দুই নেত্রী গত ৬ অক্টোবর দুটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সময় বলেছেন, ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে হবে। তিনি জানান, দলীয় সরকারের অধীনেই দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে বেগম জিয়া ওই একই দিনই হবিগঞ্জে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বলেছেন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। সেই লক্ষ্যে ঈদের পর কঠোর কর্মসূচি দেয়া হবে। দুই নেত্রীর পরস্পরবিরোধী অবস্থান দেশে এক সংকট তৈরি করেছে। সাধারণ মানৃষ এক ধরনের আতঙ্কের মধ্যে আছে। এখন মহাজোট সরকার যদি দলীয়ভাবে নির্বাচন করে এবং তাতে যদি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল অংশ না নেয়, তাহলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না।
এদেশে ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু একটি বড় দল (বিএনপি ও আওয়ামী লীগ) অংশগ্রহণ না করায় তার কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। অন্যদিকে ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে দুটি বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করায় শুধু দেশেই নয়, বরং বিদেশেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। এখন ২০১৩ সালে যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে একটি বড় দল বিএনপি যদি অংশগ্রহণ না করে, তাহলে সংগত কারণেই ওই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। ভুলে গেলে চলবে না, আমাদের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি অবিসংবাদিত শক্তি। একটি দলকে বাদ দিয়ে অন্যদল এককভাবে যেমন গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি, ঠিক তেমনি এই দু’দলের একটিকে বাদ দেয়ার কিংবা ‘মাইনাস’ করার কোনো ষড়যন্ত্রও সফল হয়নি। এই দল দুটোর মাঝে প্রচণ্ড বিরোধ আছে। এ বিরোধ এখন ব্যক্তিপর্যায়ে চলে গেছে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এই দল দুটোর কারণেই গণতন্ত্র এদেশে স্তরে স্তরে শক্তিশালী হচ্ছে।
আমরা যদি পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাব, এদেশে ১৯৭৩ সালে প্রথম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর ২০০৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট নয়টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মাঝে ১৯৮৬ (তৃতীয়), ১৯৮৮ (চতুর্থ) ও ১৯৯৬ (ষষ্ঠ) সালে অনুষ্ঠিত হওয়া সংসদ নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। বাকি ৬টি সংসদ নির্বাচন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বচনে আওয়ামী লীগ শতকরা ৭৩.২০ ভাগ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছিল। ওই সময় সংসদে কোনো বিরোধী দল ছিল না। ওই সময়ও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে (রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের আওতায়) সদ্যগঠিত বিএনপি ২০৭টি আসন পায়। শতকরা হিসাবপ্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৪১.০৭ ভাগ। আওয়ামী লীগ মীজান ও মালেক আলাদা আলাদাভাবে নির্বাচন করে। যৌথভাবে তারা পায় ৪১টি আসন (মালেক ৩৯), শতকরা হিসাবে যা ছিল ২৭.৩৪ ভাগ। এর বাইরে তৃতীয় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয় মুসলিম লীগ ও আইডিএল ঐক্য (২০ আসন, ১০.০৭ ভাগ ভোট) গনঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে বিএনপি ১৪১ আসন (৩০.৮১ ভাগ ভোট) ও আওয়ামী লীগ ৮৮ (৩০.০৮ ভাগ ভোট) আসন পেয়েছিল। জামায়াত ১৮ ও জাতীয় পার্টি ৩৫ আসন পেয়েছিল। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দৃশ্যপট বদলে যায়। প্রথমবারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (১৪৬ আসন, ৩৭.৪৪ ভাগ ভোট) বিজয়ী হয়। বিএনপির আসন দাঁড়ায় ১১৬ (৩৩.৬১)। জাতীয় পার্টি ৩২ (১৬.৩৯ ভাগ ভোট) আসন গিয়ে তৃতীয় অবস্থান ধরে রাখে। অষ্ঠম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০১) দৃশ্যপট আবার বদলে যায়। বিএনপি ১৯৩ আসন (৪০.৯৭ ভাগ ভোট) পেলেও চারদলীয় জোট পায় শতকরা ৪৭ ভাগ ভোট, আর আসন পায় ২১৬। আওয়ামী লীগের আসন কমে এসে দাঁড়ায় ৬২ (৪০.১৩ ভাগ ভোট)।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের (২০০৮) প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। ২০০৭ সালের ‘এক-এগারোর’ ঘটনা পুরো রাজনৈতিক সিস্টেমকে একটি বড় ধরনের ধাক্কা দেয়। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন না উঠলেও ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের ভূমিকা এ ব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করে। এমনই এক পরিস্থিতিতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় (২৩১, ৪৮.০৬ ভাগ ভোট)। বিএনপির আসন কমে এসে দাঁড়ায় মাত্র ৩০টিতে (শতকরা ৩২.৪৫ ভাগ ভোট)। জাতীয় পার্টি (২৬, ৭.০৫ ভাগ ভোট) তৃতীয় অবস্থান ধরে রাখে। সংসদীয় নির্বাচনের ফলাফল আমাদের দেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে।
এক, এদেশের রাজনীতি দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এই দল দুটোর যে কোনো একটিকে বাদ দিয়ে এককভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করা অসম্ভব। রাষ্ট্র পরিচালনায় বড় দল দুটোর মাঝে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার । দুই, বড় দল দুটোর বাইরে তৃতীয় একটি বড় দলের জন্ম হয়নি। তৃতীয় ধারার কথা বারবার বলা হলেও সাধারণ মানুষ এই তৃতীয় ধারার প্রতি আস্থাশীল নয়। জাতীয় পার্টি তৃতীয় শক্তি নয়; বরং একটি আঞ্চলিক দল এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ‘ঐক্য’ তৃতীয় শক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার পথে প্রধান অন্তরায়। তিন, এককভাবে নির্বাচন করার ফলে সেসব নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচন এর বড় প্রমাণ। চার, এ দেশের রাজনীতিতে দুটি ধারা দৃশ্যমান।
একদিকে ধর্মকে প্রধান করে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের একটি ধারা; অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষবাদী, একক দলের সমাজতন্ত্রী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ সমর্থকদের একটি ধারা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এ মুহূর্তে যে অচলাবস্থা, তার কেন্দ্র মূলত একটি, আর তা হচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার-যারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। সংবিধানে ১৫তম সংশোধনী আনার ফলে সংবিধানে এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলে কিছু নেই। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকার তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। সমস্যাটা তৈরি হয়েছে এখানেই। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতাসীন সরকার কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকে না। আওয়ামী লীগও অতীতে ক্ষমতাসীনদের দ্বারা পরিচালিত নির্বাচন সমর্থন করেনি। মাগুরা, ভোলা কিংবা সর্বশেষ গাজীপুর-৪ উপ-নির্বাচন আমাদের কাছে একেকটা দৃষ্টান্ত-যেখানে প্রমাণিত হয়েছে, ক্ষমতাসীন দল নির্বাচনে প্রভাব খাটায় এবং বিরোধী দলের অংশগ্রহণ না থাকলে তাতে সাধারণ ভোটারের আগ্রহ থাকে না। তাই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের দাবি উঠেছে, তা যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সরকারের তাতে সম্মতি না থাকায় পরিস্থিতি দিন দিন জটিল হচ্ছে।
এরই মধ্যে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সরকারপ্রধানের একটি নেতিবাচক মন্তব্যের কারণে সে সম্ভাবনাও ক্ষীণ।পরিস্থিতি যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। এখনো নির্বাচনের অনেক দিন বাকি। তারপরও নির্বাচনের প্রশ্নে যদি একটি সমাধান না হয়, তাহলে আগামী বছর দেশ একটি বড় ধরনের সংকটের মুখে পড়বে। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হবে, এটাই মানুষ প্রত্যাশা করে।
Daily MANOBKONTHO
21.10.12
0 comments:
Post a Comment