বাংলাদেশের রাজনীতি যখন ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, তখন বিরোধীদলীয়
নেত্রী খালেদা জিয়া বেইজিং ও নয়াদিলি্ল সফর করলেন। ধারণা করছি, ৬
নভেম্বরের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও
যাবেন এবং মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের সদস্যদের সঙ্গেও তিনি
মতবিনিময় করবেন। বিরোধীদলীয় নেত্রীর বিদেশ সফরের মধ্য দিয়ে সাধারণ
মানুষের মধ্যে এমন একটি ধারণার জন্ম হয়েছে যে, ক্ষমতার \'কেন্দ্র\' বদলে
যাচ্ছে এবং আওয়ামী লীগ তথা মহাজোট সরকারের \'ব্যর্থতা\'কে পুঁজি করে তিনি
সমর্থন আদায়ের (?) জন্য বেইজিং ও নয়াদিলি্ল সফর করছেন। বাংলাদেশের
রাজনীতির জন্য ভারত ও চীন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সাম্প্রতিক
সময়গুলোতে ভারত বাংলাদেশের রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে নানা
কারণে। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে রাজনীতি, তাতে ভারত একটি
গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে
প্রভাব ফেলছে, বাংলাদেশ সেই প্রভাবের বাইরে থাকতে পারে না। উপরন্তু ভারত
একটি অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। বিশ্বব্যাংকের উপদেষ্টা হরিন্দর কোহলির মতে,
আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। তখন
মাথাপিছু আয় ৯৪০ ডলার থেকে ২২ হাজার ডলারে গিয়ে দাঁড়াবে। ২০০৭ সালে
বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত যেখানে অবদান রাখত মাত্র ২ ভাগ, তখন অবদান রাখবে ১৭
ভাগ। সুতরাং এই অর্থনীতির প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশের ওপর পড়বেই।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা জানেন, একটি বড় দেশের পাশে যদি একটি ছোট
দেশ থাকে, তাহলে ওই বড় দেশ ছোট দেশের ওপর প্রভাব খাটায়। মেদভেদেভের
(রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী) ধারণা ্তুতড়হব ড়ভ
চৎরারষবমবফ ওহঃবৎবংঃ্থ অনেকটা এ ধারণাকেই সমর্থন করে। তাই বাংলাদেশের
পররাষ্ট্রনীতিতে অতিমাত্রায় \'ভারতমুখিতা\' সাম্প্রতিককালে বিতর্কের
মাত্রা বাড়ালেও বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা ভারতের \'প্রভাব\' থেকে বের হয়ে
আসতে পারব না। তবে এ ক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা এক জায়গায়_
দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমরা দক্ষতার পরিচয় দিতে পারিনি। আমাদের
\'প্রাপ্তি\' এখানে কম, ভারতের \'প্রাপ্তি\' অনেক বেশি। মহাজোট সরকার
ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি
হয়েছে। ২০০৯ সালেই প্রধানমন্ত্রী ভারতে গেছেন। ফিরতি সফরে ভারতের
প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আসেন ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে। এ ধরনের সফর ও
পাল্টা সফরের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ হয়ে গেছে যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে
ভারত একটি \'ফ্যাক্টর\'। খালেদা জিয়া এটাকে বিবেচনায় নিয়েই ভারতে গেলেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বাংলাদেশে পরিবর্তিত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে
খালেদা জিয়া ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছেন। চীন সফরের সময় চীনের ভাইস
প্রেসিডেন্ট জি জিন পিং, যিনি মার্চে (২০১৩) প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিতে
যাচ্ছেন, খালেদা জিয়াকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। এটা কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
খালেদা জিয়া যে চীনা নীতিনির্ধারকদের কতটুকু আস্থায় আছেন এটা তার বড়
প্রমাণ। নয়াদিলি্লতে খালেদা জিয়ার সঙ্গে যাদের সাক্ষাৎ হয়েছে তা থেকেও
ধরে নেওয়া যায় তার এই সফর নিছক সাধারণ কোনো ভ্রমণ নয়। রাষ্ট্রপতি,
প্রধানমন্ত্রী, নিরাপত্তা উপদেষ্টা, কিংবা লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেত্রী_
লিস্টে সবাই আছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা মূলত খালেদা জিয়ার কাছ থেকে কিছু
বিষয় বোঝার চেষ্টা করেছেন। বিশেষ করে ভারতকে দেওয়া ট্রানজিট কিংবা
নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সে ব্যাপারে
বিএনপির অবস্থান কী কিংবা তারা কী চায়। বলা ভালো, বিএনপি শুধু ভারতকে
দেওয়া ট্রানজিটের পক্ষে নয়, বরং বিএনপি চায় সত্যিকার অর্থেই ট্রানজিটের
বহুমাত্রিক ব্যবহার। অর্থাৎ নেপাল, ভুটান এমনকি চীনকেও ট্রানজিটের আওতায়
আনা হোক। নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে সহযোগিতা, তাতেও বিএনপির পূর্ণ সায় নেই।
টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধী বিএনপি। আঞ্চলিক সহযোগিতার আলোকে পানি সমস্যার
সমাধান চায় বিএনপি। সীমান্ত হত্যা বন্ধ হোক_ ওটাও বিএনপি চায়। যে বিষয়টি
বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, খালেদা জিয়া ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের আস্থা
অর্জন করতে পারলেন কি-না। যদি আস্থা অর্জন করতে পারেন, সেটা হবে তার জন্য
বড় সাফল্য। ধারণা করছি, এখন খালেদা জিয়ার সফরের পরপরই পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
গওহর রিজভী নয়াদিলি্ল যাবেন। দীপু মনি তার ভারত সফর বাতিল করেছেন। অনেক
বিষয় ঝুলে আছে। এর মধ্যে অন্যতম তিস্তার পানি বণ্টন। গওহর রিজভী না গেলেই
বরং আমি অবাক হবো।
এটা স্পষ্ট, ভারত যেমনি ঠিক তেমনি চীনা নেতৃবৃন্দও \'নির্দিষ্ট কতগুলো
বিষয়ে\' খালেদা জিয়ার অবস্থান জানতে চেয়েছে। \'চীনকে ঘিরে ফেলার\' যে
নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়েছে, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত
গুরুত্বপূর্ণ। আগামীতে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন নৌসেনা ঘাঁটি
গড়বে। বাংলাদেশ চীনের নিকট প্রতিবেশী। চীনা নেতৃবৃন্দ যে এ ব্যাপারে
খালেদা জিয়ার মনোভাব জেনেছেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু যে
প্রশ্নটি নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন, তা হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে
বিদেশি শক্তি আদৌ নাক গলাচ্ছে কি-না! ২০১৩ বাংলাদেশে নির্বাচনের বছর।
বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারই নির্বাচনের আয়োজন করবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ নেই। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের
অবস্থান পরস্পরবিরোধী। বিএনপি চাচ্ছে একটি নির্দলীয় সরকার, যারা দশম
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করবে। সরকারের এতে সম্মতি নেই। ফলে দিন যতই
এগিয়ে যাচ্ছে, ততই সংকটের গভীরতা বাড়ছে। গত এক বছরে যেসব বিদেশি ভিআইপি
বাংলাদেশ সফর করে গেছেন, তারা প্রায় সবাই এক বাক্যে এ কথাটাই বলে গেছেন
যে, সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমেই নির্বাচন হোক। সুতরাং একটি প্রশ্ন থাকবেই_
দশম সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু তাতে \'সব
দলের\' অংশগ্রহণ থাকবে কি-না? বিএনপি জানিয়ে দিয়েছে, তারা বর্তমান
সরকারকে ক্ষমতায় রেখে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না। খালেদা জিয়ার সরকারের
সময় এ ব্যাপারে ভারতের বক্তব্য হয়তো তাকে জানানো হয়েছে। কেননা বাংলাদেশে
যদি অস্থিতিশীলতা বিরাজ করে, তা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকেও স্পর্শ
করতে পারে। ভারত সবসময়ই চায় বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা থাকুক। এখানে একটা কথা
বলা প্রয়োজন, জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের
অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। এটা কূটনীতির একটি বৈশিষ্ট্য।
সুতরাং বাংলাদেশে কবে নাগাদ নির্বাচন হবে, তাতে বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কি
করবে না_ এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতের নীতিনির্ধারকরা এ বিষয়
নিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন না। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় যে
কোনো ফর্মেই হোক, এ বিষয়টি উঠেছে। এটা কখনও কাম্য নয় যে, আমরা আমাদের
অভ্যন্তরীণ বিষয়াদি নিয়ে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলব। বিদেশিরা কেন আমাদের
অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলবে? কথা বলবে? হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ
সফরের সময় তিনি যখন \'সব দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি নির্বাচনের\'
কথা বলে গিয়েছিলেন, তাতে কি আমদের মান-মর্যাদা বেড়েছিল? আমরা এই সুযোগটি
কেন করে দিলাম? পরিস্থিতি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে,
বিদেশি অতিথিরা প্রকাশ্যেই এ ব্যাপারে মন্তব্য করছেন। এটা শোভন নয় এবং এতে
করে আমাদের মান-মর্যাদাও বাড়ে না। খালেদা জিয়া একটি বড় দলের
প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই দলটির একটি শক্ত অবস্থান
রয়েছে। একাধিকবার ভাঙনের মুখে পড়লেও তাতে দলটির খুব একটা ক্ষতি হয়েছে
বলে মনে হয় না। লাখ লাখ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে এই দলটির প্রতি।
দলটিকে আস্থায় না নিলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে আরও উন্নত পর্যায়ে নিয়ে
যাওয়া যাবে না।
Daily SAMAKAL
06.11.12
0 comments:
Post a Comment