নয়গোটা জার্মান রাজনীতিকেই এখন একটি বড় প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। পাঠকদের স্মরণ থাকার কথাগত বছরের এই সময় আমি যখন জার্মানি সফর করছিলামতখন যুগান্তরের পাঠকদের আমি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম এ দলটি সম্পর্কে। জার্মানিতে তখন (২০১৬) সিরীয় ও ইরাকি শরণার্থীদের নিয়ে নানা বিতর্ক চলছে। আমি ফ্রাঙ্কফুর্ট নগরীতে অনেক সিরীয় শরণার্থীকে দেখেছি। তারা জার্মান ভাষা তো জানেই নাইংরেজিও বলতে পারে না। ফ্রাঙ্কফুর্ট নগরীর মূল কেন্দ্র সাইল-এ আমি অনেক সিরীয় শরণার্থীকে ভিক্ষা পর্যন্ত করতে দেখেছি। এ সময়েই এএফডি পার্টি তার অবস্থান শক্তিশালী করে। ধীরে ধীরে তারা মুসলমান ও শরণার্থী বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে তাদের অবস্থান শক্তিশালী করছিল। আমি তখন লিখেছিলাম- জার্মানি বদলে যাচ্ছে! এবার আমার ওই মন্তব্যেরই বাস্তব রূপ দেখলাম সাধারণ নির্বাচনে। তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এএফডি। তাদের নানা বক্তব্য এখন বড় ধরনের শঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। এটা মার্কেলের জন্য চিন্তার কারণ। কেননা এএফডি দক্ষিণপন্থীদের ভোটই কেড়েছে। এর অর্থ হচ্ছেযারা একসময় সিডিইউর ওপর আস্থা রাখতেনতারা এখন আর সেই আস্থাটি রাখতে পারছেন না। তারা সমর্থন করছেন নতুন দল এএফডিকে। মার্কেল তাই নির্বাচনের পর বলেছেনতিনি খতিয়ে দেখবেন কেন ভোটাররা তার দল ছেড়ে গেল আর কেনই বা এএফডির মতো কট্টরপন্থী একটি দলকে ভোট দিল। কিন্তু তাতে কি এএফডির উত্থান ঠেকানো যাবে?
মের্কেল ক্ষমতায় থেকে যাচ্ছেন বটেকিন্তু এ নির্বাচন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রথমতকট্টর দক্ষিণপন্থী ও নব্য নাৎসি পার্টি হিসেবে পরিচিত এএফডির উত্থান প্রমাণ করল জার্মানিতে কট্টরপন্থীদের অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। আগামীতে এরা সিডিইউ-সিএসইউর বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। জার্মানির ১৬টি রাজ্যের মধ্যে ১৩টির পার্লামেন্টে এদের প্রতিনিধিত্ব আগেই নিশ্চিত হয়েছিল। এখন কেন্দ্রে এদের অবস্থান তৃতীয়। সবচেয়ে বড় রাজ্য এবং রক্ষণশীলদের তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত বায়ার্ন প্রদেশে ১৯৪৮ সালের পর এই প্রথমবারের মতো সিএসইউ (সিডিইউর বিকল্প দলশুধু বায়ার্নে) সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে। এখানে এএফডি ভালো করেছে। ফলে আশঙ্কাধীরে ধীরে সিডিইউ-সিএসইউর বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এএফডি। আমরা যেন ভুলে না যাই এডলফ হিটলার ও তার নাৎসি পার্টি জার্মানিতে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন এবং হিটলার নির্বাচিত চ্যান্সেলর হিসেবেই রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেছিলেন। এখন এএফডি ধীরে ধীরে নাৎসি পার্টির অবস্থানে যাচ্ছে কিনা সেটিই দেখার বিষয়।
দ্বিতীয়ত২০১৫ সালে ইউরোপে বিপুলসংখ্যক শরণার্থীর (সিরীয়ইরাকি ও আফগান) আগমনকে কেন্দ্র করে পুরো ইউরোপের রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে যায়। কট্টরপন্থীদের ব্যাপক উত্থান ঘটে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিজয় এই দক্ষিণপন্থী উত্থানকে আরও উৎসাহিত করেছে। ওই সময় ১০ লাখেরও বেশি সিরীয় শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে মার্কেল সারা বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। কিন্তু পার্শ্ববর্তী তিনটি দেশ তার সমালোচনা করেছিল। হাঙ্গেরিপোল্যান্ড ও চেক রিপাবলিক বরাবরই সিরীয়-ইরাকি শরণার্থীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়ার বিপক্ষে ছিল। মার্কেল যখন জার্মানিতে এসব শরণার্থী আসার সুযোগ করে দেনতখন এই তিনটি দেশের সরকারপ্রধান এর সমালোচনা করেছিলেন। এখন তারা নতুন করে যুক্তি তুলবেন যেতাদের সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল। জার্মান নির্বাচন ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে কট্টরপন্থীদের আরও উৎসাহিত করবে। আগামী মাসে চেক রিপাবলিকের নির্বাচন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আন্দ্রেই বাবিস ও তার দল ভালো করবেন বলে সবার ধারণা। বাবিস অনেকটা ডোনাল্ড ট্রাম্প স্টাইলে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চান। তিনি একজন ধনাঢ্য ব্যক্তি। চেক রিপাবলিকে তার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান বিলিয়ন ডলারের মালিক। বাবিসহাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর ওরবান কিংবা পোল্যান্ডের ক্ষমতাসীন দলের নেতা জারুজলাভ কাসিনিস্কির মতো দক্ষিণপন্থী নেতাদের উত্থান পুরো ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাজনীতির দৃশ্যপট বদলে দিতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেসব মডারেট নেতা আছেন তাদেরবিশেষ করে মার্কেল ও ম্যাত্রেঁদ্ধার (ফ্রান্স) মতো নেতাদের ভূমিকা সীমিত হয়ে যেতে পারে।
তৃতীয়তজার্মানিতে সিডিইউ-সিএসইউএফডিপি আর গ্রিন পার্টির সমন্বয়ে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হলে সেই সরকারকে কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হবে। এ ক্ষেত্রে অ্যাঙ্গেলা মার্কেল কতটুকু ঐক্য ধরে রাখতে পারবেনএটাও একটা প্রশ্ন। কারণ অনেক জাতীয় ইস্যুতে এফডিপি ও গ্রিন পার্টির মধ্যে নীতিগতভাবে মতপার্থক্য রয়েছে। যেমনগ্রিন পার্টি চাচ্ছে আগামীতে ২০টি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে। কিন্তু ব্যবসাবান্ধব এফডিপি এর পক্ষে। তাহলে সমঝোতা হবে কীভাবেএই মতপার্থক্য জার্মানিতে আগাম নির্বাচনের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে পারে। এ ক্ষেত্রে একটি সংখ্যালঘু সরকার হয়তো গঠিত হতে পারেকিন্তু মার্কেল তা চাচ্ছেন না।
চতুর্থতএএফডির বিজয় সরকারকে শরণার্থী ও রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থীদের ক্ষেত্রে আরও কড়াকড়ি আরোপে বাধ্য করতে পারে। ২০১৬ সালে প্রায় ৮ লাখ শরণার্থী জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছে। তবে ২০১৭ সালে এ সংখ্যা কম। শুধু তাই নয়জাতিগত বৈষম্যও বেড়ে যেতে পারে। এএফডির শীর্ষ নেতা আলেকজান্ডার গাউল্যান্ড গ্রিন পার্টির নেতাদের সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করেছেন তা অনাকাঙ্ক্ষিত। তিনি বলেছেনএদের তুরস্কে চলে যাওয়া উচিত। জার্মানির অতীত নিয়ে তিনি প্রশংসামূলক মন্তব্য করেছেনযা বিতর্ক বাড়িয়েছে।
কাজেই আগামীতে সরকার পরিচালনা করবে যে কোয়ালিশনসেই সরকার থাকবে নড়বড়ে। ৭০৯ সিটের পার্লামেন্টে তাদের হাতে থাকবে মাত্র ৩৯৩ আসন। সুতরাং বোঝাই যায় কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেয়া মার্কেলের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। টানা চার বছর চ্যান্সেলর হয়ে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন তিনি। এক সময়ের পূর্ব জার্মানিতে জন্ম নেয়া এই শিক্ষাবিদ (যার রসায়নে পিএইচডি ডিগ্রি রয়েছে) রাজনীতিতে এসেছিলেন দুই জার্মানি একত্রিত হওয়ার পরই। সঠিক নীতিসাধারণ জীবনযাপনশরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতিইউরোপীয় ইউনিয়নের ঐক্য ধরে রাখাট্রাম্পের কট্টর নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান তাকে বিশ্ব রাজনীতিতে অসাধারণ করেছে। তিনি এক সময়ের জার্মান চ্যান্সেলর উইলি ব্র্যান্ডের জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন। কট্টরপন্থীদের অব্যাহত উত্থানের মুখে সীমিতসংখ্যক কোয়ালিশন সিট নিয়ে তিনি আগামীতে কীভাবে জার্মানির নেতৃত্ব দেনসেটিই দেখার বিষয়। তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছেকেন মানুষ এএফডির মতো দলকে ভোট দিল তা খতিয়ে দেখা। মানুষ কি প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর আস্থা হারিয়ে এএফডিকে ভোট দিয়েছেশুধু জাতিগত বৈষম্যমুসলমান বিদ্বেষ কিংবা শরণার্থী-বিরোধিতাই কি এএফডিকে জনপ্রিয় করেছেএসব এখন খতিয়ে দেখতে হবে।
মার্কেল যদি এএফডিকে সন্তুষ্ট করার জন্য বাধ্য হয়ে তার নীতিতে পরিবর্তন আনেনতাহলে তা জার্মানির জন্য কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। এএফডি চাচ্ছে ইউরো জোন থেকে জার্মানি বেরিয়ে আসুক। এটা নিশ্চয়ই মার্কেল করবেন না। কিন্তু তিনি চাপে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় কিছু সংস্কার আসতে পারে। ইইউতে জার্মানি বড় দেশ। দেশটির যে কোনো সিদ্ধান্ত ইইউর রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে। দক্ষিণপন্থীদের ব্যাপক উত্থান পুরো ইউরোপের চেহারা আগামীতে বদলে দিতে পারে। শরণার্থী ইস্যুকে কেন্দ্র করে ব্রিটেন ইইউ থেকে বেরিয়ে গেছে। সেখানে নির্বাচনে তেরেসা মে সুবিধা করতে পারেননি। তিনি অতিমাত্রায় নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন আরেকটি দলের ওপর। এখন অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের অবস্থা হতে যাচ্ছে তেমনটি। কট্টরপন্থী এএফডিকে ব্যালেন্স করার জন্য তাকে এখন কোয়ালিশন পার্টনার এফডিপি ও গ্রিন পার্টিকে ছাড় দিতে হবে। এ দল দুটির মাঝেও সমন্বয় সৃষ্টি করতে হবে। তিনি যদি ব্যর্থ হনতাহলে আগাম নির্বাচন অবশ্যম্ভাবী।

রোহিঙ্গারা কি আদৌ ফিরে যেতে পারবে?

প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি ভাষণটি দেন। তার এ ভাষণে তিনি উত্তর কোরিয়া ও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং জলবায়ু চুক্তি নিয়ে কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো আমাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিল ট্রাম্প কোন কোন বিষয়ে কথা বলবেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার এ ভাষণ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা যেখানে ৪ লাখের ওপর রোহিঙ্গা নাগরিককে জোর করে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়া হয়েছে, যেখানে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তার মতে রাখাইনে গণহত্যা হয়েছে, সেখানে সঙ্গত কারণেই প্রত্যাশা ছিল ট্রাম্প এ গণহত্যা ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। তিনি যে বলবেন না, এটা আমরা জানতাম। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও বিষয়টি স্পষ্ট ছিল। আর এ জন্যই তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ট্রাম্পের সঙ্গে কয়েক মিনিটের আলাপে তিনি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রসঙ্গটি তুললেও ট্রাম্প এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি। প্রধানমন্ত্রী এটা আরও স্পষ্ট করেছেন, শরণার্থীদের বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থান পরিষ্কার। সে জন্য রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের বিষয়ে ট্রাম্পের সহায়তা চেয়ে কোনো কাজ হবে না। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বুধবার জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা সংকট অবসানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে বলিষ্ঠ ও দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেছেন ট্রাম্প।

তবে জাতিসংঘে ট্রাম্পের ভাষণে সিরীয় শরণার্থীদের কথা এসেছে। শরণার্থীদের পুনর্বাসন নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে দক্ষিণ সুদান, ইয়েমেন আর সোমালিয়ার কথা। অথচ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যে মানবিক বিপর্যয় ঘটেছে, কয়েক লাখ শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তা তিনি এড়িয়ে গেছেন। তিনি সিরিয়া ও দক্ষিণ সুদানের শরণার্থী সংকটের কথা যখন বলতে পারেন, তখন তো রোহিঙ্গা প্রসঙ্গও আসা উচিত ছিল! তিনি কি সচেতনভাবে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন, নাকি অসচেতনভাবেই বিষয়টি বাদ পড়ে গেছে? কিন্তু এ বিষয়টি বাদ পড়ার কথা নয় কোনোভাবেই। তিনি যখন উত্তর কোরিয়া কিংবা ইরানকে রগ স্টেট বা দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যখন কিউবা কিংবা ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রপ্রধানকে স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রী হিসেবে অভিহিত করেন, তখন মিয়ানমারের সামরিক জান্তার মানবতাবিরোধী অপরাধ এড়িয়ে যান কীভাবে? উত্তর কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রেখে যদি অপরাধ করে থাকে, তাহলে তার চেয়ে বেশি অপরাধ করেছেন মিয়ানমারের সামরিক শাসক ও বেসামরিক প্রশাসন। অং সান সু চি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেত্রী হতে পারেন, কিন্তু তিনি গণহত্যার দায় এড়াতে পারেন না। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এ ভাষণকে মিথ্যা ভাষণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সু চি তার ভাষণে বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কোনো জাতিগত নির্মূল অভিযান চালাচ্ছে না। অথচ বিবিসির জনাথন হেড নিজে মংডু থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলেছেন, সেনা অভিযান চলছে এবং রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে। রিতা চক্রবর্তীর আরেকটি প্রতিবেদন (বিবিসি) অনুযায়ী, বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে পরিষ্কার দেখা গেছে আগুনের ধোঁয়া। তাহলে বিবিসির এসব প্রতিবেদন কি মিথ্যা? আসলে সু চি মিথ্যাচার করেছেন। সত্যকে লুকানোর চেষ্টা করেছেন। আর সেনাবাহিনীর শিখিয়ে দেয়া ভাষণই তিনি পাঠ করেছেন মাত্র।

ট্রাম্প আর সু চির বক্তব্যের মধ্যে অদ্ভুত এক
মিল আছে- রোহিঙ্গারা যে টার্গেট হয়েছেন এবং তাদের যে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তা কেউই স্বীকার করেননি। ট্রাম্প মূলত কর্পোরেট জগতের বাসিন্দা। যেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে, সেখানে তিনি আছেন এবং সেভাবেই তৈরি হচ্ছে নীতি। মিয়ানমারে তার স্বার্থ রয়েছে। তাই তিনি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। সেখানে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। কাঠ, কৃষি, সুপেয় পানির পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর খনিজসম্পদ, যা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। আর এসব প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে আকৃষ্ট হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। যারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক সিনিয়র জেনারেলের স্ত্রীরা দামি পাথর ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ওইসব প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে দামি পাথর আহরণ, কাঠ সংগ্রহ, খনিজসম্পদ আহরণ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডারদের হাতেই এ ব্যবসা পরিচালনার ভার অর্পিত। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা (চীন ও জাপানি) সরাসরি এসব আঞ্চলিক কমান্ডারকে হাতে রেখে তাদের ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে এ অঞ্চলে পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। ২০১২ সালে মিয়ানমারে একটি ভূমি আইন পাস হয়েছে। এ ভূমি আইনের কারণেই সরকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের নামে ভূমি অধিগ্রহণ করছে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ না দিয়েই। কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। কেননা জমি অধিগ্রহণ না করলে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা যাবে না। আর এভাবেই পরিকল্পিতভাবে আরাকানের রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা আর কোনোদিন নিজ বাসভূমে ফিরতে না পারে। বলা হচ্ছে, বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা আরাকান এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে সমুদ্রের গভীরে প্রায় ২০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে। ২০০৪ সালের আরাকানের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কৃত হয়। ২০১৩ সালে চীন এখানে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করে তার ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ে গ্যাস নিচ্ছে। উপরন্তু আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কাইয়াউকফিউয়ে (Kyaukphyu) একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। এ ধরনের একটি সমুদ্রবন্দর কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় নির্মাণ করতে চেয়েছিল চীন। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এ সমুদ্রবন্দরটি চীনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সড়কপথে এ গভীর সমুদ্রবন্দর চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে করে ইউনান প্রদেশের পণ্য আমদানি-রফতানিতে অর্ধেক সময় কম লাগবে। ফলে পণ্যের মূল্যও কম হবে। তাই চীন রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে চীনের সমর্থন পাওয়া যাবে না।

ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে। আরাকানে ভারত সড়ক নির্মাণ করছে। ভারতের দুটি রাজ্যের সঙ্গে আরাকানের সীমান্ত রয়েছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দেশের অভ্যন্তরে হামলা করে আশ্রয় নেয় আরাকানের গভীর জঙ্গলে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরাকানে ওইসব বিচ্ছিন্নতাবাদীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার অনুমতি দিয়েছিল। সুতরাং ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এটাই স্বাভাবিক।

যুক্তরাষ্ট্রেরও এ অঞ্চলে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। আরাকান সমুদ্রবর্তী গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। মার্কিন কোম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগ করতে চায়। উপরন্তু চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে হলে ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারকেও প্রয়োজন মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের। বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের দীর্ঘদিনের। এ ক্ষেত্রে মুখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বললেও কার্যত যুক্তরাষ্ট্র আগামীতেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রশ্নে তেমন কোনো কঠোর অবস্থানে যাবে না। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে তাই একাই এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে তা আশা করতে পারি না।

পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করে গেছেন। তার ওই সফরের সময় রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, নারী ধর্ষণ, উপরন্তু জাতিসংঘের মতে ৪ লাখের ওপরে রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় কিংবা আশ্রয়ের সম্ভাবনার কথা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও মোদি-সু চির আলোচনায় কিংবা যৌথ ইশতেহারে এসব ব্যাপারে কোনো কথা বলা হয়নি। তারা আরাকানের নিরাপত্তা ইস্যুটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বলেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে তারা যৌথভাবে কাজ করবেন।

৮ সেপ্টেম্বর বালিতে (ইন্দোনেশিয়া) ওয়ার্ল্ড পার্লামেন্টারি ফোরাম অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। ওই সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল; কিন্তু
সহিংসতার ঘটনা যথার্থ নয় বলে ঘোষণাপত্র থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ভারত। এতেই প্রমাণিত হয় রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে থাকবে না ভারত। ফলে রোহিঙ্গা নিয়ে আঞ্চলিক সমাধানের পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। এতে করে রোহিঙ্গারা আদৌ নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে কিনা, সে সন্দেহ থাকলই।

মিয়ানমার ১৯৮২ সালে সেখানে একটি তথাকথিত নাগরিকত্ব আইন চালু করেছিল, যার মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে আসছিল। এ প্রক্রিয়া, অর্থাৎ মিয়ানমারকে মুসলমানশূন্য করা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সেই ধারাবাহিকতাই বর্তমান সংকটের জন্ম। সুতরাং মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে আমরা যদি এটা চিন্তা করে থাকি, তাহলে আমরা ভুল করছি। তারা কোনোদিনই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। সুতরাং একটা অনিশ্চয়তা থেকেই গেল বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এদের একটা অংশ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে কেউ কেউ। বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে অনেকে। আবার একটা অংশ রয়ে গেছে শরণার্থী শিবিরে। যদিও এটা সত্য, শরণার্থী ক্যাম্পে যারা আগে থেকে আছেন, তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্তৃক নিবন্ধিত। কিন্তু একটা বড় অংশই নিবন্ধিত নয়। এখন এদের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন আসা ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এ সংখ্যা ১০ লাখে উন্নীত হবে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ।

সুতরাং বাংলাদেশ যে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ভারতের সাহায্য চেয়েছিল। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভারত আদর্শ বন্ধুর মতো বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শরণার্থীদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে দিল্লি ইতিমধ্যে মিয়ানমার সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছে (আনন্দবাজার, ১৯ সেপ্টেম্বর)। এর পেছনে কি আদৌ কোনো সত্যতা আছে? রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের অবস্থান পরিষ্কার- তারা মিয়ানমার সরকারের অবস্থানকেই সমর্থন করছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গেও কথা বলেছেন, কিন্তু সেই আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচিত হয়নি। সুতরাং এটা স্পষ্ট, রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমরা বৃহৎ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সমর্থন পাব না। কারণ এসব শক্তির মিয়ানমারে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে।

তবে জাতিসংঘকে আমরা ব্যবহার করতে পারি। সম্প্রতি নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং নিন্দাও জানানো হয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার মতো মিয়ানমারের ওপর কোনো অর্থনৈতিক অবরোধের কথা বলা হয়নি। এভাবে তো আরাকানে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হবে না। এবং নিরাপত্তা পরিষদের কোনো অনুমোদন না থাকায় সেখানে গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও গঠন করা যাবে না। ফলে বর্তমান সংকটে বাংলাদেশে আসা ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরতে পারবেন কিনা, এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এদের অন্য দেশে পুনর্বাসন করবে, এটাও আমার মনে হয় না। তারা এখন স্থায়ী শরণার্থীতে পরিণত হতে যাচ্ছে। বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের শরণার্থীদের কাহিনী আমরা জানি। খুব কম ক্ষেত্রেই শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে গেছে। ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস আমরা জানি। সিরিয়া ও ইরাক থেকে যারা দেশান্তরিত হয়ে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে, তারাও নিজ দেশে ফিরে যাবে, এটা আশা করতে পারি না।


আজ কতগুলো বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক. রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের তৎপর হওয়া। কূটনৈতিক চ্যানেলে বাংলাদেশের ভূমিকাকে আরও সম্প্রসারিত করা। দুই. মিয়ানমারে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক একটি প্যানেলের মাধ্যমে চিহ্নিত করা এবং তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার করা। অং সান সু চি তার দায় এড়াতে পারেন না। তাকেও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। তিন. মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে হবে। এবং মিয়ানমারে সব ধরনের অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনে মিয়ানমার সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ইরান ও ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। মিয়ানমারের সম্পত্তি (বিদেশে) ফ্রিজ করার সিদ্ধান্তও নিতে পারে জাতিসংঘ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জাতিসংঘ কিছুই করতে পারবে না। জাতিসংঘ মহাসচিব সু চির জন্য যতই
শেষ সুযোগের কথা বলুন না কেন, নিরাপত্তা পরিষদে উল্লিখিত সিদ্ধান্তগুলোর একটিও কার্যকর করতে পারবেন না। কারণ মিয়ানমারে বৃহৎ দেশগুলোর স্বার্থ অনেক বেশি। তাই রোহিঙ্গা নির্যাতনের কাহিনী শুধু কাগজ-কলমেই থেকে যেতে পারে।

ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা শুধু পরিবেশগতই নয়, নানাবিধ সংকট তৈরি করেছে। স্থানীয় (উখিয়া) জনগণের চেয়ে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বেশি। ফলে স্থানীয় জনসাধারণ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা বৈরিতা তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো পক্ষ এসব রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করতে চাইবে। জঙ্গিবাদ প্রসারের আশঙ্কাও আছে। অদূর ভবিষ্যতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে একটি আলাদা
রোহিঙ্গাল্যান্ড গঠনের সম্ভাবনা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। সমুদ্রঘেঁষা এ অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে। বৃহৎ শক্তির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ও সহযোগিতাকে আমরা অস্বীকার করি কীভাবে? সিরিয়ার রাকা থেকে বিতাড়িত আইএস জঙ্গিদের জন্য এ অঞ্চল একটি অভয়ারণ্য হতে যাচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে বেশি করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সংকট তৈরি করল।

অং সান সু চির মিথ্যাচার

নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী মিয়ানমারের তথাকথিত গণতন্ত্রী নেত্রী অং সান সু চি গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন, তা মিথ্যাচারে ভরা। লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিকের বাংলাদেশে আশ্রয়, তাদের ওপর অত্যাচারের করুণ কাহিনিতে সারা বিশ্বের মানুষ যখন প্রতিবাদমুখর ও গণহত্যার দায়ে তার এবং সেই সঙ্গে শীর্ষস্থানীয় সেনা কমান্ডারদের বিচারের দাবি এখন জোরদার হচ্ছে, তখন সু চি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিলেন। বিশ্বের সর্বত্র তার ভাষণের ব্যাপারে আগ্রহ ছিল। তিনি রোহিঙ্গা গণহত্যার ব্যাপারে কী বলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে তার কর্মসূচি কী, এসব ব্যাপারে তাদের আগ্রহ ছিল। তাই তার ভাষণ নিয়ে সর্বত্র একটা আগ্রহ তৈরি হলেও তিনি হতাশ করেছেন। এমনকি বিবিসির সাংবাদিকরা পর্যন্ত তিনি রোহিঙ্গা নির্যাতন প্রশ্নে মিথ্যা কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন। মনে হচ্ছে সেনা শাসকরা যা তাকে গিলিয়েছেন, তিনি তাই বলেছেন। তিনি তার ভাষণে মূল যে কথাগুলো বলেছেন, তা অনেকটা এ রকম : ক. ৫ সেপ্টেম্বর থেকে সামরিক বাহিনীর অভিযান বন্ধ রয়েছে, খ. রাখাইনে সবার জন্য শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সুবিধা আছে, গ. ৫০ ভাগ রোহিঙ্গা পালিয়েছে, ঘ. মুসলমানদের মিয়ানমার থেকে দলে দলে পাঠানো রহস্যময়, ঙ. রাখাইনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ঢুকতে দেওয়া হবে ইত্যাদি। এসব বক্তব্যের মধ্যে সত্যতা আছে কতটুকু? পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিই ঐতিহাসিকভাবেই রাখাইন স্টেটের মানুষ রোহিঙ্গা নামে পরিচিত এবং আন্তর্জাতিকভাবে তা স্বীকৃতও বটে। কিন্তু সু চি একবারও তার ভাষণে রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেননি। তিনি বলেছেন, বাঙালি ও মুসলমান। এর অর্থ হচ্ছে তিনি তার অবস্থান এতটুকুও পরিবর্তন করেননি। তাহলে এ সমস্যার সমাধান হবে কীভাবে? তিনি যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন! কিন্তু তা সম্ভব কীভাবে? যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকের কাছেই নাগরিকত্ব প্রমাণের কোনো কাগজপত্র নেই। তা হলে তাদের নাগরিকত্ব সু চি সরকার নিশ্চিত করবে কীভাবে? এটা একটা ভাঁওতাকাজি। লোক দেখানোর নামে হয়তো আগামীতে কিছু শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেবে মিয়ানমার। কিন্তু অনেককেই তারা নেবে না। ফলে উখিয়া, টেকনাফে যে বিশাল রোহিঙ্গা জনবসতি গড়ে উঠছে, তারা অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোয় থাকতে বাধ্য হবে বছরের পর বছর! ৫ সেপ্টেম্বর থেকে সেনা অভিযান বন্ধ রয়েছে বলে যে কথা সু চি বলেছেন, তা সর্বৈব মিথ্যা। কেননা সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়েও বিবিসি কিংবা আলজাজিরা যেমন সংবাদ প্রচার করেছে, তাতে স্পষ্ট দেখা গেছে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত অঞ্চলে ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তা হলে সু চির বক্তব্যের পেছনে সত্যতা থাকল কোথায়? রাখাইনে সবার জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সুবিধা আছেÑ দাবি করেছেন সু চি। এটা যে কত বড় মিথ্যা কথা, তা রোহিঙ্গা কিশোর-কিশোরীরা যে সাক্ষাৎকার দিয়েছে, তাতেই প্রমাণিত হয়েছে। গার্ডিয়ানে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে করুণ কাহিনি, যেখানে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের অন্যদের থেকে আলাদা করা হয়েছিল। প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষাপাঠ শেষ হওয়ার পর কোনো রোহিঙ্গাকেই আর মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়া হতো না। এরা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে যেতে পারত না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তো চিন্তাও করা যায় না! এমনকি বিয়ে করার জন্য এদের অনুমতি নিতে হতো। নিউইয়র্কভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলছে, রাখাইন অঞ্চলে ২১৪টি গ্রাম ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। সংস্থাটি স্যাটেলাইট থেকে ধারণকৃত ছবি তুলে দেখিয়ে দিয়েছে আগে ওই সব গ্রামে কী অবস্থা ছিল, আর এখন কী অবস্থা হয়েছে। তাহলে সু চির কথায় যুক্তি থাকে কতটুকু? শতকরা ৫০ ভাগ মুসলমান পালিয়েছে, তাদের পালানো রহস্যজনকÑ এ কথা বলছেন সু চি! জীবন রক্ষার্থে যিনি এবং যারা দিনের পর দিন, না খেয়ে, পাহাড় অতিক্রম করে শুধু বেঁচে থাকার আশায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, তারা কেন পালাবে? তাদের তো বাধ্য করা হয়েছে। এই বাধ্য করার বিষয়টিকে সু চি আখ্যায়িত করেছেন পালানো হিসেবে। আমার দুঃখ লাগে এই মানুষটির জন্য, যখন তিনি দেশে অন্তরীণ ছিলেন, তখন বাংলাদেশের মানুষ তার মুক্তি দাবি করেছে। তার জন্য প্রার্থনা করেছে। তাকে নিয়ে আশাবাদী হয়েছে। অথচ তিনি যে একজন সাম্প্রদায়িক মানুষ, প্রচ- মুসলমানবিদ্বেষী মানুষ, তা আমরা প্রথম জানতে পেরেছিলাম যখন তিনি অন্তরীণ অবস্থা থেকে মুক্তি পান। সেই ২০১৫ সালের কথাÑ তিনি তখন সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন, কখনো তিনি স্বীকার করে নেননি রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। পাঠক, সাব্রা ও সাতিলার (ংধনৎধ ধহফ ংযধঃরষধ) হত্যাকা-ের কথা কী আপনাদের মনে আছে? গাজায় ছিল সাব্রা ও সাতিলা ক্যাম্প, যেখানে ফিলিস্তিনিরা বাস করত। ওই ক্যাম্পে ইসরায়েলিরা বোমা হামলা চালিয়ে দুই হাজারজন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছিল। বিশ্বব্যাপী এর প্রতিবাদ উঠেছিল। ১৯৮২ সালের ১৬-১৭ সেপ্টেম্বরের ওই ঘটনার জন্য পরে ইসরায়েল একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বাধ্য হয়। তদন্ত কমিটি তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল। শ্যারন পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেব্রেনিসকা (বসনিয়া) হত্যাকা-ের (১৯৯৫ সালের ১১-১৩ জুলাই) খবর মনে আছে? ৮ হাজার ৩৭৫ জন মুসলমানকে হত্যা করেছিল বসনিয়ার সার্ব যুদ্ধাপরাধীরা। এ জন্য তাদের (সার্ব সেনা কমান্ডার) বিচার হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (হেগে অবস্থিত)। আজকে রাখাইনে সেনাবাহিনী যে অত্যাচার, নির্যাতন আর হত্যাকা- চালিয়েছে, তার সঙ্গে সাব্রা-সাতিলা কিংবা সেব্রেনিসকার গণহত্যার কোনো পার্থক্য নেই। সু চি জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাখাইনে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সে ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি। আলজাজিরার প্রতিবেদনে তাই বলা হয়েছেÑ ঝঁঁ শুর নঁৎুরহম যবধফ রহ ংধহফ ড়াবৎ ৎড়যরহমুধ পৎরংরংÑ অর্থাৎ রোহিঙ্গা সংকটে সু চি বালির মধ্যে মাথা গুঁজে দিয়ে এই সংকটটা না দেখার ভান করেছেন। সু চি তার ভাষণে প্রথম দিকেই বলেছেন, ডব পড়হফবসহ ধষষ যঁসধহ ৎরমযঃং ারড়ষধঃরড়হÑ অর্থাৎ তারা সব ধরনের মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করেন! কী মিথ্যাবাদী এই অং সান সু চি? একটি বারের জন্যও তিনি রাখাইনে যে হত্যাকা- হয়েছে, তার সমালোচনা করেননি। তিনি শুধু মিথ্যাবাদীই নন, ভ-। প্রতারক। এ জন্যই এসব গণহত্যার বিচার হওয়া প্রয়োজন। বিশ্বের অনেক জায়গায় মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছিল। এ আদালত এখনো কাজ করছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন পৃথিবীর কোন কোন দেশে যেখানে গণহত্যা হয়েছে, সেখানে এ ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক কঙ্গোয় ২০০৪ সালে, কম্বোডিয়ায় ২০০১ সালে এ ধরনের ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ট্রাইব্যুনাল মানবতাবিরোধী অপরাধে যারা জড়িত তাদের বিচার করেছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেই বিচারকার্য এখনো চলছে। আজ মিয়ানমারে যে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান তথা গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তা খোদ বাংলাদেশেই নয়, বরং জাতিসংঘও একে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তা জেইদ রাদ আল হুসেইন জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে দেওয়া ভাষণে রোহিঙ্গা হত্যাকা-কে গণহত্যা হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, এই পাশবিকতার ঘটনা পাঠ্যপুস্তকের জন্য জাতিগত নির্মূলের একটি উদাহরণ হয়ে থাকবে। রয়টার্স জনাব হুসেইনের বক্তব্য উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী থিংক ট্যাংক কাউন্সিল অব ফরেন রিলেশনস-এর এক প্রতিবেদনে (গুধহসধৎ, ঈধসনড়ফরধ ধহফ ঃযব ড়ভভড়ৎঁহরঃু ভড়ৎ ঃযব ঁ.ঝ. ঈড়হমৎবংং, ঝবঢ়ঃবসনবৎ ০৭, ২০১৭) বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতির ব্যাপারে জাতিসংঘের সিরিয়াসলি কিছু করা উচিত। প্রতিবেদনে সিনেটর ম্যাককেইন ও কংগ্রেসম্যান এডওয়ার্ড রয়েস অং সান সু চিকে যে সহিংসতা বন্ধে চিঠি লিখেছেন, তা উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে মিয়ানমারে সব ধরনের সামরিক সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণ বন্ধ এবং একই সঙ্গে কংগ্রেসে রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটি শুনানি আয়োজন করার আহ্বান জানানো হয়। রোহিঙ্গাদের যখন ঢল নামছে, তখন বাংলাদেশ প্রস্তাব করেছে রোহিঙ্গাদের জন্য আরাকানে একটি সেভ জোন প্রতিষ্ঠা করার, যেখানে শান্তিরক্ষা বাহিনী (জাতিসংঘ) রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দেবে। প্রধানমন্ত্রী ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত সেফি উবার্টকে বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফেরাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ সৃষ্টি করা উচিত। আর বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে গৃহীত এক প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে নাগরিকত্ব দিয়ে নিরাপদে নিজ দেশে বসবাস করার সুযোগ করে দিতে মিয়ানমারের ওপর কূটনৈতিক চাপ দেওয়ার একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে ১১ সেপ্টেম্বর। তবে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটি করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী। তিনি মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সরকারের একজন শীর্ষ মন্ত্রী যখন গণহত্যার কথা বলেন, তখন ধরে নিতে হবে এটাই সরকারি ব্যাখ্যা! এবং সরকারি অবস্থান! তাহলে সরকার এখন এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে নিয়ে কী করবে? প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে ওআইসি কন্ট্র্যাক্ট গ্রুপের বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ছয় দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। এগুলো অনেকটা এ রকমÑ ১. রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন বন্ধ করা, ২. একটি নিরাপদ এলাকা বা সেভ জোন প্রতিষ্ঠা করা, ৩. বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা যাতে নিজ বাসভূমে ফিরতে পারে, সে ব্যবস্থা করা, ৪. কফি আনান কমিশনের প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন, ৫. রোহিঙ্গাদের বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করার প্রপাগান্ডা বন্ধ করা, ৬. রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে না ফেরা পর্যন্ত তাদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা। এটি একটি যুগোপযোগী প্রস্তাব। তবে আমি খুশি হতাম যদি ওই প্রস্তাবের সঙ্গে আরও একটি প্রস্তাব থাকত, যেখানে বাংলাদেশ গণহত্যার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করত। এটি একটি ন্যায্য দাবি। আমার ধারণা, ওআইসির দেশগুলো গণহত্যা বিচারের দাবিকে সমর্থন করবে। আমরা বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন যারা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের বিচার করতে সক্ষম হয়েছি। সেই বিচার এখনো চলছে। বিশ্বের যেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধ হয়েছে, বাংলাদেশ তার সমালোচনা করেছে। এখন সু চি রোহিঙ্গা নির্যাতনের প্রশ্নে ভুল তথ্য দিয়েছেন। তার এই বক্তব্য খ-ন করার দায়িত্ব বাংলাদেশের। বাংলাদেশ তথ্য-প্রমাণসহ কূটনৈতিক চ্যানেলে রোহিঙ্গা সংকটের প্রকৃত কারণ তুলে ধরতে পারে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের রাখাইনে যাওয়ার দাবিও বাংলাদেশ করতে পারে। সেই সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধ খতিয়ে দেখার জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনএইচসিআর যাতে একটি তথ্যানুসন্ধান কমিটি গঠন করতে পারে, সে ব্যাপারটির ব্যাপারেও বাংলাদেশ জোর দিতে পারে।
বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নাগরিককে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের সহানুভূতি অর্জন করেছে। কিন্তু এটা যে একটা নিরাপত্তা সংকট তৈরি করতে পারে, তা আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। অনির্দিষ্টকালের জন্য রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে থাকতে পারে না। তাই সু চির এই মিথ্যাচারের শুধু প্রতিবাদই নয়, বরং এই মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার জন্যও বাংলাদেশকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এ জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে আরও তৎপর হতে হবে। আমাদের ব্যর্থতা রোহিঙ্গাদের একটি অনির্দিষ্টকালের জন্য এই অঞ্চলে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দিতে পারে, যা কিনা পার্বত্যাঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন একটি মাত্রা এনে দিতে পারে ভবিষ্যতে।

রোহিঙ্গা সংকট কি ভারত-চীন সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে

বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে মোদি সরকারের সময় দুই দেশের সম্পর্ক যথেষ্ট উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। কিন্তু ভারতের কাছে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমারের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর তাই ভারত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নীতিকে সমর্থন করবেÑ এটাই স্বাভাবিক। চীনের অবস্থানও অনেকটা তেমনই রোহিঙ্গা নির্যাতনের খবরে সারা বিশ্ব যখন আজ প্রতিবাদমুখর, যখন সাড়ে ৪ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান তাদের জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে, তখন ভারত ও মিয়ানমারের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। ২৫ আগস্ট যখন মিয়ানমারে গণহত্যা শুরু হয়, তার ঠিক এক মাস আগে ৭ জুলাই মিয়ানমারের সিনিয়র জেনারেল ও গণহত্যার অন্যতম রূপকার মিন আউং হ্লাইং ৮ দিনের সফরে ভারতে গিয়েছিলেন। এটা ছিল একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। কেননা মোদি যখন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন, তখন পার্শ্ববর্তী সব সরকারপ্রধানকে দিল্লি আমন্ত্রণ জানালেও তৎকালীন মিয়ানমারের রাষ্ট্রপ্রধান থেইন সেইনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তখন সেনাপ্রধান জেনারেল হ্লাইংকে দিল্লিতে রেড কার্পেট সংবর্ধনা দেয়া কিংবা মিয়ানমারের ৩৭ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলারের টর্পেডো সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে ভারত-মিয়ানমার সম্পর্ক নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। অনেক বিশ্লেষকের ভাষায়, মিয়ানমারে চীনের প্রভাব হ্রাস করার জন্যই ভারত এ ভূমিকা নিয়েছে। ফলে ভারত-চীন সম্পর্ক নতুন করে আবার প্রশ্নের মুখে পড়ল। ডোকলামে স্ট্যাটাস কো বজায় থাকা, শিয়ামেনে (চীনে) সর্বশেষ ব্রিকস সম্মেলনে মোদির যোগদান ও মোদি-শি জিন পিং বৈঠকের পর ধারণা করা হয়েছিল, দুই দেশ বুঝি সম্পর্ক আবার স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাপ্রধানের দিল্লি সফর, সেখানে মোদিসহ নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে বৈঠক কিংবা মিয়ানমারে ভারতের অস্ত্র বিক্রিÑ সব মিলিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে যে আস্থাহীনতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তা রয়েই গেল। খুব সংগত কারণেই এতে ব্রিকসের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বলা ভালো, পাঁচটি দেশ নিয়ে ব্রিকস গঠিত। চীন ও ভারতের পাশাপাশি ব্রিকসে রয়েছে রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল। ব্রিকস বিশ্বের বড় অর্থনীতির জোট। চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বড় অর্থনৈতিক শক্তি। আর ভারত জাপানকে পাস কাটিয়ে এশিয়ায় দ্বিতীয় বড় অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়েছে। সুতরাং ব্রিকস যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে তা যুক্তরাষ্ট্রের একক কর্তৃত্বকে খর্ব করবে। এখানে সাম্প্রতিককালে চীন ও ভারতের মধ্যে একটা আস্থাহীনতার সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ভূমিকা নিয়ে ভারত সন্দিহান। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও মালদ্বীপে চীনের প্রভাব বাড়ছে। চীন যে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড এর এক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করছে (যাতে ভারত যোগ দেয়নি), তা সন্দেহের চোখে দেখছে ভারত। ভারত মনে করে, এর মাধ্যমে চীন এ অঞ্চলে তার প্রভাববলয়ের একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে এবং এ অঞ্চলের দেশগুলোকে তার আওতায় নিয়ে নিচ্ছে। ভারত তাই মনে করে, এসব প্রকল্পের মাধ্যমে এ অঞ্চলে চীন তার প্রভাব ও প্রতিপত্তি বাড়াচ্ছে। ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে এরই মধ্যে চীন ও ভারত একধরনের সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ফলে ব্রিকস কতটুকু সফল হবে কিংবা চীন ও ভারত তাদের বৈরিতা কতটুকু কমিয়ে আনতে পারবে, এ প্রশ্ন ছিল বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, বৈরিতা ভুলে মোদি ব্রিকস সম্মেলনে যোগ দিলেন। শি জিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠক করলেন। এর মধ্য দিয়ে মোদি তার দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। ডোকলাম নিয়ে তিনি এখনও ভারতে কট্টরপন্থীদের চাপের মুখে আছেন। কট্টরপন্থীরা চীনের সঙ্গে এখনই একটি যুদ্ধ চাচ্ছেন! কিন্তু যুদ্ধের চেয়েও এ মুহূর্তে মোদির প্রয়োজন উন্নয়ন। প্রয়োজন তরুণ প্রজন্মের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করা। এজন্য তার প্রয়োজন চীনের আর্থিক সহযোগিতা। ওই সহযোগিতা চীন নিশ্চিত করেছে। এখানে বলা ভালো, প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ গোল্ডম্যান স্যাকসের (Goldman Sachs) ধারণা অনুযায়ী এ ব্রিকস গড়ে ওঠে। ২০০১ সালে এ সংস্থাটির জন্ম। এটি মূলত তিনটি পর্যায় পার করছে। প্রথম পর্যায় ২০০১ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত। এখন পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিকসে যোগ দেয়নি। তখন এই চারটি দেশ শুধু বিনিয়োগ পর্যায়ে তাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখে। ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিকস একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আন্তর্জাতিক আসরে আত্মপ্রকাশ করে। এ সময় দক্ষিণ আফ্রিকা (২০১১) এতে যোগ দেয়। ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয় তৃতীয় পর্যায়। ওই সময় ব্রিকস বিশ্বব্যাংক তথা আইএমএফের বিকল্প হিসেবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে। এ তৃতীয় পর্যায় থেকে যা এখনও চলমান, ব্রিকসকে আন্তর্জাতিক আসরে যথেষ্ট পরিচিত করেছে এবং বিশ্বমিডিয়া তথা বিশ্লেষকরা ব্রিকসকে মনে করছেন মার্কিন আধিপত্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে। আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রশ্নে ব্রিকসে কোনো বিভক্তি নেই। তবে নেতৃত্বের প্রশ্নে এক ধরনের সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতা আছে। বিশেষ করে ব্রিকসের নেতৃত্ব কার কাছে থাকবে, চীন না রাশিয়াÑ এটা নিয়ে এক ধরনের স্নায়বিক প্রতিযোগিতা আছে। অন্যদিকে ভারত ও চীনের মধ্যে রয়েছে এক ধরনের আস্থাহীনতার সম্পর্ক। চীনের অতিমাত্রায় পাকিস্তানপ্রীতি এ আস্থাহীনতার জন্ম দিয়েছে। শুধু ডোকলাম নয়, বরং ভারতের অরুণাচল রাজ্য নিয়েও ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে সর্বশেষ নবম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলন প্রমাণ করল, ব্রিকস নেতারা আঞ্চলিক দ্বন্দ্বকে পাস কাটিয়ে তাকাতে চান সামনের দিকে। ব্রিকসের সার্থকতা এখানেই। ব্রিকস বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এরই মধ্যে আবির্ভূত হয়েছে। জোটটি ভবিষ্যতে সাম্প্রসারিত হবে কিনা, তা এ মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে ব্রিকস যে আঞ্চলিক অর্থনৈতিক শক্তিগুলোকে সংস্থাটির সঙ্গে রাখতে চায়, তা স্পষ্ট। এ কারণেই এবার শীর্ষ সম্মেলনে মিসর, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, তাজিকিস্তান, গায়ানার রাষ্ট্র তথা সরকারপ্রধানরা এ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এসব দেশ এক-একটি উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি। এ দেশগুলো যদি যে কোনো প্রক্রিয়ায় (অনেকটা আসিয়ানের মতো) ব্রিকসে যোগ দেয়, তা ব্রিকসের শক্তিকে আরও শক্তিশালী করবে। তবে এক্ষেত্রে সরাসরি সদস্য হিসেবে যোগ না দিয়ে সহযোগী সদস্য হিসেবে এ দেশগুলো ব্রিকসের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে। বর্তমানে বিশ্বের শতকরা ৪০ ভাগ মানুষ এ ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোয় বসবাস করে। বিশ্ব জিডিপির শতকরা ২৩ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে ব্রিকস। ফলে ব্রিকস যে বিশ্ব রাজনীতিতে আলোচনায় থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তবে সামনের দিনগুলো ব্রিকসের জন্য যে সহজ, তা বলা যাবে না। এবারের শীর্ষ সম্মেলনের সেøাগান ছিল ভবিষ্যতের জন্য শক্তিশালী সম্মানিত উদ্যোগ। মেসেজটি পরিষ্কারÑ পশ্চিমা আধিপত্য, পশ্চিমা অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে নতুন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্ম দেয়া। এ কারণেই ব্রিকস ২০১৪ সালে নতুন একটি বিনিয়োগ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে, যার নাম নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এ ব্যাংক এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রজেক্টে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। মূলত চীন, ভারত ও রাশিয়ায় এ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এবারের শীর্ষ সম্মেলনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা ইস্যু নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি কীভাবে যৌথভাবে মোকাবিলা করা যায়, এটাও আলোচনা হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন বর্তমান বিশ্বে একটি বহুল আলোচিত বিষয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসার (কপ-২১) সিদ্ধান্ত সম্মেলনে আলোচিত হয়। এখানে একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো, বিশেষ করে চীন ও ভারত প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল, তার প্রতি কমিটমেন্ট করেছে। সবুজ এনার্জির কথাও তারা বলেছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, বলা হয়ে থাকে চীন ও ভারত হচ্ছে শীর্ষ পরিবেশ দূষণকারী দুইটি দেশ। এ দুইটি দেশে কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। এর ফলে পরিবেশ দূষণ হয়। চীন এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। চীন সোলার এনার্জি সেক্টরে বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছে এবং একটা পরিবর্তনও এনেছে চীন। চীনের অনেক ছোট ছোট শহর অনেকটাই এখন সোলার এনার্জিনির্ভর। চীন এ সবুজ এনার্জি ছড়িয়ে দিতে চায় বিশ্বের সর্বত্র। এখানেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের পার্থক্য। যুক্তরাষ্ট্র যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর তাদের নির্ভরতা আরও বাড়িয়েছে এবং তেল ও গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি করেছে, সেখানে চীন ও ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর (ফসিল ফুয়েল) তাদের নির্ভরতা কমানোর কথা বলছে।
ফলে ব্রিকসের সম্ভাবনা যখন বিশ্ব আসরে বাড়ছে, তখন চীন ও ভারতের বৈরিতা কোনো ভালো খবর হতে পারে না। রোহিঙ্গা প্রশ্নে দেশ দুইটির মধ্যে মূলত তেমন কোনো মতপার্তক্য নেই। উভয় দেশই রোহিঙ্গা প্রশ্নে মিয়ানমারের অবস্থানকে সমর্থন করছে। অর্থাৎ এখানে বাংলাদেশবিরোধী একটি অবস্থান তারা নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ নিয়ে। ভারত কর্তৃক মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ চীন খুব ভালো চোখে নেবে না। রোহিঙ্গা প্রশ্নটির সঙ্গে দেশ দুইটির যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। নিজেদের জাতীয় স্বার্থের আলোকেই দেশ দুইটি তাদের রোহিঙ্গা নীতি পরিচালনা করছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে তাদের স্বার্থ উপেক্ষিত হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে ভারত গুরুত্ব দেয়। বিশেষ করে মোদি সরকারের সময় দুই দেশের সম্পর্ক যথেষ্ট উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। কিন্তু ভারতের কাছে এ মুহূর্তে বাংলাদেশের চেয়ে মিয়ানমারের গুরুত্ব অনেক বেশি। আর তাই ভারত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নীতিকে সমর্থন করবেÑ এটাই স্বাভাবিক। চীনের অবস্থানও অনেকটা তেমনই। বাংলাদেশের ব্যাপারে চীনের স্বার্থ থাকলেও চীন মিয়ানমারকে গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। যে প্রয়োজনে বাংলাদেশকে প্রয়োজন ছিল চীনের (বিসিআইএম করিডোর, সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর), সে প্রয়োজন এখন মিয়ানমার মেটাচ্ছে। সোনাদিয়ার বদলে আরাকান উপকূলে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। সেই সঙ্গে রয়েছে আরাকান গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত ও উত্তোলিত গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিংয়ে নিয়ে যাওয়া। ফলে চীনের কাছে স্ট্র্যাটেজিক কারণেই বাংলাদেশ গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীন ও ভারতের অবস্থান এক হলেও প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে চীন ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকে যাবেই। এ দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত ব্রিকসের বিকাশকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে! তবে বাংলাদেশের জন্য যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে বাংলাদেশের উচিত হবে তার স্বার্থকে আদায় করে নেয়া। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের অগ্রাধিকার হচ্ছে রোহিঙ্গদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন, সেখানে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং আরাকানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা। বাংলাদেশকে এ লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশ তিনটি বড় দেশ চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ককে ব্যবহার করে রোহিঙ্গা প্রশ্নে অগ্রাধিকারগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। এজন্য দরকার স্মার্ট ডিপ্লোম্যাসি।


রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কোন পথে

নতুন করে যখন প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তখন সংগত কারণেই একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে। আর তা হচ্ছে ওপারে চারটি গ্রাম নিয়ে একটি 'সেফ জোন' প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করেছিল, যা জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। কিন্তু গত ১৪ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও সরকারের মূল ব্যক্তি অং সান সু চির অফিস থেকে জানানো হয়েছে মিয়ানমার এ ধরনের প্রস্তাবে রাজি হবে না। দ্বিতীয় আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতভাবে দীর্ঘমেয়াদে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সম্মত হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে রাখাইনের সামরিক অভিযানে 'মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ' এর অভিযোগ তোলা হয়। সেখানে চলমান সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ত্রাণ কর্মীদের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের তাগিদ দেয়া হয়। এটা নাকি এক বিরল ঐকমত্য? ১৫টি সদস্য রাষ্ট্রই সহিংসতা বন্ধে একমত পোষণ করে। কিন্তু মিসর প্রস্তাব করেছিল রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাবার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার। চীন তাতে রাজি হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের কী লাভ হলো? এরা পরলেন এক অনিশ্চয়তার মুখে। তাদের নিজ দেশে ফিরে যাবার সম্ভাবনাও এখন ক্ষীণ। নিরাপত্তা পরিষদের এই সিদ্ধান্ত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে না। প্রথমত, রোহিঙ্গারা যে নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয়ত, যারা সেখানে অপরাধ সংগঠিত করেছে, তাদের বিচারের ব্যাপারে কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠনের কথাও বলা হয়নি। এতে তো সেখানে যুদ্ধবাজদের উৎসাহিত করা হলো। তৃতীয়ত, সাধারণত এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে থাকে। অতি সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির ব্যাপারে দেশটির বিরুদ্ধে নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে নিরাপত্তা পরিষদ। অতীতে ইরাকে সাদ্দাম হোসেন সরকারের বিরুদ্ধেও অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল নিরাপত্তা পরিষদ। ইরানের বিরুদ্ধেও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার যখন স্পষ্টতই জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানে লিপ্ত, যখন শত শত শিশু ও নারী তারা হত্যা করেছে, তখন জাতিসংঘের কোনো ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। শুধু সহিংসতা বন্ধের আহ্বান রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখবে না। সেখানকার যুদ্ধবাজদের যদি বিচার করা যেত, তাহলে অন্তত সতর্ক থাকত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী! আজকে জাতিসংঘ যতই বিবৃতি দিক, কিংবা জাতিসংঘের মহাসচিব যতই সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানান না কেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই একটি বড় 'অর্জন' করেছে। তারা আরাকানে বসবাসকারী প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে হয় হত্যা, নতুবা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। এবং কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা না হওয়ায় আগামীতে দশ লাখ মানুষ আরাকান ত্যাগ করতে বাধ্য হবে।
মিয়ানমারের গণহত্যা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই গণ হত্যায় কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তার কোনো সুস্পষ্ট তথ্য এখন অবধি পাওয়া না গেলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সোসাল মিডিয়ায় গণহত্যা ও নিযার্তনের যে ছবি ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা বিশ্বের গণতহত্যার ইতিহাসে নতুন এক সংযোজন। এই গণহত্যায় টার্গের করা হয়েছে মিয়ানমারের মুসলমানদের, যারা রোহিঙ্গা হিসেবে বেশি পরিচিত। খোদ জাতিসংঘের মানবধিকারবিষয়ক শীর্ষ কর্মকার্তা এটাকে 'গণহত্যা' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং আজ এই গণত্যার সাথে যারা জড়িত তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার করা প্রয়োজন। অং সান সু চি, যিনি মিয়ানমার সরকারের মূল ব্যাক্তি ও যার নেতৃত্ব সকরার পরিচালিত হয়। তিনি তার দায় এড়াতে পারেন না। কেননা এই হত্যাকা-ের সব দায় দায়িত্ব তার। তাকেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই অতীতে, যেখানেই মানবতাবিরোধি অপরাধ হয়েছে (হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি নষ্ট), আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, সেখানে যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার করেছে। লাইব্রেরিয়ার যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট চার্লস টেলরেকে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাকে ৫০ বছর কারাদ- দিয়েছে। সাবেক যুগোসস্নাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মিলোসেভিচও অভিযুক্ত হয়েছিলেন মুসলমানদের গণহত্যায়। তার বিচার শুরু হয়েছিল হেগে। হৃদযন্ত্রের ক্রীড়া বন্ধ হয়ে জেলেই তার মৃত্যু হয়। তবে অপরাপর সার্ব যুদ্ধবাজদের অনেকেরই বিচার হয়েছে এবং তারা শাস্তি ভোগ করছেন। রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য (হুতু উপজাতি বনাম তুতসি উপজাতি) যেসব রাজনীতিবিদ ও সেনা কমান্ডাররা জড়িত ছিল, তাদের প্রায় সবার বিচার হয়েছে। কেনিয়ায় জাতিগত সহিংসতার জন্য (২০০৭-২০০৮) যে হাজার হাজার মানুষ সেখানে মারা গিয়েছিল, তার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্ত্বাকে সমন পর্যন্ত জারি করেছিলেন। তার বিচার 'স্থগিত' করা হয়েছিল বটে। কিন্তু ভাইস-প্রেসিডেন্টের বিচার হচ্ছে। এ ধরনের গণহত্যা বিশেষ করে ধর্ষণ, হত্যা, লুণ্ঠন, শিশু ও নারী হত্যাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছে। সুতরাং আজ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য এ ধরনের একটি আদালত গঠনের প্রয়োজন; কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সেটি করা কতটুকু সম্ভব হবে, কিংবা আদৌ সম্ভব হবে কি-না সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। কেননা আঞ্চলিক শক্তিগুলো, বিশেষ করে চীন ও ভারতের বিশাল স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারের। আরাকানের গভীর সমুদ্রে বিশাল গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। চীন ও ভারত সেখানে বিনিয়োগ করেছে। চীন সেখানে প্রাপ্ত ও উত্তোলিত গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে ইউনানের কুনমিং-এ গ্যাস নিচ্ছে চীন। উপরন্তু আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কাইয়াকুক পিউই (কুধঁশ চযুঁ) এ একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। এ ধরনের একটি সমুদ্রবন্দর কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় নির্মাণ করতে চেয়েছিল চীন। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এই সমুদ্রবন্দরটি চীনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সড়কপথে এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে করে ইউনান প্রদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অর্ধেক সময় কম লাগবে। ফলে পণ্যের মূল্যও কম হবে। সুতরাং চীন রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে চীনের তাতে আপত্তি থাকবে। ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে। আরাকানে ভারত সড়ক নির্মাণ করছে। ভারতের দুটি রাজ্যের সঙ্গে আরাকানের সীমান্ত রয়েছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের অভ্যন্তরে হামলা করে আশ্রয় নেয় আরাকানের গভীর জঙ্গলে। এক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরাকানে ওইসব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে অনুমতি দিয়েছিল। সুতরাং ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রেরও এ অঞ্চলের ব্যাপারে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। আরাকান সমুদ্রবর্তী গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। মার্কিন কোম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগ করতে চায়। উপরন্তু চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে হলে ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারকেও প্রয়োজন মার্কিন স্ট্রাটেজিস্টদের। বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের দীর্ঘদিনের। এক্ষেত্রে মুখে মানবাধিকার লংঘনের কথা বললেও কার্যত যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রশ্নে তেমন কোনো কঠোর অবস্থানে যাবে না। ভূ-রাজনীতির কারণে বাংলাদেশকে তাই একাই এ সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে_ তা আশা করতে পারি না। পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অতি সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করে গেছেন। তার ওই সফরের সময় রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পেঁৗছেছিল। রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, উপরন্তু জাতিসংঘের মতে, প্রায় কয়েক লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় কিংবা আশ্রয়ের সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও এই গণহত্যার ব্যাপারে মোদি-অং সান সু চি আলোচনায় কিংবা যৌথ ইশতেহারে কোনো কথা বলা হয়নি। তারা আরাকানের নিরাপত্তা ইস্যুটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বলেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে তারা যৌথভাবে কাজ করবেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর বালিতে (ইন্দোনেশিয়া) 'ওয়ার্ল্ড পার্লামেন্টোরি ফোরাম অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট' শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। ওই সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু 'সহিংসতার ঘটনা যথার্থ নয়' বলে ঘোষণাপত্র থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ভারত। এতেই প্রমাণিত হয় রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে থাকবে না ভারত। ফলে রোহিঙ্গা নিয়ে আঞ্চলিক সমাধানের পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। এতে করে রোহিঙ্গারা আদৌ নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে কি-না, সে সন্দেহ থাকলই। মিয়ানমার ১৯৮২ সালে সেখানে একটি তথাকথিত নাগরিকত্ব আইন চালু করেছিল। যার মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে আসছিল। এই প্রক্রিয়া, অর্থাৎ মিয়ানমারকে মুসলমানশূন্য করা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায়ই বর্তমান সংকটের জন্ম। সুতরাং মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে_ আমরা যদি এটা চিন্তা করে থাকি, আমরা এটা ভুল করেছি। তারা কোনোদিনই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। সুতরাং একটা শঙ্কা থেকেই গেল বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী? এদের একটা অংশ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে কেউ কেউ। বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন কেউ কেউ। আবার একটা অংশ রয়ে গেছে শরণার্থী শিবিরে। যদিও এটা সত্য শরণার্থী ক্যাম্পে যারা আছেন, তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্তৃক নিবন্ধিত। কিন্তু একটা বড় অংশই নিবন্ধিত নয়।
এই সংকট আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ খুব ঘনবসতির দেশ। একটি ছোট দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ বসবাস করে। আমরা নতুন করে 'বিদেশি' অর্থাৎ মিয়ানমারের নাগরিকদের অনির্দিষ্টকালের জন্য আশ্রয় দিতে পারি না। এ ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট নীতিমালা দরকার। বিদেশি মেহমানরা বাংলাদেশে এসে আমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করলেও আমাদের কোনো সিনিয়র মন্ত্রীকে বিদেশে তৎপর হতে দেখিনি। বিদেশি মেহমানরা সবাই আমাদের সাহায্যের কথা বলছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে তাদের কারো কোনো কর্মসূচি নেই। এমনকি কোনো পক্ষ থেকেই কেউ মিয়ানমার সরকারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের কথাও বলছেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনের স্বার্থের কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। গত ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং নিন্দাও জানানো হয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার মতো কোনো অর্থনৈতিক অবরোধের কথা বলা হয়নি। এতে করে তো আরাকানে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হবে না এবং নিরাপত্তা পরিষদের কোনো অনুমোদন না থাকায় সেখানে গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও গঠন করা যাবে না। ফলে বর্তমান সংকটে বাংলাদেশে আসা ৪ লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরতে পারবেন কি-না, এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সমস্যায় এদের অন্যদেশে পুনর্বাসন করবে, এটাও আমার মনে হয় না। তারা এখন স্থায়ী শরণার্থীতে পরিণত হতে যাচ্ছেন। বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের শরণার্থীদের কাহিনী আমরা জানি। খুব কম ক্ষেত্রেই শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে গেছেন। ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস আমরা জানি। সিরিয়া ও ইরাক থেকে যারা দেশান্তরিত হয়ে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছেন এরাও নিজ দেশে ফিরে যাবেন, এটা আশা করতে পারি না। 
আজ দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক. রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের তৎপর হওয়া। কূটনৈতিক চ্যানেলে বাংলাদেশের ভূমিকাকে আরও সম্প্রসারিত করা। দুই. মিয়ানমারে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক একটি প্যানেলের মাধ্যমে চিহ্নিত করা এবং তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার করা। অং সান সু চি তার দায় এড়াতে পারেন না। তাকেও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে।



ভূ-রাজনীতি, করপোরেট সংস্কৃতি ও রোহিঙ্গা সংকট

রোহিঙ্গা সংকট চতুর্থ সপ্তাহে গড়িয়েছে। এটা এখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে যে এই সংকটকে শুধু একটি জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানই নয়, বরং এর সঙ্গে এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি ও করপোরেট জগতের একটি স্বার্থও জড়িত। এ অঞ্চলে, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগরঘেঁষা আরাকান স্টেটের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এবং আঞ্চলিক তথা বৃহৎ শক্তির স্বার্থ রয়েছে এ অঞ্চলে। চীন ও ভারতের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে। আর একই সঙ্গে রয়েছে ব্যবসায়িক স্বার্থ। আর তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে রোহিঙ্গারা। এ অঞ্চলে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। কাঠ, কৃষি, সুপেয় পানির পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর খনিজ সম্পদ, যা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। আর এসব প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে আকৃষ্ট হয়েছে বহুজাতিক কম্পানিগুলো।
যাঁরা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা রাখেন তাঁরা জানেন সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষভাবে ও পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে।
অনেক সিনিয়র জেনারেলের স্ত্রীরা দামি পাথর ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। এসব প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে দামি পাথর আহরণ, কাঠ সংগ্রহ করা, খনিজ সম্পদ আহরণ করাএগুলো নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডারদের হাতেই এ ব্যবসা পরিচালনার ভার অর্পিত। সুতরাং বিদেশি বিনিয়োগকারীরা (চীন ও জাপানি বিনিয়োগকারী) সরাসরি এসব আঞ্চলিক কমান্ডারকে হাতে রেখে, তাদের ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে এ অঞ্চলে পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। ২০১২ সালে মিয়ানমারে একটি ভূমি আইন পাস হয়েছে। এই ভূমি আইনের কারণেই সরকার প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের নামে ভূমি অধিগ্রহণ করছে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ না করেই। করপোরেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। কেননা জমি অধিগ্রহণ না করলে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা যাবে না। আর এভাবেই পরিকল্পিতভাবে আরাকানের রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা আর কোনো দিন নিজ বাসভূমে ফিরতে না পারে।
বলা হচ্ছে, বঙ্গোপসাগরঘেঁষা আরাকান ও বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে সমুদ্রের গভীরে প্রায় ২০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে। ২০০৪ সালে আরাকান গভীর সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কৃত হয়। ২০১৩ সালে চীন এখানে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করে এই গ্যাস চীনের ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ে নিচ্ছে। উপরন্তু আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কাইয়াকুক পিউইয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। এ ধরনের একটি সমুদ্রবন্দর কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় নির্মাণ করতে চেয়েছিল চীন। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। সমুদ্রবন্দরটি চীনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সড়কপথে এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে ইউনান প্রদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অর্ধেক সময় কম লাগবে। ফলে পণ্যের মূল্যও কম হবে। সুতরাং চীন রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াবে না। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে চীন তাতে ভেটো দেবে। ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে। আরাকানে ভারত সড়ক নির্মাণ করছে। ভারতের দুটি রাজ্যের সঙ্গে আরাকানের সীমান্ত রয়েছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের অভ্যন্তরে হামলা করে আশ্রয় নেয় আরাকানের গভীর জঙ্গলে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরাকানে ওই সব বিচ্ছিন্নতাবাদীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে অনুমতি দিয়েছিল। সুতরাং ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রেরও এ অঞ্চলের ব্যাপারে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। আরাকানলাগোয়া গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। মার্কিন কম্পানিগুলো সেখানে বিনিয়োগ করতে চায়। উপরন্তু চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে হলে ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারকেও প্রয়োজন মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের। বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের দীর্ঘদিনের। এ ক্ষেত্রে মুখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বললেও কার্যত যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রশ্নে তেমন কোনো কঠোর অবস্থানে যাবে না। ভূ-রাজনীতির কারণে বাংলাদেশকে তাই একাই এ সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে, তা আশা করতে পারি না।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অতি সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করে গেছেন। তাঁর ওই সফরের সময় রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, উপরন্তু জাতিসংঘের মতে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় কিংবা আশ্রয়ের সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও এ গণহত্যার ব্যাপারে মোদি-অং সান সু চির আলোচনায় কিংবা যৌথ ইশতেহারে কোনো কথা বলা হয়নি। তাঁরা আরাকানের নিরাপত্তা ইস্যুটিকে প্রধান করেছেন এবং বলেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে তাঁরা যৌথভাবে কাজ করবেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর বালিতে ওয়ার্ল্ড পার্লামেন্টারি ফোরাম অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। ওই সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ওই সহিংসতার ঘটনা যথার্থ নয় বলে ঘোষণাপত্র থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ভারত। এ দুটি ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয় যে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে নয়, বরং মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত। এখানে ভূ-রাজনীতিটাই আসল। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও তেমনই। যুক্তরাষ্ট্রের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারে। মিয়ানমার এখন একরকম উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার কারণে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা এখন দলে দলে মিয়ানমারে ভিড় করছে। মার্কিন বিনিয়োগ সেখানে বাড়ছে।
স্ট্র্যাটেজিক্যালি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ওই অঞ্চলের গুরুত্ব অনেক বেশি। মিয়ানমারের তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকারকে আস্থায় রেখে যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে চায়। তাদের স্ট্র্যাটেজি পরিষ্কারচীনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারকে ব্যবহার করা। এ অঞ্চলে বিদ্রোহীদের উসকে দিয়ে চীনে গ্যাস তথা তেল সরবরাহের পাইপলাইন বন্ধ করে দেওয়া। এর ফলে চীনের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একই সঙ্গে বৃহত্তর বঙ্গোপসাগরে যুক্তরাষ্ট্র তার মেরিন উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায়। এই মেরিন উপস্থিতি প্রয়োজনে চীনা গ্যাস ও তেল সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে। চীনের প্রচুর জ্বালানি শক্তির প্রয়োজন। চাহিদাও বেশি। ওই জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতেই চীন এ অঞ্চলের সমুদ্রবন্দরগুলোকে একটি নেটওয়ার্কের আওতায় এনেছে, যাকে চীন বলছে ঝঃত্রহম ড়ভ চবধত্ষং বা মুক্তার মালা নীতি। এই নেটওয়ার্ক যদি ভেঙে ফেলা যায়, তাহলে চীনের জ্বালানি সরবরাহে ঘাটতি দেখা দেবে। এমনকি চীন যে ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড নামে এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে তা-ও বাস্তবায়িত হবে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির সঙ্গে মিল আছে ভারতের। ভারত এ মহাপরিকল্পনায় যুক্ত হয়নি। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ হচ্ছে মিয়ানমারকে তাদের একটি পরিকল্পনায় যুক্ত করা।
মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ফলে মিয়ানমারের সেনা নেতৃত্ব কখনোই চীনবিরোধী কোনো অ্যালায়েন্সে যোগ দেবে না। তাই সংগত কারণেই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্ব পাবে কম। তবে এখানে আরো একটা সম্ভাবনার কথা একেবারে ফেলে দেওয়া যায় না। আর তা হচ্ছে আরাকান মুসলিম নিধনকে সামনে রেখে এ অঞ্চলে আল-কায়েদা ও আইএসের জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ও তাদের সামরিক তত্পরতা! আরাকান স্যালভেশন আর্মির খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাদের সশস্ত্র তত্পরতা ও তাদের নেতাদের বক্তব্য প্রচারিত হচ্ছে। আইএস এভাবেই সিরিয়া ও ইরাকে তাদের তত্পরতা বৃদ্ধি করে বিশ্বকে অবাক করে দিয়েছিল। এখন তাদের সেই খিলাফতের দিন শেষ। সিরিয়ার রাকা থেকে আইএস এখন পালাচ্ছে। ভুলে গেলে চলবে না, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ায় আইএস তথা আল-কায়েদা সংশ্লিষ্ট জঙ্গি সংগঠনগুলো তত্পর। ফিলিপাইনের সলু দ্বীপপুঞ্জের একটি এলাকা নিয়ে তারা সেখানে তাদের প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। সেনাবাহিনী সেখানে দীর্ঘদিন ধরে অপারেশন পরিচালনা করছে। ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলোর তত্পরতা এখন সিরিয়া-ইরাক থেকে হ্রাস পেয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সুতরাং জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছে আরাকান এখন একটি মোক্ষম এলাকা। বঙ্গোপসাগরবেষ্টিত আরাকানে জঙ্গি তত্পরতা বেড়ে যাওয়ার জন্য উত্তম একটি জায়গা। ভয়টা হচ্ছে আইএস যদি আরাকানে ঘাঁটি গাড়তে পারে(?) তাতে আক্রান্ত হবে বাংলাদেশও। বৃহত্তর কক্সবাজার অঞ্চলে জঙ্গি তত্পরতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই গেল।
রোহিঙ্গা সমস্যার একটি ধর্মীয় দিক আছে, এটা সত্য। মিয়ানমারে কট্টরপন্থী বৌদ্ধদের প্রভাব বাড়ছে। তারা মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। তারা মুসলমানদের উত্খাত করে আরাকানে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়াতে চায়, এটা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও সত্য, মিয়ানমারে একদিকে বহুজাতিক কম্পানির প্রভাব বাড়ছে, অন্যদিকে বৃহৎ শক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের আর্থিক সংশ্লিষ্টতা বাড়ছে। আরাকানের গভীর সমুদ্রে গ্যাস ও তেলপ্রাপ্তি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের পরিস্থিতিকে আরো জটিল করবে। চীন একদিকে তার তেল ও গ্যাস সরবরাহ (থান শ গ্যাসক্ষেত্র থেকে পাইপযোগে ইউনানের কুনমিং) যেমন নিশ্চিত করতে চাইবে, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাইবে এতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে। ফলে আরাকানের পরিস্থিতি যে ভবিষ্যতে আরো জটিল হবে, তা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি। ফলে এই ভূ-রাজনীতি আর করপোরেট স্বার্থ রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যেতে পারে।
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলো। এ জন্য বাংলাদেশ কোনোভাবেই দায়ী নয়। বাংলাদেশের নমনীয় কূটনীতিও লক্ষ করার মতো। রোহিঙ্গা সমস্যা যখন বাড়ছে তখন খাদ্যমন্ত্রী মিয়ানমার গেছেন। বাংলাদেশ সরকার কোনো কড়া বিবৃতিও দেয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকেও সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ সম্ভবত একটি লো প্রফাইল কূটনীতি গ্রহণ করছে। সম্ভবত বাংলাদেশ চায় না রোহিঙ্গা প্রশ্নে কড়া অবস্থান নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হোক। মিয়ানমারে আমাদের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। বিমসটেক কিংবা বিসিআইএম করিডরে দেশ দুটি একসঙ্গে কাজ করছে। বাংলাদেশ তাই অর্থনৈতিক স্বার্থকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশ প্রায় চার লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে মানবিকতা প্রদর্শন করেছে, যা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু এর নেতিবাচক দিকটিও বিবেচনায় নিতে হবে। এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার উপস্থিতি, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর তত্পরতা আরাকানসহ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী একাধিক জেলাকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। আইএস সিরিয়া ও ইরাকের একটা অংশ নিয়ে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট প্রতিষ্ঠা করেছিল। মার্কিন (এবং ইসরায়েলি কানেকশনে) গোপন দলিলে একটি তথাকথিত রোহিঙ্গা ল্যান্ড প্রতিষ্ঠার (?) খবরও আমি পড়েছি। ভবিষ্যতে কী হবে বলা মুশকিল। তবে বাংলাদেশ যে বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়ল, তা অস্বীকার করা যাবে না।