দ্বিতীয়বার
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা প্রথম
বিদেশ সফরে মিয়ানমার আসছেন ১৯ নভেম্বর। ওই সময় তিনি কম্বোডিয়ায় অনুষ্ঠিত
আশিয়ান শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দেবেন। ওবামার মিয়ানমার সফরের গুরুত্ব অনেক।
মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট ‘সিভিলিয়ান’ হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর তার দেশের
‘দুয়াল খুলে দিয়েছেন।’ মিয়ানমারে প্রথমবারের মতো একজন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ,
কোকাকোলার অফিস খোলা এবং সর্বশেষ ওবামার মিয়ানমার সফর প্রমাণ করে মার্কিন
প্রশাসন পরিবর্তিত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে মিয়ানমারকে কত গুরুত্ব দিচ্ছে।
শুধু তাই নয়, ওবামার উপস্থিতিতে থাইল্যান্ডে যে যুক্তরাষ্ট্র-থাইল্যান্ড
সামরিক মহড়া অনুষ্ঠিত হবে, তাতে অংশ নিতে মিয়ানমারকেও আমন্ত্রণ জানানো
হয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই, দক্ষিণ এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চল ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র
যে স্ট্র্যাটেজি রচনা করছে তাতে মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যেই
মূলত ওবামা মিয়ানমারে আসছেন। ওই স্ট্র্যাটেজিতে বাংলাদেশও রয়েছে। পাঠক
স্মরণ করার চেষ্টা করুন, টাইমস অব ইন্ডিয়ার অন লাইন সংস্করণে একটি সংবাদ
পরিবেশিত হয়েছিল গত ৩১ মে। তাতে বলা হয়েছিল চট্টগ্রামে ঘাঁটি গড়ছে মার্কিন
সপ্তম নৌবহর! যদিও বাংলাদেশ সরকার তা অস্বীকার করেছে। হিলারি ক্লিনটনের
বাংলাদেশ সফরের সময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল বলেও সংবাদটিতে উল্লেখ করা
হয়েছিল। দক্ষিণ চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি বেড়ে
যাওয়ার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এ রকমটি চাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র একই সঙ্গে
বাংলাদেশের সঙ্গে ‘আকসা’ নামে একটি চুক্তিও করতে চাচ্ছে।
বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে নানা কারণে। প্রথমত, ভারত মহাসগরীয় অঞ্চলে চীনের নৌবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে সেখানে যে ‘শূন্যতার’ সৃষ্টি হবে, সেই শূন্যতা পূরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘শান্তিরক্ষী’ বাহিনী গঠন করা, যারা ২০১৪ সালে মার্কিন সৈন্যদের পরিবর্তে আফগানিস্তানে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইসলামিক কট্টরপন্থিরা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন করে একটি ঘাঁটি গড়তে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মোর্চা গঠন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিপুল জ্বালানি সম্পদ রয়েছে গভীর সমুদ্রে। মার্কিন আইওসির এ ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের জন্য এ কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অবস্থান করে খুব সহজেই মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় এবং বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী চীনের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে প্রভাব খাটানো সম্ভব। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর পরই বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। ‘আকসা’ চুক্তি এ লক্ষ্যেই স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হিলারির সফরের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল একটি যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর। এই সংলাপের আওতায় বছরে একবার বাংলাদেশ ও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা মিলিত হবেন। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধবোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা নানাভাবে বিশ্লেষণ হতে পারে। সন্ত্রাসবাদ রোধে সহযোগিতার আলোকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন। আরো একটা কথা। তরুণদের এক সমাবেশে হিলারি ক্লিনটন যখন বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কথা বলেন, তখন আমাদের প্রখ্যাত মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্ট রবার্ট কাপলানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাপলান লিখেছেন দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির উদ্দেশ্য একটাই-আর তা হচ্ছে চীনের প্রভাবকে সংকুচিত করা। বাংলাদেশের অবস্থান তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের আকৃষ্ট করবে। মার্কিন স্ট্র্যাটেজিতে ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। চীন ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌ-শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। চীন এ অঞ্চলে ‘মুক্তারমালার’ মতো বিভিন্ন সামুদ্রিক বন্দরে তার অবস্থান শক্তিশালী করে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। চীনের ‘মুক্তমালার’যে নেটওয়ার্ক, তাতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত গাওদার সমুদ্রবন্দর একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে ভারত মহাসাগর পার হয়ে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এ পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীন যে তেল আমদানি করে তার ৮০ ভাগ এই মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীনে যায়। তাই সঙ্গত কারণেই চীনের জন্য তার ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাওদারে চীনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিটও থাকবে, যা কি-না ভারত মহাসাগরের সব নৌম্যুভমেন্ট মনিটর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব আরো বেড়েছে। স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৮০ নটিক্যাল মাইল। আর ইরান সীমান্ত রয়েছে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। চীন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে গাওদার সমুদ্র ন্দর উন্নয়নে। চীন তার দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস এই গাওদার বন্দর দিয়েই পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। চীন শ্রীলঙ্কার হামবানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে চীন শ্রীলঙ্কার সরকারকে সমর্থন করেছিল। মিয়ানমারে রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর একটি রাডার স্টেশন। সিটওয়েসহ আরো বেশক’টি বন্দরে রয়েছে চীনা উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা গড়ে তুলছে তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চীনের এই জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করা ও চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম একটি পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি সেই স্ট্র্যাটেজিকে সামনে রেখেই এখন যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ চুক্তি করতে আগ্রহী হয়েছে। আকসা চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। যতদূর জানা গেছে, এ ধরনের চুক্তি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। প্রস্তাবিত আকসা চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ‘গাইডেড মিসাইল’সহ বেশ কয়েক ধরনের আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করবে। এসব অস্ত্র ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সহযোগিতা দেয়ার কথাও রয়েছে। এছাড়া থাকবে যৌথ মহড়া ও সংলাপের ব্যবস্থা। প্রস্তাবিত ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রাবিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার জন্য বাংলাদেশে ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত এই চুক্তিটির এক সময় নাম ছিল ‘ন্যাটো মিউচ্যুয়াল সার্পোট অ্যাক্ট’। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও সরবরাহ বিনিময় সহজ করার জন্য এটি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ওই অ্যাক্টে পরিবর্তন আনা হয়, যাতে করে ন্যাটোর সদস্য নয়, এমন দেশগুলোর সঙ্গে এ ধরনের একটি চুক্তি করা যায়। চুক্তিটির নামেও পরিবর্তন আনা হয়। চুক্তিটি এখন ‘আকসা’ চুক্তি নামে পরিচিত।
‘আকসা’ চুক্তি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে না; বরং বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, বাংলাদেশ সেই পরিকল্পনার যদি অংশ হয়, তাহলে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে। একইভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতেও বাধ্য। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজির অংশ হতে পারি না। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্তিও খুব কম। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর ও তথাকথিত প্রশিক্ষণগ্রহণ করে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারব না। তাই প্রস্তাবিত চুক্তিটি স্বাক্ষরের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ, বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া জরুরি। চুক্তিটি নিয়ে সংসদে আলোচনা করারও প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের একটি চুক্তি বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের উসকে দিতে পারে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও বেড়ে যেতে পারে, যা কোনোমতেই কাম্য নয়। সংসদকে অবহিত না করে এ ধরনের একটি চুক্তি যদি করা হয়, তাহলে সেই চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
সুতরাং বাংলাদেশ যখন ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির একটা অংশ হতে যাচ্ছে, ঠিক তখন মিয়ানমার সফরে আসছেন ওবামা। দীর্ঘদিন মিয়ানমার মার্কিন প্রশাসনের কাছে ছিল একটি ‘নিষিদ্ধ রাষ্ট্র’। সব ধরনের সাহায্য, বাণিজ্য বন্ধ ছিল। এখন পরিবর্তন আসছে মিয়ানমারে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি, তাতে মিয়ানমারকে যুক্ত করতে চায় মার্কিন প্রশাসন। চলতি বছরের জুন মাসে সিঙ্গাপুরে বিখ্যাত সাংগ্রিলা ‘ডায়লগ’-এর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিবছরই এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এটা মূলত নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটা শীর্ষ সম্মেলন। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রণতরীর সংখ্যা বাড়াবে। ২০১৩ সালে এই রণতরীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬-এ। সুতরাং মার্কিন রণতরী চট্টগ্রাম বন্দরের ‘পোর্ট অব কল’-এর সুবিধা নেবে, তা বলাই বাহুল্য। এ জন্যই তাদের প্রয়োজন ‘আকসা’ চুক্তি। সম্ভবত এটা বিবেচনায় নিয়েই ভারতীয় পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল যে, চট্টগ্রাম বন্দরে ঘাঁটি গাড়ছে মার্কিন নৌবাহিনী। ওবামার মিয়ানমার সফর তাই নিছক সাধারণ একটি রাষ্ট্রীয় সফর নয়। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি ও এ অঞ্চলের দেশগুলোর (ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান) সমন্বয়ে চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে (ভারত, বাংলাদেশ এবং সম্ভাব্য মিয়ানমার) চীনের বিরুদ্ধে আরেকটি অ্যালয়েন্স গড়ে তোলা। উদ্দেশ্য একটাই-‘চীনকে ঘিরে ফেলার’ একটি নীতি। এই স্ট্র্যাটেজিতে মিয়ানমার নিজেকে জড়িত করবে বলে মনে হয় না। খুব দ্রুত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। এ থেকে বাংলাদেশ কতটুকু সুবিধা নিতে পারে, সেটাই এখন লক্ষ্য করার বিষয়।
Daily MANOBKONTHO
18.11.12
বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে নানা কারণে। প্রথমত, ভারত মহাসগরীয় অঞ্চলে চীনের নৌবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে সেখানে যে ‘শূন্যতার’ সৃষ্টি হবে, সেই শূন্যতা পূরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘শান্তিরক্ষী’ বাহিনী গঠন করা, যারা ২০১৪ সালে মার্কিন সৈন্যদের পরিবর্তে আফগানিস্তানে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইসলামিক কট্টরপন্থিরা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন করে একটি ঘাঁটি গড়তে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মোর্চা গঠন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের বিপুল জ্বালানি সম্পদ রয়েছে গভীর সমুদ্রে। মার্কিন আইওসির এ ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের জন্য এ কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অবস্থান করে খুব সহজেই মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় এবং বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী চীনের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে প্রভাব খাটানো সম্ভব। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর পরই বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। ‘আকসা’ চুক্তি এ লক্ষ্যেই স্বাক্ষরিত হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
হিলারির সফরের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল একটি যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি স্বাক্ষর। এই সংলাপের আওতায় বছরে একবার বাংলাদেশ ও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা মিলিত হবেন। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধবোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা নানাভাবে বিশ্লেষণ হতে পারে। সন্ত্রাসবাদ রোধে সহযোগিতার আলোকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন। আরো একটা কথা। তরুণদের এক সমাবেশে হিলারি ক্লিনটন যখন বাংলাদেশের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্বের কথা বলেন, তখন আমাদের প্রখ্যাত মার্কিন স্ট্র্যাটেজিস্ট রবার্ট কাপলানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাপলান লিখেছেন দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির উদ্দেশ্য একটাই-আর তা হচ্ছে চীনের প্রভাবকে সংকুচিত করা। বাংলাদেশের অবস্থান তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের আকৃষ্ট করবে। মার্কিন স্ট্র্যাটেজিতে ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। চীন ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌ-শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। চীন এ অঞ্চলে ‘মুক্তারমালার’ মতো বিভিন্ন সামুদ্রিক বন্দরে তার অবস্থান শক্তিশালী করে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। চীনের ‘মুক্তমালার’যে নেটওয়ার্ক, তাতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত গাওদার সমুদ্রবন্দর একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে ভারত মহাসাগর পার হয়ে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এ পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীন যে তেল আমদানি করে তার ৮০ ভাগ এই মালাক্কা প্রণালী হয়ে চীনে যায়। তাই সঙ্গত কারণেই চীনের জন্য তার ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাওদারে চীনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিটও থাকবে, যা কি-না ভারত মহাসাগরের সব নৌম্যুভমেন্ট মনিটর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব আরো বেড়েছে। স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৮০ নটিক্যাল মাইল। আর ইরান সীমান্ত রয়েছে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। চীন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে গাওদার সমুদ্র ন্দর উন্নয়নে। চীন তার দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস এই গাওদার বন্দর দিয়েই পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। চীন শ্রীলঙ্কার হামবানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে চীন শ্রীলঙ্কার সরকারকে সমর্থন করেছিল। মিয়ানমারে রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর একটি রাডার স্টেশন। সিটওয়েসহ আরো বেশক’টি বন্দরে রয়েছে চীনা উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা গড়ে তুলছে তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চীনের এই জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করা ও চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম একটি পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে স্ট্র্যাটেজি সেই স্ট্র্যাটেজিকে সামনে রেখেই এখন যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ চুক্তি করতে আগ্রহী হয়েছে। আকসা চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়নি। যতদূর জানা গেছে, এ ধরনের চুক্তি অত্যন্ত স্পর্শকাতর। প্রস্তাবিত আকসা চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে ‘গাইডেড মিসাইল’সহ বেশ কয়েক ধরনের আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করবে। এসব অস্ত্র ব্যবহারের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সহযোগিতা দেয়ার কথাও রয়েছে। এছাড়া থাকবে যৌথ মহড়া ও সংলাপের ব্যবস্থা। প্রস্তাবিত ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনী জ্বালানি সংগ্রহ, যাত্রাবিরতি, সাময়িক অবস্থানসহ এ ধরনের বিভিন্ন সুবিধার জন্য বাংলাদেশে ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতিরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, প্রস্তাবিত এই চুক্তিটির এক সময় নাম ছিল ‘ন্যাটো মিউচ্যুয়াল সার্পোট অ্যাক্ট’। যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা ও সরবরাহ বিনিময় সহজ করার জন্য এটি করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে ওই অ্যাক্টে পরিবর্তন আনা হয়, যাতে করে ন্যাটোর সদস্য নয়, এমন দেশগুলোর সঙ্গে এ ধরনের একটি চুক্তি করা যায়। চুক্তিটির নামেও পরিবর্তন আনা হয়। চুক্তিটি এখন ‘আকসা’ চুক্তি নামে পরিচিত।
‘আকসা’ চুক্তি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করবে না; বরং বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতির যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে, বাংলাদেশ সেই পরিকল্পনার যদি অংশ হয়, তাহলে বাংলাদেশ বহির্বিশ্বে ইমেজ সংকটের মুখে পড়বে। একইভাবে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতেও বাধ্য। আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজির অংশ হতে পারি না। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্তিও খুব কম। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর ও তথাকথিত প্রশিক্ষণগ্রহণ করে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পারব না। তাই প্রস্তাবিত চুক্তিটি স্বাক্ষরের আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ, বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া জরুরি। চুক্তিটি নিয়ে সংসদে আলোচনা করারও প্রয়োজন রয়েছে। এ ধরনের একটি চুক্তি বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের উসকে দিতে পারে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও বেড়ে যেতে পারে, যা কোনোমতেই কাম্য নয়। সংসদকে অবহিত না করে এ ধরনের একটি চুক্তি যদি করা হয়, তাহলে সেই চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
সুতরাং বাংলাদেশ যখন ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজির একটা অংশ হতে যাচ্ছে, ঠিক তখন মিয়ানমার সফরে আসছেন ওবামা। দীর্ঘদিন মিয়ানমার মার্কিন প্রশাসনের কাছে ছিল একটি ‘নিষিদ্ধ রাষ্ট্র’। সব ধরনের সাহায্য, বাণিজ্য বন্ধ ছিল। এখন পরিবর্তন আসছে মিয়ানমারে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি, তাতে মিয়ানমারকে যুক্ত করতে চায় মার্কিন প্রশাসন। চলতি বছরের জুন মাসে সিঙ্গাপুরে বিখ্যাত সাংগ্রিলা ‘ডায়লগ’-এর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতিবছরই এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এটা মূলত নিরাপত্তা সংক্রান্ত একটা শীর্ষ সম্মেলন। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লিওন প্যানেট্টা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রণতরীর সংখ্যা বাড়াবে। ২০১৩ সালে এই রণতরীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬-এ। সুতরাং মার্কিন রণতরী চট্টগ্রাম বন্দরের ‘পোর্ট অব কল’-এর সুবিধা নেবে, তা বলাই বাহুল্য। এ জন্যই তাদের প্রয়োজন ‘আকসা’ চুক্তি। সম্ভবত এটা বিবেচনায় নিয়েই ভারতীয় পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছিল যে, চট্টগ্রাম বন্দরে ঘাঁটি গাড়ছে মার্কিন নৌবাহিনী। ওবামার মিয়ানমার সফর তাই নিছক সাধারণ একটি রাষ্ট্রীয় সফর নয়। দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন নৌবাহিনীর উপস্থিতি ও এ অঞ্চলের দেশগুলোর (ফিলিপাইন, তাইওয়ান, জাপান) সমন্বয়ে চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে (ভারত, বাংলাদেশ এবং সম্ভাব্য মিয়ানমার) চীনের বিরুদ্ধে আরেকটি অ্যালয়েন্স গড়ে তোলা। উদ্দেশ্য একটাই-‘চীনকে ঘিরে ফেলার’ একটি নীতি। এই স্ট্র্যাটেজিতে মিয়ানমার নিজেকে জড়িত করবে বলে মনে হয় না। খুব দ্রুত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির প্রেক্ষাপট বদলে যাচ্ছে। এ থেকে বাংলাদেশ কতটুকু সুবিধা নিতে পারে, সেটাই এখন লক্ষ্য করার বিষয়।
Daily MANOBKONTHO
18.11.12
0 comments:
Post a Comment