রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্র!


সংবাদ শিরোন
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর রাঙ্গামাটিতে বাঙালি-পাহাড়ি সংঘর্ষ ও ২৯ সেপ্টেম্বর রামুতে সহিংস ঘটনাবলির পর গত ৯ অক্টোবর অনেকটা গোপনে অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার পার্বত্য জেলা বান্দরবান সফর করেন এবং সেখানে গোপনে পাহাড়ি নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার থিথি ডি কফের গোপনে পাহাড়ি নেতাদের সাথে বৈঠক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী কোনো কূটনৈতিক, এমনকি কোনো বিদেশী নাগরিক যদি পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো জেলায় সফরে যান, সে ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রশাসনকে পূর্বাহ্নে অবহিত করতে হবে এবং তাদের যেকোনো মতবিনিময়ে প্রথম শ্রেণীর একজন কর্মকর্তার উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ডেপুটি হাইকমিশনার থিথি ডি কফের ক্ষেত্রে এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী (যুগান্তর ১১ অক্টোবর) জানা যায়, অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার যখন পাহাড়ি নেতাদের সাথে বৈঠক করছিলেন, তখন জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের প্রবেশ বাধা দেয়া হয়েছিল।
বিষয়টি আমাদের জন্য উদ্বেগ ও আতঙ্কের। প্রথমত. একজন ডেপুটি হাইকশিনারের এমন কোনো কারণ থাকতে পারে না যে, তিনি পাহাড়ি নেতাদের সাথে গোপনে বৈঠক করবেন। দ্বিতীয়ত. যেখানে যে কোনো অনুষ্ঠানে সরকারি কর্মকর্তাদের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক, সেখানে তাদের বাধা দেয়া হলো কেন? তৃতীয়ত. যেখানে পাহাড়ে একটি চক্র স্থানীয় পরিবেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছে, সেখানে পাহাড়ি নেতাদের সাথে একজন বিদেশী রাষ্ট্রদূতের বৈঠক কি পরিস্থিতিকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলবে না?
আমরা দীর্ঘদিন ধরেই লক্ষ করে আসছি যে, একটি চক্র পার্বত্য চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করে সেখান থেকে ফায়দা ওঠাতে চায়। আর এই চক্রের সাথে বিদেশীরা সরাসরিভাবে জড়িত। এদের আশ্রয়, প্রশয়ে ও আর্থিক সহযোগিতায় ইতোমধ্যে পাহাড়িদের নিয়ে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এদের উসকানি দিচ্ছেন সাবেক গ্যারিলা নেতা ও জনসংহতি সমিতির প্রধান সন্তু লারমা। বিদেশী বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়া সরকারের ভূমিকা এখানে লক্ষ করার মতো। তারা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রচুর পাহাড়ি ছাত্র বৃত্তি দিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে যায়। ‘অস-এড’ এর কোনো বৃত্তি বাঙালি ছাত্ররা পায় না, বা তাদের দেয়া হয় না। পাহাড়ি এলাকায় বাঙালিরা মানবেতর জীবন যাপন করলেও কোনো বিদেশী সাহায্য তারা পায় না। ইউএনডিপির কোনো প্রজেক্টে বাঙালিরা চাকরি পায় না। বাঙালিরা সেখানে এক রকম ‘দ্বিতীয় শ্রেণী’র নাগরিকের মতো বসবাস করছে, যা সংবিধানের ২৭ ও ২৮ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপূর্ণ লঙ্ঘন।
আমরা আরো গভীরভাবে লক্ষ করেছি যে, সন্তু লারমা হচ্ছেন অন্যতম উসকানিদাতা। সরকার পাহাড়িদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিলেও সন্তু লারমা একের পর এক উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। রামুর ঘটনায় সর্বশেষ যে বক্তব্যটি তিনি দেন, তাও ছিল উসকানিমূলক। এমনকি তিনি বাবরার ‘আদিবাসী সমাজ’ বলে যে বক্তব্য দেন, তাও সংবিধান বিরোধী। সংবিধানে ‘আদিবাসী’ বলে কিছু নেই। আছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। আসলে এই মুহূর্তে পার্বত্য অঞ্চলে একাধিক সমস্যা রয়েছে। মূল সমস্যা একটিই আর তা হচ্ছে এ অঞ্চলে ব্যাপক খ্রিষ্ট্রীয়করণ। অথচ পাহাড়িদের বিশেষ করে সন্তু বাবুদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া যায় যে, পাহাড়িদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। এটা একটা মিথ্যা প্রপাগাণ্ডা। পরিসংখ্যান বলে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকহারে খ্রিষ্টীয়করণ হচ্ছে। অর্থের বিনিময়ে গরিব পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে খ্রিষ্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে। তারপর এদের অনেককে চাকরি দেয়া হচ্ছে। পাহাড়ে বেশ কিছু খ্রিষ্টীয় মিশনারী স্থাপিত হয়েছে। পাহাড়িদের ধর্মান্তরিত করে ওই সব স্কুলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চার্চ, যেখানে প্রতি রোববার পাহাড়িদের যাওয়া এক রকম বাধ্যতামূলক। বিদেশী নাগরিকদের পার্বত্য চট্টগ্রামে সফরের উদ্দেশ্য একটিইÑ খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার ও পাহাড়িদের খ্রিষ্ট ধর্মের ব্যাপারে আকৃষ্ট করা। যে হারে পাহাড়ে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রসার বাড়ছে, তা আমাদের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। এক সময় এই খ্রিষ্টীয় জনগোষ্ঠী বিদেশীদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে। পাঠক, পূর্ব তিমুরের কথা স্মরণ করুন। পূর্ব তিমুর ছিল ইন্দোনেশিয়ার একটি প্রদেশ। ইন্দোনেশিয়ার জনগণ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী। তবে পূর্ব তিমুরের মানুষ ছিল খ্রিষ্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী। পূর্ব তিমুর ইন্দোনেশিয়ার সাথে সংযুক্তির পর সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তাধারা শক্তিশালী হয়। শুরু হয় গ্যারিলা যুদ্ধ। পরে পশ্চিমাদের স্বার্থেই ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমূর স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আর স্বাধীনতার পর থেকে অস্ট্রেলিয়া পূর্ব তিমূরের রাজনীতিতে অন্যতম শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার প্রভাব অনেক বেশি। সাম্প্রতিককালে দক্ষিণ সুদানের কথাও আমরা উল্লেখ করতে পারি। মুসলমান অধ্যুষিত সুদানকে ভেঙে খ্রিষ্টীয় ধর্মে বিশ্বাসী দক্ষিণ সুদানকে একটি আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আমাদের একটা শঙ্কা থেকেই গেল। বিদেশী নাগরিকদের ঘন ঘন পার্বত্য চট্টগ্রাম যাওয়া, বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের সেখানে গোপন মিটিং করা, বিদেশে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা ইত্যাদি আমাদের শঙ্কাকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। এখানে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে আরো কিছু তথ্য দিতে পারি। এক সময়, অতীতে আজকে যে ‘সাতবোন রাজ্য’ নামে পরিচিত, সেখানকার মানুষ জঙ্গলে বাস করত ও প্রকৃতি পূজারী ছিল। তাদের কোনো ধর্ম ছিল না। প্রকৃতিকে, শক্তিকে, সূর্যকে তারা পূজা করত। ব্রিটিশদের নজর পড়ল এ অঞ্চলের দিকে। জঙ্গলে বাস করা মানুষদের ‘শিক্ষিত’ করার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করল। সাথে গেল মিশনারিরা। যারা খ্রিষ্ট ধর্ম প্রচার করত। ওই অঞ্চলে তারা চার্চ প্রতিষ্ঠা করলো। ভালো ভালো কথা বলা, আর্থিক সাহায্য করা ইত্যাদিতে আকৃষ্ট হলো জঙ্গলের মানুষ। তারপর বছরের পর বছর গেল। আজ যদি পরিসংখ্যান নেয়া যায়, তাহলে দেখা যাবে মিজোরামের ৯৯ ভাগ মানুষ আজ খ্রিষ্টান। নাগাল্যান্ডের ৯০ ভাগ, মনিপুরের ৬০ ভাগ আর মেঘালয়ের প্রায় ১০০ ভাগ মানুষ আজ খ্রিষ্টান। ব্রিটিশদের পরিকল্পনা সার্থক হয়েছে। সেখানে খ্রিষ্টান ধর্ম একটি শক্তি। সেখানে হিন্দু কিংবা মুসলমান ধর্মের বিকাশ ঘটেনি। ভারতের অন্যত্র ইসলাম ধর্মের বিকাশ ঘটলেও মিশনারিদের কারণে ‘সাতবোন রাজ্যে’ ইসলামের বিকাশ ঘটেনি। আমাদের আতঙ্কের জায়গাটা হচ্ছে ওখানে; মানচিত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাশে মিজোরাম, তার উপরে নাগাল্যান্ড, মনিপুর, অরুণাচল, মেঘালয়। আমাদের সিলেটের পাশেই রয়েছে আসাম ও মেঘালয়। আসামে কিছু মুসলমান থাকলেও মেঘালয়ের প্রায় ১০০ ভাগই খ্রিষ্টান। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে যেহারে খ্রিষ্টান ধর্ম বিস্তার লাভ করছে, তাতে করে পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম, তথা ‘সাতবোন’ রাজ্যের খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা উৎফুল্লিত হতে পারেন। দুই অঞ্চলে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা আমাদের জন্য একটা বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে আগামী দিনগুলোতে। তাই অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার যখন গোপনে পার্বত্য চট্টগ্রাম সফর করেন, তখন উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা সন্দেহমুক্ত থাকতে পারি না। শুধুমাত্র মানবিক কারণে তিনি যদি বান্দরবান গিয়ে থাকেন, তাহলে তার বাঙালি নেতাদের সাথে কথা বলা উচিত ছিল। কিন্তু তিনি তা করেননি।
আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করেছি যে, মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সৈন্য ও ৩৫টি সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ফলে সেখানে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বেড়েছে। পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পগুলোতে এখন সন্ত্রাসীরা আশ্রয় নিয়েছে। ওই অঞ্চলগুলো এখন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু আমাদের সন্তু বাবু এর কোনো প্রতিবাদ করছেন না। যখন বরকলে (২১ মে ২০১১) বড় ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটেছিল, তখনও প্রতিবাদ করেননি সন্তু বাবু। তথাকথিত ‘ভূমি অধিকার’ এর কথা বলে তিনি মূলত চাচ্ছেন ‘পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন’(?) এবং সেই সাথে ওই অঞ্চল থেকে বাঙালিদের বিতাড়ন। এর আগে তিনি একবার বাঙালিদের নোয়াখালীর চরে প্রত্যাবাসনের প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। এ ধরনের সাহস তিনি কোথায় পান, ভাবতেই অবাক লাগে। দুঃখজনক হলেও সত্য, তথাকথিত বাম বুদ্ধিজীবী তথা সুশীল সমাজ সন্তু লারমার ওই বক্তব্যের সমালোচনা করেনি।
বাঙালিরা তাদের অধিকার নিয়ে সেখানে থাকেন। সংবিধান তাদের সেই অধিকার দিয়েছে। পাহাড়িরা ভূমিপুত্র নন। বাঙালিদের মতো চাকমারাও এ অঞ্চলে প্রায় একই সময় বসবাস করতে শুরু করেন। চাকমাদের আদি বাসস্থান ছিল উত্তর ভারতের হিমালয়ের পাদদেশে। ‘চম্পকনগর’ নামক স্থানে ছিল তাদের ঐশ্বর্যমণ্ডিত রাজধানী। বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী চাকমাদের উপর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে গেলে তারা দেশান্তরিত হয়ে আশ্রয় নেয় পার্বত্য চট্টগ্রামের বিরান এলাকায়। এক সময় তারা বাঙালিদের মতো সমতলেই বসবাস করতো।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে পুনরায় ‘ষড়যন্ত্র’ হচ্ছে বলে আমরা আশঙ্কা করছি। রামুর ঘটনাবলির রেশ শেষ হবার আগেই একজন বিদেশী কূটনৈতিক যখন গোপনে বান্দরবান সফর করেন ও পাহাড়ি নেতাদের সাথে গোপনে মতবিনিময় করেন, তখন আমাদের সন্দেহ আরো বেড়ে যায়। এ দেশের মানুষ পার্বত্য চট্টগ্রামকে নিয়ে কোনো ষড়যন্ত্রকেই বরদাশত করবে না। অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনারের বান্দরবান সফরকে তাই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে।

0 comments:

Post a Comment