রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সম্পর্কে কী আদৌ পরিবর্তন আসবে?

 প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বিতীয় টার্মে বিজয় ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারি কিনটনের সম্ভাব্য বিদায়ের মধ্যদিয়ে যে প্রশ্নটি এখন উঠেছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিনি নীতিতে আদৌ পরিবর্তন আসবে কী না? যারা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের কিছুটা খোঁজ খবর রাখেন, তারা জানেন বেশ কিছু বিষয় নিয়ে দু’দেশের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। অধ্যাপক ইউনূসের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের অসন্তোষের খবর আমরা সবাই জানি। ওবামার নির্বাচনের পরদিনও অর্থমন্ত্রী পুনরায় অধ্যাপক ইউনূস সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। এর ফলে ওবামার নয়া প্রশাসন বিষয়টি খুব ভালো চোখে দেখবে বলেও মনে হয় না। ড. ইউনূস ইস্যুর বাইরেও ‘টিকফা’ ও ‘আকসা’ চুক্তি নিয়ে দু’ দেশের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে। দু’টো চুক্তিই স্বাক্ষরিত হয়নি। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি ‘চাপ’ আছে। এমনকি ‘টিকফা’ চুক্তি স্বাক্ষরিত না হলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক যুক্তরাষ্ট্রে কোনো সুবিধা পাবে না, এমন কথাও বলেছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা।  তার বক্তব্য পত্র-পত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। এখন বাংলাদেশ ওবামা প্রশাসনের সমর্থন পেতে ‘টিকফা’ এবং ‘আকসা’ চুক্তি স্বাক্ষর করে কী না সেটাই দেখার বিষয়। তবে এ দেশের মানুষ জানে না ‘টিকফা’ চুক্তি কী? এই চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, সে ব্যাপারেও আমরা স্পষ্ট নই। দুঃখজনক হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে বিদেশে, এ ধরনের চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের আমলে এ ধরনের কোনো চুক্তি নিয়ে সংসদে আমরা আলোচনা হতে দেখিনি। মজিনার কথাবার্তা থেকে মনে হয়েছে বাংলাদেশী পণ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর বাংলাদেশী পণ্য মানেই তো তৈরি পোশাক। সেই তৈরি পোশাক রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তার একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্র মূলত প্রেসার খাটিয়ে সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। হিলারি কিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় একটি ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। এ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কিছুই নেই। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ নামে একটি চুক্তির প্রস্তাব করেছিল। ‘আকসা’ চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সুষ্টি হবে। এই উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে আগামীতে। ‘আকসা’ চুক্তি প্রস্তাবের রেশ ফুরিয়ে যাবার আগেই মজিনা বললেন, ‘টিকফা’ চুক্তির কথা। এই চুক্তিটি আসলে কী, কিংবা এতে করে আমরা কতটুকু উপকৃত হব, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আমরা অনেকেই জানি না। সংবাদপত্রেও এটা নিয়ে খুব একটা আলোচনা হয়নি। তবে মজিনা বলেছেন, এই চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষিত হবে। কীভাবে হবে, তা অবিশ্যি তিনি বিস্তারিত বলেননি। এমনকি এই চুক্তির সাথে ‘টিফা’ বা টিআইইএফএ চুক্তির কোনো যোগ আছে কীনা, তাও আমরা নিশ্চিত নই। যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই ‘টিফা’ চুক্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তাতে রাজী হয়নি। তখন বাংলাদেশের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র টিাইসিএফ চুক্তি করার প্রস্তাব করেছিল। চুক্তিটির পূর্ণ নাম হচ্ছে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইকনোমিক কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট’। বাংলাদেশ যদি এই চুক্তিটি স্বাক্ষর করে তাহলে বাংলাদেশ পাইরেটেড কোনো পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। শ্রমিকের মানও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। তাছাড়া ওষুধ প্রস্তুত ও রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেধশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডব্লিউটিওর কাছ থেকে ট্রিপসের আওতায় যে সুবিধা ভোগ করছে, তাও বাতিল হতে পারে। আসলে টিআইইএফএ’র এরই বিকল্প নাম হচ্ছে ‘টিফা’। এর বিস্তারিত কোনো পক্ষ থেকেই উপস্থাপন না করায় তাতে নানা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি চুক্তির প্রস্তাব করে। তখন এর নাম ছিল ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ বা ‘টিফা’। ২০০২ সালে প্রণীত টিফার প্রথম খসড়াটিতে ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কোনো  কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আপত্তি থাকায় ২০০৫ সালে সংশোধিত টিফায় ৭টি ধারা ও ১৯টি প্রস্তাবনা বহাল থাকে। ওই সময় সংশোধিত টিফায় ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে বিনিয়োগ বাতিল করাসহ মামলার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টিও শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়। যুক্তরাষ্ট্র টিফা চুক্তির খসড়ায় ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রস্তাবনায় মেধাস্বত্ব অধিকার, আন্তর্জাতিক শ্রমমান ও পরিবেশগত সুরক্ষাÑ এই তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। শুধু এই তিনটি ধারাই নয়, বরং টিফা চুক্তির একাধিক ধারা ছিল বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। যেমন বলা যেতে পারে মেধাস্বত্ব আইন। এটা মানলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ধস নামবে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রায় ৫৫টি দেশে ওষুধ রফতানি করে। বাংলাদেশের ওষুধের মান আন্তর্জাতিক মানের। এখন মেধাস্বত্বের শর্তের কারণে বাংলাদেশ অন্য দেশের ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশ বা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অধিকার রয়েছে। ওষুধের পেটেন্ট ব্যবহার করেই বাংলাদেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ তৈরি করছে, যা দিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুযোগ ভোগ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে কী না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে শ্রমমানের কথা বলছে, সেটা নিয়েও কথা আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে যে, বাংলাদেশের  শ্রমিকদের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইএলও’র মান বজায় রাখা কঠিন। ইউরোপের একজন শ্রমিক যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন এবং শ্রমিকদের যে মান, তার সাথে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মানের বিচার করা যাবে না। ইউরোপে একজন শ্রমিকের যে অধিকার, সেই অধিকার বাংলাদেশের শ্রমিকদের নেই। এটাই বাস্তব। এই বাস্তবতা মানতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিশ্ব শ্রমিক মানকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের শ্রমমানকে বিচার করা যাবে না। সুতরাং আজ ‘টিকফা’ বলি আর টিফা চুক্তি বলি, কোনো চুক্তিই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করবে না। বরং এ ধরনের চুক্তি মার্কিনীদের স্বার্থই রক্ষা করবে মাত্র। এ ধরনের কোনো চুক্তির সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারকে কোনো মতেই মেলানো যাবে না। শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার আমাদের অধিকার। আমরা তো একের পর এক যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগ দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি). থেকেও কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভিন্ন দেশকে বড় অঙ্কের মঞ্জুরি সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এমসিসি গঠন করেছিল মার্কিন কংগ্রেস। এর যুক্তি হিসেবে সুস্পষ্টভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া না হলেও ধারণা করা হচ্ছে গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিনিয়োগের পরিবেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এমসিসি থেকে বাংলাদেশকে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ড. ইউনূসের বিষয়টিও যে অন্যতম একটি কারণ, তা জোসেফ ক্রাউলির একটি মন্তব্য থেকে জানা যায়। জোসেফ ক্রাউলি মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো-চেয়ারম্যান।
পদ্মা সেতু নিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়টি এখানে প্রাধান্য পাচ্ছে বেশি। আর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘টিকফা’ চুক্তি না হলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি। নিঃসন্দেহে এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র এখানে নাক গলাতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কথা মতো আমরা যেমনি শ্রমমান নির্ধারণ করতে পারি না, ঠিক তেমনি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা আমাদের যে সুযোগ দিয়েছে, সেই সুযোগ আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। আমরা সমমর্যাদা ভিত্তিক সম্পর্ক চাই। হিলারি কিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়েও কথা আছে। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে ভারত মহাসাগরে ৭ম নৌবহর ঘাঁটি তৈরি করতে পারেÑ এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘চীনকে ঘিরে ফেলার নীতি গ্রহণ করা। ওবামার প্রথম শাসনের সাথে চীনের সম্পর্ক ভালো ছিল না। চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যের (৫৩৯ বিলিয়ন ডলার) নিয়েও কথা আছে। পূর্ব এশিয়ায়ও যুক্তরাষ্ট্র চীন বিরোধী একটি এলায়েন্স গড়ে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকার সাথে বাংলাদেশ নিজেকে সম্পর্কিত করতে পারে না। তাই ওবামার দ্বিতীয় টার্মে দু’ দেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নত হবেÑ এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং আমি আশঙ্কা করছি বাংলাদেশের উপর মার্কিনি চাপ আরো বাড়বে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ওবামা প্রশাসনকে কতটুকু ছাড় দেয় সেটাই দেখার বিষয়। আমাদের প্রত্যাশ্যা বাংলাদেশ সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক গড়ে তুলুক। যেখানে আমাদের কোনো ‘স্বার্থ’ নেই, সেখানে বা সেইসব চুক্তিতে আমরা স্বাক্ষর করতে পারি না। আমরা ভারত-মার্কিনি স্বার্থে আমাদের জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিতে পারি না।

0 comments:

Post a Comment