রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

রোহিঙ্গা সংকট ও আমাদের পররাষ্ট্রনীতি

রোহিঙ্গা সংকট আমাদের পররাষ্ট্র নীতিকে একটি প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আগস্টের শেষের দিকে এই সংকটের মাত্রা বাড়লেও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকা- আমার চোখে এখন অব্দি ধরা পড়েনি। সম্ভবত আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিরা এক ধরনের 'ডায়লামা' ফেস করছেন। এ ব্যাপারে তাদের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতি নেই। কী তাদের করা উচিত, বোধ করি এটাও তারা উপলব্ধি করতে পারছেন না। রোহিঙ্গা সংকটের গভীরতা বাড়ছে। কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকা- নেই। সংকটের গভীরতা বেড়ে যাওয়ায় ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। বাংলাদেশকে সাহায্য করার কথা তিনি বলেছেন। তুরস্কের রাষ্ট্রপ্রধানের স্ত্রী মিসেস এরদোগান সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ এসেছিলেন। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা এলাকায় তিনি ত্রাণ বিতরণ করেছেন। তিনি রোহিঙ্গা এলাকায় গিয়ে কেঁদেছেন। সেই ছবি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ওআইসি একটি টাস্ক ফোর্স গঠনের কথা বলেছে। রোহিঙ্গা সংকটকে সামনে রেখে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার সফর করেছেন। ভারত এই রোহিঙ্গা সংকটে কিছুটা আক্রান্ত হলেও, নরেন্দ্র মোদির মিয়ানমার সফর আমাদের জন্য কোনো আশার সংবাদ বয়ে আনেনি। সোদি স্পষ্টতই মিয়ানমার সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সেখানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে, সেখানে মোদি অং সান সু চি আলোচনায় এই বিষয়টি স্থান পায়নি। স্থান পেয়েছে আরাকানের নিরাপত্তা পরিস্থিতি। বলা ভালো ২৫ আগস্ট একটি আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশান আর্মি আরাকান রাজ্যে কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ি আক্রমণ করে ১২ জন পুলিশকে হত্যা করে। বিদ্রোহীদের পক্ষ থেকে প্রায় ১০০ বিদ্রোহী মারাও যায়। এর পর থেকেই সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমান বিরোধী অভিযান শুরু হয়েছে। এবং আরও দুঃখজনক যা, তা হচ্ছে রোহিঙ্গা নিপীড়নের ব্যাপারে অং সান সু চির নীরবতা। এই সংকট শুরু হওয়ার পর প্রথমে তিনি এটাকে 'বাঙালি বিদ্রোহী' হিসেবে আখ্যায়িত করার চেষ্টা করেন। এবং পরে তিনি বলেন আরাকানের পরিস্থিতি শান্ত। তার অভিযোগ রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে গিয়ে সেখানে থাকছেন। অথচ ইতিহাস বলে ভিন্ন কথা। রোহিঙ্গারা সেখানে বসবাস করে আসছে শত বছর ধরে। এক সময় রোহিঙ্গাদের বর্তমান আবাসভূমি আরাকান রাজ্য ছিল স্বাধীন রাজ্য। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা কোডপায়া এটি দখল করে বার্মার অধীন একটি করদ রাজ্যে পরিণত করেন। আরাকান রাজ্যের রাজা বৌদ্ধ হলেও তিনি মুসলমান উপাধি গ্রহণ করতেন। তার মুদ্রাতে ফার্সি ভাষায় লেখা থাকত কালেমা। 

আরাকান রাজ দরবারে কাজ করতেন অনেক বাঙালি মুসলমান। বাংলার সঙ্গে আরাকানের ছিল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক। ধারণা করা হয় রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম স্ত্র্রোহং থেকে। কালের পরিক্রমায় স্ত্র্রোহং থেকে রোয়াং, সেখান থেকে রোয়াইঙ্গিয়া এবং অতঃপর রোহিঙ্গা। মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে আরাকানকে ডাকা হতো রোসাং নামে। ১৪০৬ সালে আরাকানের রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পালায়ন করেন। গৌড়ের তৎকালীন শাসক জালালুদ্দিন শাহ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে কর্মী উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলা মোহম্মদ সোলায়মান শাহ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজদরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং রাজদরবারে রাজকবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন পদ্মাবতী। এ ছাড়া সতী ময়না ও লোর, চন্দ্রানী, সয়ফুল মূলক, হাঙ্গ গামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে। 
ইতিহাস বলে ভাই আওরঙ্গজেবের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়ে মোগল যুবরাজ শাহ সুজা ১৬৬০ সালে সড়কপথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আরাকানে পালায়ন করেন। তৎকালীন রোসাং রাজা চন্দ্র সুধর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ সুজা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এরপর আরাকানে যে দীর্ঘমেয়াদি অরাজকতা সৃষ্টি হয়, তার অবসান ঘটে বার্মার হাতে আরাকানের স্বাধীনতা হরনের মধ্য দিয়ে। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবেই আরাকানের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের একটা সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তার অর্থ নয় আরাকানের মুুসলমানরা যারা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত, তারা বাংলাদেশি। মিয়ানমারের ইতিহাস থেকে জানা যায় মিয়ানমারের পার্লামেন্টে অতীতে মুসলমান রোহিঙ্গারা আরাকান থেকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তাদের নামধামও সোস্যাল মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। তারা যদি মিয়ানমারের নাগরিক না হয়ে থাকেন, তাহলে তারা মিয়ানমার পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন কীভাবে? আসলে মিয়ানমার সরকার একটা কৌশল অবলম্বন করেছে। যার মাধ্যমে তারা আরাকানকে মুসলমান শূন্য করতে চায়। এ কারণেই ১৯৬২ সালে তারা সেখানে একটি তথাকথিত নাগরিকত্ব আইন চালু করেছিল। যার মাধ্যমে তারা রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে আসছিল। এই প্রক্রিয়া অর্থাৎ মিয়ানমারকে মুসলমানশূন্য করা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সেই ধারাবাহিকতাই বর্তমান সংকটের জন্ম। সুতরাং মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে আমরা যদি এটা চিন্তা করে থাকি, আমরা এটা ভুল করেছি। তারা কোনোদিনই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না। সুতরাং একটা শঙ্কা থেকেই গেল_ বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ কী। এদের একটা অংশ বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মিশে গেছে। বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়েছে কেউ কেউ। বাংলাদেশি পাসপোর্ট গ্রহণ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন কেউ কেউ। আবার একটা অংশ রয়ে গেছে শরণার্থী শিবিরে। যদিও এটা সত্য শরণার্থী ক্যাম্পে যারা আছেন, তাদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। এরা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর কর্তৃক নিবন্ধিত। কিন্তু একটা বড় অংশই নিবন্ধিত নয়। এই সংকট আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে খুব ঘন বসতির দেশ। একটি ছোট্ট দেশে বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস করে। আমরা নতুন করে বিদেশি অর্থাৎ মিয়ানমারের নাগরিকদের অনির্দিষ্টকালের জন্য আশ্রয় দিতে পারি না। এ ব্যাপারে আমাদের সুস্পষ্ট নীতিমালা দরকার। বিদেশি মেহমনরা বাংলাদেশে এসে আমাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করলেও আমাদের কোনো সিনিয়র মন্ত্রীকে বিদেশে তৎপর হতে দেখিনি। বিদেশি মেহমানরা সবাই আমাদের সাহায্যের কথা বলছেন। কিন্তু রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফেরত নেয়ার ব্যাপারে তাদের কারও কোনো কর্মসূচি নেই। এমনকি কোনো পক্ষ থেকেই কেউ মিয়ানমার সরকারের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপের কথাও বলছেন না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের ভূমিকাও এখানে লক্ষণীয়। চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে নির্লিপ্ত। মিয়ানমারে তাদের জাতীয় স্বার্থ আছে। 

আরাকান উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রচুর জ্বালানি সম্পদ (তেল ও গ্যাস) আবিষ্কৃত হয়েছে। চীন এখানে বিনিয়োগ করেছে। সাবেক সেনাশাসক খান খা-এর নামে আরাকানে গভীর সমুদ্রে একটি গ্যাস ক্ষেত্র রয়েছে। যা ২০০৪ সালে আবিষ্কৃত হয়। ২০১৩ সালে চীন এখানে গ্যাস পাইপ লাইন স্থাপন করেছে। যার মাধ্যমে এই গ্যাস চীনের ইউনান রাজ্যের কুনমিংয়ে গ্যাস দিচ্ছে চীন। উপরন্তু আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত কাইয়াকুক পিউইয়ে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে চীন। এ ধরনের একটি সমুদ্রবন্দর কক্সবাজারের সোনাদিয়ায় নির্মাণ করতে চেয়েছিল চীন। কিন্তু ভারতের আপত্তির কারণে বাংলাদেশ রাজি হয়নি। এই সমুদ্রবন্দরটি চীনের হচ্ছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। সড়কপথে এই গভীর সমুদ্রবন্দরটি চীনের কুনমিংয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। এতে ইউরোপ এ দেশের পণ্য আমদানিকৃত তা নিয়ে অর্ধেক সময় কম লাগবে। ফলে পণ্যের মূল্যও কম হবে। সুতরাং চীন রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়াবে না। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে গেলে চীন তাতে ভেটো দেবে। ভারতেরও স্বার্থ রয়েছে। আরাকানে ভারত সড়ক নির্মাণ করছে। ভারতের দুটি রাজ্যের সঙ্গে আরাকানদের সীমান্ত রয়েছে। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের অভ্যন্তরে হামলা করে আশ্রয় নেয় আরাকানের গভীর জঙ্গলে। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমার সরকারকে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরাকানের ওইসব বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করতে অনুমতি দিয়েছিল। সুতরাং ভারত মিয়ানমারের সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক বজায় রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রেরও এ অঞ্চলের ব্যাপারে যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। আরাকানে সমুদ্রবর্তী গভীর সমুদ্রে তেল ও গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে। মার্কিন কোম্পানিগুলো এখানে বিনিয়োগ করতে চায়। উপরন্তু চীনের বিরুদ্ধে একটি সম্ভাব্য অ্যালায়েন্স গড়ে তুলতে হলে ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারকেও প্রয়োজন মার্কিন স্ট্রাটেজিস্টদের। বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা মার্কিন স্ট্রাটেজিস্টদের দীর্ঘদিনের। এ ক্ষেত্রে মুখে মানবাধিকার লংঘনের কথা বললেও, কার্যত যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রশ্নে তেমন কোনো কঠোর অবস্থানে যাবে না। 

ভূ-রাজনীতির কারণে বাংলাদেশকে তাই একাই এ সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। এর ফলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে_ তা আশা করতে পারি না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশেই রোহিঙ্গাদের থাকার বন্দোবস্ত করতে পারে, ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়েছিল। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ আরাকানে রোহিঙ্গাদের জন্য একটি 'সেফ জোন' প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করেছে। এটা কি কোনো সমাধান? সমাধান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়া। যা কফি আনান কমিশন তাদের প্রস্তাবে উল্লেখ করেছে। বাংলাদেশকে এখন এই প্রস্তাব নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে বাংলাদেশ এ প্রস্তাব উত্থাপন করুক, আমরা এমনটাই প্রত্যাশা করি।

দৈনিক যায়যায়দিন ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭

0 comments:

Post a Comment