অবশেষে গ্রেফতার হলেন বহুল আলোচিত হলমার্ক কেলেংকারির হোতা তানভীর মাহমুদ। ভদ্রলোক ১০ বছর আগেও ছিলেন কপর্দকহীন সাধারণ একজন মানুষ। আগারগাঁও তালতলা বাজারে বাবাকে নিয়ে একটি ছোট্ট মুদি দোকান চালাতেন তিনি। অভাবের তাড়নায় পরিবারের সদস্যদের ঠিকমতো খাবার জোটাতে পারতেন না। অতঃপর মাত্র তিন হাজার টাকা মাসিক বেতনে চাকরি নেন একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে। ‘আলাদিনের জাদু’তে মাত্র ১০ বছরের মধ্যে তার কাছে সঞ্চিত হল হাজার হাজার কোটি টাকা, যার সবটাই অবৈধ। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে ৩ হাজার ৬০৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা আÍসাতের অভিযোগে অভিযুক্ত তিনি। এক সময় যিনি ছিলেন মাত্র তিন হাজার টাকার চাকুরে, তার গ্যারেজে এখন পাজেরো আর প্রাডো গাড়ির সংখ্যা ২৭। তিনি কীভাবে এটা ‘ম্যানেজ’ করলেন, কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত, এ কাহিনী এখন সংবাদপত্রের পাতায়। তানভীরসহ ২৭ জনের বিরুদ্ধে পৃথক ১১টি মামলা দায়ের করেছে দুদক। তবে এ ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদকে অভিযুক্ত না করায় মানুষের মনে রয়েছে নানা প্রশ্ন। আর তানভীর মাহমুদ জানিয়ে দিয়েছেন, তার পক্ষে টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব নয়। যদিও অনিয়মের কথা তিনি স্বীকার করেছেন।
আরেকজনের কাহিনী শুনুন। তিনি ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। ঢাকার বাইরে মফস্বলের শহরে তার জীবন। হেঁটে বা রিকশায় চলাফেরাতেই অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। মাত্র ৪ বছরের ব্যবধানে তিনিও হঠাৎ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ পেয়ে গেলেন। প্রায় এক কোটি টাকা দামের গাড়িতে (টয়োটা ল্যান্ডক্রুজার) এখন চড়েন তিনি। সন্তানদের জন্য রয়েছে আরেকটি টয়োটা গাড়ি, তাও সদ্য কেনা। ঢাকায় ফ্ল্যাট, প্লট এসব তো মামুলী ব্যাপার। সেই ‘সাধারণ’ স্কুল শিক্ষিকা জান্নাত আরা হেনরী এখন ‘অসাধারণ’, হলমার্ক কেলেংকারির ঘটনায় সোনালী ব্যাংকের বহুল সমালোচিত পরিচালনা পর্ষদের সদ্য বিদায় নেয়া একজন পরিচালক। তিনি সিরাজগঞ্জ-২ আসন থেকে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। জিততে পারেননি।
‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপে’ বহু ‘ধনরতেœর’ মালিক হওয়া তানভীর মাহমুদ ও জান্নাত আরা হেনরী দৃশ্যপটের দুটি চরিত্র মাত্র। অনুসন্ধানী সাংবাদিক বন্ধুদের কাছে নিশ্চয়ই আরও ‘তথ্য’ আছে। সেই ‘তথ্য’ দিয়ে তারা আমাদের আরও সমৃদ্ধ করবেনÑ এ প্রত্যাশাই রইল।
সিপিডি’র মতে, বিশ্বমন্দায় যখন বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে বাংলাদেশ, তখন সর্বশেষ হলমার্ক কেলেংকারির ঘটনা দেখিয়ে দিল আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের দুর্বলতা রয়েছে। হলমার্ক কেলেংকারির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেশ মানেনি অর্থ মন্ত্রণালয়। অনেকের আঙ্গুল এখন সোনালী ব্যাংকের সাবেক পরিচালনা পর্ষদের দিকে, যাদের ব্যাংকিং সম্পর্কে আদৌ কোন ধারণা নেই অথচ তাদের রাখা হয়েছিল পরিচালনা পর্ষদে। একজন স্কুল শিক্ষিকা, একজন সাংবাদিক, একজন রাজনৈতিক নেতাÑ এরা ছিলেন পরিচালনা পর্ষদে। তানভীর মাহমুদরা এদেরই খোঁজেন! এদের মাঝেই তানভীররা ‘আলাদিনের প্রদীপ’ খুঁজে পান। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অনেক আগেই সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে আমাদের অর্থমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের বিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী, অতি কথা বলা যার একটি মুদ্রা দোষ, তিনি ‘ফোঁস’ করে উঠলেনÑ বললেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের কোন এখতিয়ার নেই এ ধরনের চিঠি লেখার। অথচ ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি ব্যাংক সম্পর্কে অর্থ মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের পরামর্শ দিতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তা-ই দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের ‘বহুগুণে গুণান্বিত’ অর্থমন্ত্রী উপেক্ষা করলেন সেই উপদেশ। ফলে যে বিপত্তি ঘটল, তার দায়ভার এখন কে নেবে? এখন সদ্য বিদায়ী (টার্ম শেষ করার পর) পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকরা দোষ চাপান ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ওপর। আর এই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্য দিয়ে আমরা যা দেখলাম, তা আরও হতাশাজনক। দুদক একের পর এক সবার জবানবন্দি নিচ্ছে। সবাই মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন, তিনি দোষী নন। তা হলে দোষটা কে করল? যে শাখার নিয়ম অনুযায়ী ২০০ কোটি টাকার ওপর ঋণ দেয়ার কোন ক্ষমতা নেই, সেই শাখা থেকে কীভাবে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হল? দুদক তদন্ত করছে। তাতে কি আসল ঘটনা বেরিয়ে আসবে? আমরা আশা করছি, দুদক তার কাজের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করবে ‘তারাও পারে’। জাতির কাছে আস্থা স্থাপনের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে দুদকের জন্য। দুদক এ কাজটিই করে একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে।
প্রথমে শেয়ারবাজার কেলেংকারি, দ্বিতীয়ত হলমার্ক, ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, আইটিসিএলের অর্থ আÍসাতের ঘটনা প্রমাণ করেছে সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত দুর্বল। একের পর এক ঘটনাগুলো ঘটছে। কিন্তু সরকার নির্লিপ্ত। প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারের ঊর্ধ্বতন নীতিনির্ধারকদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। একটি ক্ষেত্রেও তারা অভিযোগগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। শেয়ারবাজার কেলেংকারিতে বাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা ‘লুট’ করল কিছু অসাধু ব্যবসায়ী। অভিযোগ আছে, এই বিপুল পরিমাণ টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়ে গেছে। এ টাকা আর দেশে ফেরত আসবে না। সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। কৃষি ব্যাংকের চেয়ারম্যান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করেছিল। কিন্তু একজনেরও বিচার হয়নি। ঠিক তেমনি বিচার হয়নি ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ কিংবা আইটিসিএলের অর্থ কেলেংকারির সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের। যে কারণে সরকারের অর্থ ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। সুতরাং এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে আস্থা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া। বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও শক্তিশালী করা। হলমার্ক কেলেংকারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের আগাম সতর্কতা যদি গ্রহণ করা হতো, তাহলে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে উন্নীত হতো না। এখানে একটা অভিযোগ ইতিমধ্যে উঠেছেÑ গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজের জন্য ঋণ নেয়া হলেও সে টাকায় হলমার্ক জমি কিনেছে অথবা যে জমি বন্ধক দেখানো হয়েছে, তার কাগজপত্র ঠিক নেই। এই মুহূর্তে যা জরুরি তা হল, দ্রুত হলমার্কের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা।
আর্থিক ব্যবস্থাপনার প্রশ্ন যখন এলো, তখন নতুন অনুমোদন পাওয়া ব্যাংকগুলো নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। আমাদের অর্থনীতির যে আকার, তাতে ৪৭টি ব্যাংকই যথেষ্ট ছিল। তারপরও রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন কয়েকটি ব্যাংকের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। এর একটি প্রতিক্রিয়া অর্থনীতিতে পড়বেই। ইতিমধ্যে লাইসেন্স বিক্রি করার অভিযোগও উঠেছে। নতুন ব্যাংকগুলো যখন পুরোদমে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করবে, তখন বাজার থেকে পুঁজি সংগ্রহ করতে ‘অসাধু পন্থার’ আশ্রয় নিতে পারে। এখন সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ওপর বাড়তি চাপ পড়ল। বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন সুপারভাইজিংয়ের জন্য আরও ক্ষমতা দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ অভিযোগ করেছেন, সেন্ট্রাল ব্যাংকের ক্ষমতা কমানো হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ব্যাংকের গভর্নরের যোগ্যতা ও মেধা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের নিয়ে প্রশ্ন আছে। এখানে সৎ, দক্ষ ও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যক্তিদের নিয়োগ দেয়া উচিত ছিল।
বিশ্বমন্দা বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে কাটিয়ে উঠতে পেরেছে, এটা বলা যাবে না। ইউরোপের তিনটি দেশÑ গ্রিস, স্পেন ও ইতালি মারাÍকভাবে মন্দায় আক্রান্ত। এর একটা প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে পারে। ফ্রান্সের মতো দেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীদের বেতন কমানো হয়েছে। অনেক দেশই কৃচ্ছ্রসাধন করছে। বাংলাদেশ এ থেকে কোন শিক্ষা নেয়নি। মন্ত্রীদের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। উপদেষ্টারাও রয়ে গেছেন। এর আদৌ প্রয়োজন ছিল না। এর মাঝে একজন মন্ত্রীর আবার কোন দফতর নেই। ‘কালো বিড়াল’খ্যাত সুরঞ্জিত বাবু এখন নিত্য গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিয়ে তার ‘দায়িত্ব’ পালন করছেন। হাইকোর্টে একটি রিটও হয়েছিল। সরকারের ব্যয় দিন দিন বাড়ছে। বেতন-ভাতা ও বিদেশ ভ্রমণে ব্যয় বাড়ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ ভ্রমণ এখন বহুল আলোচিত। আমাদের ‘ফটোগ্রাফার’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী অচিরেই তার বিদেশ ভ্রমণ দুর্বলতার কারণে ‘গিনেস্ বুকে’ নাম লিখিয়ে ফেলবেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ‘আশ্রয়স্থলে’। ভিসিদের কাজ একটিইÑ রাজনৈতিক সহকর্মীদের চাকরি দেয়া! রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলর যেখানে বলছেন শিক্ষার মানোন্নয়নের কথা, সেখানে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক’ নিয়োগের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন ভিসিরা। এই পরিস্থিতি আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
আমাদের আর্থিক ব্যবস্থাপনার ফাঁকফোকর দিয়ে তিন হাজার টাকা বেতনের একজন তানভীর মাহমুদ আজ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। একজন সাধারণ স্কুল শিক্ষিকা জান্নাত আরা হেনরী আজ কোটি কোটি টাকার মালিক। একজন তানভীর কিংবা একজন হেনরীর কথা আমরা জেনেছি। কিন্তু আমার ধারণা, আরও অনেক তানভীর-হেনরী রয়ে গেছেন, যাদের কথা আমরা কেউই জানি না। এদের সবারই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। রাজনীতির উচ্চমহলে রয়েছে তাদের যোগাযোগ। হেনরী নবম জাতীয় সংসদে প্রার্থী হয়েছিলেন। হেরেছেন বটে। কিন্তু তাতে কী, দশম নির্বাচনে প্রার্থী হবেন নিশ্চিত। যে ‘রাজনীতি’ অর্থ আÍসাৎকারী তানভীরদের জš§ দেয়, আমরা সেই ‘রাজনীতি’ চাই না। আসুন, আমরা এদের ঘৃণা করতে শিখি। সামাজিকভাবে তাদের বয়কট করাও প্রয়োজন। প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার কথামতো ‘তুই চোর’ আমরা বলব না। কিন্তু আমরা বলতেই পারি, আমরা আপনাদের ঘৃণা করি।
Daily JUGANTOR
09,10.12
0 comments:
Post a Comment