রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অভিনন্দন ও কিছু প্রশ্ন

শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামাই বিজয়ী হলেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিতে আদৌ কোনো পরিবর্তন হবে না। তবে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের দিকে অনেকের দৃষ্টি থাকবে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ইস্যুতে দু’দেশের মতপার্থক্য লক্ষ করা যায়। অধ্যাপক ইউনূস ইস্যু, গ্রামীণ ব্যাংক, শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড, ‘আকসা’ কিংবা ‘টিকফা’ চুক্তি নিয়ে মতপার্থক্য স্পষ্ট। এসব মতপার্থক্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যখন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা প্রকাশ্যেই সরকারের সমালোচনা করেছিলেন। এখন ওবামার বিজয়ের পর মার্কিন নীতিতে কী আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে? মনে হয় না। মার্কিন রাষ্ট্রদূত গত জুলাই মাসে প্রকাশ্যেই ‘টিকফা’ চুক্তি স্বাক্ষরের কথা বলেছিলেন। তিনি এ-ও বলেছিলেন, ‘টিকফা’ না হলে বাংলাদেশ তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত ও কোটা সুবিধা পাবে না। টিকফা হচ্ছে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেন্ট’। যদিও আমাদের পররাষ্ট্র সচিব ২৯ জুলাই এক প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশের কারণে যে টিকফা চুক্তি হচ্ছে না, কথাটা সত্য নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে এভাবে কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারে কি না? না পারে না। জাতিসংঘের ২.৪ এবং ২.৭নং ধারা অনুযায়ী একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপ করতে পারে না। কিন্তু ড্যান মজিনার বক্তব্য ছিল জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী। এটা দৃষ্টিকটুও। এদেশের মানুষ জানে না টিকফা চুক্তি কী? এ চুক্তিতে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, সে ব্যাপারেও আমরা স্পষ্ট নই। দুঃখজনক হচ্ছে, এসব ক্ষেত্রে বিদেশে এ ধরনের চুক্তি নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মহাজোট সরকারের আমলে এ ধরনের কোনো চুক্তি নিয়ে সংসদে আমরা আলোচনা হতে দেখিনি। মজিনার কথাবার্তা থেকে মনে হয়েছে, বাংলাদেশি পণ্যের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র একটি নেতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর বাংলাদেশি পণ্য মানেই তো তৈরি পোশাক। সেই তৈরি পোশাক রফতানিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তার একটা মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে বাংলাদেশে। যুক্তরাষ্ট্র মূলত প্রেসার খাটিয়ে সুবিধা আদায় করে নিতে চায়। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় একটি ‘অংশীদারিত্ব সংলাপ’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বাংলাদেশ। এ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কিছুই নেই।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ‘আকসা’ নামে একটি চুক্তির প্রস্তাব করেছিল। আকসা চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর বাংলাদেশে উপস্থিতির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এ উপস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে আগামীতে। আকসা চুক্তি প্রস্তাবের রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই মজিনা বললেন টিকফা চুক্তির কথা। এ চুক্তিটি আসলে কী কিংবা এতে আমরা কতটুকু উপকৃত হব, এ ব্যাপারে বিস্তারিত আমরা অনেকেই জানি না। সংবাদপত্রেও এটা নিয়ে খুব একা আলোচনাও হয়নি। তবে মজিনা বলেছেন, এ চুক্তির মাধ্যমে শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষিত হবে। কীভাবে হবে, তা অবশ্য তিনি বিস্তারিত বলেননি। এমনকি এ চুক্তির সঙ্গে ‘টিফা’ বা ‘টিআইএফএ’ চুক্তির কোনো যোগ আছে কি না, তা-ও আমরা নিশ্চিত নই। যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই টিফা চুক্তি করতে চেয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশ তাতে রাজি হয়নি। তখন বাংলাদেশের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র টিআইসিএফ চুক্তি করার প্রস্তাব করেছিল। চুক্তিটির পূর্ণ নাম হচ্ছে ‘ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপারেশন ফোরাম এগ্রিমেট’। বাংলাদেশ যদি এ চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করে, তাহলে বাংলাদেশ পাইরেটেড কোনো পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। শ্রমিকের মানও হতে হবে আন্তর্জাতিক মানের। তাছাড়া ওষুধ প্রস্তুত ও রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ডব্লিউটিও’র কাছ থেকে ট্রিপসের আওতায় যে সুবিধা ভোগ করছে, তা-ও বাতিল হতে পারে। আসলে টিআইএফএ’র এরই বিকল্প নাম হচ্ছে টিফা। কোনো পক্ষ থেকেই এর বিস্তারিত উপস্থাপন না করায় নানা সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রথমবারের মতো একটি চুক্তির প্রস্তাব করে। তখন এর নাম ছিল ‘ট্রেড অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ফ্রেমওয়ার্ক এগ্রিমেন্ট’ বা টিফা। ২০০২ সালে প্রণীত টিফার প্রথম খসড়াটিতে ১৩টি ধারা ও ৯টি প্রস্তাবনা ছিল। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আপত্তি থাকায় ২০০৫ সালে সংশোধিত টিফায় ৭টি ধারা ও ১৯টি প্রস্তাবনা বহাল থাকে। ওই সময় সংশোধিত টিফায় ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে বিনিয়োগ বাতিলসহ মামলার মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করার বিষয়টিও শর্ত হিসেবে জুড়ে দেয়া হয়।
যুক্তরাষ্ট্র টিফা চুক্তির খসড়ায় ১৫, ১৬ ও ১৭ নম্বর প্রস্তাবনায় মেধাস্বত্ব অধিকার, আন্তর্জাতিক শ্রমমান ও পরিবেশগত সুরক্ষা-এ তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। শুধু এ তিনটি ধারাই নয়, টিফা চুক্তির একাধিক ধারা ছিল বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। যেমন বলা যেতে পারে মেধাস্বত্ব আইন। এটা মানলে বাংলাদেশের ওষুধ শিল্পে ধস নামবে। বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রায় ৫৫টি দেশে ওষুধ রফতানি করে। বাংলাদেশের ওষুধ আন্তর্জাতিক মানের। এখন মেধাস্বত্ত্বের শর্তের কারণে বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশের ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্য সংশ্লিষ্ট দেশ বা কোম্পানির অনুমতি ছাড়া তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের একটি বিশেষ অধিকার রয়েছে। ওষুধের পেটেন্ট ব্যবহার করেই বাংলাদেশ নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক ওষুধ তৈরি করছে, যা দিয়ে দেশের লাখ লাখ মানুষ উপকৃত হচ্ছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ সুযোগ ভোগ করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের শর্তের কারণে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত এ সুবিধা ভোগ করতে পারবে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র যে শ্রমমানের কথা বলছে, সেটা নিয়েও কথা আছে। এটা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মান আন্তর্জাতিক পর্যায়ের নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আইএলও’র মান বজায় রাখা কঠিন। ইউরোপের একজন শ্রমিক যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন এবং শ্রমিকদের যে মান, তার সঙ্গে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মানের বিচার করা যাবে না। ইউরোপে একজন শ্রমিকের যে অধিকার, সে অধিকার বাংলাদেশের শ্রমিকদের নেই। এটাই বাস্তবতা। এ বাস্তবতা মানতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ব শ্রমিকমানকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের শ্রমমানকে বিচার করা যাবে না। সুতরাং আজ টিকফা বলি আর টিফা চুক্তি বলি, কোনো চুক্তিই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করবে না; বরং এ ধরনের চুক্তি মার্কিনিদের স্বার্থই রক্ষা করবে মাত্র। এ ধরনের কোনো চুক্তির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারকে কোনোমতেই মেলানো যাবে না। শুল্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার আমাদের অধিকার। আমরা তো যুক্তরাষ্ট্রকে একের পর এক সুযোগ দিয়েই যাচ্ছি। কিন্তু বিনিময়ে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন (এমসিসি) থেকেও কোনো সাহায্য পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিভিন্ন দেশকে বড় অঙ্কের মজুরি সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যে ২০০৪ সালের জানুয়ারিতে এমসিসি গঠন করেছিল মার্কিন কংগ্রেস। এর চুক্তি হিসেবে সুস্পষ্টভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়া না হলেও ধারণা করা হচ্ছে গণতন্ত্র, সুশাসন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, বিনিয়োগের পরিবেশ, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এমসিসি থেকে বাংলাদেশকে সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ড. ইউনূসের বিয়টিও যে অন্যতম একটি কারণ, তা জোসেফ ক্রাউলির একটি মন্তব্য থেকে জানা যায়। জোসেফ ক্রাউলি মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ ককাসের কো চেয়ারম্যান। পদ্মা সেতু নিয়ে বিদেশে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট হয়েছে। দুর্নীতির বিষয়টি এখানে প্রধান্য পাচ্ছে বেশি। আর মার্কিন রাষ্ট্রদূত বললেন, ‘টিকফা চুক্তি না হলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি’। নিঃসন্দেহে এসব বিষয় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। যুক্তরাষ্ট্র এখানে নাক গলাতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রের কথামতো আমরা যেমন শ্রমমান নির্ধারণ করতে পারি না, ঠিক তেমনই বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা আমাদের যে সুযোগ দিয়েছে, সে সুযোগ আমরা প্রত্যাখ্যান করতে পারি না। আমরা সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক চাই। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি বাংলাদেশকে একটি ‘সফট পাওয়ার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশও বিশ্বকে কিছু দিতে পারে। এখন ওবামা পুনর্নির্বাচিত হলেন। আমরা তাতে উৎফুল্ল। আমরা বিশ্বাস করি, বাংলাদেশে তৈরি পোশাকের শুল্কমুক্ত ও কোটা সুবিধা তিনি নিশ্চিত করবেন। এমসিসি থেকে যাতে সাহায্য পেতে পারি, সে ব্যাটারটিও তিনি নিশ্চিত করবেন। ওবামা যেমন হাজার হাজার মার্কিন নাগরিককে তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে মুক্তি দেয়ার আশ্বাস দিয়েছেন; ঠিক তেমনি আমরাও প্রত্যাশা করি, আমাদের ন্যায্য অধিকারের প্রতি তিনি সম্মান জানাবেন। আকসা বা টিকফা চুক্তি চাপিয়ে দিয়ে বাংলাদেশিদের বন্ধুত্ব পাওয়া যাবে না; বরং পারস্পরিক স্বার্থ যাতে নিশ্চিত হয়, সে ব্যাপারটি দেখা জরুরি।
Daily MANOBKONTHO
09.11.12

0 comments:

Post a Comment