রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

ওবামার দ্বিতীয় টার্ম ও বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক


ওয়াশিংটনে বারাক ওবামার দ্বিতীয় টার্মের বিজয় উৎসব যখন শেষ হয়ে যায়নি, ঠিক তখনই ঢাকায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আবারো একটি বেফাঁস মন্তব্য করে বসলেন। বললেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে ড. ইউনূস। সম্পূর্ণ প্রসঙ্গ বহির্ভূতভাবে তিনি এই মন্তব্যটি করেন। ড. ইউনূস এই মুহূর্তে দেশে নেই। তিনি বিদেশে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করছেন। ওবামার বিজয়ের সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্যের একটি যোগসূত্র আছে। আর তা হচ্ছে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক। ড. ইউনূসকে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের নেতিবাচক মনোভাব মার্কিন প্রশাসন কখনোই ভালো চোখে দেখেনি। এ নিয়ে একাধিকবার তাদের মন্তব্য পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতও এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। ড. ইউনূসকে নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের নেতিবাচক মনোভাব দুই দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। কেননা ডেমোক্রেটরা বরাবরই ড. ইউনূসকে একটি ভিন্ন চোখে দেখে আসছেন। ক্লিনটন পরিবারের বন্ধু তিনি। হিলারি ক্লিনটন ওবামার দ্বিতীয় টার্মে প্রশাসন না থাকলেও, তার একটি প্রভাব থেকে যাবে। তাঁকে ২০১৬ সালের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ড. ইউনূস তার ব্যক্তিগত বন্ধুও। সুতরাং ড. ইউনূসকে নিয়ে সরকারের কর্মকর্তাদের বারবার মন্তব্য, মার্কিন প্রশাসন আদৌ ভালো চোখে নেবে না। সম্পর্কের প্রশ্নে প্রস্তাবিত 'টিকফা' চুক্তি নিয়েও কথা আছে। একবার তো মার্কিন রাষ্ট্রদূত মজিনা প্রকাশ্যেই বলেছিলেন 'টিকফা' না হলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকে কোনো সুবিধা পাবে না। এমনকি রপ্তানি ক্ষেত্রে সমস্যাও তৈরি হতে পারে। 'আকসা' চুক্তির প্রস্তাব করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরের সময় একটি 'অংশিদারিত্ব সংলাপ' চুক্তি করেছিল বাংলাদেশ। এই চুক্তি নিয়েও কথা আছে। তবে এই মুহূর্তে আলোচিত বিষয় হচ্ছে 'টিকফা' চুক্তির ভবিষ্যৎ। এই চুক্তিটি আসলে কী, কিংবা এতে করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আমরা অনেকেই জানি না। সংবাদপত্রেও এটা নিয়ে খুব একটা আলোচনাও হয়নি। তবে মজিনা বলেছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষিত হবে। কীভাবে হবে, তা অবশ্য তিনি বিস্তারিত বলেননি। এমনকি এই চুক্তির সঙ্গে 'টিফা' বা টিআইইএফএ চুক্তির কোনো যোগ আছে কি না, তাও আমরা নিশ্চিত নই। যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই 'টিফা' চুক্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। তখন বাংলাদেশের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র টিআইসিএফ চুক্তি করার প্রস্তাব করেছিল। চুক্তিটির পূর্ণ নাম হচ্ছে 'ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট'। বাংলাদেশ যদি এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করে তাহলে বাংলাদেশ পাইরেটেড কোনো পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। শ্রমিকের মানও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। তাছাড়া ওষুধ প্রস্তুত ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডবিস্নউটিও'র কাছ থেকে ট্রিপসের আওতায় যে সুবিধা ভোগ করছে, তাও বাতিল হতে পারে। আসলে টিআইইএফের এরই বিকল্প নাম হচ্ছে 'টিফা'। এর বিস্তারিত কোন পক্ষ থেকেই উপস্থাপন না করায়, তাতে নানা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি চুক্তির প্রস্তাব করে। তখন এর নাম ছিল 'ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট' বা 'টিফা'। ২০০২ সালে প্রণীত টিফার প্রথম খসড়াটিতে ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কোন কোন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আপত্তি থাকায় ২০০৫ সালে সংশোধিত টিফায় ৭টি ধারা ও ১৯টি প্রস্তাবনা বহাল থাকে। ওই সময় সংশোধিত টিফায় ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে বিনিয়োগ বাতিল করাসহ মামলার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টিও শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র টিফা চুক্তির খসড়ায় ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রস্তাবনায় মেধাস্বত্ব অধিকার, আন্তর্জাতিক শ্রম মান ও পরিবেশগত সুরক্ষা-এই তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। শুধু এই তিনটি ধারাই নয়, বরং টিফা চুক্তির একাধিক ধারা ছিল বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। যেমন বলা যেতে পারে মেধাস্বত্ব আইন। এটা মানলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ধস নামবে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রায় ৫৫টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে। বাংলাদেশের ওষুধের মান আন্তর্জাতিক মানের। এখন মেধাস্বত্বের শর্তের কারণে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশের ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্য সংশ্লিষ্ট দেয়া বা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অধিকার রয়েছে। ওষুধের পেটেন্ট ব্যবহার করেই বাংলাদেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ তৈরি করছে, যা দিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুযোগ ভোগ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে কি-না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে শ্রমমানের কথা বলছে, সেটা নিয়েও কথা আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট আইএলওর মান বজায় রাখা কঠিন। ইউরোপের একজন শ্রমিক যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন এবং শ্রমিকদের যে মান, তার সাথে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মানের বিচার করা যাবে না। ইউরোপে একজন শ্রমিকের যে অধিকার, সেই অধিকার বাংলাদেশের শ্রমিকদের নেই। এটাই বাস্তব। এই বাস্তবতা মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব শ্রমিক মানকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের শ্রমমানকে বিচার করা যাবে না। সুতরাং আজ 'টিকফা' বলি, আর টিফা চুক্তি বলি, কোন চুক্তিই বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করবে না। বরং এ ধরনের চুক্তি মার্কিনীদের স্বার্থই রক্ষা করবে মাত্র। এ ধরনের কোন চুক্তির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটাযুক্ত প্রবেশাধিকারকে কোনোমতেই মেলানো যাবে না। শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার আমাদেও অধিকার। আমরা তো একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগ দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি) থেকেও কোন সাহায্য পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভিন্ন দেশকে বড় অঙ্কের মজুরি সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এমসিসি গঠন করেছিল মার্কিন কংগ্রেস। এর যুক্তি হিসেবে সুস্পষ্টভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া না হলেও ধারণা করা হচ্ছে গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিনিয়োগের পরিবেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এমসিসি থেকে বাংলাদেশকে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ড. ইউনূসের বিষয়টিও যে অন্যতম একটি কারণ, তা জোসেফ ক্রাউলির একটি মন্তব্য থেকে জানা যায়। জোসেফ ক্রাউলি মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান। পদ্মা সেতু নিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। আর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন 'টিকফা' চুক্তি না হলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি। নিঃসন্দেহে এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র এখানে নাক গলাতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো আমরা যেমনি শ্রমমান নির্ধারণ করতে পারি না। ঠিক তেমনি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা আমাদের যে সুযোগ দিয়েছে, সেই সুযোগ আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। ওবামার নীতিতে, বিশেষ করে দক্ষিণ এশীয় নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না। তবে ১৯ নভেম্বর মিয়ানমার আসছেন ওবামা। এর মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিনি নীতিতে বড় পরিবর্তন আসছে। মিয়ানমার একটি 'দুয়ার খোলা নীতি' গ্রহণ করায় মিয়ানমার-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নতুন দিকে টার্ন নিতে পারে। এ থেকে আমরা সুবিধা নিতে পারতাম। কিন্তু আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতে এই বিষয়টি উষ্ণ। মিয়ানমারের পাশাপাশি ওবামাকে যদি বাংলাদেশে সফর করার ব্যবস্থা করা যেত, তাহলে তা বহির্বিশ্বে আমাদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করতে পারত। এই সুযোগটি আমরা কাজে লাগাতে পারলাম না। ওবামার দ্বিতীয় টার্মে বাংলাদেশের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে না। এই সম্পর্ককে আরো উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটি আজ পালন করতে হবে বাংলাদেশকেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফর ভালোবাসেন। কিন্তু শুধু বিদেশ সফর দিয়ে একটা দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তন আনা যায় না।Daily JAI JAI DIN17.11.12

0 comments:

Post a Comment