সবকিছু ঠিক থাকলে খালেদা জিয়া ভারত সফরে যাচ্ছেন ২৮ অক্টোবর। চীন সফর শেষ করে তিনি যখন ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন, তখন তার এ সফরকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। খালেদা জিয়ার চীন ও তারপর ভারত সফর প্রমাণ করে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চীন ও ভারত কত গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার ভারত সফর বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের নীতিনির্ধারকরা বিএনপির রাজনীতি জানেন এবং বোঝেনও। আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে খালেদা জিয়ার গুরুত্ব বেড়েছে। এটা বিবেচনায় নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করে ভারত যাচ্ছেন। এতে একটা বিষয় স্পষ্ট, ভারত পরিবর্তিত পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে খালেদা জিয়াকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। এ দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে একটা ধারণা ছিল, ভারত শুধু আওয়ামী লীগকেই সমর্থন করে। দেখা গেল, ভারতের নীতিনির্ধারকরা এখন বিএনপি তথা খালেদা জিয়ার সঙ্গেও একটা ‘ডায়ালগ’ ওপেন করছেন। এ কারণেই তার এ সফর যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ভারত সফরের পর।
এরশাদের ‘হাই প্রোফাইল’ ভারত সফর ও ঢাকায় দেয়া বিভিন্ন বক্তব্যের পর তিনি এমন একটা ধারণার জš§ দিয়েছেন যে, বাংলাদেশের পরবর্তী নেতা হিসেবে বিশ্ব সম্প্রদায়, বিশেষ করে ভারত তাকে গণ্য করছে। এখন খালেদা জিয়ার এ সফরের পর মানুষের মনে নতুন একটা ধারণার জš§ হতে পারে। ধারণা করছি, ভারতের নীতিনির্ধারকদের মাঝে সম্ভবত একটি ‘শুভবুদ্ধির’ উদয় ঘটেছে। তারা এখন আর শুধু আওয়ামী লীগকে নিয়েই চিন্তা করেন না, বরং প্রধান বিরোধী দলের সঙ্গেও এক ধরনের ‘ডায়ালগ’ চান।
খালেদা জিয়ার ভারতে যাওয়া উচিত কী উচিত নয়, এটা নিয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে। অনেকের সঙ্গে এমনকি যারা জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ঘরানার তারাও আমাকে বলেছেন, খালেদা জিয়ার নয়াদিল্লি যাওয়া ঠিক নয়। কারণ এতে করে সাধারণ মানুষের মাঝে একটা ‘ভুল সিগনাল’ পৌঁছে যেতে পারে। এর পেছনে হয়তো যুক্তি ও আবেগ আছেÑ এটা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। কারণ স্বাধীনতার পরবর্তী ৪০ বছরে ভারত বন্ধুত্বের চেয়ে ‘শত্র“তার’ই পরিচয় দিয়েছে বেশি। তার পরও বাস্তবতা যা, তা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সমসাময়িক রাজনীতিতে ভারত একটা ‘ফ্যাক্টর’। ভারতের অবস্থান, তার অর্থনীতি, সামরিক শক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার ‘বিশেষ সম্পর্ক’ ইত্যাদি কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কে এর একটা প্রভাব পড়বেই। আমরা ভারতের এই অবস্থান থেকে কতটুকু ফায়দা তুলতে পারবÑ আমাদের বৈদেশিক নীতির সাফল্য সেখানেই। দুর্ভাগ্য, বর্তমান সরকারের সময় আমরা খুব একটা ফায়দা তুলতে পারিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যর্থতা ঢাকতে আমাদের দু’জন উপদেষ্টাকে পর্যন্ত নিয়োগ করতে হয়েছে, যারা সত্যিকার অর্থে বৈদেশিক নীতি বাস্তবায়নে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে সাহায্য করছেন। এমন এক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার ভারত সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার জন্য একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশের স্বার্থকে যথাযথভাবে ভারতের কাছে তুলে ধরার। বলার অপেক্ষা রাখে না, মহাজোট সরকারের সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রশ্নে বাংলাদেশের স্বার্থ সব সময় রক্ষিত হচ্ছে না। খালেদা জিয়া এখন এ কাজটি করতে পারেন। বাংলাদেশের মানুষের যে প্রত্যাশা, তা তুলে ধরতে পারেন ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে। প্রথমত, বাংলাদেশ বড় ধরনের ভারতীয় পানি আগ্রাসনের সম্মুখীন। গঙ্গার পানি বণ্টনে একটি চুক্তি হয়েছে বটে; কিন্তু পানি আমরা পাচ্ছি না। ফারাক্কা পয়েন্টে পানি আসার আগেই উজানে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হচ্ছে। তিস্তার পানি বণ্টনে ভারতকেই এগিয়ে আসতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের আপত্তিতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে না। সমস্যাটা ভারতের, সমাধান তাদেরই করতে হবে। বিষয়টি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে, আন্তর্জাতিক নদী আইন আমাদের অধিকারকে সংরক্ষণ করছে। আমরা আমাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারি না। ভারত আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। খোদ ভারতের অভ্যন্তরে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ভারত অত্যন্ত সুকৌশলে ও ছলনার আশ্রয় নিয়ে এ দুটো প্রজেক্ট নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের বিশাল এলাকা পানিশূন্য হয়ে যাবে। মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশের মানুষ এটা মেনে নেবে নাÑ এ বিষয়টি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বুঝিয়ে দিতে হবে। দেশ হিসেবে আমরা ‘ছোট’ হতে পারি; কিন্তু আমরা সমমর্যাদার অধিকারী। ভারতের আচরণে সেই সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ ভারতীয় ‘বাণিজ্য নীতির ফাঁদে’ আটকা পড়ে আছে অনেক দিন থেকে। অর্থাৎ ভারতীয় বাণিজ্যনীতি এমন যে, একটি বড় ধরনের বাণিজ্যিক ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছে, যা ভারত ব্যবহার করছে তার স্বার্থে। ভারত তথাকথিত বাংলাদেশী পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধার কথা ঘোষণা করলেও বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা যায় বাংলাদেশের রফতানি আয় কমে গেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১১-১২ অর্থবছরে ভারতে বাংলাদেশ রফতানি করেছে মাত্র ৪৯ কোটি ৮৪ লাখ ডলারের পণ্য (আগের বছরের আয় ৫১ কোটি ৪৯ লাখ ডলার)। এতে দেখা যায়, রফতানি আয় কমেছে (কালের কণ্ঠ, ১৮ জুলাই, ২০১২)। গেল বছর ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। তখন ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা তিনি ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু দেখা গেল ভারত অশুল্ক বাধা দূর করার কোন উদ্যোগ নেয়নি। খালেদা জিয়া এখন এ বিষয়টি ভারতীয় নেতাদের কাছে স্পষ্ট করতে পারেনÑ অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে। এতে করে বাংলাদেশ তার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে পারবে।
তৃতীয়ত, বারবার প্রতিশ্র“তি দেয়া সত্ত্বেও সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। একতরফাভাবে ভারতীয় বিএসএফ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশীদের হত্যা করছে। পৃথিবীর কোন সীমান্তে এভাবে মানুষ মারা হয় না। এই সীমান্ত হত্যা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে ভারতকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবেÑ খালেদা জিয়া এ ‘মেসেজ’টি পৌঁছে দিতে পারেন ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে।
চতুর্থত, খালেদা জিয়া ছিটমহল বিনিময়, অপদখলীয় ভূমি হস্তান্তর, সাড়ে ৬ কিলোমিটার সীমানা চিহ্নিতকরণের বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিতে পারেন। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী অনেক আগেই ছিটমহল সমস্যার সমাধান হওয়া উচিত ছিল; কিন্তু ভারত তা করেনি। আশা করব, খালেদা জিয়া দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বাংলাদেশের জনগণের কথা তুলে ধরবেন।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের দুর্বল ও ভারতঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতির সুযোগে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে সুকৌশলে ট্রানজিটের নামে করিডোর সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। তখন বলা হয়েছিল, ‘বহু পাক্ষিকতার আলোকে ভারতকে ট্রানজিট দেয়া হয়েছে’। বলা হয়েছিল, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানও অনুরূপ সুবিধা পাবে। বাংলাদেশের জন্য চীন-নেপাল-ভুটানের যে সংযোগ ভারতের ওপর দিয়ে যাবে, তা ১০০ কিলোমিটারের চেয়ে কমÑ এই সুযোগটি বাংলাদেশ পায়নি। এমনকি ভারত ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশের মাত্র ২৫ কিলোমিটার স্থল সংযোগে নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে ভারত আমাদের সেই সুযোগ দেয়নি। অথচ আমরা এককভাবে ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতের ২৮ চাকার ভারী গাড়ি পারাপারের সুযোগ করে দিয়েছি। এজন্য ভারত আমাদের কোন ট্রানজিট ‘ফি’ও দেয়নি। সাধারণ মানুষের মনোভাব আজ খালেদা জিয়াকে তুলে ধরতে হবে। শুধু তাই নয়, ভারত তার নিজ স্বার্থে এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ার রেলওয়ের পথরেখাটি নিজের সুবিধামতো রুটে আদায় করে নিয়েছে। ভারতের এই এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের পথরেখাটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢুকে ঢাকা ও সিলেট হয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে প্রবেশ করবে। এই পথটি ভারতের জন্য অনুকূল হলেও বাংলাদেশের জন্য দুর্গম, বেশি দূরত্বের ও অনিরাপদ হওয়ায় পথটি বাংলাদেশের জন্য মোটেই লাভজনক নয়। অথচ পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-টেকনাফ-সিডোই-আকিয়াব-ইয়াঙ্গুনগামী পথটি বাংলাদেশ থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দূরপ্রাচ্যের গন্তব্যগুলোয় স্থল যোগাযোগের জন্য (সড়ক ও রেলপথ) কম দূরত্বের ও কম দুর্গম এবং নিরাপদ হওয়ার ফলে বাংলাদেশের জন্য তা ছিল সুবিধাজনক; কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের ভারততোষণ নীতির কারণে এশিয়ান হাইওয়ের যে পথ আমরা বেছে নিয়েছি, তাতে আমাদের প্রাপ্তি কম। এমনকি ভারতকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের ব্যাপারেও আমরা চুক্তিবদ্ধ। এসব চুক্তি আমরা এখন বাতিল করতে পারব না। কিন্তু খালেদা জিয়া ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের এটা বোঝাতে পারেন যে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ভারত যদি এককভাবে সুবিধা নেয়, তাতে করে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধুত্ব পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ছে। আমদানি-রফতানিতে চট্টগ্রাম বন্দর এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছে। নতুন করে ভারতীয় কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার সুযোগ কম। বিষয়টি নিয়ে খালেদা জিয়া ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করতে পারেন।
বাংলাদেশের জনগণ ভারতের বন্ধুত্ব চায়। বাংলাদেশের উন্নয়নে ও সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকাশে ভারত বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কোন বিশেষ দল বা গোষ্ঠীকে ভারত যদি সমর্থন করে, তাতে বাংলাদেশে ভারতের ইমেজ নষ্ট হতে বাধ্য। বাংলাদেশের মানুষ চায় না ভারত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করুক। তবে খালেদা জিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়ে ভারত তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। আগামী দিনগুলোতে ভারত একটি ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান গ্রহণ করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বিএনপির বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল দলটি ভারতবিরোধী। খালেদা জিয়ার ভারত সফর এই বদনাম কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশ ‘ছোট’ দেশ হতে পারে; কিন্তু আমাদের অনেক কিছু দেখার আছে। ভারত সমমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়ে তুলুক, খালেদা জিয়ার এ সফরের মধ্যে এটি যদি নিশ্চিত হয়, সেটাই হবে আমাদের জন্য বড় পাওয়া।
Daily JUGANTOR
24.10.12
0 comments:
Post a Comment