রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

উপাচার্যের পদ ও কর্তব্য




আরও একজন ভিসি আলোচনার জন্ম দিলেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। বিশ্ববিদ্যালয়টি নতুন। নিজস্ব আয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টি চলতে হবে_ এটা ছিল পুরনো আইন। এ আইন নিয়ে বড় ধরনের আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল। ফলে সরকার এ ধারায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী উপাচার্য ও শিক্ষক নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ধীরে ধীরে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়াতে হবে এবং সরকারের ওপর থেকে আর্থিক চাপ কমাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয় বাড়াতে বলেছেন, সেখানে ভিসি নিজের ব্যবহারের জন্য ১ কোটি ১২ লাখ টাকায় দুটি পাজেরো গাড়ি কিনেছেন। এর একটি আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষকে ব্যবহার করতে দিয়েছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এখানে নানা সমস্যা রয়েছে। একজন ভিসি হিসেবে তার দায়িত্ব ছিল ছাত্র তথা শিক্ষকদের সমস্যাগুলো সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়টির একাডেমিক মান বাড়ানো। যেখানে সাধারণ শিক্ষকদের যাতায়াত সুবিধা তিনি এখনও পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে পারেননি, সেখানে তিনি কোটি টাকায় পাজেরো কিনলেন; কিন্তু একটি পাজেরো গাড়ি কি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির মান-মর্যাদা বাড়ায়? আবার একজন কোষাধ্যক্ষ, তিনিও ব্যবহার করছেন পাজেরো গাড়ি! বহুল প্রচারিত একটি জাতীয় দৈনিকের ১৬ অক্টোবরের প্রথম পাতায় উপাচার্য মহোদয়ের গাড়ির বিলাস নিয়ে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। উপাচার্যের গাড়ির বিলাসই নয়, বরং ভর্তি পরীক্ষার প্রাপ্ত অর্থ থেকে ৫০ লাখ টাকা উপাচার্য নিজে ও ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছেন। এটা করা কি ঠিক হয়েছে? যেখানে প্রধানমন্ত্রীর সুনির্দিষ্ট নির্দেশ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় বাড়ানোর, সেখানে উপাচার্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা কীভাবে সেই নির্দেশনার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে ভর্তির টাকা নিজেরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিলেন। ভর্তি পরীক্ষার সময় শিক্ষকরা কাজ করেন, শ্রম দেন। তারা একটা সম্মানী পেতেই পারেন; কিন্তু উপাচার্য? ট্রেজারার? তারা কী কাজ করেছেন যে 'সম্মানী' নেবেন? তাদের কি এটা উচিত হয়েছে? আমি দাবি করব, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার প্রতি সম্মান জানিয়ে উপাচার্য ওই টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ফান্ডে জমা দেবেন। আমি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য থাকাকালে দিনাজপুর হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে 'বাধ্য' করেছিলাম ভর্তি পরীক্ষার সময় নেওয়া টাকা ফেরত দিতে। মঞ্জুরি কমিশনের প্রবিধান ও নির্দেশনায়ও উপাচার্যের 'কাজ না করে' টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আলোচ্য ভিসি 'পাজেরো' গাড়ি হাঁকিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কোনো 'পাজেরো' গাড়ি ব্যবহার করেন না। তিনি ব্যবহার করেন ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা দামের নিশান গাড়ি। ভর্তি পরীক্ষার ভাতাও তিনি নেন না। তাহলে কোন যুক্তিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পাজেরো গাড়ি ব্যবহার করেন? কোন যুক্তিতে লাখ লাখ টাকা 'হাতিয়ে' নেন? জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের 'ভিসি কাহিনী' যখন নানা জল্পনা-কল্পনার জন্ম দিয়েছে, তখন ১৮ অক্টোবর একই দৈনিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পদোন্নতির নানা কাহিনী ছাপা হয়েছে। মাত্র ২ থেকে ৪ বছর শিক্ষকতা করে 'দলীয় কোটায়' রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হয়েছেন, এমন শিক্ষকের সংখ্যা একাধিক। কলেজে শিক্ষকতা করার অভিজ্ঞতাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে পদোন্নতির মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। একজন অধ্যাপক শুধু বয়সের কারণেই অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পেতে পারেন না। তার নিজস্ব গ্রন্থ থাকতে হবে। উঁচু মানের প্রকাশনা থাকতে হবে। শুধু বয়স আর কলেজে শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকে অধ্যাপক হয়েছেন। এখানে দলীয় রাজনীতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব রাজনীতিও জড়িত। যেহেতু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের আর্থিক অনিয়ম, একাডেমিক দুর্নীতির খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আমি আশা করব, মঞ্জুরি কমিশন এ ব্যাপারে অচিরেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করবে। আমি নিজে অতীতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা দুর্নীতির তদন্ত করেছিলাম। সেই রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া আছে। এখন নতুন আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা দরকার।
একজন ভিসির কথা আমরা সংবাদ মাধ্যমসূত্রে জানতে পেরেছি। আরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশি একই পরিস্থিতি। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির কাহিনী তো আরও ভয়াবহ। তিনি তার আত্মীয়-স্বজনকে চাকরি দিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। খুলনা কিংবা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েও (কুষ্টিয়া) এখন এমনি খবরের জন্ম দিয়েছেন ভিসি মহোদয়গণ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকার বিনিময়ে শিক্ষক নিয়োগের অভিযোগও পত্রপত্রিকায় এসেছে। এসব 'খবর' একজন শিক্ষক হিসেবে আমাকে আহত করে। আমি শিক্ষকতায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। একজন উপাচার্যের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। সবাই উপাচার্য হতে পারেন না। একজন উপাচার্যের কুশপুত্তলিকা যখন দাহ করা হয়, তখন এর চেয়ে আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। তাই সময় এসেছে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার। একজন অধ্যাপকের রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে। তাতে আমি দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন, তা কাম্য হতে পারে না। একজন রাজনৈতিক ব্যক্তি যখন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন, তখন তিনি রাজনৈতিক কর্মীদেরই 'শিক্ষক' হিসেবে নিয়োগ দেবেন_ এটাই স্বাভাবিক। তাই উপাচার্য নিয়োগের পদ্ধতিটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার সময় এসেছে। ইউজিসি বিষয়টি নিয়ে ভাবতে পারে। সেই সঙ্গে ভিসিদের আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। ভিসি হলেই তিনি সবকিছুর ঊধর্ে্ব নন। তিনি সবকিছু করতেও পারেন না। সিন্ডিকেটের নামে নিজের বিশেষ উদ্দেশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর চাপিয়ে দেবেন, এখানে কোনো দায়বদ্ধতা থাকবে না তা হতে পারে না।
Daily SAMAKAL
23.10.12

0 comments:

Post a Comment