নতুন করে যখন প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক মিয়ানমার থেকে
বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তখন সংগত কারণেই একটি প্রশ্ন
সামনে চলে আসে। আর তা হচ্ছে ওপারে চারটি গ্রাম নিয়ে একটি 'সেফ জোন' প্রতিষ্ঠা করার প্রস্তাব করেছিল,
যা জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। কিন্তু গত ১৪ সেপ্টেম্বর
মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ও সরকারের মূল ব্যক্তি অং সান সু চির অফিস থেকে জানানো
হয়েছে মিয়ানমার এ ধরনের প্রস্তাবে রাজি হবে না। দ্বিতীয় আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা
ঘটেছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে। নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতভাবে দীর্ঘমেয়াদে
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে সম্মত হয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে রাখাইনের সামরিক
অভিযানে 'মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ' এর অভিযোগ তোলা হয়। সেখানে চলমান সহিংসতা বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ত্রাণ
কর্মীদের অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিতের তাগিদ দেয়া হয়। এটা নাকি এক বিরল ঐকমত্য?
১৫টি সদস্য রাষ্ট্রই সহিংসতা বন্ধে একমত পোষণ করে। কিন্তু মিসর
প্রস্তাব করেছিল রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাবার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়ার। চীন
তাতে রাজি হয়নি। নিরাপত্তা পরিষদের এই সিদ্ধান্তে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া
রোহিঙ্গাদের কী লাভ হলো? এরা পরলেন এক অনিশ্চয়তার মুখে।
তাদের নিজ দেশে ফিরে যাবার সম্ভাবনাও এখন ক্ষীণ। নিরাপত্তা পরিষদের এই সিদ্ধান্ত
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখবে না। প্রথমত, রোহিঙ্গারা যে নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারবেন, তার
কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয়ত, যারা সেখানে অপরাধ সংগঠিত
করেছে, তাদের বিচারের ব্যাপারে কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ
আদালত গঠনের কথাও বলা হয়নি। এতে তো সেখানে যুদ্ধবাজদের উৎসাহিত করা হলো। তৃতীয়ত,
সাধারণত এসব ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধবাজ রাষ্ট্রগুলোর
বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে থাকে। অতি সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক
কর্মসূচির ব্যাপারে দেশটির বিরুদ্ধে নতুন করে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে
নিরাপত্তা পরিষদ। অতীতে ইরাকে সাদ্দাম হোসেন সরকারের বিরুদ্ধেও অর্থনৈতিক অবরোধ
আরোপ করেছিল নিরাপত্তা পরিষদ। ইরানের বিরুদ্ধেও একই ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
কিন্তু মিয়ানমার যখন স্পষ্টতই জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানে লিপ্ত, যখন শত শত শিশু ও নারী তারা হত্যা করেছে, তখন
জাতিসংঘের কোনো ভূমিকা দৃশ্যমান নয়। শুধু সহিংসতা বন্ধের আহ্বান রোহিঙ্গা সমস্যার
সমাধানে কোনো ভূমিকা রাখবে না। সেখানকার যুদ্ধবাজদের যদি বিচার করা যেত, তাহলে অন্তত সতর্ক থাকত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী! আজকে জাতিসংঘ যতই
বিবৃতি দিক, কিংবা জাতিসংঘের মহাসচিব যতই সহিংসতা বন্ধের
আহ্বান জানান না কেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ইতিমধ্যেই
একটি বড় 'অর্জন' করেছে। তারা
আরাকানে বসবাসকারী প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে হয় হত্যা, নতুবা
দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছে। এবং কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা না হওয়ায় আগামীতে দশ লাখ
মানুষ আরাকান ত্যাগ করতে বাধ্য হবে।
মিয়ানমারের গণহত্যা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই গণ হত্যায় কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তার কোনো সুস্পষ্ট তথ্য এখন অবধি পাওয়া না গেলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সোসাল মিডিয়ায় গণহত্যা ও নিযার্তনের যে ছবি ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা বিশ্বের গণতহত্যার ইতিহাসে নতুন এক সংযোজন। এই গণহত্যায় টার্গের করা হয়েছে মিয়ানমারের মুসলমানদের, যারা রোহিঙ্গা হিসেবে বেশি পরিচিত। খোদ জাতিসংঘের মানবধিকারবিষয়ক শীর্ষ কর্মকার্তা এটাকে 'গণহত্যা' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং আজ এই গণত্যার সাথে যারা জড়িত তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার করা প্রয়োজন। অং সান সু চি, যিনি মিয়ানমার সরকারের মূল ব্যাক্তি ও যার নেতৃত্ব সকরার পরিচালিত হয়। তিনি তার দায় এড়াতে পারেন না। কেননা এই হত্যাকা-ের সব দায় দায়িত্ব তার। তাকেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই অতীতে, যেখানেই মানবতাবিরোধি অপরাধ হয়েছে (হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি নষ্ট), আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, সেখানে যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার করেছে। লাইব্রেরিয়ার যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট চার্লস টেলরেকে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাকে ৫০ বছর কারাদ- দিয়েছে। সাবেক যুগোসস্নাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মিলোসেভিচও অভিযুক্ত হয়েছিলেন মুসলমানদের গণহত্যায়। তার বিচার শুরু হয়েছিল হেগে। হৃদযন্ত্রের ক্রীড়া বন্ধ হয়ে জেলেই তার মৃত্যু হয়। তবে অপরাপর সার্ব যুদ্ধবাজদের অনেকেরই বিচার হয়েছে এবং তারা শাস্তি ভোগ করছেন। রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য (হুতু উপজাতি বনাম তুতসি উপজাতি) যেসব রাজনীতিবিদ ও সেনা কমান্ডাররা জড়িত ছিল, তাদের প্রায় সবার বিচার হয়েছে। কেনিয়ায় জাতিগত সহিংসতার জন্য (২০০৭-২০০৮) যে হাজার হাজার মানুষ সেখানে মারা গিয়েছিল, তার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্ত্বাকে সমন পর্যন্ত জারি করেছিলেন। তার বিচার 'স্থগিত' করা হয়েছিল বটে। কিন্তু ভাইস-প্রেসিডেন্টের বিচার হচ্ছে। এ ধরনের গণহত্যা বিশেষ করে ধর্ষণ, হত্যা, লুণ্ঠন, শিশু ও নারী হত্যাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছে। সুতরাং আজ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য এ ধরনের একটি আদালত গঠনের প্রয়োজন; কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সেটি করা কতটুকু সম্ভব হবে, কিংবা আদৌ সম্ভব হবে কি-না সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। কেননা আঞ্চলিক শক্তিগুলো, বিশেষ করে চীন ও ভারতের বিশাল স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারের। আরাকানের গভীর সমুদ্রে বিশাল গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। চীন ও ভারত সেখানে বিনিয়োগ করেছে। চীন সেখানে প্রাপ্ত ও উত্তোলিত গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে ইউনানের কুনমিং-এ গ্যাস নিচ্ছে চীন। উপরন্তু আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কাইয়াকুক পিউই (কুধঁশ চযুঁ) এ একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। এ ধরনের একটি সমুদ্রবন্দর কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় নির্মাণ করতে চেয়েছিল চীন। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এই সমুদ্রবন্দরটি চীনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সড়কপথে এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে করে ইউনান প্রদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অর্ধেক সময় কম লাগবে। ফলে পণ্যের মূল্যও কম হবে। সুতরাং চীন রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে চীনের তাতে আপত্তি থাকবে। ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে। আরাকানে ভারত সড়ক নির্মাণ করছে। ভারতের দুটি রাজ্যের সঙ্গে আরাকানের সীমান্ত রয়েছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের অভ্যন্তরে হামলা করে আশ্রয় নেয় আরাকানের গভীর জঙ্গলে। এক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরাকানে ওইসব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে অনুমতি দিয়েছিল। সুতরাং ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রেরও এ অঞ্চলের ব্যাপারে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। আরাকান সমুদ্রবর্তী গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। মার্কিন কোম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগ করতে চায়। উপরন্তু চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে হলে ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারকেও প্রয়োজন মার্কিন স্ট্রাটেজিস্টদের। বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের দীর্ঘদিনের। এক্ষেত্রে মুখে মানবাধিকার লংঘনের কথা বললেও কার্যত যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রশ্নে তেমন কোনো কঠোর অবস্থানে যাবে না। ভূ-রাজনীতির কারণে বাংলাদেশকে তাই একাই এ সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে_ তা আশা করতে পারি না। পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অতি সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করে গেছেন। তার ওই সফরের সময় রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পেঁৗছেছিল। রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, উপরন্তু জাতিসংঘের মতে, প্রায় কয়েক লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় কিংবা আশ্রয়ের সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও এই গণহত্যার ব্যাপারে মোদি-অং সান সু চি আলোচনায় কিংবা যৌথ ইশতেহারে কোনো কথা বলা হয়নি। তারা আরাকানের নিরাপত্তা ইস্যুটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বলেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে তারা যৌথভাবে কাজ করবেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর বালিতে (ইন্দোনেশিয়া) 'ওয়ার্ল্ড পার্লামেন্টোরি ফোরাম অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট' শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। ওই সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু 'সহিংসতার ঘটনা যথার্থ নয়' বলে ঘোষণাপত্র থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ভারত। এতেই প্রমাণিত হয় রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে থাকবে না ভারত। ফলে রোহিঙ্গা নিয়ে আঞ্চলিক সমাধানের পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। এতে করে রোহিঙ্গারা আদৌ নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে কি-না, সে সন্দেহ থাকলই। মিয়ানমার ১৯৮২ সালে সেখানে একটি তথাকথিত নাগরিকত্ব আইন চালু করেছিল। যার মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে আসছিল। এই প্রক্রিয়া, অর্থাৎ মিয়ানমারকে মুসলমানশূন্য করা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায়ই বর্তমান সংকটের জন্ম। সুতরাং মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে_ আমরা যদি এটা চিন্তা করে থাকি, আমরা এটা ভুল করেছি। তারা কোনোদিনই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। সুতরাং একটা শঙ্কা থেকেই গেল বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী? এদের একটা অংশ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে কেউ কেউ। বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন কেউ কেউ। আবার একটা অংশ রয়ে গেছে শরণার্থী শিবিরে। যদিও এটা সত্য শরণার্থী ক্যাম্পে যারা আছেন, তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্তৃক নিবন্ধিত। কিন্তু একটা বড় অংশই নিবন্ধিত নয়।
মিয়ানমারের গণহত্যা আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এই গণ হত্যায় কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, তার কোনো সুস্পষ্ট তথ্য এখন অবধি পাওয়া না গেলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সোসাল মিডিয়ায় গণহত্যা ও নিযার্তনের যে ছবি ও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা বিশ্বের গণতহত্যার ইতিহাসে নতুন এক সংযোজন। এই গণহত্যায় টার্গের করা হয়েছে মিয়ানমারের মুসলমানদের, যারা রোহিঙ্গা হিসেবে বেশি পরিচিত। খোদ জাতিসংঘের মানবধিকারবিষয়ক শীর্ষ কর্মকার্তা এটাকে 'গণহত্যা' হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং আজ এই গণত্যার সাথে যারা জড়িত তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার করা প্রয়োজন। অং সান সু চি, যিনি মিয়ানমার সরকারের মূল ব্যাক্তি ও যার নেতৃত্ব সকরার পরিচালিত হয়। তিনি তার দায় এড়াতে পারেন না। কেননা এই হত্যাকা-ের সব দায় দায়িত্ব তার। তাকেও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই অতীতে, যেখানেই মানবতাবিরোধি অপরাধ হয়েছে (হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, সম্পত্তি নষ্ট), আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত, সেখানে যারা গণহত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিচার করেছে। লাইব্রেরিয়ার যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট চার্লস টেলরেকে গণহত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাকে ৫০ বছর কারাদ- দিয়েছে। সাবেক যুগোসস্নাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মিলোসেভিচও অভিযুক্ত হয়েছিলেন মুসলমানদের গণহত্যায়। তার বিচার শুরু হয়েছিল হেগে। হৃদযন্ত্রের ক্রীড়া বন্ধ হয়ে জেলেই তার মৃত্যু হয়। তবে অপরাপর সার্ব যুদ্ধবাজদের অনেকেরই বিচার হয়েছে এবং তারা শাস্তি ভোগ করছেন। রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য (হুতু উপজাতি বনাম তুতসি উপজাতি) যেসব রাজনীতিবিদ ও সেনা কমান্ডাররা জড়িত ছিল, তাদের প্রায় সবার বিচার হয়েছে। কেনিয়ায় জাতিগত সহিংসতার জন্য (২০০৭-২০০৮) যে হাজার হাজার মানুষ সেখানে মারা গিয়েছিল, তার জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনিয়াত্ত্বাকে সমন পর্যন্ত জারি করেছিলেন। তার বিচার 'স্থগিত' করা হয়েছিল বটে। কিন্তু ভাইস-প্রেসিডেন্টের বিচার হচ্ছে। এ ধরনের গণহত্যা বিশেষ করে ধর্ষণ, হত্যা, লুণ্ঠন, শিশু ও নারী হত্যাকে যুদ্ধাপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গঠিত হয়েছে। সুতরাং আজ মিয়ানমারের রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য এ ধরনের একটি আদালত গঠনের প্রয়োজন; কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে সেটি করা কতটুকু সম্ভব হবে, কিংবা আদৌ সম্ভব হবে কি-না সে প্রশ্ন রয়েই গেছে। কেননা আঞ্চলিক শক্তিগুলো, বিশেষ করে চীন ও ভারতের বিশাল স্বার্থ রয়েছে মিয়ানমারের। আরাকানের গভীর সমুদ্রে বিশাল গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। চীন ও ভারত সেখানে বিনিয়োগ করেছে। চীন সেখানে প্রাপ্ত ও উত্তোলিত গ্যাস পাইপ লাইনের মাধ্যমে ইউনানের কুনমিং-এ গ্যাস নিচ্ছে চীন। উপরন্তু আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কাইয়াকুক পিউই (কুধঁশ চযুঁ) এ একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। এ ধরনের একটি সমুদ্রবন্দর কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় নির্মাণ করতে চেয়েছিল চীন। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এই সমুদ্রবন্দরটি চীনের জন্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সড়কপথে এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে করে ইউনান প্রদেশের পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে অর্ধেক সময় কম লাগবে। ফলে পণ্যের মূল্যও কম হবে। সুতরাং চীন রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে চীনের তাতে আপত্তি থাকবে। ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে। আরাকানে ভারত সড়ক নির্মাণ করছে। ভারতের দুটি রাজ্যের সঙ্গে আরাকানের সীমান্ত রয়েছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের অভ্যন্তরে হামলা করে আশ্রয় নেয় আরাকানের গভীর জঙ্গলে। এক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরাকানে ওইসব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে অনুমতি দিয়েছিল। সুতরাং ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রেরও এ অঞ্চলের ব্যাপারে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। আরাকান সমুদ্রবর্তী গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। মার্কিন কোম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগ করতে চায়। উপরন্তু চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে হলে ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারকেও প্রয়োজন মার্কিন স্ট্রাটেজিস্টদের। বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্টদের দীর্ঘদিনের। এক্ষেত্রে মুখে মানবাধিকার লংঘনের কথা বললেও কার্যত যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রশ্নে তেমন কোনো কঠোর অবস্থানে যাবে না। ভূ-রাজনীতির কারণে বাংলাদেশকে তাই একাই এ সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে_ তা আশা করতে পারি না। পাঠক লক্ষ্য করে থাকবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অতি সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করে গেছেন। তার ওই সফরের সময় রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার পরিস্থিতি চরম পর্যায়ে পেঁৗছেছিল। রোহিঙ্গা মুসলমানদের হত্যা, নারীদের ধর্ষণ, উপরন্তু জাতিসংঘের মতে, প্রায় কয়েক লাখ রোহিঙ্গার বাংলাদেশে আশ্রয় কিংবা আশ্রয়ের সম্ভাবনা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হলেও এই গণহত্যার ব্যাপারে মোদি-অং সান সু চি আলোচনায় কিংবা যৌথ ইশতেহারে কোনো কথা বলা হয়নি। তারা আরাকানের নিরাপত্তা ইস্যুটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং বলেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ইস্যুতে তারা যৌথভাবে কাজ করবেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর বালিতে (ইন্দোনেশিয়া) 'ওয়ার্ল্ড পার্লামেন্টোরি ফোরাম অন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট' শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক ফোরামে অংশ নিয়েছিলেন ভারতের লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজন। ওই সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল। কিন্তু 'সহিংসতার ঘটনা যথার্থ নয়' বলে ঘোষণাপত্র থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে ভারত। এতেই প্রমাণিত হয় রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে থাকবে না ভারত। ফলে রোহিঙ্গা নিয়ে আঞ্চলিক সমাধানের পথও রুদ্ধ হয়ে গেল। এতে করে রোহিঙ্গারা আদৌ নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে কি-না, সে সন্দেহ থাকলই। মিয়ানমার ১৯৮২ সালে সেখানে একটি তথাকথিত নাগরিকত্ব আইন চালু করেছিল। যার মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে আসছিল। এই প্রক্রিয়া, অর্থাৎ মিয়ানমারকে মুসলমানশূন্য করা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সেই ধারাবাহিকতায়ই বর্তমান সংকটের জন্ম। সুতরাং মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে_ আমরা যদি এটা চিন্তা করে থাকি, আমরা এটা ভুল করেছি। তারা কোনোদিনই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। সুতরাং একটা শঙ্কা থেকেই গেল বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী? এদের একটা অংশ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে কেউ কেউ। বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন কেউ কেউ। আবার একটা অংশ রয়ে গেছে শরণার্থী শিবিরে। যদিও এটা সত্য শরণার্থী ক্যাম্পে যারা আছেন, তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্তৃক নিবন্ধিত। কিন্তু একটা বড় অংশই নিবন্ধিত নয়।
এই সংকট আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ
খুব ঘনবসতির দেশ। একটি ছোট দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ বসবাস করে। আমরা নতুন করে 'বিদেশি' অর্থাৎ মিয়ানমারের নাগরিকদের
অনির্দিষ্টকালের জন্য আশ্রয় দিতে পারি না। এ ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট নীতিমালা
দরকার। বিদেশি মেহমানরা বাংলাদেশে এসে আমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করলেও আমাদের
কোনো সিনিয়র মন্ত্রীকে বিদেশে তৎপর হতে দেখিনি। বিদেশি মেহমানরা সবাই আমাদের
সাহায্যের কথা বলছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে তাদের
কারো কোনো কর্মসূচি নেই। এমনকি কোনো পক্ষ থেকেই কেউ মিয়ানমার সরকারের ওপর
অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের কথাও বলছেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীনের স্বার্থের কথা আমি আগেই উল্লেখ করেছি। গত ১৩ সেপ্টেম্বর
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং
নিন্দাও জানানো হয়েছে। কিন্তু উত্তর কোরিয়ার মতো কোনো অর্থনৈতিক অবরোধের কথা বলা
হয়নি। এতে করে তো আরাকানে জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ হবে না এবং নিরাপত্তা পরিষদের
কোনো অনুমোদন না থাকায় সেখানে গণহত্যার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের
বিচারের জন্য কোনো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতও গঠন করা যাবে না। ফলে বর্তমান সংকটে
বাংলাদেশে আসা ৪ লাখ রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফিরতে পারবেন কি-না, এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ রয়েছে। আন্তর্জাতিক সমস্যায় এদের অন্যদেশে
পুনর্বাসন করবে, এটাও আমার মনে হয় না। তারা এখন স্থায়ী
শরণার্থীতে পরিণত হতে যাচ্ছেন। বিশ্ব ইতিহাসে এ ধরনের শরণার্থীদের কাহিনী আমরা
জানি। খুব কম ক্ষেত্রেই শরণার্থীরা নিজ দেশে ফিরে গেছেন। ফিলিস্তিনিদের ইতিহাস
আমরা জানি। সিরিয়া ও ইরাক থেকে যারা দেশান্তরিত হয়ে ইউরোপে আশ্রয় নিয়েছেন এরাও নিজ
দেশে ফিরে যাবেন, এটা আশা করতে পারি না।
আজ দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক. রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের তৎপর হওয়া। কূটনৈতিক চ্যানেলে বাংলাদেশের ভূমিকাকে আরও সম্প্রসারিত করা। দুই. মিয়ানমারে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক একটি প্যানেলের মাধ্যমে চিহ্নিত করা এবং তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার করা। অং সান সু চি তার দায় এড়াতে পারেন না। তাকেও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে।
আজ দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক. রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের তৎপর হওয়া। কূটনৈতিক চ্যানেলে বাংলাদেশের ভূমিকাকে আরও সম্প্রসারিত করা। দুই. মিয়ানমারে যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আন্তর্জাতিক একটি প্যানেলের মাধ্যমে চিহ্নিত করা এবং তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের মাধ্যমে বিচার করা। অং সান সু চি তার দায় এড়াতে পারেন না। তাকেও বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে হবে।
ধন্যবাদ স্যার
ReplyDelete