দুটি সমস্যা এই মুহূর্তে সরকারের অবস্থানকে অনেক দুর্বল করেছে। এক.
বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বড় \'জটিলতা\' ও
বিশ্বব্যাংকের ফেরা না-ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা। দুই. হলমার্ক কেলেঙ্কারিকে
কেন্দ্র করে পুরো অর্থনীতির ওপর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এই প্রভাব
কাটিয়ে উঠে অর্থনীতিকে সঠিক পথে চালিত করা দরকার। পদ্মা সেতুতে
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন নিয়ে যে \'জটিলতা\' তৈরি হয়েছে, তার পুরোপুরি অবসান
হয়েছে, তা বলা যাবে না। বিশ্বব্যাংক এখন মূলত দুটি বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত
হতে চায়। এক. দুর্নীতির অভিযোগটি তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি
বিশেষ তদন্ত ও আইনি দল গঠন করা; দুই. আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের
নিয়ে গঠিত একটি এক্সটারনাল প্যানেলের কাছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সব তথ্যের পূর্ণ
ও পর্যাপ্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ করে দেওয়া। এটা এখন স্পষ্ট যে, এ দুটি
ক্ষেত্রে আমরা যদি স্বচ্ছতার পরিচয় দিই, তাহলে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে
অর্থায়ন করবে। আমাদের যে কোনো গড়িমসি ও অসহযোগিতা বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরে
একটি ভুল সিগন্যাল পেঁৗছে দিতে পারে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে না আসা পর্যন্ত
বিশ্বব্যাংকের কর্মকাণ্ড নিয়ে মন্তব্য না করাই শ্রেয়। প্রধানমন্ত্রী
নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৬৭তম অধিবেশনে ভাষণে বিশ্বব্যাংকসহ সব আর্থিক
প্রতিষ্ঠান ও খোদ জাতিসংঘের সংস্কারের দাবি করেছেন। তার বক্তব্যের সঙ্গে
দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই। এ কথাগুলো আমরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছি। তবে এ
সময়ে এ ধরনের মন্তব্য প্রত্যাশিত নয়। এমনকি তিনি যখন নিউইয়র্কে
বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে তাকে জানিয়ে দেন যে, অর্থায়ন
বন্ধের পেছনে অপরাধীদের তিনি ছাড় দেবেন না, তখন বিশ্বব্যাংক বিষয়টি
\'অন্যভাবে\'ও নিতে পারে। আমরা বিশ্বব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছি আমাদের
স্বার্থে। প্রয়োজনটা আমাদের। এ ক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন প্রসঙ্গে যত
কম কথা বলব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। হলমার্ক কেলেঙ্কারি পুরো
অর্থব্যবস্থাকে একটি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। এর সঙ্গে শুধু সোনালী
ব্যাংকই নয়, আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংক জড়িত হয়ে পড়েছে। এটা তো স্পষ্ট, এত
বিপুল পরিমাণ অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে ওপর মহলের অনেকেই জড়িত। ব্যাংকের
কর্তাব্যক্তিরা জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্তে বিষয়টি ধরা পড়ে এবং
বাংলাদেশ ব্যাংকের উপদেশ কেন \'উপেক্ষিত\' হলো তা জানা প্রয়োজন। দুদক
বিষয়টি তদন্ত করছে। ইতিমধ্যে ব্যাংকের কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদের সাবেক
কর্মকর্তাদেরও তারা তলব করেছে। কিন্তু আদৌ কি কোনো \'ফল\' তাতে পাওয়া
গেছে? অভিযুক্ত ব্যক্তি এখনও দিব্যি \'ঘুরে\' বেড়াচ্ছেন। তিনি কেন গ্রেফতার
হননি, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাংক চিঠি লিখে জানিয়েছিল ১৫ দিনের মধ্যে
ঋণের অর্ধেক এক হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা ফেরত দেওয়ার। ওই টাকা হলমার্ক দেয়নি।
নানা ছলাকলার আশ্রয় নিচ্ছে। রাষ্ট্র কি এত দুর্বল যে, হলমার্ক থেকে টাকা
উদ্ধার করতে পারবে না? অভিযুক্ত ব্যক্তি ও ব্যক্তিদের বাইরে রেখে \'তদন্ত\'
কাজ করলে তাতে কি \'তদন্ত\' কাজে প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ থাকবে না?
কোনো সভ্য দেশে এটা সম্ভব নয়। কোটি কোটি টাকা, এ টাকা জনগণের। প্রতারণার
আশ্রয় নিয়ে এ টাকা তারা আত্মসাৎ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আগেই সতর্ক করে
দিয়েছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গেই অর্থনীতিকে
নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন। তার গতিশীল নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশ
ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়েছে। কিন্তু একটি চক্র তার ইমেজকে নষ্ট করার জন্য তার
বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। একটি অসাধু চক্র সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা
পর্ষদকে \'ম্যানেজ\' করে হাতিয়ে নিয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকা। এর আগে
শেয়ারবাজার থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা \'লুট\' হয়েছে। খোন্দকার ইব্রাহিম
খালেদের রিপোর্টে এ ব্যাপারে দোষী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হলেও \'অদৃশ্য
শক্তি\'র বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন অর্থনৈতিক ক্রিমিনালরা। প্রতিটি ক্ষেত্রে
সরকারের নির্লিপ্ততা জনমনে সরকার সম্পর্কে মিশ্র ধারণার সৃষ্টি করেছে।
হলমার্কের ঘটনার যদি \'বিচার\' না হয়, যদি আত্মসাৎ করা টাকা উদ্ধার না হয়,
তাহলে মানুষ পুরো ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে। সংবাদপত্রে এমন
খবরও ছাপা হয়েছে যে, হলমার্ক কেলেঙ্কারির অন্যতম হোতা সদ্য ওএসডিতে যাওয়া
ডিএমডি মো. মইনুল হক ছিলেন ট্রুথ কমিশনে আত্মস্বীকৃত দুর্নীতিবাজ (আমার
দেশ, ১৩ সেপ্টেম্বর)। আত্মস্বীকৃত এই দুর্নীতিবাজ ক্ষমতাসীনদের ব্যবহার করে
হলমার্কের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক রেখে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। ব্যবসায়ীদের
সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি তাই দাবি জানিয়েছিলেন অভিযুক্তদের গ্রেফতারের।
সেটা করা হয়নি। এতেই প্রমাণ হয় হলমার্ক কেলেঙ্কারির সঙ্গে রাজনৈতিক
সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়, যখন জানা যায় গত বছর বাংলাদেশ
ব্যাংক বিষয়টি লিখিতভাবে অর্থমন্ত্রীকে জানালেও অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে
কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেননি। হলমার্ক কেলেঙ্কারির দায়দায়িত্ব মুহিত সাহেব
এড়াতে পারেন না। পদ্মা সেতুর দুর্নীতির বিষয়টি নিয়ে বহির্বিশ্বে আমাদের
ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো হলমার্কের ঘটনা।
তৃতীয় আরও একটি সমস্যা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছে; আর তা হচ্ছে
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, বিশেষ করে সাংবাদিক রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ডের
কূলকিনারা না হওয়া। রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড বিভক্ত সাংবাদিক সমাজকে একত্র
করেছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যের জন্য সমালোচিত হয়েছেন
বারবার। সাংবাদিক সমাজে যারা সরকারের বন্ধু বলে পরিচিত ছিলেন, ওই
হত্যাকাণ্ডে তারাও আজ সরকারের পাশে নেই। অনেক আগেই অ্যাডভোকেট সাহারা
খাতুনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সরানো উচিত ছিল। এখন একজন শক্ত গোছের
মানুষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। কিন্তু তিনিও একটি ঝুঁকি
নিলেন। ১০ অক্টোবরের কথা বলে তিনি কোনো \'চমক\' দিতে চাননি, এটা আমি
বিশ্বাস করি। কিন্তু তথাকথিত \'গ্রিলতত্ত্ব\' ও \'একজন জজ মিয়া\' নাটক যদি
আবার মঞ্চস্থ হয়, তাহলে তা সরকারের জন্য কোনো সুনাম বয়ে আনবে না। এমনিতেই
শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ বিতর্কিত। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের
ঘটনায় র্যাব আজ বহির্বিশ্বে প্রশ্নের মুখোমুখি। ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনার
দায়িত্ব আজ সরকারের।
আগামী কয়েকটি মাস সরকারের জন্য অত্যন্ত কঠিন সময়। একদিকে বিরোধী দলের সঙ্গে
রাজনৈতিক \'দ্বন্দ্ব\' আরও তীব্র হচ্ছে, অন্যদিকে একাধিক ঘটনায় সরকারের
সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রথম ঘটনায় সরকার রেলের ভাড়া
অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধি করেছে। এর আদৌ প্রয়োজন ছিল না। সাধারণ মানুষ রেলে
চলাফেরা করে। ভাড়া কম থাকায় রেলযাত্রা তারা পছন্দ করে। ভাড়া বৃদ্ধি মানেই
হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর আঘাত আসা। আমরা ভারতের উদাহরণ দেখাতে পারি।
সাধারণত খুব কম ক্ষেত্রেই রেলের ভাড়া সেখানে বাড়ানো হয়। ভাড়া বাড়িয়ে কোনো
দলই জনপ্রিয়তা হারাতে চায় না। তৃণমূলের রেলমন্ত্রী ভাড়া বৃদ্ধি করেছিলেন
দলের সিদ্ধান্ত না নিয়ে। ফলে মমতা ব্যানার্জির নির্দেশে তাকে পদত্যাগ করতে
হয়েছিল। নয়া রেলমন্ত্রী বিষয়টি বোঝেন কি-না জানি না। কিন্তু রেলের ভাড়া
বৃদ্ধি দলের জনপ্রিয়তায় ধস নামাতে পারে। মানুষ খুশি হবে না এ সিদ্ধান্তে।
আমলাদের দ্বারা প্রণীত সিদ্ধান্ত যদি জনপ্রতিনিধিরা কোনো কিছু না বুঝেই
গ্রহণ করেন, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। দ্বিতীয় ঘটনা বিদ্যুতের
মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে। যেখানে বিদ্যুৎ চুরি রোধ করার কোনো উদ্যোগ নেই, সেখানে
বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি ঘটিয়ে সরকার কি লাভবান হবে? এতে তো ক্ষতিগ্রস্ত হবে
সাধারণ মানুষ। বিদ্যুৎ দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা থাকলেও তিনি মূলত
আমলা, জনগণের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই। সরকারপ্রধানকে তিনি সঠিক
উপদেশটি দিয়েছিলেন বলে মনে হয় না।
পদ্মা সেতু, হলমার্ক, রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড, রেল ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি_
একটি ঘটনাও সরকারের পক্ষে যায়নি। এমনিতেই কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে, এটা
নিয়ে সরকার ও বিরোধী পক্ষ পরস্পরবিরোধী এক অবস্থান গ্রহণ করেছে। সংবিধান,
নির্বাচন ইত্যাদি নিয়ে নানা প্রশ্ন। যেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আদৌ
সুযোগ নেই, সেখানে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আগ্রহ দেখিয়েছেন দায়িত্বটি নিতে।
এমনি এক পরিস্থিতিতে সমঝোতা যেখানে প্রত্যাশিত, সেখানে পদ্মা সেতু কিংবা
হলমার্কের মতো ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। সরকার
সমস্যাগুলোর দিকে যদি \'সিরিয়াসলি\' নজর দেয়, তাহলে আমাদের সবার জন্যই
মঙ্গল।
0 comments:
Post a Comment