প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের
অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি
ভাষণটি দেন। তার এ ভাষণে তিনি উত্তর কোরিয়া ও ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এবং
জলবায়ু চুক্তি নিয়ে কথা বলেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো আমাদের আগেই জানিয়ে
দিয়েছিল ট্রাম্প কোন কোন বিষয়ে কথা বলবেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তার এ ভাষণ তেমন
গুরুত্বপূর্ণ নয়। কেননা যেখানে ৪ লাখের ওপর রোহিঙ্গা নাগরিককে জোর করে বাংলাদেশে
ঠেলে দেয়া হয়েছে, যেখানে জাতিসংঘের শীর্ষ কর্মকর্তার মতে রাখাইনে ‘গণহত্যা’ হয়েছে, সেখানে সঙ্গত কারণেই প্রত্যাশা ছিল ট্রাম্প এ ‘গণহত্যা’ ও রোহিঙ্গা
শরণার্থীদের নিয়ে কথা বলবেন। কিন্তু তিনি তা বলেননি। তিনি যে বলবেন না, এটা আমরা জানতাম। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছেও বিষয়টি স্পষ্ট
ছিল। আর এ জন্যই তিনি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ট্রাম্পের
সঙ্গে কয়েক মিনিটের আলাপে তিনি বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রসঙ্গটি তুললেও
ট্রাম্প এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি। প্রধানমন্ত্রী এটা আরও স্পষ্ট করেছেন,
‘শরণার্থীদের বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থান পরিষ্কার। সে জন্য রোহিঙ্গা মুসলিম
শরণার্থীদের বিষয়ে ট্রাম্পের সহায়তা চেয়ে কোনো কাজ হবে না।’ অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের
ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স বুধবার জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা
সংকট অবসানে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে ‘বলিষ্ঠ ও দ্রুত’ পদক্ষেপ নিতে বলেছেন
ট্রাম্প।
তবে
জাতিসংঘে ট্রাম্পের ভাষণে সিরীয় শরণার্থীদের কথা এসেছে। শরণার্থীদের পুনর্বাসন
নিয়েও কথা বলেছেন তিনি। প্রসঙ্গক্রমে এসেছে দক্ষিণ সুদান, ইয়েমেন আর সোমালিয়ার কথা। অথচ মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যে মানবিক
বিপর্যয় ঘটেছে, কয়েক লাখ শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে,
তা তিনি এড়িয়ে গেছেন। তিনি সিরিয়া ও দক্ষিণ সুদানের শরণার্থী সংকটের
কথা যখন বলতে পারেন, তখন তো রোহিঙ্গা প্রসঙ্গও আসা উচিত
ছিল! তিনি কি সচেতনভাবে রোহিঙ্গাদের বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন, নাকি
অসচেতনভাবেই বিষয়টি বাদ পড়ে গেছে? কিন্তু এ বিষয়টি বাদ
পড়ার কথা নয় কোনোভাবেই। তিনি যখন উত্তর কোরিয়া কিংবা ইরানকে ‘রগ স্টেট’ বা
দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যখন কিউবা কিংবা
ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘স্বৈরাচারী’ ও ‘একনায়কতন্ত্রী’ হিসেবে অভিহিত করেন, তখন মিয়ানমারের সামরিক
জান্তার মানবতাবিরোধী অপরাধ এড়িয়ে যান কীভাবে? উত্তর
কোরিয়া তার পারমাণবিক কর্মসূচি অব্যাহত রেখে যদি ‘অপরাধ’ করে
থাকে, তাহলে তার চেয়ে বেশি ‘অপরাধ’ করেছেন
মিয়ানমারের সামরিক শাসক ও বেসামরিক প্রশাসন। অং সান সু চি গণতান্ত্রিকভাবে
নির্বাচিত নেত্রী হতে পারেন, কিন্তু তিনি গণহত্যার দায়
এড়াতে পারেন না। ১৯ সেপ্টেম্বর তিনি জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় এ ভাষণকে মিথ্যা ভাষণ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। সু
চি তার ভাষণে বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী
কোনো ‘জাতিগত
নির্মূল’ অভিযান
চালাচ্ছে না। অথচ বিবিসির জনাথন হেড নিজে মংডু থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলেছেন,
সেনা অভিযান চলছে এবং রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে।
রিতা চক্রবর্তীর আরেকটি প্রতিবেদন (বিবিসি) অনুযায়ী, বাংলাদেশের
সীমান্ত থেকে পরিষ্কার দেখা গেছে আগুনের ধোঁয়া। তাহলে বিবিসির এসব প্রতিবেদন কি
মিথ্যা? আসলে সু চি মিথ্যাচার করেছেন। সত্যকে লুকানোর
চেষ্টা করেছেন। আর সেনাবাহিনীর শিখিয়ে দেয়া ভাষণই তিনি পাঠ করেছেন মাত্র।
ট্রাম্প আর সু চির বক্তব্যের মধ্যে অদ্ভুত এক ‘মিল’ আছে- রোহিঙ্গারা যে টার্গেট হয়েছেন এবং তাদের যে উচ্ছেদ করা হয়েছে, তা কেউই স্বীকার করেননি। ট্রাম্প মূলত কর্পোরেট জগতের বাসিন্দা। যেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে, সেখানে তিনি আছেন এবং সেভাবেই তৈরি হচ্ছে নীতি। মিয়ানমারে তার স্বার্থ রয়েছে। তাই তিনি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কথা বলেননি। সেখানে রয়েছে প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। কাঠ, কৃষি, সুপেয় পানির পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর খনিজসম্পদ, যা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। আর এসব প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে আকৃষ্ট হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। যারা মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মিয়ানমারের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে। অনেক সিনিয়র জেনারেলের স্ত্রীরা দামি পাথর ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। ওইসব প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে দামি পাথর আহরণ, কাঠ সংগ্রহ, খনিজসম্পদ আহরণ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডারদের হাতেই এ ব্যবসা পরিচালনার ভার অর্পিত। তাই বিদেশি বিনিয়োগকারীরা (চীন ও জাপানি) সরাসরি এসব আঞ্চলিক কমান্ডারকে হাতে রেখে তাদের ব্যবসায়িক পার্টনার বানিয়ে এ অঞ্চলে পুঁজি বিনিয়োগ করেছে। ২০১২ সালে মিয়ানমারে একটি ভূমি আইন পাস হয়েছে। এ ভূমি আইনের কারণেই সরকার ‘প্রাকৃতিক সম্পদ’ আহরণের নামে ভূমি অধিগ্রহণ করছে কোনো ধরনের ক্ষতিপূরণ না দিয়েই। কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের স্বার্থেই এটা করা হয়েছে। কেননা জমি অধিগ্রহণ না করলে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করা যাবে না। আর এভাবেই পরিকল্পিতভাবে আরাকানের রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমি থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, যাতে তারা আর কোনোদিন নিজ বাসভূমে ফিরতে না পারে। বলা হচ্ছে, বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা আরাকান এবং বাংলাদেশের কক্সবাজার অঞ্চলে সমুদ্রের গভীরে প্রায় ২০০ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস রয়েছে। ২০০৪ সালের আরাকানের গভীর সমুদ্রে গ্যাস আবিষ্কৃত হয়। ২০১৩ সালে চীন এখানে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন করে তার ইউনান প্রদেশের কুনমিংয়ে গ্যাস নিচ্ছে। উপরন্তু আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কাইয়াউকফিউয়ে (Kyaukphyu) একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। এ ধরনের একটি সমুদ্রবন্দর কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় নির্মাণ করতে চেয়েছিল চীন। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এ সমুদ্রবন্দরটি চীনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সড়কপথে এ গভীর সমুদ্রবন্দর চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে করে ইউনান প্রদেশের পণ্য আমদানি-রফতানিতে অর্ধেক সময় কম লাগবে। ফলে পণ্যের মূল্যও কম হবে। তাই চীন রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে চীনের সমর্থন পাওয়া যাবে না।
ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে। আরাকানে ভারত সড়ক নির্মাণ করছে। ভারতের দুটি রাজ্যের সঙ্গে আরাকানের সীমান্ত রয়েছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা দেশের অভ্যন্তরে হামলা করে আশ্রয় নেয় আরাকানের গভীর জঙ্গলে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকার ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরাকানে ওইসব বিচ্ছিন্নতাবাদীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করার অনুমতি দিয়েছিল। সুতরাং ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে এটাই স্বাভাবিক।
যুক্তরাষ্ট্রেরও এ অঞ্চলে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। আরাকান সমুদ্রবর্তী গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। মার্কিন কোম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগ করতে চায়। উপরন্তু চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে হলে ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারকেও প্রয়োজন মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের। বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের দীর্ঘদিনের। এ ক্ষেত্রে মুখে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা বললেও কার্যত যুক্তরাষ্ট্র আগামীতেও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রশ্নে তেমন কোনো কঠোর অবস্থানে যাবে না। ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশকে তাই একাই এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে তা আশা করতে পারি না।
পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করে গেছেন। তার ওই সফরের সময় রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, নারী ধর্ষণ, উপরন্তু জাতিসংঘের মতে ৪ লাখের ওপরে রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় কিংবা আশ্রয়ের সম্ভাবনার কথা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও মোদি-সু চির আলোচনায় কিংবা যৌথ ইশতেহারে এসব ব্যাপারে কোনো কথা বলা হয়নি। তারা আরাকানের নিরাপত্তা ইস্যুটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বলেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে তারা যৌথভাবে কাজ করবেন।
৮ সেপ্টেম্বর বালিতে (ইন্দোনেশিয়া) ওয়ার্ল্ড পার্লামেন্টারি ফোরাম অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। ওই সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল; কিন্তু ‘সহিংসতার ঘটনা যথার্থ নয়’ বলে ঘোষণাপত্র থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ভারত। এতেই প্রমাণিত হয় রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে থাকবে না ভারত। ফলে রোহিঙ্গা নিয়ে আঞ্চলিক সমাধানের পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। এতে করে রোহিঙ্গারা আদৌ নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে কিনা, সে সন্দেহ থাকলই।
মিয়ানমার ১৯৮২ সালে সেখানে একটি তথাকথিত নাগরিকত্ব আইন চালু করেছিল, যার মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে আসছিল। এ প্রক্রিয়া, অর্থাৎ মিয়ানমারকে মুসলমানশূন্য করা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সেই ধারাবাহিকতাই বর্তমান সংকটের জন্ম। সুতরাং মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে আমরা যদি এটা চিন্তা করে থাকি, তাহলে আমরা ভুল করছি। তারা কোনোদিনই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। সুতরাং একটা অনিশ্চয়তা থেকেই গেল বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে। এদের একটা অংশ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে কেউ কেউ। বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে অনেকে। আবার একটা অংশ রয়ে গেছে শরণার্থী শিবিরে। যদিও এটা সত্য, শরণার্থী ক্যাম্পে যারা আগে থেকে আছেন, তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্তৃক নিবন্ধিত। কিন্তু একটা বড় অংশই নিবন্ধিত নয়। এখন এদের সঙ্গে যোগ হয়েছে নতুন আসা ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা। এ সংখ্যা ১০ লাখে উন্নীত হবে বলে আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ।
সুতরাং বাংলাদেশ যে বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ভারতের সাহায্য চেয়েছিল। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম কলকাতায় এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ভারত আদর্শ বন্ধুর মতো বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। শরণার্থীদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে দিল্লি ইতিমধ্যে মিয়ানমার সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছে (আনন্দবাজার, ১৯ সেপ্টেম্বর)। এর পেছনে কি আদৌ কোনো সত্যতা আছে? রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের অবস্থান পরিষ্কার- তারা মিয়ানমার সরকারের অবস্থানকেই সমর্থন করছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের সঙ্গেও কথা বলেছেন, কিন্তু সেই আলোচনায় রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচিত হয়নি। সুতরাং এটা স্পষ্ট, রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমরা বৃহৎ ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর সমর্থন পাব না। কারণ এসব শক্তির মিয়ানমারে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে।
তবে জাতিসংঘকে আমরা ব্যবহার করতে পারি। সম্প্রতি নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং নিন্দাও জানানো হয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার মতো মিয়ানমারের ওপর কোনো অর্থনৈতিক অবরোধের কথা বলা হয়নি। এভাবে তো আরাকানে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হবে না। এবং নিরাপত্তা পরিষদের কোনো অনুমোদন না থাকায় সেখানে গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচারের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও গঠন করা যাবে না। ফলে বর্তমান সংকটে বাংলাদেশে আসা ৪ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরতে পারবেন কিনা, এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এদের অন্য দেশে পুনর্বাসন করবে, এটাও আমার মনে হয় না। তারা এখন স্থায়ী শরণার্থীতে পরিণত হতে যাচ্ছে। বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের শরণার্থীদের কাহিনী আমরা জানি। খুব কম ক্ষেত্রেই শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে গেছে। ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস আমরা জানি। সিরিয়া ও ইরাক থেকে যারা দেশান্তরিত হয়ে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছে, তারাও নিজ দেশে ফিরে যাবে, এটা আশা করতে পারি না।
আজ কতগুলো বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক. রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের তৎপর হওয়া। কূটনৈতিক চ্যানেলে বাংলাদেশের ভূমিকাকে আরও সম্প্রসারিত করা। দুই. মিয়ানমারে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক একটি প্যানেলের মাধ্যমে চিহ্নিত করা এবং তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার করা। অং সান সু চি তার দায় এড়াতে পারেন না। তাকেও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। তিন. মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে হবে। এবং মিয়ানমারে সব ধরনের অস্ত্র বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে। সেই সঙ্গে প্রয়োজনে মিয়ানমার সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ইরান ও ভেনিজুয়েলার রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নেতাদের ওপর ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। মিয়ানমারের সম্পত্তি (বিদেশে) ফ্রিজ করার সিদ্ধান্তও নিতে পারে জাতিসংঘ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জাতিসংঘ কিছুই করতে পারবে না। জাতিসংঘ মহাসচিব সু চির জন্য যতই ‘শেষ সুযোগের’ কথা বলুন না কেন, নিরাপত্তা পরিষদে উল্লিখিত সিদ্ধান্তগুলোর একটিও কার্যকর করতে পারবেন না। কারণ মিয়ানমারে বৃহৎ দেশগুলোর স্বার্থ অনেক বেশি। তাই রোহিঙ্গা নির্যাতনের কাহিনী শুধু কাগজ-কলমেই থেকে যেতে পারে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা শুধু পরিবেশগতই নয়, নানাবিধ সংকট তৈরি করেছে। স্থানীয় (উখিয়া) জনগণের চেয়ে রোহিঙ্গাদের জনসংখ্যা বেশি। ফলে স্থানীয় জনসাধারণ ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে একটা বৈরিতা তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো পক্ষ এসব রোহিঙ্গাকে ব্যবহার করতে চাইবে। জঙ্গিবাদ প্রসারের আশঙ্কাও আছে। অদূর ভবিষ্যতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে একটি আলাদা ‘রোহিঙ্গাল্যান্ড’ গঠনের সম্ভাবনা একেবারে ফেলে দেয়ার মতো নয়। সমুদ্রঘেঁষা এ অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে। বৃহৎ শক্তির প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ও সহযোগিতাকে আমরা অস্বীকার করি কীভাবে? সিরিয়ার রাকা থেকে বিতাড়িত আইএস জঙ্গিদের জন্য এ অঞ্চল একটি ‘অভয়ারণ্য’ হতে যাচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখতে হবে বেশি করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গা সমস্যাটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সংকট তৈরি করল।
0 comments:
Post a Comment