রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্র!


সংবাদ শিরোন
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটিতে বাঙালি-পাহাড়ি সংঘর্ষ ও ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে সহিংস ঘটনাবলির পর গত ৯ অক্টোবর অনেকটা গোপনে অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার পার্বত্য জেলা বান্দরবান সফর করেন এবং সেখানে গোপনে পাহাড়ি নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার থিথি ডি কফের গোপনে পাহাড়ি নেতাদের সাথে বৈঠক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কোনো কূটনৈতিক, এমনকি কোনো বিদেশী নাগরিক যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো জেলায় সফরে যান, সে ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকে পূর্বাহ্নে অবহিত করতে হবে এবং তাদের যেকোনো মতবিনিময়ে প্রথম শ্রেণীর একজন কর্মকর্তার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ডেপুটি হাইকমিশনার থিথি ডি কফের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী (যুগান্তর ১১ অক্টোবর) জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার যখন পাহাড়ি নেতাদের সাথে বৈঠক করছিলেন, তখন জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রবেশ বাধা দেয়া হয়েছিল।
বিষয়টি আমাদের জন্য উদ্বেগ ও আতঙ্কের। প্রথমত. একজন ডেপুটি হাইকশিনারের এমন কোনো কারণ থাকতে পারে না যে, তিনি পাহাড়ি নেতাদের সাথে গোপনে বৈঠক করবেন। দ্বিতীয়ত. যেখানে যে কোনো অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক, সেখানে তাদের বাধা দেয়া হলো কেন? তৃতীয়ত. যেখানে পাহাড়ে একটি চক্র স্থানীয় পরিবেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে, সেখানে পাহাড়ি নেতাদের সাথে একজন বিদেশী রাষ্ট্রদূতের বৈঠক কি পরিস্থিতিকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে না?
আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ করে আসছি যে, একটি চক্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করে সেখান থেকে ফায়দা ওঠাতে চায়। আর এই চক্রের সাথে বিদেশীরা সরাসরিভাবে জড়িত। এদের আশ্রয়, প্রশয়ে ও আর্থিক সহযোগিতায় ইতোমধ্যে পাহাড়িদের নিয়ে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এদের উসকানি দিচ্ছেন সাবেক গ্যারিলা নেতা ও জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমা। বিদেশী বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ভূমিকা এখানে লক্ষ করার মতো। তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রচুর পাহাড়ি ছাত্র বৃত্তি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যায়। ‘অস-এড’ এর কোনো বৃত্তি বাঙালি ছাত্ররা পায় না, বা তাদের দেয়া হয় না। পাহাড়ি এলাকায় বাঙালিরা মানবেতর জীবন যাপন করলেও কোনো বিদেশী সাহায্য তারা পায় না। ইউএনডিপির কোনো প্রজেক্টে বাঙালিরা চাকরি পায় না। বাঙালিরা সেখানে এক রকম ‘দ্বিতীয় শ্রেণী’র নাগরিকের মতো বসবাস করছে, যা সংবিধানের ২৭ ও ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপূর্ণ লঙ্ঘন।
আমরা আরো গভীরভাবে লক্ষ করেছি যে, সন্তু লারমা হচ্ছেন অন্যতম উসকানিদাতা। সরকার পাহাড়িদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিলেও সন্তু লারমা একের পর এক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। রামুর ঘটনায় সর্বশেষ যে বক্তব্যটি তিনি দেন, তাও ছিল উসকানিমূলক। এমনকি তিনি বাবরার ‘আদিবাসী সমাজ’ বলে যে বক্তব্য দেন, তাও সংবিধান বিরোধী। সংবিধানে ‘আদিবাসী’ বলে কিছু নেই। আছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। আসলে এই মুহূর্তে পার্বত্য অঞ্চলে একাধিক সমস্যা রয়েছে। মূল সমস্যা একটিই আর তা হচ্ছে এ অঞ্চলে ব্যাপক খ্রিষ্ট্রীয়করণ। অথচ পাহাড়িদের বিশেষ করে সন্তু বাবুদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায় যে, পাহাড়িদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। এটা একটা মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা। পরিসংখ্যান বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকহারে খ্রিষ্টীয়করণ হচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে গরিব পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। তারপর এদের অনেককে চাকরি দেয়া হচ্ছে। পাহাড়ে বেশ কিছু খ্রিষ্টীয় মিশনারী স্থাপিত হয়েছে। পাহাড়িদের ধর্মান্তরিত করে ওই সব স্কুলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চার্চ, যেখানে প্রতি রোববার পাহাড়িদের যাওয়া এক রকম বাধ্যতামূলক। বিদেশী নাগরিকদের পার্বত্য চট্টগ্রামে সফরের উদ্দেশ্য একটিইÑ খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার ও পাহাড়িদের খ্রিষ্ট ধর্মের ব্যাপারে আকৃষ্ট করা। যে হারে পাহাড়ে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রসার বাড়ছে, তা আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। এক সময় এই খ্রিষ্টীয় জনগোষ্ঠী বিদেশীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। পাঠক, পূর্ব তিমুরের কথা স্মরণ করুন। পূর্ব তিমুর ছিল ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রদেশ। ইন্দোনেশিয়ার জনগণ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তবে পূর্ব তিমুরের মানুষ ছিল খ্রিষ্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী। পূর্ব তিমুর ইন্দোনেশিয়ার সাথে সংযুক্তির পর সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা শক্তিশালী হয়। শুরু হয় গ্যারিলা যুদ্ধ। পরে পশ্চিমাদের স্বার্থেই ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমূর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর স্বাধীনতার পর থেকে অস্ট্রেলিয়া পূর্ব তিমূরের রাজনীতিতে অন্যতম শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার প্রভাব অনেক বেশি। সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ সুদানের কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। মুসলমান অধ্যুষিত সুদানকে ভেঙে খ্রিষ্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী দক্ষিণ সুদানকে একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমাদের একটা শঙ্কা থেকেই গেল। বিদেশী নাগরিকদের ঘন ঘন পার্বত্য চট্টগ্রাম যাওয়া, বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের সেখানে গোপন মিটিং করা, বিদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা ইত্যাদি আমাদের শঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আরো কিছু তথ্য দিতে পারি। এক সময়, অতীতে আজকে যে ‘সাতবোন রাজ্য’ নামে পরিচিত, সেখানকার মানুষ জঙ্গলে বাস করত ও প্রকৃতি পূজারী ছিল। তাদের কোনো ধর্ম ছিল না। প্রকৃতিকে, শক্তিকে, সূর্যকে তারা পূজা করত। ব্রিটিশদের নজর পড়ল এ অঞ্চলের দিকে। জঙ্গলে বাস করা মানুষদের ‘শিক্ষিত’ করার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করল। সাথে গেল মিশনারিরা। যারা খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার করত। ওই অঞ্চলে তারা চার্চ প্রতিষ্ঠা করলো। ভালো ভালো কথা বলা, আর্থিক সাহায্য করা ইত্যাদিতে আকৃষ্ট হলো জঙ্গলের মানুষ। তারপর বছরের পর বছর গেল। আজ যদি পরিসংখ্যান নেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে মিজোরামের ৯৯ ভাগ মানুষ আজ খ্রিষ্টান। নাগাল্যান্ডের ৯০ ভাগ, মনিপুরের ৬০ ভাগ আর মেঘালয়ের প্রায় ১০০ ভাগ মানুষ আজ খ্রিষ্টান। ব্রিটিশদের পরিকল্পনা সার্থক হয়েছে। সেখানে খ্রিষ্টান ধর্ম একটি শক্তি। সেখানে হিন্দু কিংবা মুসলমান ধর্মের বিকাশ ঘটেনি। ভারতের অন্যত্র ইসলাম ধর্মের বিকাশ ঘটলেও মিশনারিদের কারণে ‘সাতবোন রাজ্যে’ ইসলামের বিকাশ ঘটেনি। আমাদের আতঙ্কের জায়গাটা হচ্ছে ওখানে; মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশে মিজোরাম, তার উপরে নাগাল্যান্ড, মনিপুর, অরুণাচল, মেঘালয়। আমাদের সিলেটের পাশেই রয়েছে আসাম ও মেঘালয়। আসামে কিছু মুসলমান থাকলেও মেঘালয়ের প্রায় ১০০ ভাগই খ্রিষ্টান। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে যেহারে খ্রিষ্টান ধর্ম বিস্তার লাভ করছে, তাতে করে পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম, তথা ‘সাতবোন’ রাজ্যের খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা উৎফুল্লিত হতে পারেন। দুই অঞ্চলে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা আমাদের জন্য একটা বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে আগামী দিনগুলোতে। তাই অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার যখন গোপনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেন, তখন উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সন্দেহমুক্ত থাকতে পারি না। শুধুমাত্র মানবিক কারণে তিনি যদি বান্দরবান গিয়ে থাকেন, তাহলে তার বাঙালি নেতাদের সাথে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি।
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করেছি যে, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সৈন্য ও ৩৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ফলে সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে। পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পগুলোতে এখন সন্ত্রাসীরা আশ্রয় নিয়েছে। ওই অঞ্চলগুলো এখন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমাদের সন্তু বাবু এর কোনো প্রতিবাদ করছেন না। যখন বরকলে (২১ মে ২০১১) বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছিল, তখনও প্রতিবাদ করেননি সন্তু বাবু। তথাকথিত ‘ভূমি অধিকার’ এর কথা বলে তিনি মূলত চাচ্ছেন ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’(?) এবং সেই সাথে ওই অঞ্চল থেকে বাঙালিদের বিতাড়ন। এর আগে তিনি একবার বাঙালিদের নোয়াখালীর চরে প্রত্যাবাসনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। এ ধরনের সাহস তিনি কোথায় পান, ভাবতেই অবাক লাগে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তথাকথিত বাম বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজ সন্তু লারমার ওই বক্তব্যের সমালোচনা করেনি।
বাঙালিরা তাদের অধিকার নিয়ে সেখানে থাকেন। সংবিধান তাদের সেই অধিকার দিয়েছে। পাহাড়িরা ভূমিপুত্র নন। বাঙালিদের মতো চাকমারাও এ অঞ্চলে প্রায় একই সময় বসবাস করতে শুরু করেন। চাকমাদের আদি বাসস্থান ছিল উত্তর ভারতের হিমালয়ের পাদদেশে। ‘চম্পকনগর’ নামক স্থানে ছিল তাদের ঐশ্বর্যমণ্ডিত রাজধানী। বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী চাকমাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে তারা দেশান্তরিত হয়ে আশ্রয় নেয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরান এলাকায়। এক সময় তারা বাঙালিদের মতো সমতলেই বসবাস করতো।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে পুনরায় ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। রামুর ঘটনাবলির রেশ শেষ হবার আগেই একজন বিদেশী কূটনৈতিক যখন গোপনে বান্দরবান সফর করেন ও পাহাড়ি নেতাদের সাথে গোপনে মতবিনিময় করেন, তখন আমাদের সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। এ দেশের মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্রকেই বরদাশত করবে না। অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনারের বান্দরবান সফরকে তাই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।

খালেদা জিয়ার ‘ভারত দর্শন’


সবকিছু ঠিক থাকলে খালেদা জিয়া ভারত সফরে যাচ্ছেন ২৮ অক্টোবর। চীন সফর শেষ করে তিনি যখন ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, তখন তার এ সফরকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। খালেদা জিয়ার চীন ও তারপর ভারত সফর প্রমাণ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চীন ও ভারত কত গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার ভারত সফর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের নীতিনির্ধারকরা বিএনপির রাজনীতি জানেন এবং বোঝেনও। আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে খালেদা জিয়ার গুরুত্ব বেড়েছে। এটা বিবেচনায় নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ভারত যাচ্ছেন। এতে একটা বিষয় স্পষ্ট, ভারত পরিবর্তিত পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে খালেদা জিয়াকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। এ দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে একটা ধারণা ছিল, ভারত শুধু আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করে। দেখা গেল, ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার সঙ্গেও একটা ‘ডায়ালগ’ ওপেন করছেন। এ কারণেই তার এ সফর যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভারত সফরের পর।
এরশাদের ‘হাই প্রোফাইল’ ভারত সফর ও ঢাকায় দেয়া বিভিন্ন বক্তব্যের পর তিনি এমন একটা ধারণার জš§ দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের পরবর্তী নেতা হিসেবে বিশ্ব সম্প্রদায়, বিশেষ করে ভারত তাকে গণ্য করছে। এখন খালেদা জিয়ার এ সফরের পর মানুষের মনে নতুন একটা ধারণার জš§ হতে পারে। ধারণা করছি, ভারতের নীতিনির্ধারকদের মাঝে সম্ভবত একটি ‘শুভবুদ্ধির’ উদয় ঘটেছে। তারা এখন আর শুধু আওয়ামী লীগকে নিয়েই চিন্তা করেন না, বরং প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গেও এক ধরনের ‘ডায়ালগ’ চান।
খালেদা জিয়ার ভারতে যাওয়া উচিত কী উচিত নয়, এটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। অনেকের সঙ্গে এমনকি যারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ঘরানার তারাও আমাকে বলেছেন, খালেদা জিয়ার নয়াদিল্লি যাওয়া ঠিক নয়। কারণ এতে করে সাধারণ মানুষের মাঝে একটা ‘ভুল সিগনাল’ পৌঁছে যেতে পারে। এর পেছনে হয়তো যুক্তি ও আবেগ আছেÑ এটা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। কারণ স্বাধীনতার পরবর্তী ৪০ বছরে ভারত বন্ধুত্বের চেয়ে ‘শত্র“তার’ই পরিচয় দিয়েছে বেশি। তার পরও বাস্তবতা যা, তা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সমসাময়িক রাজনীতিতে ভারত একটা ‘ফ্যাক্টর’। ভারতের অবস্থান, তার অর্থনীতি, সামরিক শক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কে এর একটা প্রভাব পড়বেই। আমরা ভারতের এই অবস্থান থেকে কতটুকু ফায়দা তুলতে পারবÑ আমাদের বৈদেশিক নীতির সাফল্য সেখানেই। দুর্ভাগ্য, বর্তমান সরকারের সময় আমরা খুব একটা ফায়দা তুলতে পারিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যর্থতা ঢাকতে আমাদের দু’জন উপদেষ্টাকে পর্যন্ত নিয়োগ করতে হয়েছে, যারা সত্যিকার অর্থে বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাহায্য করছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার ভারত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার জন্য একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থকে যথাযথভাবে ভারতের কাছে তুলে ধরার। বলার অপেক্ষা রাখে না, মহাজোট সরকারের সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশের স্বার্থ সব সময় রক্ষিত হচ্ছে না। খালেদা জিয়া এখন এ কাজটি করতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষের যে প্রত্যাশা, তা তুলে ধরতে পারেন ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে। প্রথমত, বাংলাদেশ বড় ধরনের ভারতীয় পানি আগ্রাসনের সম্মুখীন। গঙ্গার পানি বণ্টনে একটি চুক্তি হয়েছে বটে; কিন্তু পানি আমরা পাচ্ছি না। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি আসার আগেই উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। তিস্তার পানি বণ্টনে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের আপত্তিতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। সমস্যাটা ভারতের, সমাধান তাদেরই করতে হবে। বিষয়টি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে, আন্তর্জাতিক নদী আইন আমাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করছে। আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারি না। ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। খোদ ভারতের অভ্যন্তরে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারত অত্যন্ত সুকৌশলে ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে এ দুটো প্রজেক্ট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিশাল এলাকা পানিশূন্য হয়ে যাবে। মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশের মানুষ এটা মেনে নেবে নাÑ এ বিষয়টি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বুঝিয়ে দিতে হবে। দেশ হিসেবে আমরা ‘ছোট’ হতে পারি; কিন্তু আমরা সমমর্যাদার অধিকারী। ভারতের আচরণে সেই সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ভারতীয় ‘বাণিজ্য নীতির ফাঁদে’ আটকা পড়ে আছে অনেক দিন থেকে। অর্থাৎ ভারতীয় বাণিজ্যনীতি এমন যে, একটি বড় ধরনের বাণিজ্যিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে, যা ভারত ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। ভারত তথাকথিত বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধার কথা ঘোষণা করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় বাংলাদেশের রফতানি আয় কমে গেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ রফতানি করেছে মাত্র ৪৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের পণ্য (আগের বছরের আয় ৫১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার)। এতে দেখা যায়, রফতানি আয় কমেছে (কালের কণ্ঠ, ১৮ জুলাই, ২০১২)। গেল বছর ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তখন ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল ভারত অশুল্ক বাধা দূর করার কোন উদ্যোগ নেয়নি। খালেদা জিয়া এখন এ বিষয়টি ভারতীয় নেতাদের কাছে স্পষ্ট করতে পারেনÑ অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। এতে করে বাংলাদেশ তার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারবে।
তৃতীয়ত, বারবার প্রতিশ্র“তি দেয়া সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। একতরফাভাবে ভারতীয় বিএসএফ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। পৃথিবীর কোন সীমান্তে এভাবে মানুষ মারা হয় না। এই সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে ভারতকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবেÑ খালেদা জিয়া এ ‘মেসেজ’টি পৌঁছে দিতে পারেন ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে।
চতুর্থত, খালেদা জিয়া ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর, সাড়ে ৬ কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিতকরণের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে পারেন। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী অনেক আগেই ছিটমহল সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু ভারত তা করেনি। আশা করব, খালেদা জিয়া দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের জনগণের কথা তুলে ধরবেন।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের দুর্বল ও ভারতঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির সুযোগে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে সুকৌশলে ট্রানজিটের নামে করিডোর সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, ‘বহু পাক্ষিকতার আলোকে ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে’। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানও অনুরূপ সুবিধা পাবে। বাংলাদেশের জন্য চীন-নেপাল-ভুটানের যে সংযোগ ভারতের ওপর দিয়ে যাবে, তা ১০০ কিলোমিটারের চেয়ে কমÑ এই সুযোগটি বাংলাদেশ পায়নি। এমনকি ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের মাত্র ২৫ কিলোমিটার স্থল সংযোগে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ভারত আমাদের সেই সুযোগ দেয়নি। অথচ আমরা এককভাবে ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতের ২৮ চাকার ভারী গাড়ি পারাপারের সুযোগ করে দিয়েছি। এজন্য ভারত আমাদের কোন ট্রানজিট ‘ফি’ও দেয়নি। সাধারণ মানুষের মনোভাব আজ খালেদা জিয়াকে তুলে ধরতে হবে। শুধু তাই নয়, ভারত তার নিজ স্বার্থে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ার রেলওয়ের পথরেখাটি নিজের সুবিধামতো রুটে আদায় করে নিয়েছে। ভারতের এই এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের পথরেখাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢুকে ঢাকা ও সিলেট হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে প্রবেশ করবে। এই পথটি ভারতের জন্য অনুকূল হলেও বাংলাদেশের জন্য দুর্গম, বেশি দূরত্বের ও অনিরাপদ হওয়ায় পথটি বাংলাদেশের জন্য মোটেই লাভজনক নয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-টেকনাফ-সিডোই-আকিয়াব-ইয়াঙ্গুনগামী পথটি বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দূরপ্রাচ্যের গন্তব্যগুলোয় স্থল যোগাযোগের জন্য (সড়ক ও রেলপথ) কম দূরত্বের ও কম দুর্গম এবং নিরাপদ হওয়ার ফলে বাংলাদেশের জন্য তা ছিল সুবিধাজনক; কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের ভারততোষণ নীতির কারণে এশিয়ান হাইওয়ের যে পথ আমরা বেছে নিয়েছি, তাতে আমাদের প্রাপ্তি কম। এমনকি ভারতকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের ব্যাপারেও আমরা চুক্তিবদ্ধ। এসব চুক্তি আমরা এখন বাতিল করতে পারব না। কিন্তু খালেদা জিয়া ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এটা বোঝাতে পারেন যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারত যদি এককভাবে সুবিধা নেয়, তাতে করে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ছে। আমদানি-রফতানিতে চট্টগ্রাম বন্দর এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে। নতুন করে ভারতীয় কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার সুযোগ কম। বিষয়টি নিয়ে খালেদা জিয়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।
বাংলাদেশের জনগণ ভারতের বন্ধুত্ব চায়। বাংলাদেশের উন্নয়নে ও সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে ভারত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে ভারত যদি সমর্থন করে, তাতে বাংলাদেশে ভারতের ইমেজ নষ্ট হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানুষ চায় না ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করুক। তবে খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। আগামী দিনগুলোতে ভারত একটি ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান গ্রহণ করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বিএনপির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল দলটি ভারতবিরোধী। খালেদা জিয়ার ভারত সফর এই বদনাম কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ ‘ছোট’ দেশ হতে পারে; কিন্তু আমাদের অনেক কিছু দেখার আছে। ভারত সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলুক, খালেদা জিয়ার এ সফরের মধ্যে এটি যদি নিশ্চিত হয়, সেটাই হবে আমাদের জন্য বড় পাওয়া।
Daily JUGANTOR
24.10.12

উপাচার্যের পদ ও কর্তব্য




আরও একজন ভিসি আলোচনার জন্ম দিলেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। বিশ্ববিদ্যালয়টি নতুন। নিজস্ব আয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি চলতে হবে_ এটা ছিল পুরনো আইন। এ আইন নিয়ে বড় ধরনের আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। ফলে সরকার এ ধারায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী উপাচার্য ও শিক্ষক নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়াতে হবে এবং সরকারের ওপর থেকে আর্থিক চাপ কমাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়াতে বলেছেন, সেখানে ভিসি নিজের ব্যবহারের জন্য ১ কোটি ১২ লাখ টাকায় দুটি পাজেরো গাড়ি কিনেছেন। এর একটি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখানে নানা সমস্যা রয়েছে। একজন ভিসি হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল ছাত্র তথা শিক্ষকদের সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক মান বাড়ানো। যেখানে সাধারণ শিক্ষকদের যাতায়াত সুবিধা তিনি এখনও পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে পারেননি, সেখানে তিনি কোটি টাকায় পাজেরো কিনলেন; কিন্তু একটি পাজেরো গাড়ি কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির মান-মর্যাদা বাড়ায়? আবার একজন কোষাধ্যক্ষ, তিনিও ব্যবহার করছেন পাজেরো গাড়ি! বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিকের ১৬ অক্টোবরের প্রথম পাতায় উপাচার্য মহোদয়ের গাড়ির বিলাস নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। উপাচার্যের গাড়ির বিলাসই নয়, বরং ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত অর্থ থেকে ৫০ লাখ টাকা উপাচার্য নিজে ও ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন। এটা করা কি ঠিক হয়েছে? যেখানে প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট নির্দেশ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়ানোর, সেখানে উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কীভাবে সেই নির্দেশনার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ভর্তির টাকা নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিলেন। ভর্তি পরীক্ষার সময় শিক্ষকরা কাজ করেন, শ্রম দেন। তারা একটা সম্মানী পেতেই পারেন; কিন্তু উপাচার্য? ট্রেজারার? তারা কী কাজ করেছেন যে 'সম্মানী' নেবেন? তাদের কি এটা উচিত হয়েছে? আমি দাবি করব, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রতি সম্মান জানিয়ে উপাচার্য ওই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ডে জমা দেবেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য থাকাকালে দিনাজপুর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে 'বাধ্য' করেছিলাম ভর্তি পরীক্ষার সময় নেওয়া টাকা ফেরত দিতে। মঞ্জুরি কমিশনের প্রবিধান ও নির্দেশনায়ও উপাচার্যের 'কাজ না করে' টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আলোচ্য ভিসি 'পাজেরো' গাড়ি হাঁকিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কোনো 'পাজেরো' গাড়ি ব্যবহার করেন না। তিনি ব্যবহার করেন ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা দামের নিশান গাড়ি। ভর্তি পরীক্ষার ভাতাও তিনি নেন না। তাহলে কোন যুক্তিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পাজেরো গাড়ি ব্যবহার করেন? কোন যুক্তিতে লাখ লাখ টাকা 'হাতিয়ে' নেন? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ভিসি কাহিনী' যখন নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে, তখন ১৮ অক্টোবর একই দৈনিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির নানা কাহিনী ছাপা হয়েছে। মাত্র ২ থেকে ৪ বছর শিক্ষকতা করে 'দলীয় কোটায়' রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হয়েছেন, এমন শিক্ষকের সংখ্যা একাধিক। কলেজে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে পদোন্নতির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। একজন অধ্যাপক শুধু বয়সের কারণেই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে পারেন না। তার নিজস্ব গ্রন্থ থাকতে হবে। উঁচু মানের প্রকাশনা থাকতে হবে। শুধু বয়স আর কলেজে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকে অধ্যাপক হয়েছেন। এখানে দলীয় রাজনীতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব রাজনীতিও জড়িত। যেহেতু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আর্থিক অনিয়ম, একাডেমিক দুর্নীতির খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আমি আশা করব, মঞ্জুরি কমিশন এ ব্যাপারে অচিরেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবে। আমি নিজে অতীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা দুর্নীতির তদন্ত করেছিলাম। সেই রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে। এখন নতুন আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার।
একজন ভিসির কথা আমরা সংবাদ মাধ্যমসূত্রে জানতে পেরেছি। আরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশি একই পরিস্থিতি। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাহিনী তো আরও ভয়াবহ। তিনি তার আত্মীয়-স্বজনকে চাকরি দিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। খুলনা কিংবা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও (কুষ্টিয়া) এখন এমনি খবরের জন্ম দিয়েছেন ভিসি মহোদয়গণ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগও পত্রপত্রিকায় এসেছে। এসব 'খবর' একজন শিক্ষক হিসেবে আমাকে আহত করে। আমি শিক্ষকতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। একজন উপাচার্যের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। সবাই উপাচার্য হতে পারেন না। একজন উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা যখন দাহ করা হয়, তখন এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। তাই সময় এসেছে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার। একজন অধ্যাপকের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে। তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তা কাম্য হতে পারে না। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি যখন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তখন তিনি রাজনৈতিক কর্মীদেরই 'শিক্ষক' হিসেবে নিয়োগ দেবেন_ এটাই স্বাভাবিক। তাই উপাচার্য নিয়োগের পদ্ধতিটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। ইউজিসি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারে। সেই সঙ্গে ভিসিদের আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। ভিসি হলেই তিনি সবকিছুর ঊধর্ে্ব নন। তিনি সবকিছু করতেও পারেন না। সিন্ডিকেটের নামে নিজের বিশেষ উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপিয়ে দেবেন, এখানে কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না তা হতে পারে না।
Daily SAMAKAL
23.10.12

তৃতীয় ধারা ও বাস্তবতা


বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন দুটি জোটের বাইরে তৃতীয় একটি জোট গঠনের কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে। গত ১৭ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকের খবর ছিল এটি। ওই খবরে বলা হয়েছে, চারটি দল শিগগিরই একটি জোট গঠন করতে যাচ্ছে। এই চারটি দল হচ্ছে- অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন বিকল্প ধারা, ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম, কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এবং আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডি। খবরটি শীর্ষ সংবাদ হিসেবে ছাপা হলেও বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। এই চারটি দলই ব্যক্তিসর্বস্ব। অধ্যাপক চৌধুরী সৎ ও গুণী ব্যক্তি তাতে সন্দেহ নেই। ১৮ দলীয় জোটে যোগ না দিলেও যুগপৎ আন্দোলনে তাদের সঙ্গে আছেন। ব্যক্তি বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছাড়া বিকল্প ধারার কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো বড় জোট ছাড়া তিনি নিজে কিংবা তাঁর ছেলে মাহি চৌধুরী আদৌ বিজয়ী হতে পারবেন কি না সন্দেহ। যদিও ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর এখন রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়া উচিত। তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তাঁর তো আর কিছু পাওয়ার নেই। তিনি নিশ্চয়ই 'মোহম্মদউল্লাহ' স্টাইলে আবার ভবিষ্যতে কোনো মন্ত্রী হবেন না। তিনি জাতির অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেই ভালো করবেন। ড. কামাল হোসেন নিঃসন্দেহে ভালো লোক, সৎ এবং আন্তর্জাতিক সম্মান তাঁর রয়েছে। তাঁর নিজের সংসদীয় কোনো আসন নেই। একবারই ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেওয়া আসনে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তারপর আর তাঁকে সংসদে দেখা যায়নি। তাঁর দল ছোট, তাও ভেঙে গেছে। এই দল নিয়ে কারো সঙ্গে যাওয়া কি না যাওয়া, তাতে কিছু যায়-আসে না। ব্যক্তি কামাল হোসেন তৃতীয় ধারার প্রবক্তা। কিন্তু দুঃখ এটাই, তাতে জনগণের তেমন সাড়া নেই। তাঁর মতো একজন গুণী লোক কেন একটি 'গণজোয়ার' সৃষ্টি করতে পারলেন না- এটা আমি ভেবে পাই না। তাঁর যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা তিনি নিজেই নষ্ট করেছেন। ঢাকার বাইরে জেলা শহরগুলোতে তিনি কখনো গেছেন- এটা কেউ বলতে পারবে না। এমনকি এই খোদ ঢাকা শহরে তিনি কখনো গণসংযোগে বেরিয়েছেন, তাও কেউ বলতে পারবে না। তবে হ্যাঁ, ইস্যুভিত্তিক তিনি সোচ্চার হন। বলেন। তাঁর কর্মকাণ্ড অনেকটা সেমিনার অর্থাৎ প্রেসক্লাব-ভিত্তিক। 'বেইলী রোড' থেকে তিনি গণফোরামকে জনগণের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারেননি।
একসময়ের তুখোড় বক্তা ও জাসদ নেতা আ স ম আবদুর রব এখন ক্ষুদ্র জেএসডি নিয়ে আছেন। মূলধারা চলে গেছে ইনুর হাতে। জাসদ নিয়ে তাঁর মধ্যে বিভ্রান্তি আছে। একবার বলেন, জাসদকেন্দ্রিক রাজনীতি তিনি করেন না, কিন্তু সেই জাসদকে (জেএসডি) তিনি ছাড়তেও পারলেন না। তাঁরও একটা সম্ভাবনা ছিল। সেই সম্ভাবনাও তিনি কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছেন। ব্যক্তি হিসেবে মানুষ তাঁকে চেনে। কিন্তু দলকে কেউ চেনে না। সংসদীয় আসনে তাঁর একটা 'অবস্থান' আছে। কিন্তু প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। কোনো বড় দলের সমর্থন না পেলে তাঁর পক্ষে সংসদে ফিরে আসা কষ্টকর। পারবেন না। আওয়ামী লীগ-বিরোধী ভূমিকার কারণে তিনি সুপরিচিত। নির্বাচনে জিততে হলে তাঁকে তাকাতে হবে বিএনপির দিকে। 'তৃতীয় ধারা' তাঁর বিজয়কে নিশ্চিত করবে না। কাদের সিদ্দিকীও ব্যক্তিনির্ভর দলের প্রধান। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের নাম মানুষ যতটুকু না জানে, তার চেয়েও বেশি জানে ও চেনে কাদের সিদ্দিকীকে। দলেও তিনি পরিবারতন্ত্র কায়েম করেছেন, যদিও তিনি রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের বিরোধিতা করেন। তাঁদের এই চারজনের সমন্বয়ে কী হবে? সংসদীয় রাজনীতিতে এসব দলের আদৌ কি কোনো ভূমিকা আছে। সংসদীয় আসনে জিততে হলে তাঁদের হয় আওয়ামী লীগ নতুবা বিএনপির ওপর নির্ভর করতে হবে। কাদের সিদ্দিকী সংসদে গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তা সম্ভব হয়েছিল বিএনপির সমর্থন তথা আসন ছেড়ে দেওয়ার কারণে। এককভাবে তিনি কি জিততে পারবেন? মনে হয় না। এ ক্ষেত্রে তাঁকে আবারও বিএনপির সমর্থন নিতে হবে। তৃতীয় ধারার কথা বলে তিনি এই সমর্থন নিশ্চিত করতে পারবেন না। এখানে জাতীয় পার্টির একটি ভূমিকা লক্ষ করার বিষয়। উত্তরবঙ্গ-নির্ভর এই দলটির এলাকাভিত্তিক সমর্থন রয়েছে। এরশাদ নয়াদিল্লি ঘুরে এসে বলেছেন, তিনি এককভাবে নির্বাচন করবেন। তিনি যদি আলাদা একটি জোট গঠন করার চেষ্টা করেন (যা তিনি করেছিলেন পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে), তাতে কিছু লোককে তিনি টানতে পারবেন। অতীতে একাধিকবার বিকল্প ধারা, গণফোরাম, জেএসডি ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগকে নিয়ে এরশাদের একটি জোট গঠনের কথা বলা হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে সমস্যা রয়েছে প্রচুর। নেতৃত্ব একটা বড় প্রশ্ন। কে জোটের নেতৃত্ব দেবেন? এরশাদ, না বি চৌধুরী, না কামাল হোসেন? এখানে রাজনীতি যতটা না সুস্থ, তার চেয়েও মুখ্য ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব। এই সম্ভাবনাও এখন ক্ষীণ। ঘুরেফিরে তাই দুই জোটের প্রশ্নই এসে যায়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট কিংবা বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি অবিসংবাদিত 'সত্য'। এই 'সত্য'কে অস্বীকার করা যাবে না। মহাজোট সরকার গত প্রায় চার বছরের কর্মকাণ্ডে সফল, তা কোনোমতেই বলা যাবে না। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের ভোগান্তি যত না বেড়েছে, তার চেয়েও মহাজোটের বেশি ক্ষতি করেছে হলমার্ক কেলেঙ্কারি ও শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির ঘটনা। এর পেছনের মানুষগুলোকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে আমাদের মান-সম্মান ও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে পশ্চিমা বিশ্বে। সেই সঙ্গে গুম, হত্যা, কেলেঙ্কারির ঘটনা এখন সরকারের 'গলার কাঁটা'। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পরিবর্তন এনেও সাধারণ মানুষের আস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। ভারতের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরতা ও অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা দেওয়া পররাষ্ট্রনীতিতে একটি 'বড় ব্যর্থতা' হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নামসর্বস্ব দলের অন্তর্ভুক্তি থাকলেও ব্যক্তি বেগম জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বে বেড়েছে। অতিসম্প্রতি চীনের উপরাষ্ট্রপতি জি জিংপিনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ এবং ২৮ অক্টোবর তাঁর ভারত সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে বেগম জিয়াই হচ্ছেন বাংলাদেশের 'বিকল্প নেতা'। জি জিংপিনের মতো সিনিয়র নেতা (যিনি চীনের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন) যখন খালেদা জিয়াকে সাক্ষাতের সময় দেন, তখন এতে একটি স্পষ্ট 'সিগন্যাল' থাকে। ভারতও তার সেই পুরনো পিণ্ড (আওয়ামী লীগকে সমর্থন) থেকে বেরিয়ে আসছে। খালেদা জিয়াকে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ এ কথাই প্রমাণ করে যে ভারত তার জাতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। বাংলাদেশে তার স্বার্থ যাতে অক্ষুণ্ন থাকে, ভারত এটাই চাইবে। খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়ে তারা সেটাই নিশ্চিত হতে চাইছে। আমরা সেই পুরনো বলয় থেকে বেরোতে পারছি না- আওয়ামী লীগের 'বিকল্প' তৃতীয় ধারা নয়, বরং আওয়ামী লীগের বিকল্প বিএনপিই। সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসও তা-ই বলে। দীর্ঘদিন ধরেই 'তৃতীয় ধারা'র কথা বলা হলেও নূ্যনতম কোনো কর্মসূচি তাঁরা উপস্থাপন করতে পারেননি। তাঁরা নিজেদের আওয়ামী লীগ বা বিএনপির বিকল্প হিসেবেও উপস্থাপন করতে পারেননি। তাঁদের কর্মকাণ্ড শুধু ঢাকা শহরেই সীমাবদ্ধ, ঢাকার বাইরে যে বিশাল বাংলাদেশ, সেখানে তাঁদের পদচারণ নেই। তাঁরা এটা বোঝেন বলেও মনে হয় না। তাই যে চারটি দলের কথা বলা হয়েছে, তাঁরা শুধু আলোচনাতেই থাকবেন। কিন্তু কোনো 'আবেদন' সৃষ্টি করতে পারবেন না। কাগজে শীর্ষ সংবাদ হয়ে কারো কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় বটে, কিন্তু তা সাধারণ জনগণের মধ্যে কোনো আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারে না। তৃতীয় ধারার উদ্যোক্তারা যদি বিষয়টি নিয়ে ভাবেন, তাহলে তাঁরা এর জবাবও খুঁজে পাবেন।Daily KALERKONTHO22.10.12

দুই নেত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্য প্রসঙ্গে


দুই নেত্রী গত ৬ অক্টোবর দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় বলেছেন, ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে হবে। তিনি জানান, দলীয় সরকারের অধীনেই দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে বেগম জিয়া ওই একই দিনই হবিগঞ্জে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বলেছেন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। সেই লক্ষ্যে ঈদের পর কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। দুই নেত্রীর পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেশে এক সংকট তৈরি করেছে। সাধারণ মানৃষ এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছে। এখন মহাজোট সরকার যদি দলীয়ভাবে নির্বাচন করে এবং তাতে যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল অংশ না নেয়, তাহলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
এদেশে ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু একটি বড় দল (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ) অংশগ্রহণ না করায় তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। অন্যদিকে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে দুটি বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করায় শুধু দেশেই নয়, বরং বিদেশেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এখন ২০১৩ সালে যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে একটি বড় দল বিএনপি যদি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে সংগত কারণেই ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি অবিসংবাদিত শক্তি। একটি দলকে বাদ দিয়ে অন্যদল এককভাবে যেমন গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি, ঠিক তেমনি এই দু’দলের একটিকে বাদ দেয়ার কিংবা ‘মাইনাস’ করার কোনো ষড়যন্ত্রও সফল হয়নি। এই দল দুটোর মাঝে প্রচণ্ড বিরোধ আছে। এ বিরোধ এখন ব্যক্তিপর্যায়ে চলে গেছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই দল দুটোর কারণেই গণতন্ত্র এদেশে স্তরে স্তরে শক্তিশালী হচ্ছে।
আমরা যদি পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, এদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট নয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মাঝে ১৯৮৬ (তৃতীয়), ১৯৮৮ (চতুর্থ) ও ১৯৯৬ (ষষ্ঠ) সালে অনুষ্ঠিত হওয়া সংসদ নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। বাকি ৬টি সংসদ নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বচনে আওয়ামী লীগ শতকরা ৭৩.২০ ভাগ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল। ওই সময় সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। ওই সময়ও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে (রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আওতায়) সদ্যগঠিত বিএনপি ২০৭টি আসন পায়। শতকরা হিসাবপ্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৪১.০৭ ভাগ। আওয়ামী লীগ মীজান ও মালেক আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচন করে। যৌথভাবে তারা পায় ৪১টি আসন (মালেক ৩৯), শতকরা হিসাবে যা ছিল ২৭.৩৪ ভাগ। এর বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মুসলিম লীগ ও আইডিএল ঐক্য (২০ আসন, ১০.০৭ ভাগ ভোট)  গনঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি ১৪১ আসন (৩০.৮১ ভাগ ভোট) ও আওয়ামী লীগ ৮৮ (৩০.০৮ ভাগ ভোট) আসন পেয়েছিল। জামায়াত ১৮ ও জাতীয় পার্টি ৩৫ আসন পেয়েছিল। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দৃশ্যপট বদলে যায়। প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (১৪৬ আসন, ৩৭.৪৪ ভাগ ভোট) বিজয়ী হয়। বিএনপির আসন দাঁড়ায় ১১৬ (৩৩.৬১)। জাতীয় পার্টি ৩২ (১৬.৩৯ ভাগ ভোট) আসন গিয়ে তৃতীয় অবস্থান ধরে রাখে। অষ্ঠম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০১) দৃশ্যপট আবার বদলে যায়। বিএনপি ১৯৩ আসন (৪০.৯৭ ভাগ ভোট) পেলেও চারদলীয় জোট পায় শতকরা ৪৭ ভাগ ভোট, আর আসন পায় ২১৬। আওয়ামী লীগের আসন কমে এসে দাঁড়ায় ৬২ (৪০.১৩ ভাগ ভোট)।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০০৮) প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। ২০০৭ সালের ‘এক-এগারোর’ ঘটনা পুরো রাজনৈতিক সিস্টেমকে একটি বড় ধরনের ধাক্কা দেয়। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ভূমিকা এ ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করে। এমনই এক পরিস্থিতিতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় (২৩১, ৪৮.০৬ ভাগ ভোট)। বিএনপির আসন কমে এসে দাঁড়ায় মাত্র ৩০টিতে (শতকরা ৩২.৪৫ ভাগ ভোট)। জাতীয় পার্টি (২৬, ৭.০৫ ভাগ ভোট) তৃতীয় অবস্থান ধরে রাখে। সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল আমাদের দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে।
এক, এদেশের রাজনীতি দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এই দল দুটোর যে কোনো একটিকে বাদ দিয়ে এককভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করা অসম্ভব। রাষ্ট্র পরিচালনায় বড় দল দুটোর মাঝে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার । দুই, বড় দল দুটোর বাইরে তৃতীয় একটি বড় দলের জন্ম হয়নি। তৃতীয় ধারার কথা বারবার বলা হলেও সাধারণ মানুষ এই তৃতীয় ধারার প্রতি আস্থাশীল নয়। জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি নয়; বরং একটি আঞ্চলিক দল এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ‘ঐক্য’ তৃতীয় শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরায়। তিন, এককভাবে নির্বাচন করার ফলে সেসব নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। চার, এ দেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা দৃশ্যমান।
একদিকে ধর্মকে প্রধান করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের একটি ধারা; অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষবাদী, একক দলের সমাজতন্ত্রী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমর্থকদের একটি ধারা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ মুহূর্তে যে অচলাবস্থা, তার কেন্দ্র মূলত একটি, আর তা হচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার-যারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। সংবিধানে ১৫তম সংশোধনী আনার ফলে সংবিধানে এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলে কিছু নেই। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকার তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আওয়ামী লীগও অতীতে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত নির্বাচন সমর্থন করেনি। মাগুরা, ভোলা কিংবা সর্বশেষ গাজীপুর-৪ উপ-নির্বাচন আমাদের কাছে একেকটা দৃষ্টান্ত-যেখানে প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে প্রভাব খাটায় এবং বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকলে তাতে সাধারণ ভোটারের আগ্রহ থাকে না। তাই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি উঠেছে, তা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সরকারের তাতে সম্মতি না থাকায় পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে।
এরই মধ্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারপ্রধানের একটি নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। এখনো নির্বাচনের অনেক দিন বাকি। তারপরও নির্বাচনের প্রশ্নে যদি একটি সমাধান না হয়, তাহলে আগামী বছর দেশ একটি বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়বে। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হবে, এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে।
Daily MANOBKONTHO
21.10.12

বিবি গভর্নরের বক্তব্যকে গুরুত্ব দিতে হবে



বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ৬ অক্টোবর। তরুণ অর্থনীতিবিদদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইয়ং ইকোনমিস্টস অ্যাসোসিয়েশন’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভেতরে শেয়ারবাজার কেলেংকারি থেকে শুরু করে হলমার্ক কেলেংকারি পর্যন্ত একের পর এক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সবার দৃষ্টি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে। কিন্তু বিবি গভর্নর ছিলেন নিশ্চুপ। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তার ‘দ্বন্দ্বের’ কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হলে তিনি চলে আসেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। অবশেষে তিনি মুখ খুললেন। তার বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, বিবেকের দংশন থেকে শেষ অবদি তিনি মুখ খুললেন। তিনি ওই অনুষ্ঠানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তিনি বলেছেন, ১. ব্যাংকিং খাতে দ্বৈত শাসন চলছে; ২. জনগণের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না; ৩. রেফারি শক্তিশালী না হলে খেলা জমে না; ৪. রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে অপেশাদার পরিচালক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে; ৫. সোনালী ব্যাংকে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে; ৬. শেয়ারবাজার কেলেংকারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন ভূমিকা নেই; ৭. ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সংশোধন করতে হবে ইত্যাদি।
অর্থনীতি সম্পর্কে যারা ন্যূনতম ধারণা রাখেন, তারা জানেন বিবি গভর্নর মিথ্যা বলেননি। তার প্রতিটি বক্তব্যের গুরুত্ব রয়েছে এবং অর্থনীতিবিদরা দেশের আর্থিক খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে তার সাহসী বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। তার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ব্যাংকিং খাতে দু’রকম শাসন চলছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতার পার্থক্য রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের ব্যাপারে বিবির ভূমিকা যত স্পষ্ট, সরকারি ব্যাংকের ব্যাপারে অত স্পষ্ট নয়। প্রশ্ন ওঠে, কেন এই পার্থক্য? পৃথিবীর কোন দেশেই আর্থিক খাতে এ ধরনের পার্থক্য নির্ধারণ করা হয় না। পৃথিবীর সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনৈতিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে থাকে। বাংলাদেশে এ পার্থক্যটাই আমরা প্রত্যক্ষ করি, যা কোন অবস্থাতেই ভালো খবর নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিই আমাদের বলে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা, বিশেষ করে তদারকি ক্ষমতা বাড়াতে হবে। হলমার্কের কেলেংকারির ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু সোনালী ব্যাংক কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। আর নেয়নি বলেই পরিস্থিতি এ পর্যন্ত গড়িয়েছে। হলমার্ক কেলেংকারি নিয়ে বিবি গভর্নর যে চিঠি লিখেছিলেন অর্থমন্ত্রীকে, তাতে ‘গোসসা’ হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, বিবির গভর্নরের কোন ক্ষমতা নেই এ ধরনের চিঠি লেখার। এ থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তদারকি করার একটা ক্ষমতা, যা সনাতন, তা উপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর ভূমিকা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।
বিবির গভর্নর ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে পেশাদারি লোকদের অন্তর্ভুক্তি চান। এ কথাগুলো আজ সবাই বলছেন। এটাই বাস্তব। একজন অপেশাদার লোক যখন ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত হন, তখন তাদের জন্য বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। হলমার্ক কেলেংকারি একটা বড় উদাহরণ। সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে যারা ছিলেন, তাদের কেউ কেউ ‘আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ’ পেয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সঙ্গত কারণেই এখানে অসততার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। একজন সাংবাদিক ও একজন সাবেক ছাত্রনেতাও ছিলেন পরিচালনা পর্ষদে। তারা ব্যাংকিং কী বুঝবেন? সোনালী ব্যাংকে বড় জালিয়াতি হয়েছে, কিংবা সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে অপেশাদারি লোক ছিলেনÑ বিবির গভর্নরের এ অভিমত সরকার যদি গ্রহণ করে, তাহলে সরকার ভালো করবে। সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ তাদের টার্ম শেষ করেছে। কিন্তু অভিযোগ থেকে তারা ‘মুক্তি’ পেতে পারে না। হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তিনি বড় জালিয়াত, সন্দেহ নেই। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কেউ কেউ যে এ ঘটনায় জড়িত নন, তা বলা যাবে না। দুদক আরও তদন্ত করুক এবং দোষীদের আইনের আওতায় নেয়া হোক। দুদক একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। কিন্তু আমাদের হতাশার জায়গাটা এখানেই যে, দুদক ‘ইচ্ছে করলে’ অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু ‘অদৃশ্য কারণে’ করে না। আর ‘অদৃশ্য কারণটা’ এ দেশের আমজনতা জানে বলেই আমার ধারণা।
মিডিয়াতে লেখালেখি না হলে তানভীর ও তার শ্যালক তুষার গ্রেফতার হতেন না। তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কী? আÍসাৎ করা কোটি কোটি টাকার কী হল? আমরা চাই একই সঙ্গে তার বিচার চলবে, সেই সঙ্গে টাকা উদ্ধারেরও ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে হলমার্কের নামে যত সম্পদ আছে, তা বাজেয়াপ্ত করা হোক। আমরা জানি, বাংলাদেশের আইন এ ক্ষেত্রে অনেক দুর্বল। জনগণের টাকা যদি উদ্ধার না হয়, যদি ফাঁকফোকর দিয়ে তানভীর গং বেরিয়ে যান, সেটা হবে আমাদের জন্য সত্যিই একটা দুঃখজনক ঘটনা। তানভীরের মতো বাকিরাও গ্রেফতার হবে এবং পুলিশ তাদের রিমান্ডে নেবেÑ এটাই আশা করি।
আসলে ব্যাংকিং খাতে একটা নিয়ম-শৃংখলা ফিরিয়ে আনা উচিত। সাধারণ মানুষের একটা আস্থার জায়গা ছিল এ সরকারি ব্যাংক। একসময় বেসরকারি ব্যাংক নিয়ে নানা কথা আমরা শুনতাম। এখন দেখলাম, বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে সরকারি ব্যাংকে দুর্নীতি বেশি। হলমার্কের মতো কেলেংকারি কোন বেসরকারি ব্যাংকে ঘটত না বলে আমার ধারণা। এখন অবদি সেরকম কোন সংবাদ আমাদের কানে আসেনি। আমার আশংকা, আরও অনেক হলমার্কের মতো ঘটনা সম্পর্কে অচিরেই আমরা অবহিত হব! ৮ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিক আমাদের জানাচ্ছে আরেকটি সরকারি ব্যাংক রূপালী ব্যাংকের ঋণ বিতরণের অনিয়মের খবর। বিবির নির্বাহী পরিচালকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে, তিন প্রতিষ্ঠানের ঋণে বড় অনিয়ম পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, ৮০১ কোটি টাকা আদায় না হওয়ার আশংকা রয়েছে। কী ভয়ংকর কথা ৮শ’ কোটি টাকা লোপাট। দুদকের নজরে কি বিষয়টি এসেছে? আমি ঠিক জানি না দুদকের পক্ষে এত বড় সেক্টরের দুর্নীতি উদঘাটন করা সম্ভব কিনা? এমনিতেই নানা কাজে দুদক এখন খুবই ব্যস্ত। এর ওপর যোগ হয়েছে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়টি। বিশ্বব্যাংকের মনোনীত টিম এসেছে দুদকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য। সুতরাং তাদের ব্যস্ততা বেশি। তানভীর মাহমুদ গ্রেফতার হওয়ার আগে আরও ৫টি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যাদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রকাশ করা হচ্ছে না (সংসদীয় কমিটিতে দেয়া বক্তব্য)। এ ৫টি প্রতিষ্ঠান হচ্ছেÑ টি অ্যান্ড ব্রাদার্স, প্যারাগন নিট, নকশি নিট, ডিএন স্পোর্টস এবং খান জাহান আলী। আমরা আমজনতা এদের ব্যাপারে কিছুই জানি না। আরও কি ‘ডজন খানেক’ তানভীর মাহমুদ লুকিয়ে আছে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে! আমরা একটি শ্বেতপত্র চাই। আমরা সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাই উল্লিখিত ওই ৫টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের কোন দায়বদ্ধতা আছে কিনা? সংসদীয় কমিটি কিংবা দুদকও অভিযোগটি খতিয়ে দেখতে পারে।
আসলে সব অভিযোগই কাগজ-কলমে আটকে থাকবে যদি না বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করা হয়। এজন্য এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সংশোধন করা। অতি ক্ষমতাধর আমলারা এ কাজটি করতে দেবে কিনা, আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। তবে বিবি ‘গভর্নর’ হয়ে নিজের দায়িত্ববোধ মাথায় নিয়ে তিনি যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছেন, তাকে আমি স্বাগত জানাই। সে সঙ্গে যারা দেশকে ভালোবাসেন, অর্থনৈতিক সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে চান, তাদের অনুরোধ করব তারা যেন বিবি গভর্নরের পাশে এসে দাঁড়ান।
গভর্নর সাহেব একটি কঠিন সত্য কথা বলেছেনÑ ‘রেফারি শক্তিশালী না হলে খেলা জমে না।’ গভর্নর তো তত্ত্বগতভাবে রেফারিই! তাকে অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে। আর রাষ্ট্রের দায়িত্বই হচ্ছে তাকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলা। আমরা সেই শক্তিশালী একজন ‘রেফারি’ চাই, যিনি কলুষিত অর্থনীতিকে একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারবেন।
Daily JUGANTOR
16.10.12

বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সম্পর্কে দুটি কথা


অর্থনৈতিক সেক্টরে একের পর এক যেসব দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে, এতে করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতি তদন্তের কাজ পর্যালোচনার জন্য বিশ্বব্যাংকের একটি তদন্তদল ঢাকায় এসেছে ১৪ অক্টোবর। বিশ্বব্যাংকের তদন্ত টিমে যাঁরা অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন, তাঁদের পরিচিতি দেখেই বোঝা যায় 'পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির বিষয়টি' কত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বিশ্বব্যাংক। আন্তর্জাতিক এই প্যানেলের প্রধান হলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর গাব্রিয়েল মোরেকে ওকাম্পো। এখন যে প্রশ্নটি আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই প্যানেলের রিপোর্ট ছাড়া আদৌ পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চলবে কি না। বাংলাদেশ চাচ্ছিল বিশ্বব্যাংকের তদন্তের পাশাপাশি অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হোক। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের তাতে আপত্তি, আগে পর্যালোচনা রিপোর্ট জমা হবে, এরপর আলোচনা। আমাদের জন্য এখন একের পর এক অর্থনৈতিক দুর্নীতির রিপোর্ট সংবাদপত্রে প্রকাশিত হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, বহুল আলোচিত হলমার্ক কেলেঙ্কারির খলনায়ক তানভীর মাহমুদ গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ইতিমধ্যে তানভীর ও জিএম তুষার আহমদকে আদালত ২৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, হলমার্ক ঘটনার সঙ্গে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা তথা সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জড়িত। সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় হলমার্ক জালিয়াতির ঘটনা একটা বড় ধরনের দুর্নীতি। একই সঙ্গে ডেসটিনির বিরুদ্ধে তিন হাজার ২৮৫ কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগও উঠেছে এবং দুদকে মামলাও হয়েছে। ডেসটিনির সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের অনেকের বিরুদ্ধে সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে দুদক যখন হলমার্ক কেলেঙ্কারির আসল ঘটনা অনুসন্ধানে ব্যস্ত, ঠিক তখন আরো দুটি দুর্নীতির সংবাদ মিডিয়ায় আলোড়ন তুলেছে। এক. রূপালী ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে প্রায় হাজার কোটি টাকার লোপাটের খবর। দুই. দপ্তরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সাবেক এপিএসের সাবেক ড্রাইভার একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রায় ছয় মাস আগে বিজিবি গেটে আটক ৭৪ লাখ টাকার সঙ্গে সুরঞ্জিত বাবুর সংশ্লিষ্টতার খবর ফাঁস করে দিলে সর্বত্র আবারও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এ ঘটনায় মিডিয়ার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ারও হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু এতে করে তিনি কি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবেন? তাঁর এ ধরনের 'হুমকি' এলো যখন বিশ্বব্যাংকের তদন্ত টিম ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির ব্যাপারে অভিযোগ ছিল সাবেক রেলমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে। সেটা তদন্ত করতেই বিশ্বব্যাংকের তদন্ত টিমের ঢাকা আগমন। এখন আরো একজন মন্ত্রীর নাম এলো। লিস্টে আরো আছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, যিনি এখন 'ছুটিতে' আছেন।
অর্থনৈতিক সেক্টরে এই দুর্নীতির খবর বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তির যথেষ্ট ক্ষতি করেছে। এটা আরো দুঃখজনক যে আমাদের দেশে যেসব দুর্নীতির তদন্ত হয়, দাতাগোষ্ঠী ওই তদন্তের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। ইতিমধ্যে সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি দুদক। আবুল হোসেন কোনো দুর্নীতি করেননি- এসব সার্টিফিকেটও দিয়েছিল দুদক। সাধারণ মানুষ এতে আস্থা রাখতে পারেনি। দুদকের তদন্তে বিশ্বব্যাংকের যদি আস্থা থাকত, তাহলে বিশ্বব্যাংক ওকাম্পোর মতো একজন দক্ষ প্রসিকিউটরকে বিষয়টি তদন্ত করতে এ দেশে পাঠাত না। যদিও তারা সেই অর্থে কোনো তদন্ত করবে না। তারা দুই দেশের তদন্তকাজ পর্যালোচনা করবে। তবে তারা পদ্মা সেতুসংক্রান্ত সব কাগজপত্র দেখবে। সেখানে কোনো অনিয়ম হয়েছে কি না, তারা সেটা পর্যালোচনা করবে। এটা ব্যক্তি আবুল হোসেন নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও মঙ্গল। সাবেক মন্ত্রী আবুল হোসেন বারবার বলে আসছেন, তিনি কোনো দুর্নীতি করেননি এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেননি। দুদক তাঁকে দুর্নীতিমুক্ত বলে সার্টিফিকেটও দিয়েছিল। এখন দুদকের জন্যও একটি সুযোগের সৃষ্টি হলো- তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। বিশ্বব্যাংক টিম তাদের তদন্তে যদি অনিয়ম খুঁজে পায় কিংবা দুর্নীতির অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়, তাহলে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন তো বন্ধ হয়ে যাবেই, তার চেয়েও বড় কথা বাংলাদেশ বড় ধরনের ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে। যদিও দুদক চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, রবিবার বিশ্বব্যাংক প্যানেলের বিশেষজ্ঞরা দুদকের সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশে দুর্নীতির অভিযোগ বিশ্বব্যাংকের পুরোনো। শীর্ষ পর্যায়ে দুর্নীতি হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা প্রমাণিতও হয়েছে। একজন মন্ত্রী কিংবা একটি সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা যদি লুটপাটের সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। দুর্নীতির এই 'ইমেজ' যদি আমরা ভাঙতে না পারি, তাহলে ভবিষ্যতে দাতারা আদৌ কোনো সাহায্য দেবে না। তাদের মধ্যে এমন একটি ধারণার জন্ম হবে যে প্রকল্পে দেওয়া সাহায্য আদৌ ব্যবহৃত হবে না। আমরা, আমাদের নীতিনির্ধারকরা বিশ্বব্যাংকের তদন্ত টিমের ঢাকা আগমনকে কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন বলতে পারব না। তবে এটা বলতে পারব, বাংলাদেশ এখন বিশ্ব মিডিয়ার ওয়াচলিস্টে রয়েছে। দাতাগোষ্ঠী এই তদন্তকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আমরা একান্তভাবেই কামনা করি, বিশ্বব্যাংকের তদন্ত টিমের পর্যবেক্ষণে বেরিয়ে আসুক পদ্মা সেতু নির্মাণে কোনো দুর্নীতি হয়নি কিংবা আমাদের সাবেক মন্ত্রী ও উপদেষ্টা কোনোভাবেই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সেই সঙ্গে অতি সাম্প্রতিককালে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্ত করুক একটি বিচার বিভাগীয় টিম। দুদক তো একবার তদন্ত করেছে। সেখানে তো তারা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কোনো সম্পৃক্ততা খুঁজে পায়নি। যেহেতু অভিযোগটি আবারও উঠেছে, সে ক্ষেত্রে সরকার তার স্বচ্ছতার খাতিরে হাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে। আর অভিজ্ঞ সুরঞ্জিত বাবু নিশ্চয়ই জানেন তিনি যদি ক্যাবিনেটে থাকেন, তাহলে তদন্তের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তাই তিনিও 'ছুটিতে' যেতে পারেন। আমরা চাই তিনি দুর্নীতিমুক্ত হয়েই ফিরে আসুন। তিনি ক্যাবিনেটে থাকলে তাঁকে নিয়ে আরো লেখালেখি হবে। অনেক সত্য-অসত্য সংবাদ, ব্যঙ্গচিত্র ফেসবুকে নিত্য ছাপা হবে- এটা তাঁর নামের প্রতি সুবিচার হবে না।
আসলে সময় এসেছে সরকারের শক্ত অবস্থানে থাকার। তানভীর গ্রেপ্তার হয়েছেন। এটাই শেষ কথা নয়। তাঁকে আর্থিক অনিয়মে যে সহযোগিতা করেছে, কারা কারা অর্থ লুটপাটের সঙ্গে জড়িত ছিল, তাঁদের শুধু গ্রেপ্তারই যথেষ্ট নয়, বরং তাঁদের সব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করাও প্রয়োজন। একটি দৃষ্টান্ত স্থাপিত হোক। অন্তত বিশ্ববাসী দেখুক, আমরাও দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিতে পারি। এতে করে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। বিশ্বব্যাংকের টিম এসেছে। এটা আমাদের জন্য লজ্জার। কেন বিদেশ থেকে টিম আসবে তদন্ত করতে? কেন আমরা দুর্নীতিবাজদের বারবার প্রোটেকশন দেব? আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি শক্ত অবস্থানে যেতে পারি, তাহলে আগামী নির্বাচন সরকারের জন্য যেমন একটি 'প্লাস পয়েন্ট', ঠিক তেমনি বিশ্ব আসরে মাথা তুলে দাঁড়ানোরও একটি সুযোগ তৈরি হবে। বিশ্বব্যাংকের তদন্ত টিমের ঢাকা আগমনকে কেন্দ্র করে আমাদের নীতিনির্ধারকরা যদি পুরো বিষয় নিয়ে ভাবেন, সেখানেই আমাদের সবার মঙ্গল নিহিত।Daily KALERKONTHO16.10.12

আশার আলো বনাম থলের বিড়াল



দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তার বিরুদ্ধে আনীত ড্রাইভার আজম খানের অভিযোগকে আইসিআইর ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। আজম খান মন্ত্রীর সাবেক এপিএসের ড্রাইভার। ড্রাইভার আজম পলাতক অবস্থায় থেকে আরটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আবারও জানালেন, পিলখানায় যে ৭৪ লাখ টাকাসহ সাবেক এপিএস ফারুক আটক হয়েছিলেন, তার গন্তব্য ছিল সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জিগাতলার বাড়ি। গত ৬ অক্টোবর প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে এই খবরটিই প্রাধান্য পেয়েছে। নতুন করে রেলের \'ঘুষ-বাণিজ্যের\' খবরটি এলো এমন এক সময় যখন পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য ঢাকায় আসছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সাবেক প্রধান প্রসিকিউটর লুই গ্যাব্রিয়েল মারিনো ওকাম্পো।
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের কারও কারও বিরুদ্ধে যখন \'বড় দুর্নীতির\' অভিযোগ ওঠে এবং সেই অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য বিদেশ থেকে তদন্ত দল আসে, তখন বিদেশে আমাদের মান-মর্যাদা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! ক্ষমতাসীনরা এটা কতটুকু বোঝেন, আমি জানি না। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের এই পর্যবেক্ষণ টিমের ঢাকায় আসার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, আমাদের দেশে যেসব তদন্ত সংস্থার মাধ্যমে এ ধরনের তদন্ত পরিচালিত হয়, তাতে বিদেশিদের আস্থা থাকে না। আমি মনে করি, দুদকের জন্য একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি হলো এখন তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। বিশ্বব্যাংকের পর্যবেক্ষক দল যদি দুদকের তদন্তে সন্তুষ্ট না হয়, তাহলে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ভবিষ্যতে যে কোনো বৈদেশিক সাহায্যও হুমকির মুখে থাকবে।
দুদকের তদন্তে এর আগে প্রমাণিত হয়েছিল ধৃত ৭৪ লাখ টাকার সঙ্গে সুরঞ্জিতের কোনো সম্পর্ক নেই! এ দেশের সাধারণ মানুষ, এমনকি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নির্বাচনী এলাকা দিরাইয়ের মানুষ কি তা বিশ্বাস করেছে? মানুষ বিশ্বাস করেনি। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করেন। এটা সত্য এবং এক সময় বাম রাজনীতির সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। এমনকি আওয়ামী লীগের রাজনীতির বিরোধিতা করেও অতীতে একতা পার্টির প্রার্থী হিসেবে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। এতে প্রমাণ করে, তিনি তার এলাকায় জনপ্রিয়। তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েও তার জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছেন। কিন্তু \'রাজনীতি\' অর্থ আয়ের একটা মাধ্যম হতে পারে না। সুরঞ্জিতের পারিবারিক ঐতিহ্য এমন ছিল না যে, তিনি মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে শতকোটি টাকার মালিক হতে পারেন! তার আয়ের উৎস কী? একজন এমপি হিসেবে তিনি কত টাকা \'সম্মানী\' পান? রাষ্ট্র তাকে একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে যে সুযোগ দেয়, তা দিয়ে কি তিনি (১০ কোটি টাকা) দিরাইয়ে \'সেন মার্কেট\' করতে পারেন? তার যে ২০ কোটি টাকার একাধিক মাছের খামার রয়েছে, সেই টাকার উৎস কী? যে ধানি জমি তার রয়েছে, তা কি পারিবারিকভাবে তিনি পেয়েছেন! তার ছেলে সৌমেন যে টেলিকম কোম্পানিতে ৫ কোটি টাকা লগি্ন করেছে, তা কি তার বৈধ? জিগাতলায় সুরঞ্জিতের যে ৫ তলা বাড়িটি রয়েছে তা কি তার বৈধ আয়ে কেনা? নাকি দখল করা? সংবাদপত্রে এর আগে ওই বাড়িটি নিয়ে প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছিল।
আজ এসব প্রসঙ্গ থাক। রাজনীতিবিদরা জনগণের সেবা করবেন, এটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু একজন রাজনীতিবিদের যখন কোনো বৈধ আয় থাকে না, তখন তিনি যখন কোটি কোটি টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেন, তখন তার সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। প্রসঙ্গক্রমেই এসে গেল মওলানা ভাসানীর কথা। তার মৃত্যুর কিছুদিন আগে (আমরা তখন সবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি) আমরা টাঙ্গাইলে \'হুজুরের\' সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। একটা ভাঙা বাড়ির বারান্দায় বসিয়ে তিনি আমাদের গাছের একটি করে ক\'দিনের পুরনো কলা খেতে দিয়েছিলেন। ভাসানী অগাধ সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু হননি। দুঃখী মানুষের কথা তিনি আজীবন বলে গেছেন। ইচ্ছা করলে খোদ ঢাকা শহরেই একাধিক বাড়ি তিনি করে যেতে পারতেন। তিনি কি আমাদের রাজনীতিবিদদের জন্য একটি আদর্শ হতে পারতেন না? ভাসানীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী ও সন্তানরা বিলাসবহুল জীবনযাপন করে গেছেন, এটা বলা যাবে না। বরং তাদের অনেকের আর্থিক কষ্টে দিন কেটেছিল বা এখনও কাটছে। কিংবা হাজী দানেশ? কী সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন কমরেড মণি সিংহ? উদাহরণ প্রসঙ্গ থাক। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত তো পরবর্তী প্রজন্মের রাজনীতিবিদ। তরুণ বয়সে এমপি নির্বাচিত হয়ে তিনি এক সময় আশার আলো ছড়িয়েছিলেন। কিন্তু \'থলের বিড়াল\' তো এখন বেরিয়ে পড়েছে। তিনি রেলের \'কালো বিড়াল\' তাড়াতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজেই যে \'কালো বিড়াল\', তা তিনি নিজেই প্রমাণ করলেন। বিরোধী দলকে এটা আর প্রমাণ করতে হবে না।
প্রথমবার তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। সেটা একটা ভালো দিক ছিল। কিন্তু সরকারপ্রধান কেন যে আবার তাকে পদত্যাগের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মন্ত্রিসভায় ফিরিয়ে আনলেন, আমি তা বুঝতে আজও অক্ষম। আরও অবাক হওয়ার বিষয়_ মন্ত্রিসভা সম্প্রসারিত হলো। কিন্তু সেন বাবু থেকে গেলেন কোনো দফতর ছাড়াই। এ ক্ষেত্রে একটা জিনিস স্পষ্ট, আর তা হচ্ছে সরকারপ্রধানের আস্থা তিনি এখনও ফিরে পাননি। এমতাবস্থায় আমি তাকে অনুরোধ করব স্বপ্রণোদিত হয়ে ছুটিতে যেতে। ইতিমধ্যে ক্যাবিনেটে তার থাকা না থাকা নিয়ে হাইকোর্টে রিট হয়েছে। হাইকোর্ট যখন একটি রিট শুনানির জন্য গ্রহণ করেন, তখন বুঝতে হবে আবেদনের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও \'মেরিট\' আছে। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে, মন্ত্রীর পেছনে সরকার লাখ লাখ টাকা খরচ করে। একজন মন্ত্রী শুধু \'গোলটেবিলে\' বক্তৃতা দিয়ে বেড়াবেন, তার জন্য তো রাষ্ট্র প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা খরচ করতে পারে না? মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার \'ক্ষমতা\' যদি না থাকে, তাহলে তার চলে যাওয়াই মঙ্গল। আমি চাইব তিনি \'ছুটিতে\' যাবেন এবং সরকারকে একটি বিব্রতকর অবস্থা থেকে মুক্তি দেবেন। তিনি ভালো বলেন। রসিকতা করেন। \'টক শো\' মন্ত্রী হিসেবে তার চাহিদা অনেক বেশি। এমনিতেই সরকারের \'ঝামেলা\' অনেক বেশি। একের পর এক সংকট তৈরি হচ্ছে। সরকার কোনোটারই কূল-কিনারা করতে পারছে না। হলমার্কের ঘটনার যখন কোনো \'সমাধান\' সরকার দিতে পারছে না, তখন হলমার্কের বিতর্কিত এমডি তানভীর মাহমুদ \'হাটে\' হাঁড়ি ভেঙে দিলেন। অভিযোগ করলেন ৫টি প্রতিষ্ঠানের (টি অ্যান্ড ব্রাদার্স, প্যারাগন নিট, নকশি নিট, ডিএন স্পোর্টস ও খানজাহান আলী) হাজার কোটি টাকার ঋণ প্রকাশ করা হচ্ছে না। এই অভিযোগের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে জানি না, তবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য এই তথ্য একটি \'সূত্র\'। এ বিষয়টি আমরা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দিলাম। কিন্তু বাস্তব যা তা হচ্ছে, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত আমাদের অনেক ক্ষতি করে গেলেন। এর আগে আবুল হোসেনও অনেক ক্ষতি করেছেন। অনেকটা আবুল হোসেনের কারণেই বিশ্বব্যাংকের একটি পর্যবেক্ষণ দল বাংলাদেশে এলো। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটা স্বীকার করেন আর না-ই করেন, মন্ত্রিসভার সদস্যদের দুর্নীতির খবর আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট করেছে। এই ভাবমূর্তি আমরা কাটিয়ে উঠব কীভাবে?
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বার্ষিক আয় মাত্র ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। এটাকেই আমরা \'সত্য\' বলে ধরে নিচ্ছি। আর সত্য বলে ধরে নিলে তিনি ১০ কোটি টাকা দিয়ে \'সেন মার্কেট\' নির্মাণ করলেন কীভাবে? তার দেওয়া তথ্যকে ভিত্তি করে নির্বাচন কমিশন তো এখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে পারে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন \'নেবে\' না, এটাই বাস্তব। আর দুদক আমাদের জানিয়েছে, ড্রাইভার আজমকে \'পাওয়ার\' পরই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে জিজ্ঞাসা করা হবে।
দুদক চেয়ারম্যানের কথায় কেউ বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না।
আসলেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তরা \'কালো বিড়াল\'। পেশা হিসেবে একজন আইনজীবী হলেও জীবনে কোনোদিন কোর্টে দাঁড়িয়েছেন, মক্কেলের জন্য লড়েছেন, তা কেউ জানে না। কিন্তু দিনে দিনে তার সম্পদ স্ফীত হয়েছে। তার জন্য সরকার একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু \'একজনের\' জন্য আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে পারে না। তিনি \'ছুটিতে\' যান। দুদক বিষয়টি নিয়ে পুনর্তদন্ত করুক। সেন বাবু ক্যাবিনেটে থাকলে সুষ্ঠু তদন্ত হবে না। প্রধানমন্ত্রীর হাতকে শক্তিশালী করার জন্যই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ক্যাবিনেট থেকে বিদায় নেওয়া উচিত।
Daily SAMAKAL
16.10,12

রাঙামাটি থেকে রামু

রাঙামাটিতে একটি ছোট ঘটনা ঘটেছিল গত ২২ সেপ্টেম্বর। দু'জন ছাত্রের মাঝে (যাদের একজন বাঙালি, অপরজন পাহাড়ি) সংঘর্ষের পর শহরজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। তার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামুতে ঘটল একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ১৬টি বৌদ্ধমন্দিরে ভাংচুর ও অগি্নসংযোগ করা হয়। পবিত্র কোরআন শরীফের ওপর নারীর পা-সংবলিত একটি ছবি ফেসবুকে আপলোড করা হয়। এই ছবি উত্তম কুমার বড়ুয়া নামে এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুক আইডিতে সংযুক্ত করা হয়। মুহূর্তের মধ্যে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। রামুতে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতেই আওয়ামী মৎসজীবী লীগের রামু উপজেলার সভাপতি আনছারুল হক ভুট্টো ও যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে একটি মিছিল বের হয়। ওই মিছিলটিই হয়ে ওঠে সাহিংসতার কারণ। এর রেশ ধরে পটিয়ায় যে ঘটনা ঘটে, তাতে অংশ নেয় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ইউনিফর্ম পরা বেশ কিছু শ্রমিক। সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি আসে, তা হচ্ছে রাঙামাটির ঘটনার পর সেখানে যখন শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, তখন রামুতে হঠাৎ করে কারা উসকে দিল বাঙালিদের? ফেসবকে হঠাৎ করে কে বা কারা ওই ছবি আপলোড করল? ইতোমধ্যে সন্তু লারমার সংবিধানকে কটাক্ষ করে রাখা একটি বক্তব্য কলাপাড়ায়, (৩০ সেপ্টেম্বর) সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন করে তিনি বারবার 'আদিবাসীর কথা বলে যাচ্ছেন। সংবিধানে আদিবাসী' বলে কোনো শব্দ নেই। অতীতে তিনি একাধিকবার বাঙালি বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে পাহাড়ের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করেছেন। তার বিতর্কিত বক্তব্য পুনরায় 'হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার হুমকি'? আমাদের শুধু বিচলিতই করেনি, বরং তার ওপর সারা জাতি যে আস্থা রেখেছিল, তাতে ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে। তার উস্কানিমূলক বক্তব্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে মাঝে মধ্যেই সহিংস ঘটনা সংঘটিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। রাঙামাটি কলেজের 'ছোট' ঘটনার পেছনে হয়ত এ ধরনের মানসিকতা কাজ করে থাকতে পারে। যেখানে পাহাড়ি-বাঙালিদের মাঝে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ বজায় থাকা প্রয়োজন, সেখানে অত্যন্ত কৌশলে এক ধরনের কৃত্রিম বিভেদ জিইয়ে রাখা হয়েছে। এজন্য পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ তাদের দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। সরকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল ও সেখানে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে 'বিদ্রোহী' জনসংহতি সমিতির সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তিই শুধু করেনি, বরং বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জনসংহতি সমিতির দাবি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সৈন্য ও ৩৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কিন্তু তারপরও সন্তু লারমা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি চাচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, যাতে করে সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। গত ২২ ও ২৯ সেপ্টেম্বরের সহিংস ঘটনাবলীর পর, এটা আবারো প্রমাণিত হলো সেনাবাহনী ছাড়া সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আমরা বারবার বলে আসছি পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটি চক্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। পাহাড়িদের একটা অংশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করছে। পাহাড়িরা সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত রয়েছে। চাঁদাবাজি এখন সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সেখানে কোনো ব্যবসা পাহাড়িদের চাঁদা না দিয়ে করা যায় না। এই যে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, তার মূল কেন্দ্রে আছেন সন্তু লারমা স্বয়ং। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করে নেয়ার দাবি তার অনেক পরনো। প্রশ্ন হচ্ছে সন্ত লারমা এ ধরনের কোনো বক্তব্য রাখার অধিকার রাখেন কিনা? তিনি রাখেন না। কেননা তিনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নির্বাচিত নেতা নন। তিনি চাকমা জনগোষ্ঠীর এককভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন না। ইউপিডিএফও পাহাড়ি তথা চাকমাদের প্রতিনিধিত্ব করে। দ্বিতীয়ত, চাকমাদের মতো বাঙালিরাও সেখানকার 'সেটলার'। বিরান পাহাড়ি অঞ্চলে প্রথমে চাকমারা দেশান্তরিত হয়ে এখানে বসবাস শুরু করে। প্রায় একই সময় বাঙালিরাও সেখানে বসবাস করতে শুরু করে। তবে নিঃসন্দেহে তারা সংখ্যায় কম ছিল। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা কিংবা লুসাই জনগোষ্ঠী আদিবাসী নয়। বাংলাদেশের আদি জনগোষ্ঠী হচ্ছে সাঁওতাল ও খাসিয়ারা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে সরকার যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিলেও, সাঁওতাল ও খাসিয়া জনগোষ্ঠী সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আজ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। তাদের কর্মযোগ্যতা, শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। অথচ সেই সেনাবাহিনীকে বারবার বিতর্কিত করছেন সন্তু লারমা। সেনাবাহিনী পার্বত্য এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় যে বড় ভূমিকা রাখছে, তার প্রমাণ ২১ মে'র (২০১১) বরকলের ঘটনা, আর সর্বশেষ রাঙামাটির ঘটনায়ও তারা সেই অবদান রাখলেন। প্রায়ই পাহাড়ে অস্ত্রধারীরা সহিংস ঘটনা ঘটায়, প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে যার কোনো একটি ঘটনার সঙ্গে বাঙালিরা জড়িত নন। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্যই সেখানে সেনবাহিনীর উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে। সেনাবাহিনী না থাকলে পাহাড়ি অঞ্চল চলে যাবে সন্ত্রাসীদের হাতে। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে যে, যেসব অঞ্চল থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেখানে সন্ত্রাসীরা পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পগুলোতে তাদের আস্তানা গড়ে তুলেছে। পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে আমাদের আশঙ্কার আরো প্রকট কারণ রয়েছে। আর তা হচ্ছে পাহাড়ে ব্যাপকভাবে খ্রিস্টধর্মের বিস্তার। সেখানে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতদের ঘন ঘন সফর, ইউএনডিপির কর্মকা- ইত্যাদি এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যারা দেশ, জাতি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে ভাবেন, তাদের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। মিশনারীরা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়িদের ধর্মান্তরিত করছে। উপজাতীয়দের দারিদ্র্য পুঁজি করে খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাপক বিস্তার ঘটছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে। ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রজেক্টে পাহাড়ি ধর্মান্তরিত লোকদের চাকরি দেয়া হচ্ছে। অথচ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা সেখানে চাকরি পাচ্ছে না। বাঙালিদের সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্র্রেণীর নাগরিক হিসেবে। একটি অভিযোগ আছে যে পশ্চিমা শক্তিগুলো এ অঞ্চলে পূর্ব তিমুর অথবা দক্ষিণ সুদানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। এক সময় পূর্ব তিমুর ছিল মুসলমান অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়ার একটি অংশ, একটি প্রদেশ। খ্রিস্টান অধ্যুষিত পূর্ব তিমুরকে পশ্চিমারা স্বাধীন করেছিল তাদের স্বার্থে। ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমুর স্বাধীন হয়। একই ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ সুদানে। মুসলমান অধ্যুষিত সুদানের একটি অংশ ছিল দক্ষিণ সুদান। খ্রিস্টান অধ্যুষিত দক্ষিণ সুদানে পশ্চিমারা স্বাধীন করেছিল তাদের স্বার্থে। পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানে প্রচুর তেল রয়েছে। পশ্চিমাদের স্বার্থ সেখানেই। পাহাড়ে যেহারে ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে, তা মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের ছাড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটা শঙ্কা থেকেই গেল। পাহাড়ে স্পষ্টতই অলিখিত একটা বিভাজন তৈরি হয়েছে। সেখানে বাঙালিরা ব্যবসা করতে পারে না। বাঙালিদের কোনো ব্যবসা করার সুযোগ নেই। বাঙালিরা যে কাজগুলো করে, তা পাহাড়িরা করে না। তারপরও বাঙালিরা কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত নয়। সংবিধানের ১৯নং অনুচ্ছেদ (সুযোগের ক্ষমতা), ২৭নং অনুচ্ছেদ (আইনের দৃষ্টিতে ক্ষমতা), ২৮নং (ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য) অনুচ্ছেদ বাঙালিদের যে অধিকার দিয়েছে, তা থেকে বঞ্চিত বাঙালিরা। শত শত বাঙালি সেখানে মানবেতর জীবনযাপন করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হওয়াও জরুরি। নির্বাচন না হওয়ায় সন্ত্রাসীরা সুযোগ পাচ্ছে। আরো একটা কথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ পুনর্গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। কোনো ধরনের নির্বাচন কিংবা দায়বদ্ধতা ছাড়াই সন্তু লারমা ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এটা অবৈধ ও অশোভন। একটানা দীর্ঘ ১৩ বছর এ দেশের রাষ্ট্রপতিও ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সরকার সন্তু লারমাকে প্রতিমন্ত্রীর সব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন, কিন্তু তার উস্কানিমূলক বক্তব্য পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ত্রাসী কর্মকা- বাড়িয়ে দিয়েছে। রাঙামাটির ঘটনায়ও তিনি কোনো বিবৃতি দেননি। সেখানে শান্তি মিছিল হয়েছে। পাহাড়ি ও বাঙালিরা এক সাথে মিছিল করেছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচুর শুভবুদ্ধির মানুষ রয়েছেন, যারা চান সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকতে। সন্ত্রাসী কর্মকা- কখনোই শান্তি আনতে পারে না। একটি ছোট ঘটনাকে যারা তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছেন, তারা দেশের শত্রু। তারা পাহাড়ি এলাকায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। এদের সম্পর্কে আমরা যত সতর্ক থাকব, ততই আমাদের মঙ্গল। রাঙামাটির ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই রামু, পটিয়া, উখিয়াতে ঘটল অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হাজার বছরের যে ধর্মীয় সম্প্রীতি তা নষ্ট হলো। বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টার খবর আমরা পত্রপত্রিকা থেকে পাই। তাই রামুর ঘটনাকে হাল্কাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই। রামুর ঘটনার সঙ্গে রাঙামাটির ঘটনার কোনো মিল আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। যারাই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চায়, তারাই রাষ্ট্রের শত্রু। রামুর ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা হোক। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হোক। বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে মূল ঘটনাকে আড়াল করা ঠিক হবে না। সবাইকে একসঙ্গে হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যারা বিনষ্ট করে, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। রামুর ঘটনাই যেন শেষ ঘটনা হয়।Daily JAI JAI DIN16.10.12

যে গল্প রূপকথাকেও হার মানায়



অবশেষে গ্রেফতার হলেন বহুল আলোচিত হলমার্ক কেলেংকারির হোতা তানভীর মাহমুদ। ভদ্রলোক ১০ বছর আগেও ছিলেন কপর্দকহীন সাধারণ একজন মানুষ। আগারগাঁও তালতলা বাজারে বাবাকে নিয়ে একটি ছোট্ট মুদি দোকান চালাতেন তিনি। অভাবের তাড়নায় পরিবারের সদস্যদের ঠিকমতো খাবার জোটাতে পারতেন না। অতঃপর মাত্র তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি নেন একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। ‘আলাদিনের জাদু’তে মাত্র ১০ বছরের মধ্যে তার কাছে সঞ্চিত হল হাজার হাজার কোটি টাকা, যার সবটাই অবৈধ। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা আÍসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। এক সময় যিনি ছিলেন মাত্র তিন হাজার টাকার চাকুরে, তার গ্যারেজে এখন পাজেরো আর প্রাডো গাড়ির সংখ্যা ২৭। তিনি কীভাবে এটা ‘ম্যানেজ’ করলেন, কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত, এ কাহিনী এখন সংবাদপত্রের পাতায়। তানভীরসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে পৃথক ১১টি মামলা দায়ের করেছে দুদক। তবে এ ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে অভিযুক্ত না করায় মানুষের মনে রয়েছে নানা প্রশ্ন। আর তানভীর মাহমুদ জানিয়ে দিয়েছেন, তার পক্ষে টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। যদিও অনিয়মের কথা তিনি স্বীকার করেছেন।
আরেকজনের কাহিনী শুনুন। তিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। ঢাকার বাইরে মফস্বলের শহরে তার জীবন। হেঁটে বা রিকশায় চলাফেরাতেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে তিনিও হঠাৎ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পেয়ে গেলেন। প্রায় এক কোটি টাকা দামের গাড়িতে (টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার) এখন চড়েন তিনি। সন্তানদের জন্য রয়েছে আরেকটি টয়োটা গাড়ি, তাও সদ্য কেনা। ঢাকায় ফ্ল্যাট, প্লট এসব তো মামুলী ব্যাপার। সেই ‘সাধারণ’ স্কুল শিক্ষিকা জান্নাত আরা হেনরী এখন ‘অসাধারণ’, হলমার্ক কেলেংকারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের বহুল সমালোচিত পরিচালনা পর্ষদের সদ্য বিদায় নেয়া একজন পরিচালক। তিনি সিরাজগঞ্জ-২ আসন থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। জিততে পারেননি।
‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপে’ বহু ‘ধনরতেœর’ মালিক হওয়া তানভীর মাহমুদ ও জান্নাত আরা হেনরী দৃশ্যপটের দুটি চরিত্র মাত্র। অনুসন্ধানী সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে নিশ্চয়ই আরও ‘তথ্য’ আছে। সেই ‘তথ্য’ দিয়ে তারা আমাদের আরও সমৃদ্ধ করবেনÑ এ প্রত্যাশাই রইল।
সিপিডি’র মতে, বিশ্বমন্দায় যখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে বাংলাদেশ, তখন সর্বশেষ হলমার্ক কেলেংকারির ঘটনা দেখিয়ে দিল আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। হলমার্ক কেলেংকারির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেশ মানেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। অনেকের আঙ্গুল এখন সোনালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের দিকে, যাদের ব্যাংকিং সম্পর্কে আদৌ কোন ধারণা নেই অথচ তাদের রাখা হয়েছিল পরিচালনা পর্ষদে। একজন স্কুল শিক্ষিকা, একজন সাংবাদিক, একজন রাজনৈতিক নেতাÑ এরা ছিলেন পরিচালনা পর্ষদে। তানভীর মাহমুদরা এদেরই খোঁজেন! এদের মাঝেই তানভীররা ‘আলাদিনের প্রদীপ’ খুঁজে পান। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অনেক আগেই সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে আমাদের অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী, অতি কথা বলা যার একটি মুদ্রা দোষ, তিনি ‘ফোঁস’ করে উঠলেনÑ বললেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন এখতিয়ার নেই এ ধরনের চিঠি লেখার। অথচ ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি ব্যাংক সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের পরামর্শ দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তা-ই দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের ‘বহুগুণে গুণান্বিত’ অর্থমন্ত্রী উপেক্ষা করলেন সেই উপদেশ। ফলে যে বিপত্তি ঘটল, তার দায়ভার এখন কে নেবে? এখন সদ্য বিদায়ী (টার্ম শেষ করার পর) পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকরা দোষ চাপান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর। আর এই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে আমরা যা দেখলাম, তা আরও হতাশাজনক। দুদক একের পর এক সবার জবানবন্দি নিচ্ছে। সবাই মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তিনি দোষী নন। তা হলে দোষটা কে করল? যে শাখার নিয়ম অনুযায়ী ২০০ কোটি টাকার ওপর ঋণ দেয়ার কোন ক্ষমতা নেই, সেই শাখা থেকে কীভাবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হল? দুদক তদন্ত করছে। তাতে কি আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে? আমরা আশা করছি, দুদক তার কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করবে ‘তারাও পারে’। জাতির কাছে আস্থা স্থাপনের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে দুদকের জন্য। দুদক এ কাজটিই করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
প্রথমে শেয়ারবাজার কেলেংকারি, দ্বিতীয়ত হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, আইটিসিএলের অর্থ আÍসাতের ঘটনা প্রমাণ করেছে সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। একের পর এক ঘটনাগুলো ঘটছে। কিন্তু সরকার নির্লিপ্ত। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের ঊর্ধ্বতন নীতিনির্ধারকদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। একটি ক্ষেত্রেও তারা অভিযোগগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। শেয়ারবাজার কেলেংকারিতে বাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ‘লুট’ করল কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। অভিযোগ আছে, এই বিপুল পরিমাণ টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। এ টাকা আর দেশে ফেরত আসবে না। সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু একজনেরও বিচার হয়নি। ঠিক তেমনি বিচার হয়নি ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ কিংবা আইটিসিএলের অর্থ কেলেংকারির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের। যে কারণে সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। সুতরাং এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া। বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও শক্তিশালী করা। হলমার্ক কেলেংকারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগাম সতর্কতা যদি গ্রহণ করা হতো, তাহলে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে উন্নীত হতো না। এখানে একটা অভিযোগ ইতিমধ্যে উঠেছেÑ গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য ঋণ নেয়া হলেও সে টাকায় হলমার্ক জমি কিনেছে অথবা যে জমি বন্ধক দেখানো হয়েছে, তার কাগজপত্র ঠিক নেই। এই মুহূর্তে যা জরুরি তা হল, দ্রুত হলমার্কের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা।
আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন যখন এলো, তখন নতুন অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। আমাদের অর্থনীতির যে আকার, তাতে ৪৭টি ব্যাংকই যথেষ্ট ছিল। তারপরও রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন কয়েকটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর একটি প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতে পড়বেই। ইতিমধ্যে লাইসেন্স বিক্রি করার অভিযোগও উঠেছে। নতুন ব্যাংকগুলো যখন পুরোদমে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করবে, তখন বাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করতে ‘অসাধু পন্থার’ আশ্রয় নিতে পারে। এখন সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর বাড়তি চাপ পড়ল। বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন সুপারভাইজিংয়ের জন্য আরও ক্ষমতা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেছেন, সেন্ট্রাল ব্যাংকের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের গভর্নরের যোগ্যতা ও মেধা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নিয়ে প্রশ্ন আছে। এখানে সৎ, দক্ষ ও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া উচিত ছিল।
বিশ্বমন্দা বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, এটা বলা যাবে না। ইউরোপের তিনটি দেশÑ গ্রিস, স্পেন ও ইতালি মারাÍকভাবে মন্দায় আক্রান্ত। এর একটা প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে পারে। ফ্রান্সের মতো দেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীদের বেতন কমানো হয়েছে। অনেক দেশই কৃচ্ছ্রসাধন করছে। বাংলাদেশ এ থেকে কোন শিক্ষা নেয়নি। মন্ত্রীদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। উপদেষ্টারাও রয়ে গেছেন। এর আদৌ প্রয়োজন ছিল না। এর মাঝে একজন মন্ত্রীর আবার কোন দফতর নেই। ‘কালো বিড়াল’খ্যাত সুরঞ্জিত বাবু এখন নিত্য গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে তার ‘দায়িত্ব’ পালন করছেন। হাইকোর্টে একটি রিটও হয়েছিল। সরকারের ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। বেতন-ভাতা ও বিদেশ ভ্রমণে ব্যয় বাড়ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণ এখন বহুল আলোচিত। আমাদের ‘ফটোগ্রাফার’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অচিরেই তার বিদেশ ভ্রমণ দুর্বলতার কারণে ‘গিনেস্ বুকে’ নাম লিখিয়ে ফেলবেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ‘আশ্রয়স্থলে’। ভিসিদের কাজ একটিইÑ রাজনৈতিক সহকর্মীদের চাকরি দেয়া! রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর যেখানে বলছেন শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা, সেখানে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক’ নিয়োগের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন ভিসিরা। এই পরিস্থিতি আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ফাঁকফোকর দিয়ে তিন হাজার টাকা বেতনের একজন তানভীর মাহমুদ আজ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষিকা জান্নাত আরা হেনরী আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। একজন তানভীর কিংবা একজন হেনরীর কথা আমরা জেনেছি। কিন্তু আমার ধারণা, আরও অনেক তানভীর-হেনরী রয়ে গেছেন, যাদের কথা আমরা কেউই জানি না। এদের সবারই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। রাজনীতির উচ্চমহলে রয়েছে তাদের যোগাযোগ। হেনরী নবম জাতীয় সংসদে প্রার্থী হয়েছিলেন। হেরেছেন বটে। কিন্তু তাতে কী, দশম নির্বাচনে প্রার্থী হবেন নিশ্চিত। যে ‘রাজনীতি’ অর্থ আÍসাৎকারী তানভীরদের জš§ দেয়, আমরা সেই ‘রাজনীতি’ চাই না। আসুন, আমরা এদের ঘৃণা করতে শিখি। সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করাও প্রয়োজন। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার কথামতো ‘তুই চোর’ আমরা বলব না। কিন্তু আমরা বলতেই পারি, আমরা আপনাদের ঘৃণা করি।
Daily JUGANTOR
09,10.12

বামিয়ান থেকে রামু এবং কিছু প্রশ্ন


বামিয়ান ভ্যালি থেকে কক্সবাজারের রামুর দূরত্ব কত, আমার জানা নেই। কিন্তু মিল তো এক জায়গায় আছে! ২০০১ সালে তালেবান জঙ্গিরা আফগানিস্তানের হাজারাজাত অঞ্চলে অবস্থিত বামিয়ান ভ্যালিতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত দুটি বৌদ্ধ স্থাপত্য ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। আজ ১১ বছর পর দেখলাম রামুতে ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগে তৈরি হওয়া বৌদ্ধমন্দির গুঁড়িয়ে দিল সন্ত্রাসীরা। বামিয়ান ভ্যালিতে গৌতম বুদ্ধের দুটি স্থাপত্য, যা বিশ্ব হ্যারিটেজের একটা অংশ ছিল, কট্টরপন্থী তালেবানদের কাছে তা 'ইসলামবিরোধী' বলে মনে হয়েছিল। তাই বিশ্ব ঐতিহ্যের এই স্মৃতিটুকু ধ্বংস করে দিতে তারা এতটুকুও চিন্তা করেনি। দুই হাজার ৫০০ মিটার উঁচুতে অবস্থতি দুটি বিখ্যাত বৌদ্ধমূর্তির সঙ্গে রামুর সমতলে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিহারের আমরা মিল হয়তো খুঁজে পাব না। কিন্তু যে মানসিকতা তালেবানদের বৌদ্ধমূর্তি দুটি ধ্বংস করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আজ সেই একই মানসিকতা রামু কিংবা উখিয়ায় প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিহারগুলো ধ্বংস করে দিতে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা বারবার বলছি, তালেবানরা প্রকৃত ইসলামের অনুসারী নয়। এরা সন্ত্রাসী। রাষ্ট্রকে তারা মধ্যযুগে নিয়ে যেতে চায়। আজকে রামুতে যে ঘটনা ঘটল, তা-ও ইসলাম নয়। ইসলাম পরমতসহিষ্ণুতা শেখায়। ইসলামের নাম করে যারা বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করল, তারা শুধু ইসলামেরই শত্রু নয়, বরং তারা মানবতারও শত্রু। হাজার বছরের সম্প্রীতির এই দেশে এ ঘটনা কেন ঘটল। ইসলাম ধর্মাবলম্বী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা শত শত বছর ধরে পাশাপাশি থেকে এসেছে। অতীতে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও বৌদ্ধ বিহারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এমনকি ভারতে শত বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ যখন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল (৬ ডিসেম্বর ১৯৯২) হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা, সেদিনও এতটুকু উত্তপ্ত হয়নি এ জনপদ। আজ এমন কী ঘটল, যাতে বৌদ্ধ বিহারগুলো গুঁড়িয়ে দিতে হবে? কারা এবং কোন শক্তি এর পেছনে কাজ করছে? মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য ছিল, তারা জানত। আমি ধরে নিচ্ছি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনি 'ফালতু' কথা বলতে পারেন না। অভিযোগটি যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এটা সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের জন্য তা কোনো মঙ্গলজনক নয়। রামুর ঘটনা নিয়ে মন্ত্রীরাও পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন। যেখানে মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, স্থানীয় প্রশাসন আন্তরিক ছিল না, তাদের কর্মতৎপরতা লক্ষ করা যায়নি; সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বললেন, প্রশাসন নীরব ছিল না। মন্ত্রীদের পরস্পরবিরোধী এই বক্তব্যে মূল ঘটনা চাপা পড়ে যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বললেন, মৌলবাদী গোষ্ঠী ও বিএনপির এমপি জড়িত। যদি স্থানীয় বিএনপির এমপির কোনো সংশ্লিষ্টতা থেকে থাকে(?), অবশ্যই তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। কিন্তু কোনো তদন্ত ছাড়া কি কাউকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়? বিজ্ঞ মানুষ মহীউদ্দীন খান আলমগীর, 'জনতার মঞ্চ'-এর নায়ক, অনেক আইনকানুন তিনি ভালো জানেন। তাঁর কাছে যদি প্রমাণ থেকে থাকে এবং মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করাই মঙ্গল। অপরাধী হলে আমরাও বিএনপির এমপির বিচার চাই! কিন্তু কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। এক. চারজন মার্কিন 'ছোট' মন্ত্রীর কক্সবাজার সফরের পর পরই এ ধরনের ঘটনা ঘটল; দুই. প্রধানমন্ত্রীর নিউ ইয়র্কে দেওয়া বক্তব্য- 'বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে' এবং 'বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপূর্ণ দেশে পরিণত করতে চাই' (সমকাল, ২৮ সেপ্টেম্বর)- এ বক্তব্যের পর পরই রামুর ঘটনা ঘটল; তিন. রামুর ঘটনার আগে রাঙামাটিতে বাঙালি-পাহাড়ি সংঘর্ষের রেশ ধরে সেখানে ১৪৪ ধারা পর্যন্ত জারি করতে হয়েছিল; চার. 'ইনসাল্ট আল্লাহ'-এর নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পবিত্র কোরআন শরিফকে অবমাননাকর দৃশ্য কেন বৌদ্ধ যুবক উত্তম কুমার বড়ুয়াকে ট্যাগ করা হয়েছিল? কেন কোনো মুসলমান যুবককে ট্যাগ করা হয়নি? কেন উত্তম কুমার বড়ুয়ার ট্যাগ করা ওই ছবি আরো অনেকের সঙ্গে শেয়ার করেন? পাঁচ. মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে কারা বা কাদের উসকানিতে হাজার হাজার মানুষকে জড়ো করা হয়েছিল এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ও জাহাজভাঙা কম্পানি থেকে শত শত লোক জড়ো করা হয়েছিল? ছয়. রামুতে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে প্রথম যে মিছিলটি বের হয়, যা পরে সহিংস হয়ে ওঠে- ওই মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন মৎস্যজীবী লীগের রামু উপজেলার সভাপতি আনছারুল হক ভুট্টো, জেলা ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন, যুবলীগ নেতা হাফেজ মোহম্মদ। যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম সেলিম ওই মিছিলে নেতৃত্ব দেন। প্রশ্ন ওঠে, কারা বা কাদের নেতৃত্বে তাঁরা অতি দ্রুত ওই মিছিলের আয়োজন করেন? সাত. জেরিকেন নিয়ে যারা মিছিলে অংশ নিয়েছিল, তারা কারা?
৪ অক্টোবরের একটি জাতীয় দৈনিকের লিড স্টোরি ছিল- 'হামলাকারীদের তালিকা পুলিশের হাতে'। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করাই শ্রেয়। কেননা এতে করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে আমরা আস্থা ফিরে পেতে পারি। এ ঘটনায় পুলিশ স্থানীয় বিএনপিদলীয় এমপি লুৎফুর রহমান কাজলকে ফাঁসাতে যাচ্ছে- এমন অভিযোগও উঠেছে সংবাদপত্রে। এমপি লুৎফুর রহমান বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন, এটা সত্য কথা। কিন্তু তিনি কতটুকু দোষী বা নির্দোষ, তা শুধু বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমেই প্রমাণিত হতে পারে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো তদন্তের আগেই যখন স্থানীয় এমপিকে অভিযুক্ত করেন, তখন স্থানীয় প্রশাসনের তদন্তে তা প্রতিফলিত হতে পারে। স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত এমপির সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের (আওয়ামী লীগ) দ্বন্দ্ব ছিল। এমনকি সাবেক বিএনপিদলীয় এমপির সঙ্গে নির্বাচিত এমপিরও দ্বন্দ্ব ছিল (সমকাল, ৪ অক্টোবর)। রামুর সহিংস ঘটনাবলিতে কোনো পক্ষ এই দ্বন্দ্বকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে কি না, এটা ভেবে দেখার বিষয়।
আমার বিবেচনায় বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে, যা আমি হালকাভাবে নিতে পারি না। প্রথমত, যেসব যুবক মোটরসাইকেলে করে হাতে কেরোসিনের জেরিকেন নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল, তাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এরা যে পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধমন্দিরে ও বাসাবাড়িতে আগুন লাগিয়েছে, তা স্পষ্ট। এরা নিজেরা করেনি। এদের দিয়ে আগুন লাগানো হয়েছে। কারা এদের ইন্ধন জুগিয়েছিল? দ্বিতীয়ত, রাশেদ খান মেনন মৌলবাদীগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীগোষ্ঠীর রামুর ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ এনেছেন। অভিযোগটি ফেলে দেওয়ার নয়। একটি বিদেশি চক্র দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে অপতৎপরতায় লিপ্ত। রোহিঙ্গাদের জঙ্গি কানেকশনও আছে। আন্তর্জাতিক একটি গোষ্ঠী রাখাইন স্টেট থেকে অধিক হারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশেও উদ্বুদ্ধ করছে, যা বাংলাদেশ সরকারের শক্ত অবস্থানের কারণে সম্ভব হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও প্রকাশ্যে অনুরোধ করেছিল রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়ের। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অভিযোগ আছে, কোনো একটি চক্র রামুর ঘটনায় রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেছে। তৃতীয়ত, অভিযুক্ত উত্তম কুমার বড়ুয়ার ভূমিকাকে হালকাভাবে দেখারও কোনো সুযোগ নেই। কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমা নেওয়া উত্তমের রয়েছে নিজস্ব কম্পিউটারের দোকান। তাঁর ফেসবুকে ৫০টিরও বেশি ইসলাম ধর্মের অবমাননাকর ছবি রয়েছে (গোয়েন্দারা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারেন)। ৩২ বছরের এই যুবক নিরীহ, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে তা মনে হয় না (আমার দেশ, ৪ অক্টোবর)। চতুর্থত, সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের ব্যবধান বাড়ছে। রাজনীতি উত্তপ্ত হচ্ছে। আন্দোলন তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে রামুর মতো ঘটনা 'সৃষ্টি করে' সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা কি কেউ করছে?
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। হাজার বছরের ইতিহাসে মুসলমানদের সঙ্গে বৌদ্ধদের কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। আজ কেন হলো। এখানে 'ব্লেম গেম'-এর আশ্রয় না নিয়ে প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। সরকারপ্রধান ও বিরোধী দলের নেতারও রামুতে যাওয়া উচিত, যাতে করে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়। এমনিতেই বহির্বিশ্বে কোনো কোনো মহল থেকে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারা চলছে। রামুর ঘটনায় এ ধরনের অভিযোগ আরো শক্তিশালী হবে। বিদেশে এ ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। সরকার ও বিরোধী দলকে মিলেই এই ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে হবে
Daily KALERKONTHO08.10.12

কাপাসিয়ার নির্বাচন যে প্রশ্নের কোনো সমাধান দেয় না


ঢাকার সনি্নকটে গাজীপুর-৪ আসনে একটি উপনির্বাচন হয়ে গেল গত ৩০ সেপ্টেম্বর। সংবাদপত্রের ভাষায় 'ভোটারবিহীন নির্বাচনে রিমির জয়, চাচার প্রত্যাখ্যান' (কালের কণ্ঠ, ১ অক্টোবর)। সংবাদপত্রগুলো আমাদের বলে দিচ্ছে নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি ছিল না। তবুও নিয়ম অনুযায়ী নির্বাচন হয়েছে। 'একজন' বিজয়ী হয়েছেন। আর যিনি বিজয়ী হলেন, তিনি আর কেউ নন, রাজনীতিতে অপরিচিত, কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি। যিনি এখন সংসদে যাবেন তার আপন ভাই তানজিম আহমেদ সোহেলের ছেড়ে দেয়া আসনে বিজয়ী হয়ে। এই 'বিজয়'-এর মধ্যদিয়ে সিমিন হোসেন রিমি কী পাবেন, জানি না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অনাস্থা ও ঐক্যের বড় অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে তিনি আদৌ কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবেন না। প্রথাগত ওই নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি। ফলে নির্বাচন যে 'প্রতিদ্বন্দ্বিতা'র কথা বলা হয় তা ওই নির্বাচনে ছিল না। দ্বিতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী তার আপন চাচা আফসার উদ্দিন আহমদ (এবং সেই সঙ্গে সিপিবি প্রার্থী আসাদুল্লাহ বাদল) প্রকাশ্যেই অভিযোগ এনেছেন 'ভোট জালিয়াতির'। ভোটকেন্দ্র দখল করে 'নৌকা মার্কায়' সিল দেয়ার অভিযোগও ছিল তার। তৃতীয়ত যে 'অভিযোগে' সোহেল তাজ পদত্যাগ করেছিলেন, তার প্রতি সম্মান দেখালেন না বড় বোন সিমিন হোসেন রিমি। তাজউদ্দীনের পরিবার এই নির্বাচন থেকে কী পেল, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারে। রিমি তো অনেক আগেই এমপি হতে পারতেন। নিদেনপক্ষে 'মহিলা কোটায়' কি তিনি এর আগে এমপি হতে পারতেন না? তাঁকে কি আসন বাড়ানোর পর এমপি করা উচিত ছিল না? তাতে করে কি শহীদ তাজউদ্দীনের প্রতি সম্মান দেখানো যেত না? এখন শেষ বেলায় এসে এমপি হয়ে কী করবেন সিমিন হোসেন রিমি? রাজনীতি তো উত্তপ্ত হচ্ছে। সরকার আর বিরোধী দলের মাঝে ব্যবধান বাড়ছেই। এই অসময়ে এসে তাজউদ্দীন কন্যা কী করবেন? বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোটের নেত্রী বেগম জিয়া গত ২৩ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরের এক বিশাল সভায় স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ছাড়া অন্য কোনো প্রথা তার জোট মেনে নেবে না। বেগম জিয়ার এই মন্তব্য আসলো আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ ও প্রধানমন্ত্রীর একটি উক্তির পর। ১৬ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে অভিযোগ উঠেছে এক বছর আগে দেয়া রায়ের সঙ্গে প্রকাশিত রায়ের কিছু অসঙ্গতির। পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেয়া হবে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন এবং একটি ক্ষুদ্র মন্ত্রিসভা থাকবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যে কথাটি বলেননি, তা হচ্ছে ওই সময় কার নেতৃত্বে সরকার পরিচালিত হবে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কে থাকবেন? প্রধানমন্ত্রীর নীরবতা প্রমাণ করে তিনি ওই সময়ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বটি পালন করতে চান। সমস্যাটা তো এখানেই। প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে যে নির্বাচন হবে, তার নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। উপরন্তু বিদেশি দাতাগোষ্ঠী যখন বারবার বলছে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, এখন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী হিসেবে তিনি যখন 'প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব' পালন করবেন, সেই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা থাকবে না। ফলে একদলীয় বা মহাজোটের শরিকদের নিয়ে নির্বাচন, সেই নির্বাচন দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত রায়টি দেশে একটি বড় ধরনের রাজনৈতিক সঙ্কটের সৃষ্টি করেছে। তবে সূক্ষ্মভাবে বিচার করলে দেখা যাবে ওই রায়ের মধ্যেই একটি নিরপেক্ষ সরকারের কথা বলা হয়েছে। সরকার ওই রায়টি প্রকাশের আগেই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। অথচ পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর আমরা দেখলাম ৭ জন বিচারপতির মধ্যে তিনজন বিচারপতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের পক্ষে মত দেননি। তাদের ক্ষমতাকে বিবেচনায় নিয়েই নির্বাচনের আগে একটি নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। তাতে করে একটা সমঝোতা সম্ভব। নতুবা দেশ এক মহাসঙ্কটে পতিত হবে। প্রকাশিত রায়ে দেখা যায় আপিল বিভাগের দু'জন বিচারপতি অভিমত দিয়েছেন 'ত্রয়োদশ সংশোধনী সাংবিধানিক ও বৈধ'। গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এর প্রয়োজন আছে বলেও তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সেই সঙ্গে একজন বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনীকে 'সাংবিধানিক ও বৈধ' বলে স্বীকার করলেও, এটি রাখা বা না রাখার ভার ছেড়ে দিয়েছেন জাতীয় সংসদের হাতে। পুরো তিনটি মতামত নিয়েই একটি রায় এবং রায়টি হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে। প্রকাশিত রায়ের অনেক দিক আছে, যা নিয়ে আমরা আলোচনা করতে পারি। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিদের রায়ে ত্রয়োদশ সংশোধনী (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) বাতিল হয়েছে। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা আইনগতভাবে বিবেচনায় নেয়া যাবে না, এটা সত্য তবে বাকি তিনজন বিচারপতি যেহেতু এই সংশোধনীকে 'বৈধ ও সাংবিধানিকসম্মত' বলেছেন এবং যেহেতু তাদের মতামতও রায়ের একটি অংশ, সে ক্ষেত্রে তাদের মতামতকে আমরা 'যে কোনো ফর্মে' বিবেচনায় নিতে পারি। যেহেতু পরবর্তী দুটো সংসদ নির্বাচন 'তত্ত্বাবধায়ক সরকারের' মাধ্যমে সম্পন্ন করা, সংসদ ভেঙে দিয়ে নির্বাচিত ব্যক্তিদের দিয়ে এই সরকার পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছে_ এটা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি। যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে সর্বশেষ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নিযুক্তিকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এটাকে ভিত্তি হিসেবে বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে। একজন বিচারপতি যেহেতু 'চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের' ভার সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে দশম জাতীয় সংসদ কিভাবে আয়োজন করা যায়, সে ব্যাপারে সংসদ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রয়োজনে স্পিকার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে পারেন এবং দুটি বড় দল বা জোটের পাঁচজন সদস্য নিয়ে এই সরকার গঠিত হতে পারে, যারা শুধু নির্বাচন পরিচালনা করবেন। তবে নিরপেক্ষতার স্বার্থে স্পিকারসহ কেউই নির্বাচনে প্রার্থী হবেন না। ইসিকে শক্তিশালী করার কথাও বলা আছে রায়ে। বিষয়টি নতুন নয়। অনেকেই ইসিকে শক্তিশালী করার কথা বলেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ইসি সুশীল সমাজের সঙ্গে মতবিনিময় করে। সেখানেও এ প্রসঙ্গটি উঠেছে। ইসিকে স্বাধীনভাবে পরিচালনার কথা বলা হলেও আইন সংশোধন ছাড়া ইসিকে স্বাধীন করা যাবে না। তত্ত্বগতভাবে ইসি স্বাধীন হলো। কিন্তু নির্বাচন চলাকালীন সময়ের আগে ও পরের মাসগুলো কয়েকটি মন্ত্রণালয় যদি ইসির নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্বাচনের এক মাস আগে ও নির্বাচনের এক মাস পর ইসির নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের (মাঠ পর্যায়ে) বদলি করার ক্ষমতা পাবেন। এমনকি মাঠ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা যদি আইনবহির্ভূত কোনো কর্মকা-ে লিপ্ত হন, তাকে শাস্তি দিতে পারবেন। শুধু দুএকটি ধারা পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করা যাবে না। সত্যিকার অর্থেই সংসদে আইন পাস করিয়ে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। আর্থিকভাবে ইসি স্বাধীন হবে। এ জন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকবে। অথবা অর্থের জন্যই সরকার ইসির কর্মকা-ে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পাবে। সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা রায়ে বলা আছে। এটা একটা ভালো দিক। যদি সংসদ সদস্যদের ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন হয় (যা সংশোধিত সংবিধানে আছে), তাহলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে প্রভাব খাটাবেন, তখন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের করার কিছুই থাকবে না। তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২-এর প্রথম বড় ধরনের সংশোধন করা হয় ২০০১ সালে। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাহিনীকে যুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে আরপিওতে আরো সংস্কার আনা হয়। এক্ষেত্রে ইসিকে আরো সংস্কার আনতে হবে আরপিওতে। শুধু এই বিষয়টি নিয়ে ইসি যদি আবার মত বিনিময় করে, তাহলে ইসি ভালো করবে। আমি আগেই উল্লেখ করেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত রায়ের মাঝেই সঙ্কট সমাধানের পথ বলে দেয়া আছে। যে কোনো ফর্মে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন নতুবা দেশ এক গভীর সংঘাতে নিপতিত হবে। উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের আগে বেশ কয়েকজন 'এমিকাস কিউরি' (আদালতের বহু) নিয়োগ করেছিলেন। এমিকাস কিউরিদের একজন বাদে সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এরা দেশের শীর্ষর্স্থানীয় আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। এদের মতামতকেও আমরা ফেলে দিতে পারি না। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এটা উপলব্ধি করেই উচ্চ আদালত 'আরো দুটো সংসদ' তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে অভিমত দিয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সংসদ। আমি এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে চাই। সংসদ প্রকাশিত রায়ের আলোকে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিক। সেই সিদ্ধান্তে বিএনপি সম্পৃক্ত হোক। সংসদে আলোচনায় তাদের সুযোগ দেয়া হোক। পরস্পরের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস যদি থাকে, আমার বিশ্বাস একটা পথ আমরা খুঁজে পাবই। ইসিকে স্বাধীন করতে হবে পর্যায়ক্রমে যাতে করে ইসি সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে একাদশ কিংবা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন স্পন্সর করতে পারে। উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। কিন্তু বিচারপতিদের একটা বড় অংশ যেখানে চেয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকুক, এটাই হোক আলোচনার ভিত্তি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে নিজেকে ক্ষমতায় রেখে যদি কোনো সমাধানের পথ খোঁজেন, সঙ্গতকারণেই তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বেগম জিয়া হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তার অনেক সুযোগ ছিল হরতাল, অবরোধের মত কর্মসূচি দেয়ার। তা তিনি দেননি। তিনি ধীরে ধীরে নির্দলীয় সরকারের পক্ষে জনমত গড়ে তুলছেন। এটা একটা ভালো দিক। আমরা চাইবো সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট একটি বড় জোট। এদের জনসমর্থন প্রচুর। এদের মতামতকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এদের মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে একটি নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে নয়, বরং রায়ের আলোকেই সরকার যদি নির্বাচনের আগে একটি নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে, সেটা হবে সবার জন্য মঙ্গল। সরকারের নীতি নির্ধারকরা কাপাসিয়ার উপনির্বাচন থেকে শিখতে পারেন। যে নির্বাচনে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ থাকে না, সেই নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের কোনো আগ্রহও থাকে না। তারপরও কি একটি সমঝোতায় আমরা যেতে পারি না? ব্যারিস্টার রফিক-উল হক স্বপ্রণোদিত হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন তাতে নেই। ফলে জটিলতা থেকে গেলই। এমনি এক পরিস্থিতিতে সিমিন হোসেন রিমি এমপি নির্বাচিত হয়ে এই বিভক্ত রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবেন না। বরং তিনি শহীদ তাজউদ্দীনের নামের প্রতি তেমন কোনো সুবিচারও করলেন না।Daily JAI JAI DIN08.10.12

সরকারের অনেক সমস্যা


দুটি সমস্যা এই মুহূর্তে সরকারের অবস্থানকে অনেক দুর্বল করেছে। এক. বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বড় \'জটিলতা\' ও বিশ্বব্যাংকের ফেরা না-ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা। দুই. হলমার্ক কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে পুরো অর্থনীতির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই প্রভাব কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিকে সঠিক পথে চালিত করা দরকার। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে যে \'জটিলতা\' তৈরি হয়েছে, তার পুরোপুরি অবসান হয়েছে, তা বলা যাবে না। বিশ্বব্যাংক এখন মূলত দুটি বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চায়। এক. দুর্নীতির অভিযোগটি তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্ত ও আইনি দল গঠন করা; দুই. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি এক্সটারনাল প্যানেলের কাছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দেওয়া। এটা এখন স্পষ্ট যে, এ দুটি ক্ষেত্রে আমরা যদি স্বচ্ছতার পরিচয় দিই, তাহলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে। আমাদের যে কোনো গড়িমসি ও অসহযোগিতা বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরে একটি ভুল সিগন্যাল পেঁৗছে দিতে পারে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে না আসা পর্যন্ত বিশ্বব্যাংকের কর্মকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য না করাই শ্রেয়। প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৬৭তম অধিবেশনে ভাষণে বিশ্বব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও খোদ জাতিসংঘের সংস্কারের দাবি করেছেন। তার বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। এ কথাগুলো আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি। তবে এ সময়ে এ ধরনের মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়। এমনকি তিনি যখন নিউইয়র্কে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে তাকে জানিয়ে দেন যে, অর্থায়ন বন্ধের পেছনে অপরাধীদের তিনি ছাড় দেবেন না, তখন বিশ্বব্যাংক বিষয়টি \'অন্যভাবে\'ও নিতে পারে। আমরা বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছি আমাদের স্বার্থে। প্রয়োজনটা আমাদের। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রসঙ্গে যত কম কথা বলব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। হলমার্ক কেলেঙ্কারি পুরো অর্থব্যবস্থাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এর সঙ্গে শুধু সোনালী ব্যাংকই নয়, আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংক জড়িত হয়ে পড়েছে। এটা তো স্পষ্ট, এত বিপুল পরিমাণ অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে ওপর মহলের অনেকেই জড়িত। ব্যাংকের কর্তাব্যক্তিরা জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়ে এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেশ কেন \'উপেক্ষিত\' হলো তা জানা প্রয়োজন। দুদক বিষয়টি তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদের সাবেক কর্মকর্তাদেরও তারা তলব করেছে। কিন্তু আদৌ কি কোনো \'ফল\' তাতে পাওয়া গেছে? অভিযুক্ত ব্যক্তি এখনও দিব্যি \'ঘুরে\' বেড়াচ্ছেন। তিনি কেন গ্রেফতার হননি, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাংক চিঠি লিখে জানিয়েছিল ১৫ দিনের মধ্যে ঋণের অর্ধেক এক হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার। ওই টাকা হলমার্ক দেয়নি। নানা ছলাকলার আশ্রয় নিচ্ছে। রাষ্ট্র কি এত দুর্বল যে, হলমার্ক থেকে টাকা উদ্ধার করতে পারবে না? অভিযুক্ত ব্যক্তি ও ব্যক্তিদের বাইরে রেখে \'তদন্ত\' কাজ করলে তাতে কি \'তদন্ত\' কাজে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে না? কোনো সভ্য দেশে এটা সম্ভব নয়। কোটি কোটি টাকা, এ টাকা জনগণের। প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে এ টাকা তারা আত্মসাৎ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আগেই সতর্ক করে দিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গেই অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। তার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়েছে। কিন্তু একটি চক্র তার ইমেজকে নষ্ট করার জন্য তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। একটি অসাধু চক্র সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পর্ষদকে \'ম্যানেজ\' করে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর আগে শেয়ারবাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা \'লুট\' হয়েছে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের রিপোর্টে এ ব্যাপারে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হলেও \'অদৃশ্য শক্তি\'র বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন অর্থনৈতিক ক্রিমিনালরা। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের নির্লিপ্ততা জনমনে সরকার সম্পর্কে মিশ্র ধারণার সৃষ্টি করেছে। হলমার্কের ঘটনার যদি \'বিচার\' না হয়, যদি আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধার না হয়, তাহলে মানুষ পুরো ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। সংবাদপত্রে এমন খবরও ছাপা হয়েছে যে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা সদ্য ওএসডিতে যাওয়া ডিএমডি মো. মইনুল হক ছিলেন ট্রুথ কমিশনে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ (আমার দেশ, ১৩ সেপ্টেম্বর)। আত্মস্বীকৃত এই দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনদের ব্যবহার করে হলমার্কের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রেখে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি তাই দাবি জানিয়েছিলেন অভিযুক্তদের গ্রেফতারের। সেটা করা হয়নি। এতেই প্রমাণ হয় হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়, যখন জানা যায় গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টি লিখিতভাবে অর্থমন্ত্রীকে জানালেও অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায়দায়িত্ব মুহিত সাহেব এড়াতে পারেন না। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো হলমার্কের ঘটনা।
তৃতীয় আরও একটি সমস্যা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে; আর তা হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিশেষ করে সাংবাদিক রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ডের কূলকিনারা না হওয়া। রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড বিভক্ত সাংবাদিক সমাজকে একত্র করেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যের জন্য সমালোচিত হয়েছেন বারবার। সাংবাদিক সমাজে যারা সরকারের বন্ধু বলে পরিচিত ছিলেন, ওই হত্যাকাণ্ডে তারাও আজ সরকারের পাশে নেই। অনেক আগেই অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরানো উচিত ছিল। এখন একজন শক্ত গোছের মানুষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু তিনিও একটি ঝুঁকি নিলেন। ১০ অক্টোবরের কথা বলে তিনি কোনো \'চমক\' দিতে চাননি, এটা আমি বিশ্বাস করি। কিন্তু তথাকথিত \'গ্রিলতত্ত্ব\' ও \'একজন জজ মিয়া\' নাটক যদি আবার মঞ্চস্থ হয়, তাহলে তা সরকারের জন্য কোনো সুনাম বয়ে আনবে না। এমনিতেই শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ বিতর্কিত। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় র‌্যাব আজ বহির্বিশ্বে প্রশ্নের মুখোমুখি। ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আজ সরকারের।
আগামী কয়েকটি মাস সরকারের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময়। একদিকে বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক \'দ্বন্দ্ব\' আরও তীব্র হচ্ছে, অন্যদিকে একাধিক ঘটনায় সরকারের সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথম ঘটনায় সরকার রেলের ভাড়া অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করেছে। এর আদৌ প্রয়োজন ছিল না। সাধারণ মানুষ রেলে চলাফেরা করে। ভাড়া কম থাকায় রেলযাত্রা তারা পছন্দ করে। ভাড়া বৃদ্ধি মানেই হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর আঘাত আসা। আমরা ভারতের উদাহরণ দেখাতে পারি। সাধারণত খুব কম ক্ষেত্রেই রেলের ভাড়া সেখানে বাড়ানো হয়। ভাড়া বাড়িয়ে কোনো দলই জনপ্রিয়তা হারাতে চায় না। তৃণমূলের রেলমন্ত্রী ভাড়া বৃদ্ধি করেছিলেন দলের সিদ্ধান্ত না নিয়ে। ফলে মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। নয়া রেলমন্ত্রী বিষয়টি বোঝেন কি-না জানি না। কিন্তু রেলের ভাড়া বৃদ্ধি দলের জনপ্রিয়তায় ধস নামাতে পারে। মানুষ খুশি হবে না এ সিদ্ধান্তে। আমলাদের দ্বারা প্রণীত সিদ্ধান্ত যদি জনপ্রতিনিধিরা কোনো কিছু না বুঝেই গ্রহণ করেন, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। দ্বিতীয় ঘটনা বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে। যেখানে বিদ্যুৎ চুরি রোধ করার কোনো উদ্যোগ নেই, সেখানে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে সরকার কি লাভবান হবে? এতে তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। বিদ্যুৎ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা থাকলেও তিনি মূলত আমলা, জনগণের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারপ্রধানকে তিনি সঠিক উপদেশটি দিয়েছিলেন বলে মনে হয় না।
পদ্মা সেতু, হলমার্ক, রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড, রেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি_ একটি ঘটনাও সরকারের পক্ষে যায়নি। এমনিতেই কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, এটা নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পরবিরোধী এক অবস্থান গ্রহণ করেছে। সংবিধান, নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন। যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদৌ সুযোগ নেই, সেখানে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আগ্রহ দেখিয়েছেন দায়িত্বটি নিতে। এমনি এক পরিস্থিতিতে সমঝোতা যেখানে প্রত্যাশিত, সেখানে পদ্মা সেতু কিংবা হলমার্কের মতো ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। সরকার সমস্যাগুলোর দিকে যদি \'সিরিয়াসলি\' নজর দেয়, তাহলে আমাদের সবার জন্যই মঙ্গল।