রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

‘প্লুটোক্র্যাসি’: বাংলাদেশ স্টাইল


সমাজ বিজ্ঞানের গবেষকদের কাছে ‘প্লুটোক্র্যাসি’ শব্দটা একেবারে অপরিচিত নয়। এর অর্থ হচ্ছে ধনিকতন্ত্র। অর্থাৎ ধনিক শ্রেণীনির্ভর একটি সমাজ। পুঁজিবাদী সমাজে, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কিংবা পশ্চিম ইউরোপে প্রচুর ধনী লোক রয়েছেন। এমনকি ‘সমাজতান্ত্রিক’ চীনেও এখন প্রচুর ধনী লোক রয়েছেন। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের ধনী লোকদের মধ্যে পার্থক্য এই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা ধনী হয়েছেন বা ধনীগোষ্ঠী রয়েছেন, তারা মূলত পারিবারিকভাবেই বড় লোক। উত্তরাধিকার সূত্রে তারা সম্পদের মালিক হয়েছেন। একটা তথ্য দিই-যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ২৫ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ লোক। ২৫ বছর আগে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১২ ভাগ। এই ১ ভাগ লোকের বার্ষিক আয় এক একজনের প্রায় তিন কোটি ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় মাসিক আয় ২০ কোটি টাকার ওপর। তবে এটাও সত্য, সেখানে প্রতি ৩ জনে একজন গরিব। আর চীনে সংস্কারের পরই ধনী লোকের সংখ্যা বাড়ছে। আগে কোনো ব্যক্তিগত খাত চীনে ছিল না। এখন ব্যক্তিগত খাতের বিকাশের ফলে সেখানে ধনী লোকের জš§ হয়েছে। ব্যক্তিগত খাতে রফতানিমুখী শিল্পের বিকাশ ঘটায় চীনে এখন ধনী লোকের সংখ্যা অনেক। তবে সরকারি অর্থ আÍসাৎ করে কেউ ধনী হয়েছে, এটা আমেরিকাতে যেমন অচিন্তনীয়, ঠিক তেমনি চীনেও চিন্তা করা যায় না। আমেরিকাতে অর্থ কেলেঙ্কারির সাজা অত্যন্ত কঠিন। এমনকি কেউ যদি আয়কর না দেন, তিনিও সমান অপরাধী। চীনেও বিষয়টি সহজ নয়। যারা সেখানে ধনী হয়েছেন, তারা সরকারকে আয়কর দিয়েই ধনী হয়েছেন, কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনা ভিন্ন।
হলমার্কের ঘটনায় শুধু যে মালিকপক্ষ দায়ী তা কিন্তু নয়। একটি অসাধু চক্র, যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ রয়েছে, তারা হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। লুটপাট করে ধনী হয়েছেন। ব্যবসা করে এরা ধনী হননি। শুধু সোনালী ব্যাংক নয়; বরং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২৬টি ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে ওই চক্র- এমন অভিযোগ রয়েছে। এই ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পরও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হয়নি। এমনকি সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এখনো স্বপদে বহাল রয়েছেন। সরকারি দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা অভিযুক্তদের গ্রেফতারের দাবি জানালেও, একটা ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না অভিযুক্তদের আদৌ গ্রেফতার করা হবে কি না। হলমার্কের কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে যেসব প্রশ্নের জš§ হয়েছে তার জবাব জানা আমাদের জন্য জরুরি। সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখার সর্বোচ্চ ঋণ দেয়ার ক্ষমতা দুশ’ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে হলমার্কের মতো অখ্যাত একটি প্রতিষ্ঠান কী করে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা ঋণ পেল? এত বিপুলসংখ্যক ঋণ বরাদ্দের জন্য স্থানীয় ব্যবস্থাপকের সেই ক্ষমতা নেই। তাহলে কে তাকে প্ররোচিত করেছে এত বিপুলসংখ্যক ঋণ বরাদ্দের জন্য? কে এই ‘শক্তি?’ এটা জনা আমাদের জন্য জরুরি। হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে যেখানে পুরো জাতি আজ আতঙ্কিত, এই ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আমরা দেখলাম সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সদস্যদের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত-তারা পূর্ণ সময় কাটাবেন। এর কি আদৌ প্রয়োজন ছিল? কেন চেয়ারম্যান এখনো বহাল আছেন? তিনি যদি পর্ষদে থাকেন, তাহলে কী তিনি তদন্তে প্রভাব বিস্তার করবেন না? সোনালী ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে যাদের রাখা হয়েছিল, তারা সবাই রাজনৈতিকভাবে একটি দলের অনুগত। যাদের ব্যাংকিং সম্পর্কে আদৌ কোনো ধারণা নেই, তাদের রাখা হলো কাদের স্বার্থে? অর্থমন্ত্রী প্রকাশ্যেই হলমার্ক গ্র“পের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। এতে করে কি এই কেলেঙ্কারির সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করে না? বাম মোর্চা তার পদত্যাগ দাবি করেছে। শেখ সেলিম ও তোফায়েল আহমদের মতো প্রভাবশালী নেতারা অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন। অর্থমন্ত্রী আমাদের নিশ্চয়তা দিয়েছেন যে, হলমার্ককে দেয়া ঋণের অর্ধেক পরিশোধের জন্য তাদের চিঠি দেয়া হয়েছে এবং ১৫ দিনের মাঝে অর্ধেক টাকা ফেরত পাওয়া যাবে। কিন্তু একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক আমাদের জানাচ্ছে যে, ‘টাকা ফেরত দিতে চাইছে না হলকার্ম।’ সংবাদপত্রটি আমাদের জানাচ্ছে, হলমার্কের কেনা বিভিন্ন জমিতে তাদের যে সাইনবোর্ড টানানো ছিল তা সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
এমন খবরও সংবাদপত্রটি আমাদের দিয়েছে যে, হলমার্ক গ্র“পের এমডি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দৌড়ঝাপ শুরু করে দিয়েছেন। এখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এক হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে হলমার্ক। এখন কী হবে? সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী আরো ২৬টি ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে হলমার্ক। এর অর্থ বেসরকারি ব্যাংকগুলোও হলমার্কের প্রতারণার শিকার হচ্ছে। হলমার্কের এই লুটপাট পুরো অর্থ ব্যবস্থাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিল। মানুষের আস্থা হারিয়ে ফেলেছে ব্যাংক ব্যবস্থা। এর জন্য কাদের দায়ী করব? একটি অনলাইন বার্তা সংস্থা আমাদের জানিয়েছে যে, হলমার্ক ঋণ পেতে ৫০ কোটি টাকার আধুনিক গাড়ি ক্রয় করেছিল। সোনালী ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপটৌকন দেয়ার জন্য এই গাড়িগুলো ক্রয় করেছিল। ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা ওই গাড়িগুলো ব্যবহারও করেছেন। এখন ওই গাড়িগুলোর কী হবে? দুদক বলছে তারা হলমার্কের এমডি ও তার স্ত্রীকে তলব করবে। ইতোমধ্যে করেছেও। প্রথমে শেয়ারবাজার, তারপর পদ্মা সেতু, এখন হলমার্ক-প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে এবং একটি ক্ষেত্রেও অভিযুক্তদের বিচার হয়নি। সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একটি প্রভাবশালী চক্র শুধু শেয়ারবাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছিল ২০ হাজার কোটি টাকা। ইব্রাহিম খালেদ রিপোর্টে এই ঘটনায় যারা জড়িত ছিল, তাদের চিহ্নিত করা হলেও কারোরই বিচার হয়নি। ক্ষতি হয়েছিল ৪০ লাখ ক্ষুদে বিনিয়োগকারীর। কোনো রকম টেন্ডার ছাড়া কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের নামে লুটপাট করা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ডেসটিনি নামের একটি এমএলএম কোম্পানি অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে পাচার করেছে ১০ হাজার কোটি টাকা। সরকারের লোকজন এই ডেসটিনি গ্র“পের সঙ্গে জড়িত। একই সঙ্গে অপর একটি এমএলএম কোম্পানি যুবক ৩ হাজার কোটি টাকা, ইউগেটটুইউ ৩ হাজার কোটি টাকা, এইমওয়ে কর্পোরেশন প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা নিয়েছে। কোনো একটি ক্ষেত্রেও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হয়নি।
হলমার্ক কেলেঙ্কারি দেখিয়ে দিল আমাদের অর্থ ব্যবস্থায় মারাÍক সব ত্র“টি রয়েছে। ব্যাংকগুলোতে নিয়মিত ইন্সপেকশন হওয়ার কথা, তা হয়নি। ফলে এ ধরনের আর্থিক অনিয়ম রয়ে গেছে। কোথাও কোথাও এসব ‘অনিয়ম’ অর্থের বিনিময়ে ধাপাচাপা দেয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুস্পষ্ট অভিমত থাকলেও সেই অভিমতকে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিবেচনায় নেয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চাচ্ছেন অর্থনীতিতে একটি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে। বিভিন্ন কর্মসূচিও তিনি নিচ্ছেন। কড়া হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা সত্ত্বেও অসাধু চক্র অর্থনীতিকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নরকে মনে হয়েছে অসহায়। তিনি যখন সব ব্যাংককে এই ঋণের ব্যাপারে সতর্ক করে দিচ্ছেন, সেখানে একটি অসাধু চক্র রাজনৈতিক যোগসাজশে বৃহৎ অংকের ঋণ নিচ্ছে।
হলমার্কের ঘটনায় শুধু একটি ব্যাংকের কথা আমরা জানলাম। রাষ্ট্রায়ত্ত ফাঁকি-প্রতিটি ব্যাংকেই এ ধরনের বড় ঋণ জালিয়াতি রয়েছে বলে আমার ধারণা। খুব দ্রুত বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তদারকি করা উচিত। এতে করে অনেক ‘গোপন তথ্য’ বেরিয়ে যেতে পারে। একজন তানভির মাহমুদ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। সাধারণ মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল এই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক। এখন সেই আস্থায় চিড় ধরল। ডেসটিনির কথা আমরা জেনেছি। এখন জানলাম হলমার্কের কথা। এ ধরনের শত শত ‘তানভির মাহমুদ’ ব্যাংকের টাকা লুটপাট করে প্রভাবশালীদের কারণে পার পেয়ে যাচ্ছেন। এদের যদি আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া না যায়, তাহলে ‘ক্লেপটোক্রেসি’র বদনাম অচিরেই আমাদের ঘাড়ে বর্তাবে। উন্নতির যত দৃষ্টান্তই আমরা দিই না কেন বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি তাতে উজ্জ্বল হবে না। অর্থমন্ত্রী সজ্জন ব্যক্তি। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও দক্ষ ব্যক্তি। কিন্তু অসাধু চক্রকে যদি আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে না পারি, তাহলে মানুষের আস্থা আর থাকবে না।
Daily Manobkontho
07.10.12

0 comments:

Post a Comment