প্রকাশিত রায়ে দেখা যায়, আপিল বিভাগের দু’জন বিচারপতি অভিমত দিয়েছেন ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী সাংবিধানিক ও বৈধ। গণতান্ত্রিক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এর প্রয়োজন আছে বলেও তারা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। সেই সাথে একজন বিচারপতি ত্রয়োদশ সংশোধনীকে ‘সাংবিধানিক ও বৈধ’ বলে স্বীকার করলেও এটি রাখা বা না রাখার ভার ছেড়ে দিয়েছেন জাতীয় সংসদের হাতে। পুরো তিনটি মতামত নিয়েই একটি রায় এবং রায়টি হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে।
ইসিকে শক্তিশালী করার কথাও বলা আছে রায়ে। বিষয়টি নতুন নয়। অনেকেই ইসিকে শক্তিশালী করার কথা বলেন। গত ১৩ সেপ্টেম্বর ইসি সুশীল সমাজের সাথে মতবিনিময় করে। সেখানেও এ প্রসঙ্গটি উঠেছে। ইসিকে স্বাধীনভাবে পরিচালনার কথা বলা হলেও আইন সংশোধন ছাড়া ইসিকে স্বাধীন করা যাবে না। তত্ত্বগতভাবে ইসি স্বাধীন হলো। কিন্তু নির্বাচন চলাকালীন আগে ও পরের মাসগুলো কয়েকটি মন্ত্রণালয় যদি ইসির নিয়ন্ত্রণে না থাকে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে না। স্থানীয় সরকার, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্বাচনের এক মাস আগে ও নির্বাচনের এক মাস পর ইসির নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ওই সময় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের (মাঠপর্যায়ে) বদলি করার ক্ষমতা পাবেন। এমনকি মাঠপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তা যদি আইনবহির্ভূত কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, তাঁকে শাস্তি দিতে পারবেন। শুধু দু’একটি ধারা পরিবর্তন করে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন করা যাবে না। সত্যিকার অর্থেই সংসদে আইন পাস করিয়ে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হবে। আর্থিকভাবে ইসি স্বাধীন হবে। এজন্য বাজেটে বরাদ্দ থাকবে, নতুবা অর্থের জন্যই সরকার ইসির কর্মকাণ্ডে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ পাবে। সংসদ ভেঙে দেয়ার কথা রায়ে বলা আছে। এটা একটা ভালো দিক। যদি সংসদ সদস্যদের ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন হয় (যা সংশোধিত সংবিধানে আছে), তাহলে সেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। কেননা সংসদ সদস্যরা স্থানীয়ভাবে প্রভাব খাটাবেন, তখন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের করার কিছুই থাকবে না। তবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) এ ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ এর প্রথম বড় ধরনের সংশোধন করা হয় ২০০১ সালে। তখন আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংখ্যায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ২০০৮ সালে আরপিওতে আরো সংস্কার আনা হয়। এ ক্ষেত্রে ইসিকে আরো সংস্কার আনতে হবে আরপিওতে। শুধু এই বিষয়টি নিয়ে ইসি যদি আবার মতবিনিময় করে, তাহলে ইসি ভালো করবে।
আমি আগেই উল্লেখ করেছি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিলসংক্রান্ত রায়ের মাঝেই সঙ্কট সমাধানের পথ বলে দেয়া আছে। যে কোনো ফর্মে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন, নতুবা দেশ এক গভীর সঙ্ঘাতে নিপতিত হবে। উচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের আগে বেশ কয়েকজন ‘এমিকাস কিউরি’ (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ করেছিলেন। ‘এমিকাস কিউরি’দের একজন বাদে সবাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। এরা দেশের শীর্ষস্থানীয় আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। এদের মতামতকেও আমরা ফেলে দিতে পারি না। বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি এটা উপলব্ধি করেই উচ্চ আদালত আরো দু’টো সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখার পক্ষে অভিমত দিয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে সংসদ। আমি এ বিষয়টির উপর গুরুত্ব দিতে চাই। সংসদ প্রকাশিত রায়ের আলোকে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকার গঠনের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত নিক। সেই সিদ্ধান্তে বিএনপি সম্পৃক্ত হোক। সংসদে আলোচনায় তাদের সুযোগ দেয়া হোক। পরস্পরের উপর আস্থা ও বিশ্বাস যদি থাকে, আমার বিশ্বাস একটা পথ আমরা খুঁজে পাবোই। ইসিকে স্বাধীন করতে হবে পর্যায়ক্রমে, যাতে করে ইসি সরকারের প্রভাবমুক্ত হয়ে একাদশ কিংবা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারে। উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় না। কিন্তু বিচারপতিদের একটা বড় অংশ যেখানে চেয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা থাকুক এটাই হোক আলোচনার ভিত্তি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী নিজে নিজেকে ক্ষমতায় রেখে যদি কোনো সমাধানের পথ খোঁজেন, সঙ্গতকারণেই তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বেগম জিয়া হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। তার অনেক সুযোগ ছিল হরতাল, অবরোধের মত কর্মসূচি দেয়ার। তা তিনি দেননি। তিনি ধীরে ধীরে নির্দলীয় সরকারের পক্ষে জনমত গড়ে তুলছেন। এটা একটা ভালো দিক। আমরা চাইবো সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে। বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট একটি বড় জোট। এদের জনসমর্থন প্রচুর। এদের মতামতকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। এদের মতামতকে বিবেচনায় নিয়ে একটি নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে নয়, বরং রায়ের আলোকেই সরকার যদি নির্বাচনের আগে একটি নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করে, সেটা হবে সবার জন্য মঙ্গল।
0 comments:
Post a Comment