রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিশ্বব্যাংকের সংস্কারের দাবি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কার দাবি করেছেন। জাতিসংঘের ৬৭তম অধিবেশনে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি এই আহ্বান জানান। তিনি বলেছেন, 'এসব প্রতিষ্ঠানের কাঠামো ও সিদ্ধান্ত-প্রক্রিয়া ৬০ বছরের পুরনো ক্ষমতার সমীকরণের প্রতিফলন।' প্রধানমন্ত্রী যে কথাটা বলতে চেয়েছেন, তা হচ্ছে বেটন উড্স সম্মেলনের পর অনেক দিন পার হয়ে গেছে। বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি সামনে রেখে এসব প্রতিষ্ঠানে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অংশগ্রহণ বাড়ানো উচিত। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না। কিন্তু তিনি এমন একটা সময় এ ধরনের বক্তব্য রাখলেন, যখন পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। পদ্মা সেতু অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক ফিরে আসবে বলা হলেও এখনো বেশ কিছু 'শর্ত' রয়েছে, যা পূরণ সাপেক্ষেই বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত নেবে। প্রধানমন্ত্রী বক্তব্যটি রাখলেন বিশ্বসভায়। তাঁর এ ধরনের বক্তব্য একটি 'ভুল' সিগন্যাল পৌঁছে দিতে পারে। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের শুধু সংস্কারের কথাই বলেননি, নিউ ইয়র্কে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক বৈঠকে তিনি তাঁর কাছ থেকে জানতে চেয়েছিলেন, কেন এর আগে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করা হয়েছিল। তিনি বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, অর্থায়ন বন্ধের পেছনে অপরাধীদের তিনি ছাড় দেবেন না। 'অপরাধী' হিসেবে তিনি কারো নাম উল্লেখ না করলেও আকার-ইঙ্গিতে অধ্যাপক ইউনূসকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। বিশ্বব্যাংকের কাছে অর্থায়ন বন্ধের ব্যাখ্যা দাবি করার পর পরই বিশ্বব্যাংকের একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। ওই বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক স্পষ্ট করে বলেছে যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু নির্মাণে অর্থায়নে পুনরায় ফিরে এসেছে বলে যে কথা বলা হয়েছে, তা পুরোপুরি সত্য নয়। বিবৃতিতে বিশ্বব্যাংক স্পষ্ট করেছে, কিছু শর্তের সন্তোষজনক বাস্তবায়ন হলেই শুধু বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে সম্পৃক্ত হবে। বিশ্বব্যাংক কী চাচ্ছে, তা আমরা ইতিমধ্যে জেনে গেছি। এই যখন পরিস্থিতি, তখন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের সংস্কারের কথা বললেন। যদিও শুধু বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফই নয়, বরং জাতিসংঘের সংস্কারও তিনি চেয়েছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য কী বিশ্বব্যাংক সিরিয়াসলি নেবে? সাধারণত বিশ্বব্যাংক এসব বক্তব্যকে গুরুত্ব দেয় না। কেননা এসব বক্তব্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের নেতারা মোটামুটি পরিচিত। উন্নয়নশীল দেশগুলো বেশ কিছুদিন ধরেই এ ধরনের দাবি জানিয়ে আসছে। এসব দাবি বিশ্বব্যাংক যে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছে না, তা বলা যাবে না। বিশ্বব্যাংকের ভেতরে সংস্কার নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক সমাজসেবা করে না। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তারা যে সাহায্য দেয়, এটা তাদের বিনিয়োগ। সুদসহ তারা আসল বুঝে নেয়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের ঋণ পলিসি নিয়ে নানা কথা আছে। যারা পল ব্যারেন, রাউল প্রোবিস, গ্রাহাম হেনকক, পল সুইজি, এজি ফ্রাংক কিংবা সামির আমিনের লেখার সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ ঋণ কেন দেয়, তাদের স্বার্থ কী এবং ঋণের বিনিময়ে তাদের 'প্রাপ্তি' কী। তাই শেখ হাসিনা যখন সংস্কারের কথা বলেন, তখন তিনি উন্নয়নশীল বিশ্বের কোটি কোটি লোকের মনের কথার প্রতিধ্বনি করেন মাত্র। কিন্তু সময়টা বেছে নেওয়া বোধ করি তাঁর ঠিক হয়নি। বিশ্বব্যাংকের একটি টিম ১ অক্টোবর ঢাকায় আসার কথা ছিল। আসেনি। তবে শিগগির দুটি টিম আসবে বলে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। তাদের অবস্থান এখন পরিষ্কার। তাদের স্বার্থেই তারা অর্থায়ন করবে। তবে তারা দুটো বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায়। এক. অভিযোগ (দুর্নীতির) তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি বিশেষ তদন্ত ও আইনি দল গঠন করা, দুই. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি এঙ্টারনাল প্যানেলের কাছে তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দেওয়া। এ দুটো বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের মনোভাব স্পষ্ট হওয়ার পরই বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসবে। ইতিমধ্যে আমাদের মন্ত্রীদের 'অতিকথন' বিশ্বব্যাংক কর্তৃক সমালোচিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের ২০ সেপ্টেম্বরের বক্তব্য আমরা না বুঝেই বলে দিয়েছি, বিশ্বব্যাংক অর্থায়নে ফিরে আসছে। আসলে ব্যাপারটি তেমন নয়। কতগুলো বিষয়ে সরকারের মনোভাব 'পজেটিভ' হলেই তারা অর্থায়ন করবে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনা আরো হবে। তখন প্রধানমন্ত্রীর দুটো বক্তব্য আদৌ বিশ্বব্যাংকের দৃষ্টি আকৃষ্ট করবে কি না তা আগামী দিনে তাদের কর্মকাণ্ডের ওপরই নির্ভর করছে। তবে যত দিন পর্যন্ত না অর্থায়ন নিশ্চিত হয়, তত দিন এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য না করাই মঙ্গল। দুঃখজনক হচ্ছে, আমাদের নেতা-নেত্রীরা এ কথাটা ভুলে যান। প্রধানমন্ত্রী যখন নিউ ইয়র্কে বিশ্বব্যাংকের সংস্কারের কথা বলছেন, তখন ঢাকায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ বললেন আরেকটা কথা। একটি অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকায় একটি হোটেলে রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে মিটিং করার পর পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক এখন দোটানায়। বিশ্বব্যাংকের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে যাঁদের ধারণা নেই, তাঁরাই এ ধরনের কথাবার্তা বলতে পারেন। বিশ্বব্যাংক একটি স্পষ্ট নীতি অনুসরণ করে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে। কোনো ব্যক্তি বা কোনো সরকারপ্রধানের কথায় তারা ঋণ দেয় না, ঋণ বাতিলও করে না। অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে 'অভিযোগ' রয়েছে, যা সরকারপ্রধানসহ দলের নীতিনির্ধারকরা অনেকেই বলেন। কিন্তু এর কোনো সত্যতা নেই। অধ্যাপক ইউনূসের কথায় বিশ্বব্যাংক কোনো সিদ্ধান্ত নেবে- এটা আমি মনে করি না। আসলে দলীয়ভাবে, অভ্যন্তরীণভাবে আমরা বিষয়গুলো যেভাবে দেখি, আন্তর্জাতিক কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দর কষাকষিতেও আমরা সেভাবে বিষয়গুলো দেখছি। আমরা যদি এই মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে না পারি, বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে না।
বিশ্বব্যাংকের কর্মপরিধি ও অর্থায়ন প্রসঙ্গ নিয়ে আমরা যত কম কথা বলব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করবে, তবে তারা নিশ্চিত হতে চায় যে ওই অর্থায়নে কোনো দুর্নীতি হবে না। যদি দুর্নীতি হয়, তাহলে বিশ্বব্যাংকের নিজেরও সমস্যা রয়েছে। কেননা বিশ্বব্যাংকের নিজের কোনো টাকা নেই। তারা ধনী দেশগুলোর কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে। এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি হলে টাকা জোগান দেওয়া রাষ্ট্রগুলোর সরকার তাদের জনগণের কাছ থেকে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। তাই বিতর্ক এড়াতে দুর্নীতির প্রশ্নটিকে তারা প্রাধান্য দেয়। বিশ্বব্যাংক নিজেরা দুর্নীতি করে না, এটা বলা যাবে না। তারা যে বিনিয়োগ করে, বিনিয়োগের টাকায় তাদের পছন্দমতো বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, সদস্য দেশগুলো থেকে প্রজেক্টের জন্য ব্যবহৃত সাজসরঞ্জাম ক্রয়, বিশেষজ্ঞদের উচ্চ বেতন ইত্যাদি নিয়ে বিদেশে, এমনকি বাংলাদেশেও গবেষণা হয়েছে। সুধী সমাজের কাছে এটা স্পষ্ট যে বিশ্বব্যাংকের ঋণের পেছনে একটা 'রাজনীতি' আছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংক ছাড়া আমাদের বিকল্প খুব কম। একটা অবিবেচক সিদ্ধান্ত আমরা প্রায় নিতে গিয়েছিলাম- নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ। অবশ্যই আমরা অর্থায়ন করব; কিন্তু পুরো অর্থ বহন করা সম্ভব নয়। বৈদেশিক মুদ্রার জোগান, বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, প্রযুক্তি হস্তান্তর ইত্যাদি মিলিয়ে আমরা সেই পর্যায়ে উন্নীত হইনি যে নিজেরা সেতুটি নির্মাণ করব। মালয়েশিয়ার প্রস্তাবও সন্তোষজনক ছিল না। এটা নিয়ে ইতিমধ্যে লেখালেখিও হয়েছে। চীন বা আইডিবির পক্ষেও সম্ভব ছিল না এককভাবে অর্থায়ন করার। তাই বিশ্বব্যাংক ছাড়া আমাদের বিকল্পও ছিল না। আশার কথা, বিশ্বব্যাংক 'শর্তসাপেক্ষে' পুনরায় অর্থায়নে ফিরে এসেছে। এখন আমাদের 'অতিকথা বলা' অর্থমন্ত্রী ও 'গোলটেবিল মন্ত্রী' যত কম কথা বলবেন বিশ্বব্যাংক নিয়ে, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। মনে রাখতে হবে, বিশ্বব্যাংকের আলোচনার মূল কেন্দ্রবিন্দু এখন দুর্নীতির অভিযোগটি তদন্তের জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা করা ও সব সরকারি নথিপত্র দেখতে দেওয়া। কোনো একটি ক্ষেত্রে আমাদের অসহযোগিতা ওয়াশিংটনে ভিন্ন ম্যাসেজ পৌঁছে দেবে। শর্তহীনভাবে তাদের সহযোগিতা করা আমাদের প্রয়োজন। আমরা বিশ্বব্যাংকের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করতে পারি না। তারা অর্থায়ন করবে কি না, সে ব্যাপারে আমরা এক শ ভাগ নিশ্চিত নই এ মুহূর্তে। আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। বিভিন্ন আলোচনায় আমাদের সততা ও স্বচ্ছতা যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে পদ্মা সেতুর অর্থায়নের বিষয়টি ঝুলে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী সংস্কারের যে কথা বলেছেন, তা তাৎপর্যপূর্ণ তো বটেই, এর ভিন্ন ব্যাখ্যাও হতে পারে। ভিন্নভাবেও দেখা হতে পারে প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য। এ মুহূর্তে এ ধরনের বক্তব্য প্রত্যাশিত নয়। পদ্মা সেতু ইতিমধ্যেই একটি নির্বাচনী 'ইস্যু' হয়ে গেছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০৮) আওয়ামী লীগ ওয়াদা করেছিল, তারা পদ্মা সেতু নির্মাণ করবে। আর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও পদ্মা সেতু নির্মাণের বিষয়টি যে আবার একটি 'ইস্যু' হতে যাচ্ছে, তা দিব্যি দিয়ে বলা যায়।Daily KALER KONTHO02.10.12

0 comments:

Post a Comment