রাঙামাটিতে
একটি ছোট ঘটনা ঘটেছিল গত ২২ সেপ্টেম্বর। দু'জন ছাত্রের মাঝে (যাদের একজন
বাঙালি, অপরজন পাহাড়ি) সংঘর্ষের পর শহরজুড়ে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছিল। তার রেশ
ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামুতে ঘটল একটি
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী ১৬টি বৌদ্ধমন্দিরে ভাংচুর ও
অগি্নসংযোগ করা হয়। পবিত্র কোরআন শরীফের ওপর নারীর পা-সংবলিত একটি ছবি
ফেসবুকে আপলোড করা হয়। এই ছবি উত্তম কুমার বড়ুয়া নামে এক বৌদ্ধ যুবকের
ফেসবুক আইডিতে সংযুক্ত করা হয়। মুহূর্তের মধ্যে তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে।
রামুতে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতেই আওয়ামী মৎসজীবী লীগের রামু উপজেলার সভাপতি
আনছারুল হক ভুট্টো ও যুবলীগ নেতা নুরুল ইসলাম সেলিমের নেতৃত্বে একটি মিছিল
বের হয়। ওই মিছিলটিই হয়ে ওঠে সাহিংসতার কারণ। এর রেশ ধরে পটিয়ায় যে ঘটনা
ঘটে, তাতে অংশ নেয় ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের ইউনিফর্ম পরা বেশ কিছু
শ্রমিক। সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি আসে, তা হচ্ছে রাঙামাটির ঘটনার পর সেখানে
যখন শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, তখন রামুতে হঠাৎ করে কারা উসকে দিল
বাঙালিদের? ফেসবকে হঠাৎ করে কে বা কারা ওই ছবি আপলোড করল? ইতোমধ্যে সন্তু
লারমার সংবিধানকে কটাক্ষ করে রাখা একটি বক্তব্য কলাপাড়ায়, (৩০ সেপ্টেম্বর)
সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন করে তিনি বারবার 'আদিবাসীর কথা বলে
যাচ্ছেন। সংবিধানে আদিবাসী' বলে কোনো শব্দ নেই। অতীতে তিনি একাধিকবার
বাঙালি বিদ্বেষী বক্তব্য দিয়ে পাহাড়ের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করেছেন। তার
বিতর্কিত বক্তব্য পুনরায় 'হাতে অস্ত্র তুলে নেয়ার হুমকি'? আমাদের শুধু
বিচলিতই করেনি, বরং তার ওপর সারা জাতি যে আস্থা রেখেছিল, তাতে ঘাটতির
সৃষ্টি হয়েছে। তার উস্কানিমূলক বক্তব্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে মাঝে মধ্যেই
সহিংস ঘটনা সংঘটিত করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। রাঙামাটি কলেজের 'ছোট' ঘটনার পেছনে
হয়ত এ ধরনের মানসিকতা কাজ করে থাকতে পারে। যেখানে পাহাড়ি-বাঙালিদের মাঝে
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ বজায় থাকা প্রয়োজন, সেখানে অত্যন্ত কৌশলে
এক ধরনের কৃত্রিম বিভেদ জিইয়ে রাখা হয়েছে। এজন্য পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ তাদের
দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।
সরকার পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল ও সেখানে দীর্ঘস্থায়ী শান্তি
প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে 'বিদ্রোহী' জনসংহতি সমিতির সঙ্গে একটি শান্তি চুক্তিই
শুধু করেনি, বরং বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর জনসংহতি সমিতির দাবি
অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে এক ব্রিগেড সৈন্য ও ৩৫টি সেনা ক্যাম্প
প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কিন্তু তারপরও সন্তু লারমা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে
একের পর এক বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন। তিনি চাচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে
সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, যাতে করে সেখানে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্যে
পরিণত হয়। গত ২২ ও ২৯ সেপ্টেম্বরের সহিংস ঘটনাবলীর পর, এটা আবারো প্রমাণিত
হলো সেনাবাহনী ছাড়া সেখানে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
আমরা বারবার বলে আসছি পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে একটি চক্র বাংলাদেশের
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। পাহাড়িদের একটা অংশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে
নানা ধরনের বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন করছে। পাহাড়িরা সন্ত্রাসী
কর্মকা-ে লিপ্ত রয়েছে। চাঁদাবাজি এখন সেখানে স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত
হয়েছে। সেখানে কোনো ব্যবসা পাহাড়িদের চাঁদা না দিয়ে করা যায় না। এই যে
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, তার মূল কেন্দ্রে আছেন সন্তু লারমা স্বয়ং। সেখানে
দীর্ঘদিন ধরে বসবাসরত বাঙালিদের পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রত্যাহার করে
নেয়ার দাবি তার অনেক পরনো। প্রশ্ন হচ্ছে সন্ত লারমা এ ধরনের কোনো বক্তব্য
রাখার অধিকার রাখেন কিনা? তিনি রাখেন না। কেননা তিনি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর
নির্বাচিত নেতা নন। তিনি চাকমা জনগোষ্ঠীর এককভাবে প্রতিনিধিত্ব করেন না।
ইউপিডিএফও পাহাড়ি তথা চাকমাদের প্রতিনিধিত্ব করে। দ্বিতীয়ত, চাকমাদের মতো
বাঙালিরাও সেখানকার 'সেটলার'। বিরান পাহাড়ি অঞ্চলে প্রথমে চাকমারা
দেশান্তরিত হয়ে এখানে বসবাস শুরু করে। প্রায় একই সময় বাঙালিরাও সেখানে
বসবাস করতে শুরু করে। তবে নিঃসন্দেহে তারা সংখ্যায় কম ছিল। চাকমা, মারমা,
ত্রিপুরা কিংবা লুসাই জনগোষ্ঠী আদিবাসী নয়। বাংলাদেশের আদি জনগোষ্ঠী হচ্ছে
সাঁওতাল ও খাসিয়ারা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে সরকার যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দিলেও,
সাঁওতাল ও খাসিয়া জনগোষ্ঠী সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আজ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত। তাদের কর্মযোগ্যতা,
শান্তি প্রতিষ্ঠায় তাদের অবদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। অথচ সেই
সেনাবাহিনীকে বারবার বিতর্কিত করছেন সন্তু লারমা। সেনাবাহিনী পার্বত্য
এলাকার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় যে বড় ভূমিকা রাখছে, তার প্রমাণ ২১ মে'র
(২০১১) বরকলের ঘটনা, আর সর্বশেষ রাঙামাটির ঘটনায়ও তারা সেই অবদান রাখলেন।
প্রায়ই পাহাড়ে অস্ত্রধারীরা সহিংস ঘটনা ঘটায়, প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করে যার
কোনো একটি ঘটনার সঙ্গে বাঙালিরা জড়িত নন। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের নিয়ন্ত্রণে
আনার জন্যই সেখানে সেনবাহিনীর উপস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে। সেনাবাহিনী না
থাকলে পাহাড়ি অঞ্চল চলে যাবে সন্ত্রাসীদের হাতে। ইতোমধ্যে খবর বেরিয়েছে যে,
যেসব অঞ্চল থেকে সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে, সেখানে সন্ত্রাসীরা
পরিত্যক্ত সেনা ক্যাম্পগুলোতে তাদের আস্তানা গড়ে তুলেছে।
পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে আমাদের আশঙ্কার আরো প্রকট কারণ রয়েছে। আর তা হচ্ছে
পাহাড়ে ব্যাপকভাবে খ্রিস্টধর্মের বিস্তার। সেখানে ইউরোপীয় রাষ্ট্রদূতদের ঘন
ঘন সফর, ইউএনডিপির কর্মকা- ইত্যাদি এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যারা
দেশ, জাতি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে ভাবেন, তাদের জন্য পার্বত্য
চট্টগ্রামের পরিস্থিতি এক ধরনের উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। মিশনারীরা অর্থের
প্রলোভন দেখিয়ে পাহাড়িদের ধর্মান্তরিত করছে। উপজাতীয়দের দারিদ্র্য পুঁজি
করে খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাপক বিস্তার ঘটছে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত
অঞ্চলগুলোতে। ইউএনডিপির বিভিন্ন প্রজেক্টে পাহাড়ি ধর্মান্তরিত লোকদের চাকরি
দেয়া হচ্ছে। অথচ যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা সেখানে চাকরি পাচ্ছে না।
বাঙালিদের সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে দ্বিতীয় শ্র্রেণীর নাগরিক হিসেবে। একটি
অভিযোগ আছে যে পশ্চিমা শক্তিগুলো এ অঞ্চলে পূর্ব তিমুর অথবা দক্ষিণ সুদানের
মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়। এক সময় পূর্ব তিমুর ছিল মুসলমান অধ্যুষিত
ইন্দোনেশিয়ার একটি অংশ, একটি প্রদেশ। খ্রিস্টান অধ্যুষিত পূর্ব তিমুরকে
পশ্চিমারা স্বাধীন করেছিল তাদের স্বার্থে। ১৯৯৯ সালে পূর্ব তিমুর স্বাধীন
হয়। একই ঘটনা ঘটেছে দক্ষিণ সুদানে। মুসলমান অধ্যুষিত সুদানের একটি অংশ ছিল
দক্ষিণ সুদান। খ্রিস্টান অধ্যুষিত দক্ষিণ সুদানে পশ্চিমারা স্বাধীন করেছিল
তাদের স্বার্থে। পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানে প্রচুর তেল রয়েছে। পশ্চিমাদের
স্বার্থ সেখানেই। পাহাড়ে যেহারে ধর্মান্তকরণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে, তা
মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের ছাড়িয়ে গেছে ইতোমধ্যে। সুতরাং পার্বত্য চট্টগ্রাম
নিয়ে একটা শঙ্কা থেকেই গেল।
পাহাড়ে স্পষ্টতই অলিখিত একটা বিভাজন তৈরি হয়েছে। সেখানে বাঙালিরা ব্যবসা
করতে পারে না। বাঙালিদের কোনো ব্যবসা করার সুযোগ নেই। বাঙালিরা যে কাজগুলো
করে, তা পাহাড়িরা করে না। তারপরও বাঙালিরা কোনো সন্ত্রাসী কর্মকা-ে লিপ্ত
নয়। সংবিধানের ১৯নং অনুচ্ছেদ (সুযোগের ক্ষমতা), ২৭নং অনুচ্ছেদ (আইনের
দৃষ্টিতে ক্ষমতা), ২৮নং (ধর্ম প্রভৃতি কারণে বৈষম্য) অনুচ্ছেদ বাঙালিদের যে
অধিকার দিয়েছে, তা থেকে বঞ্চিত বাঙালিরা। শত শত বাঙালি সেখানে মানবেতর
জীবনযাপন করছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হওয়াও জরুরি। নির্বাচন না
হওয়ায় সন্ত্রাসীরা সুযোগ পাচ্ছে। আরো একটা কথা। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক
পরিষদ পুনর্গঠন জরুরি হয়ে পড়েছে। কোনো ধরনের নির্বাচন কিংবা দায়বদ্ধতা
ছাড়াই সন্তু লারমা ১৯৯৯ সালের ১২ মে থেকে আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যানের
দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এটা অবৈধ ও অশোভন। একটানা দীর্ঘ ১৩ বছর এ দেশের
রাষ্ট্রপতিও ক্ষমতায় থাকতে পারেন না। জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সরকার
সন্তু লারমাকে প্রতিমন্ত্রীর সব সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন, কিন্তু তার
উস্কানিমূলক বক্তব্য পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ত্রাসী কর্মকা- বাড়িয়ে দিয়েছে।
রাঙামাটির ঘটনায়ও তিনি কোনো বিবৃতি দেননি। সেখানে শান্তি মিছিল হয়েছে।
পাহাড়ি ও বাঙালিরা এক সাথে মিছিল করেছে। পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মাঝে প্রচুর
শুভবুদ্ধির মানুষ রয়েছেন, যারা চান সবাইকে নিয়ে মিলেমিশে থাকতে। সন্ত্রাসী
কর্মকা- কখনোই শান্তি আনতে পারে না। একটি ছোট ঘটনাকে যারা তাদের স্বার্থে
ব্যবহার করেছেন, তারা দেশের শত্রু। তারা পাহাড়ি এলাকায় অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি
করে সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। এদের সম্পর্কে আমরা যত সতর্ক থাকব, ততই
আমাদের মঙ্গল।
রাঙামাটির ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই রামু, পটিয়া, উখিয়াতে ঘটল
অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। হাজার বছরের যে ধর্মীয় সম্প্রীতি তা নষ্ট হলো।
বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রচেষ্টার খবর আমরা
পত্রপত্রিকা থেকে পাই। তাই রামুর ঘটনাকে হাল্কাভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
রামুর ঘটনার সঙ্গে রাঙামাটির ঘটনার কোনো মিল আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা
প্রয়োজন। যারাই অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে চায়, তারাই রাষ্ট্রের শত্রু।
রামুর ঘটনায় যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করা হোক। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া
হোক। বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য দিয়ে মূল ঘটনাকে আড়াল করা ঠিক হবে না। সবাইকে
একসঙ্গে হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যারা বিনষ্ট করে, তাদের বিরুদ্ধে
দাঁড়াতে হবে। রামুর ঘটনাই যেন শেষ ঘটনা হয়।Daily JAI JAI DIN16.10.12
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment