বামিয়ান ভ্যালি থেকে কক্সবাজারের রামুর দূরত্ব কত, আমার জানা নেই। কিন্তু মিল তো এক জায়গায় আছে! ২০০১ সালে তালেবান জঙ্গিরা আফগানিস্তানের হাজারাজাত অঞ্চলে অবস্থিত বামিয়ান ভ্যালিতে ষষ্ঠ শতাব্দীতে নির্মিত দুটি বৌদ্ধ স্থাপত্য ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল। আজ ১১ বছর পর দেখলাম রামুতে ২০০ থেকে ৩০০ বছর আগে তৈরি হওয়া বৌদ্ধমন্দির গুঁড়িয়ে দিল সন্ত্রাসীরা। বামিয়ান ভ্যালিতে গৌতম বুদ্ধের দুটি স্থাপত্য, যা বিশ্ব হ্যারিটেজের একটা অংশ ছিল, কট্টরপন্থী তালেবানদের কাছে তা 'ইসলামবিরোধী' বলে মনে হয়েছিল। তাই বিশ্ব ঐতিহ্যের এই স্মৃতিটুকু ধ্বংস করে দিতে তারা এতটুকুও চিন্তা করেনি। দুই হাজার ৫০০ মিটার উঁচুতে অবস্থতি দুটি বিখ্যাত বৌদ্ধমূর্তির সঙ্গে রামুর সমতলে প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিহারের আমরা মিল হয়তো খুঁজে পাব না। কিন্তু যে মানসিকতা তালেবানদের বৌদ্ধমূর্তি দুটি ধ্বংস করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল, আজ সেই একই মানসিকতা রামু কিংবা উখিয়ায় প্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিহারগুলো ধ্বংস করে দিতে উদ্বুদ্ধ করে। আমরা বারবার বলছি, তালেবানরা প্রকৃত ইসলামের অনুসারী নয়। এরা সন্ত্রাসী। রাষ্ট্রকে তারা মধ্যযুগে নিয়ে যেতে চায়। আজকে রামুতে যে ঘটনা ঘটল, তা-ও ইসলাম নয়। ইসলাম পরমতসহিষ্ণুতা শেখায়। ইসলামের নাম করে যারা বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করল, তারা শুধু ইসলামেরই শত্রু নয়, বরং তারা মানবতারও শত্রু। হাজার বছরের সম্প্রীতির এই দেশে এ ঘটনা কেন ঘটল। ইসলাম ধর্মাবলম্বী ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা শত শত বছর ধরে পাশাপাশি থেকে এসেছে। অতীতে কখনো কোনো সমস্যা হয়নি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও বৌদ্ধ বিহারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এমনকি ভারতে শত বছরের পুরনো বাবরি মসজিদ যখন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল (৬ ডিসেম্বর ১৯৯২) হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীরা, সেদিনও এতটুকু উত্তপ্ত হয়নি এ জনপদ। আজ এমন কী ঘটল, যাতে বৌদ্ধ বিহারগুলো গুঁড়িয়ে দিতে হবে? কারা এবং কোন শক্তি এর পেছনে কাজ করছে? মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য ছিল, তারা জানত। আমি ধরে নিচ্ছি মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনি 'ফালতু' কথা বলতে পারেন না। অভিযোগটি যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে এটা সত্যিই দুঃখজনক। আমাদের জন্য তা কোনো মঙ্গলজনক নয়। রামুর ঘটনা নিয়ে মন্ত্রীরাও পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা বলেছেন। যেখানে মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, স্থানীয় প্রশাসন আন্তরিক ছিল না, তাদের কর্মতৎপরতা লক্ষ করা যায়নি; সেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বললেন, প্রশাসন নীরব ছিল না। মন্ত্রীদের পরস্পরবিরোধী এই বক্তব্যে মূল ঘটনা চাপা পড়ে যায়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বললেন, মৌলবাদী গোষ্ঠী ও বিএনপির এমপি জড়িত। যদি স্থানীয় বিএনপির এমপির কোনো সংশ্লিষ্টতা থেকে থাকে(?), অবশ্যই তিনি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। কিন্তু কোনো তদন্ত ছাড়া কি কাউকে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত করা যায়? বিজ্ঞ মানুষ মহীউদ্দীন খান আলমগীর, 'জনতার মঞ্চ'-এর নায়ক, অনেক আইনকানুন তিনি ভালো জানেন। তাঁর কাছে যদি প্রমাণ থেকে থাকে এবং মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের বক্তব্য যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে তা জনসম্মুখে প্রকাশ করাই মঙ্গল। অপরাধী হলে আমরাও বিএনপির এমপির বিচার চাই! কিন্তু কতগুলো বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। এক. চারজন মার্কিন 'ছোট' মন্ত্রীর কক্সবাজার সফরের পর পরই এ ধরনের ঘটনা ঘটল; দুই. প্রধানমন্ত্রীর নিউ ইয়র্কে দেওয়া বক্তব্য- 'বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে' এবং 'বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিপূর্ণ দেশে পরিণত করতে চাই' (সমকাল, ২৮ সেপ্টেম্বর)- এ বক্তব্যের পর পরই রামুর ঘটনা ঘটল; তিন. রামুর ঘটনার আগে রাঙামাটিতে বাঙালি-পাহাড়ি সংঘর্ষের রেশ ধরে সেখানে ১৪৪ ধারা পর্যন্ত জারি করতে হয়েছিল; চার. 'ইনসাল্ট আল্লাহ'-এর নামে একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে পবিত্র কোরআন শরিফকে অবমাননাকর দৃশ্য কেন বৌদ্ধ যুবক উত্তম কুমার বড়ুয়াকে ট্যাগ করা হয়েছিল? কেন কোনো মুসলমান যুবককে ট্যাগ করা হয়নি? কেন উত্তম কুমার বড়ুয়ার ট্যাগ করা ওই ছবি আরো অনেকের সঙ্গে শেয়ার করেন? পাঁচ. মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে কারা বা কাদের উসকানিতে হাজার হাজার মানুষকে জড়ো করা হয়েছিল এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ও জাহাজভাঙা কম্পানি থেকে শত শত লোক জড়ো করা হয়েছিল? ছয়. রামুতে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে প্রথম যে মিছিলটি বের হয়, যা পরে সহিংস হয়ে ওঠে- ওই মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন মৎস্যজীবী লীগের রামু উপজেলার সভাপতি আনছারুল হক ভুট্টো, জেলা ছাত্রলীগ নেতা সাদ্দাম হোসেন, যুবলীগ নেতা হাফেজ মোহম্মদ। যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম সেলিম ওই মিছিলে নেতৃত্ব দেন। প্রশ্ন ওঠে, কারা বা কাদের নেতৃত্বে তাঁরা অতি দ্রুত ওই মিছিলের আয়োজন করেন? সাত. জেরিকেন নিয়ে যারা মিছিলে অংশ নিয়েছিল, তারা কারা?
৪ অক্টোবরের একটি জাতীয় দৈনিকের লিড স্টোরি ছিল- 'হামলাকারীদের তালিকা পুলিশের হাতে'। যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে দ্রুত অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করাই শ্রেয়। কেননা এতে করে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে আমরা আস্থা ফিরে পেতে পারি। এ ঘটনায় পুলিশ স্থানীয় বিএনপিদলীয় এমপি লুৎফুর রহমান কাজলকে ফাঁসাতে যাচ্ছে- এমন অভিযোগও উঠেছে সংবাদপত্রে। এমপি লুৎফুর রহমান বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য রেখেছেন, এটা সত্য কথা। কিন্তু তিনি কতটুকু দোষী বা নির্দোষ, তা শুধু বিচার বিভাগীয় তদন্তের মাধ্যমেই প্রমাণিত হতে পারে। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোনো তদন্তের আগেই যখন স্থানীয় এমপিকে অভিযুক্ত করেন, তখন স্থানীয় প্রশাসনের তদন্তে তা প্রতিফলিত হতে পারে। স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত এমপির সঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যানের (আওয়ামী লীগ) দ্বন্দ্ব ছিল। এমনকি সাবেক বিএনপিদলীয় এমপির সঙ্গে নির্বাচিত এমপিরও দ্বন্দ্ব ছিল (সমকাল, ৪ অক্টোবর)। রামুর সহিংস ঘটনাবলিতে কোনো পক্ষ এই দ্বন্দ্বকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে কি না, এটা ভেবে দেখার বিষয়।
আমার বিবেচনায় বেশ কয়েকটি বিষয় রয়েছে, যা আমি হালকাভাবে নিতে পারি না। প্রথমত, যেসব যুবক মোটরসাইকেলে করে হাতে কেরোসিনের জেরিকেন নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিল, তাদের খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এরা যে পরিকল্পিতভাবে বৌদ্ধমন্দিরে ও বাসাবাড়িতে আগুন লাগিয়েছে, তা স্পষ্ট। এরা নিজেরা করেনি। এদের দিয়ে আগুন লাগানো হয়েছে। কারা এদের ইন্ধন জুগিয়েছিল? দ্বিতীয়ত, রাশেদ খান মেনন মৌলবাদীগোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদীগোষ্ঠীর রামুর ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ এনেছেন। অভিযোগটি ফেলে দেওয়ার নয়। একটি বিদেশি চক্র দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের নিয়ে অপতৎপরতায় লিপ্ত। রোহিঙ্গাদের জঙ্গি কানেকশনও আছে। আন্তর্জাতিক একটি গোষ্ঠী রাখাইন স্টেট থেকে অধিক হারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশেও উদ্বুদ্ধ করছে, যা বাংলাদেশ সরকারের শক্ত অবস্থানের কারণে সম্ভব হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও প্রকাশ্যে অনুরোধ করেছিল রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আশ্রয়ের। বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। অভিযোগ আছে, কোনো একটি চক্র রামুর ঘটনায় রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করেছে। তৃতীয়ত, অভিযুক্ত উত্তম কুমার বড়ুয়ার ভূমিকাকে হালকাভাবে দেখারও কোনো সুযোগ নেই। কম্পিউটার সায়েন্সে ডিপ্লোমা নেওয়া উত্তমের রয়েছে নিজস্ব কম্পিউটারের দোকান। তাঁর ফেসবুকে ৫০টিরও বেশি ইসলাম ধর্মের অবমাননাকর ছবি রয়েছে (গোয়েন্দারা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারেন)। ৩২ বছরের এই যুবক নিরীহ, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে তা মনে হয় না (আমার দেশ, ৪ অক্টোবর)। চতুর্থত, সরকারের সঙ্গে বিরোধী দলের ব্যবধান বাড়ছে। রাজনীতি উত্তপ্ত হচ্ছে। আন্দোলন তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে রামুর মতো ঘটনা 'সৃষ্টি করে' সাধারণ মানুষের দৃষ্টি অন্যদিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা কি কেউ করছে?
বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। হাজার বছরের ইতিহাসে মুসলমানদের সঙ্গে বৌদ্ধদের কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। আজ কেন হলো। এখানে 'ব্লেম গেম'-এর আশ্রয় না নিয়ে প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। সরকারপ্রধান ও বিরোধী দলের নেতারও রামুতে যাওয়া উচিত, যাতে করে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি হয়। এমনিতেই বহির্বিশ্বে কোনো কোনো মহল থেকে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্র বানানোর পাঁয়তারা চলছে। রামুর ঘটনায় এ ধরনের অভিযোগ আরো শক্তিশালী হবে। বিদেশে এ ঘটনায় বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। সরকার ও বিরোধী দলকে মিলেই এই ভাবমূর্তি উদ্ধার করতে হবেDaily KALERKONTHO08.10.12
0 comments:
Post a Comment