মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামার বিজয়ের পর যে
প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে— তিনি কি একটি স্থিতিশীল অর্থনীতি
উপহার দিতে পারবেন? নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি বারবারই বলছিলেন, তাকে
আরেকবার সুযোগ দেয়া হোক, যাতে করে যেসব কর্মসূচি তিনি হাতে নিয়েছেন, তা শেষ
করতে পারেন। তার এসব কর্মসূচির অন্যতম হচ্ছে সবার জন্য চাকরির ব্যবস্থা
করা। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব ভালো, তা বলা যাবে না। সবশেষ
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ লাখ ৭১ হাজার মানুষ চাকরি পেলেও পরিস্থিতি আদৌ ভালো
নয়। সদ্য পাস গ্রাজুয়েটরা চাকরি পাচ্ছেন না। একটি চাকরির জন্য
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চারজন করে। মোট জনসংখ্যার প্রতি তিনজনের একজন গরিব।
৪৯ দশমিক ১ মিলিয়ন মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। আর ৪৭ দশমিক ৮
শতাংশ পরিবার কোনো না কোনোভাবে ‘ফুড স্ট্যাম্প’ তথা খাদ্য সহায়তার ওপর
নির্ভরশীল। ওবামার বিজয় কি তাদেরকে আদৌ আশাবাদী করবে? যে বিশাল জনগোষ্ঠী
দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে, তাদের কি তিনি ‘দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র’
থেকে বের করে আনতে পারবেন?
তার বিজয়ের মধ্য দিয়ে এসব প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে মনে আছে, যুক্তরাষ্ট্রের
সমাজে অসততা, দরিদ্রতা আর বৈষম্যের প্রতিবাদে ‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’-এর জন্ম
হয়েছে। সে মুভমেন্ট এরই মধ্যে পার করেছে ৪২০ দিন।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন ও সমাজতন্ত্রের পতনের পর
বিশ্বব্যাপী একটি ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, পুঁজিবাদই সমাজের মঙ্গল আনতে
পারে(?)। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কনজারভেটিভ তাত্ত্বিক (ফুকুয়ামা) এ ধারণার
সপক্ষে তাদের লেখনি অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই প্রমাণ
হলো, পুঁজিবাদও সমাজ বিকাশে কোনো অবদান রাখতে পারছে না; পুঁজিবাদী সমাজেই
বড় বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কথা। ১৫ শতাংশ মানুষ
সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের পাঁচ ভাগের
এক ভাগের মালিক জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট
আয়ের ৮-৯ শতাংশ সঞ্চিত হতো। ২০১১ সালে তারা ভোগ করেন মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫
শতাংশ। ১০ শতাংশ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ ভোগ করেন।
শীর্ষে থাকা ১ শতাংশ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ শতাংশের
মালিক। আর জোসেফ স্টিগলিেজর মতে, শীর্ষে থাকা এ ১ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করেন
যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশ। এ ধনীরা এক রাতে জুয়া খেলায় হেরে যান
লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে
Casino Capitalism। আরেক পরিসংখ্যান বলে, সেখানে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন অর্থাৎ ১
কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। জুকোট্টি পার্কে জমায়েত হওয়া অনেক তরুণ
জানিয়েছিলেন, তারা গ্রাজুয়েশন সম্পন্নের পর চাকরি পাচ্ছেন না। অথচ ২০১০
সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছিল ২৩ শতাংশ।
যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এই যে বৈষম্য, এ ধরনের বৈষম্য লক্ষ করা যায় পশ্চিম
ইউরোপের অনেক দেশেই।
এক ধরনের ‘Class Warfare’ বা শ্রেণী যুদ্ধের সূচনা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে।
অক্যুপাই মুভমেন্টগুলো তার বড় প্রমাণ। এ শ্রেণী যুদ্ধের কথা বলেছিলেন
কার্ল মার্কস। মার্কসের বিশ্লেষণে এমন শ্রেণী দ্বন্দ্ব কোনো সমাজে বিপ্লবের
সূচনা করতে পারে। মার্কস ও এঙ্গেলস বিখ্যাত The Communist Manifesto
গ্রন্থে এ দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, ‘a fight that each time
ended, either in a revolutionary reconstitution of society at large, or
in the common ruin of the contending clases.’ অর্থাৎ দ্বন্দ্বের ফলে
সমাজে বিপ্লবী পরিবর্তন আসবে অথবা উভয় শ্রেণীর বিলুপ্তি ঘটবে। মার্কস
চূড়ান্ত বিচারে শোষিত শ্রেণীর ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলেছিলেন। সমাজে শ্রেণী
দ্বন্দ্ব সনাতন। আজ এত বছর পরও সেই শ্রেণী দ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটছে যেন
অক্যুপাই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মার্কস আজও বেঁচে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের এ
শ্রেণী দ্বন্দ্বকে কীভাবে বিশ্লেষণ করতেন, বলতে পারব না। তবে নোয়াম চমস্কির
লেখনিতে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজব্যবস্থার চমত্কার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তিনি
যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে আখ্যায়িত করেছেন Plutonomy হিসেবে অর্থাৎ সম্পদশালী
ধনী শ্রেণীনির্ভর একটি সমাজ। তিনি লিখেছেন, ‘Increasingly, wealth
concentrated in the financial sector. Politicians faced with the rising
cost of compaigns, were driven ever deeper into the packets of wealthy
backers.’— এটাই হচ্ছে আসল কথা। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ধনিক শ্রেণীর
হাতে। রাজনীতি, অর্থনীতি এরাই পরিচালনা করেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে বলা
হয় ‘Billionaire Friendly’। ধনিক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে কংগ্রেস।
ধনীদের টাকায় কংগ্রেস সদস্যরা নির্বাচিত হন। এরপর তারা ধনীদের আরও
সুযোগ-সুবিধা দেন। নোয়াম চমস্কি তাই আমেরিকার অক্যুপাই মুভমেন্টে এতটুকুও
অবাক হননি। তিনি লিখেছেন, ‘The most exciting aspect of the occupy
movement is the construction of the linkages that are talking place all
over. If they can be sustained and expanded, occupy can lead to
dedicated efforts to set society on a more humane course.’ মার্কস যেখানে
বিপ্লবের কথা বলেছেন, সেখানে চমস্কি বলছেন ‘More Human Course’-এর কথা।
সারা বিশ্বে যে অক্যুপাই মুভমেন্ট পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে একটা সমন্বয় থাকা
দরকার— এটাও চমস্কির অভিমত। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিবাদী সমাজে
একটি পরিবর্তন আসন্ন। কেননা দেখা যাচ্ছে, পুঁজিবাদী সমাজে অসমতা ও বৈষম্য
বাড়ছে। পশ্চিম ইউরোপ একসময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু দেখা
যাচ্ছে, ইউরোপীয় ঐক্যে বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিস ও ইতালির
পরিস্থিতির রেশ ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর বিভক্তির কথা প্রকাশ্যেই বলা
হচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি এ বিভক্তির পক্ষে। কেননা ইইউভুক্ত গরিব দেশগুলো
দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এরা ঋণ গ্রহণ করে পরিশোধ করতে পারছে না। প্রবৃদ্ধি কমে
গেছে। বেকার সমস্যা বাড়ছে। শ্রেণী বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। জার্মানি ইউরোপে ধনী
রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও দেশটিতে দারিদ্র্যের হার ৬ শতাংশ আর বেকারত্বের
হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সুইজারল্যান্ড ইইউ-এর সদস্য নয়। এখানে বেকারত্বের
হার ২ দশমিক ৮ আর ৭ শতাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বেলজিয়ামে এ
হার যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ ও ১৫ শতাংশ। পর্তুগাল ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। এখানে
বেকারত্ব ও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৩ ও
১৮ শতাংশ। শুধু ইউরোপের কথা কেন বলি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া
কিংবা তাইওয়ানের মতো শিল্পোন্নত দেশেও অক্যুপাই মুভমেন্টের খবর আমরা জানি।
কেননা এসব দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ওই সব
দেশেও অক্যুপাই মুভমেন্টের জন্ম হয়েছে।
বারাক ওবামার বিজয় তাই সঙ্গত কারণেই একটি প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে তরুণ
প্রজন্মের কাছে। তারা চাকরি চান। সবার জন্য চান স্বাস্থ্যসেবা। মার্কিন
জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের কোনো ‘হেলথ ইন্স্যুরেন্স’ নেই। ওবামা
স্বাস্থ্যসেবায় কিছু কাটছাঁট করতেও বাধ্য হয়েছিলেন। এখন দেখার বিষয়, তিনি
স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে কত দূর যান। ১৬ ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক ঘাটতি নিয়ে
ওবামা তার দ্বিতীয় টার্ম শুরু করবেন। তিনি নির্বাচনের আগে প্রতিশ্রুতি
দিয়েছিলেন, এ ঘাটতি চার ট্রিলিয়ন ডলারে কমিয়ে আনবেন। ১০ লাখ লোকের
কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার কর্মসূচি তার রয়েছে। মোটরগাড়িশিল্পকে বাঁচাতে
প্রণোদনা দেয়াটা সরকারের সফলতা বলে মনে করেন তিনি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে খুব একটা পরিবর্তন আসবে বলে মনে হয় না। ২০১৪ সালে
তিনি আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। ইরান ও
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির শান্তিপূর্ণ সমাধান চান তিনি। এতে করে
ইসরায়লি নেতৃত্ব যে খুশি হবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ওবামা জাতীয়
নিরাপত্তা সুরক্ষা ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় কৃতিত্ব দাবি করেছিলেন। ওসামা
বিন লাদেনকে হত্যার নির্দেশ তিনি দিয়েছিলেন। সামরিক ব্যয় বাড়ানোর বিপক্ষে
ওবামা। আগামী এক দশকে এ খাতে ব্যয় সাড়ে ৪৮ কোটি ডলার কমাতে চান তিনি।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না।
বরং বাংলাদেশকে কিছুটা হলেও যে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা গুরুত্ব দেন, সে
নীতি অব্যাহত থাকবে। মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট থেকে বাংলাদেশের
সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাও উজ্জ্বল। এর কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য জটিলতা রয়ে
গেছে। ‘টিকফা’ ও ‘আকসা’ চুক্তি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে কিছুটা মতপার্থক্য
রয়েছে। ওবামার বিজয়ের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশী তৈরি পোশাক
পণ্যের (আরএমজি) শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হলো। যদিও
শ্রমিকদের অধিকার, শ্রমিক নেতা আমিনুল হত্যাকাণ্ডের বিচার কিংবা অধ্যাপক
ইউনুস ‘ইস্যু’তে মার্কিন নীতিনির্ধারকরা কিছুটা ‘অসন্তুষ্ট’। তবে এটা কেটে
যাবে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করে।
ওবামার বিজয় প্রমাণ করল, ২০০৮ সালে যে আস্থা ও বিশ্বাস নিয়ে প্রথমবারের
মতো একজন আফ্রো-আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পথ প্রশস্ত
করেছিলেন, চার বছর পরও আমেরিকানরা আবারও তার ওপর আস্থা রাখলেন। এখন দেখার
বিষয়, তিনি সে ‘আস্থার’ কতটুকু মর্যাদা দেন।
Daily BONIK BARTA
09.11.12
0 comments:
Post a Comment