বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ৬ অক্টোবর। তরুণ অর্থনীতিবিদদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইয়ং ইকোনমিস্টস অ্যাসোসিয়েশন’ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে যেসব মন্তব্য করেছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। দেশের ভেতরে শেয়ারবাজার কেলেংকারি থেকে শুরু করে হলমার্ক কেলেংকারি পর্যন্ত একের পর এক ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সবার দৃষ্টি ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের দিকে। কিন্তু বিবি গভর্নর ছিলেন নিশ্চুপ। সাম্প্রতিক সময়ে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে তার ‘দ্বন্দ্বের’ কথা পত্রপত্রিকায় ছাপা হলে তিনি চলে আসেন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। অবশেষে তিনি মুখ খুললেন। তার বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছে, বিবেকের দংশন থেকে শেষ অবদি তিনি মুখ খুললেন। তিনি ওই অনুষ্ঠানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন, যা দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তিনি বলেছেন, ১. ব্যাংকিং খাতে দ্বৈত শাসন চলছে; ২. জনগণের টাকা নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না; ৩. রেফারি শক্তিশালী না হলে খেলা জমে না; ৪. রাষ্ট্রীয় ব্যাংকে অপেশাদার পরিচালক নিয়োগ বন্ধ করতে হবে; ৫. সোনালী ব্যাংকে বড় ধরনের জালিয়াতি হয়েছে; ৬. শেয়ারবাজার কেলেংকারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন ভূমিকা নেই; ৭. ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সংশোধন করতে হবে ইত্যাদি।
অর্থনীতি সম্পর্কে যারা ন্যূনতম ধারণা রাখেন, তারা জানেন বিবি গভর্নর মিথ্যা বলেননি। তার প্রতিটি বক্তব্যের গুরুত্ব রয়েছে এবং অর্থনীতিবিদরা দেশের আর্থিক খাতে শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে তার সাহসী বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছেন। তার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ব্যাংকিং খাতে দু’রকম শাসন চলছে। সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের তদারকিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতার পার্থক্য রয়েছে। বেসরকারি ব্যাংকের ব্যাপারে বিবির ভূমিকা যত স্পষ্ট, সরকারি ব্যাংকের ব্যাপারে অত স্পষ্ট নয়। প্রশ্ন ওঠে, কেন এই পার্থক্য? পৃথিবীর কোন দেশেই আর্থিক খাতে এ ধরনের পার্থক্য নির্ধারণ করা হয় না। পৃথিবীর সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনৈতিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ ও পর্যবেক্ষণ করে থাকে। বাংলাদেশে এ পার্থক্যটাই আমরা প্রত্যক্ষ করি, যা কোন অবস্থাতেই ভালো খবর নয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিই আমাদের বলে দিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্ষমতা, বিশেষ করে তদারকি ক্ষমতা বাড়াতে হবে। হলমার্কের কেলেংকারির ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু সোনালী ব্যাংক কোন কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। আর নেয়নি বলেই পরিস্থিতি এ পর্যন্ত গড়িয়েছে। হলমার্ক কেলেংকারি নিয়ে বিবি গভর্নর যে চিঠি লিখেছিলেন অর্থমন্ত্রীকে, তাতে ‘গোসসা’ হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, বিবির গভর্নরের কোন ক্ষমতা নেই এ ধরনের চিঠি লেখার। এ থেকেই বোঝা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তদারকি করার একটা ক্ষমতা, যা সনাতন, তা উপেক্ষা করতে চেয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর ভূমিকা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।
বিবির গভর্নর ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে পেশাদারি লোকদের অন্তর্ভুক্তি চান। এ কথাগুলো আজ সবাই বলছেন। এটাই বাস্তব। একজন অপেশাদার লোক যখন ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে অন্তর্ভুক্ত হন, তখন তাদের জন্য বড় বিপর্যয় ঘটতে পারে। হলমার্ক কেলেংকারি একটা বড় উদাহরণ। সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে যারা ছিলেন, তাদের কেউ কেউ ‘আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ’ পেয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সঙ্গত কারণেই এখানে অসততার প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। একজন সাংবাদিক ও একজন সাবেক ছাত্রনেতাও ছিলেন পরিচালনা পর্ষদে। তারা ব্যাংকিং কী বুঝবেন? সোনালী ব্যাংকে বড় জালিয়াতি হয়েছে, কিংবা সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে অপেশাদারি লোক ছিলেনÑ বিবির গভর্নরের এ অভিমত সরকার যদি গ্রহণ করে, তাহলে সরকার ভালো করবে। সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ তাদের টার্ম শেষ করেছে। কিন্তু অভিযোগ থেকে তারা ‘মুক্তি’ পেতে পারে না। হলমার্কের এমডি তানভীর মাহমুদকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তিনি বড় জালিয়াত, সন্দেহ নেই। কিন্তু সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কেউ কেউ যে এ ঘটনায় জড়িত নন, তা বলা যাবে না। দুদক আরও তদন্ত করুক এবং দোষীদের আইনের আওতায় নেয়া হোক। দুদক একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। কিন্তু আমাদের হতাশার জায়গাটা এখানেই যে, দুদক ‘ইচ্ছে করলে’ অনেক কিছু করতে পারে। কিন্তু ‘অদৃশ্য কারণে’ করে না। আর ‘অদৃশ্য কারণটা’ এ দেশের আমজনতা জানে বলেই আমার ধারণা।
মিডিয়াতে লেখালেখি না হলে তানভীর ও তার শ্যালক তুষার গ্রেফতার হতেন না। তাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে কী? আÍসাৎ করা কোটি কোটি টাকার কী হল? আমরা চাই একই সঙ্গে তার বিচার চলবে, সেই সঙ্গে টাকা উদ্ধারেরও ব্যবস্থা করা হবে। প্রয়োজনে হলমার্কের নামে যত সম্পদ আছে, তা বাজেয়াপ্ত করা হোক। আমরা জানি, বাংলাদেশের আইন এ ক্ষেত্রে অনেক দুর্বল। জনগণের টাকা যদি উদ্ধার না হয়, যদি ফাঁকফোকর দিয়ে তানভীর গং বেরিয়ে যান, সেটা হবে আমাদের জন্য সত্যিই একটা দুঃখজনক ঘটনা। তানভীরের মতো বাকিরাও গ্রেফতার হবে এবং পুলিশ তাদের রিমান্ডে নেবেÑ এটাই আশা করি।
আসলে ব্যাংকিং খাতে একটা নিয়ম-শৃংখলা ফিরিয়ে আনা উচিত। সাধারণ মানুষের একটা আস্থার জায়গা ছিল এ সরকারি ব্যাংক। একসময় বেসরকারি ব্যাংক নিয়ে নানা কথা আমরা শুনতাম। এখন দেখলাম, বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ে সরকারি ব্যাংকে দুর্নীতি বেশি। হলমার্কের মতো কেলেংকারি কোন বেসরকারি ব্যাংকে ঘটত না বলে আমার ধারণা। এখন অবদি সেরকম কোন সংবাদ আমাদের কানে আসেনি। আমার আশংকা, আরও অনেক হলমার্কের মতো ঘটনা সম্পর্কে অচিরেই আমরা অবহিত হব! ৮ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিক আমাদের জানাচ্ছে আরেকটি সরকারি ব্যাংক রূপালী ব্যাংকের ঋণ বিতরণের অনিয়মের খবর। বিবির নির্বাহী পরিচালকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হচ্ছে, তিন প্রতিষ্ঠানের ঋণে বড় অনিয়ম পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে, ৮০১ কোটি টাকা আদায় না হওয়ার আশংকা রয়েছে। কী ভয়ংকর কথা ৮শ’ কোটি টাকা লোপাট। দুদকের নজরে কি বিষয়টি এসেছে? আমি ঠিক জানি না দুদকের পক্ষে এত বড় সেক্টরের দুর্নীতি উদঘাটন করা সম্ভব কিনা? এমনিতেই নানা কাজে দুদক এখন খুবই ব্যস্ত। এর ওপর যোগ হয়েছে পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়টি। বিশ্বব্যাংকের মনোনীত টিম এসেছে দুদকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের জন্য। সুতরাং তাদের ব্যস্ততা বেশি। তানভীর মাহমুদ গ্রেফতার হওয়ার আগে আরও ৫টি প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করেছিলেন, যাদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ প্রকাশ করা হচ্ছে না (সংসদীয় কমিটিতে দেয়া বক্তব্য)। এ ৫টি প্রতিষ্ঠান হচ্ছেÑ টি অ্যান্ড ব্রাদার্স, প্যারাগন নিট, নকশি নিট, ডিএন স্পোর্টস এবং খান জাহান আলী। আমরা আমজনতা এদের ব্যাপারে কিছুই জানি না। আরও কি ‘ডজন খানেক’ তানভীর মাহমুদ লুকিয়ে আছে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে! আমরা একটি শ্বেতপত্র চাই। আমরা সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাই উল্লিখিত ওই ৫টি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের কোন দায়বদ্ধতা আছে কিনা? সংসদীয় কমিটি কিংবা দুদকও অভিযোগটি খতিয়ে দেখতে পারে।
আসলে সব অভিযোগই কাগজ-কলমে আটকে থাকবে যদি না বাংলাদেশ ব্যাংককে শক্তিশালী করা হয়। এজন্য এ মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে ব্যাংকিং কোম্পানি আইন সংশোধন করা। অতি ক্ষমতাধর আমলারা এ কাজটি করতে দেবে কিনা, আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। তবে বিবি ‘গভর্নর’ হয়ে নিজের দায়িত্ববোধ মাথায় নিয়ে তিনি যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছেন, তাকে আমি স্বাগত জানাই। সে সঙ্গে যারা দেশকে ভালোবাসেন, অর্থনৈতিক সেক্টরকে দুর্নীতিমুক্ত রাখতে চান, তাদের অনুরোধ করব তারা যেন বিবি গভর্নরের পাশে এসে দাঁড়ান।
গভর্নর সাহেব একটি কঠিন সত্য কথা বলেছেনÑ ‘রেফারি শক্তিশালী না হলে খেলা জমে না।’ গভর্নর তো তত্ত্বগতভাবে রেফারিই! তাকে অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে। আর রাষ্ট্রের দায়িত্বই হচ্ছে তাকে শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তোলা। আমরা সেই শক্তিশালী একজন ‘রেফারি’ চাই, যিনি কলুষিত অর্থনীতিকে একটি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আনতে পারবেন।
Daily JUGANTOR
16.10.12
0 comments:
Post a Comment