খালেদা জিয়া সম্প্রতি অভিযোগ করেছেন যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে সম্পৃক্ত করতে সরকার জামায়াতে ইসলামীকে পক্ষে আনার চেষ্টা চালাচ্ছে। ওই সভায় জামায়াতে ইসলামী চট্টগ্রাম মহানগর আমির শামসুল ইসলাম এমপিও বক্তৃতা করেন। খালেদা জিয়া প্রশ্ন রাখেন, জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তলে তলে সরকারের কোনো সম্পর্ক আছে কি না সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন। আমরা যাঁরা রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি করি, তাঁদের কাছে খালেদা জিয়ার এই মন্তব্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়ার এই মন্তব্যের পাশাপাশি ইদানীং ছাত্রশিবিরের কর্মকাণ্ডের সচিত্র প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে। সরকারের দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতেই শিবির এই কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী বর্তমানে ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল। জোটের পক্ষ থেকে সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্বও আছে। খালেদা জিয়া যে 'অভিযোগ'টি করেছেন, এ ধরনের অভিযোগ ইদানীং আমি শুনতে পাচ্ছি। বিশেষ করে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রকাশ্যেই যখন বলেন, বর্তমান সরকারের আমলেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম শেষ হবে, তখন থেকেই বাজারে নানা 'গুজব' ভাসছে। এর কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা বলতে পারব না। তবে রাজনীতির ছাত্র হিসেবেই জানি, রাজনীতিতে স্থায়ী 'বন্ধু' বলে কিছু নেই। আজ যে 'শত্রু', কাল সে 'মিত্র'ও হতে পারে। ভারতে তৃণমূল কংগ্রেস ইউপিএ সরকারের মিত্র ছিল। 'ছিল' বললাম এ কারণে যে সম্প্রতি তারা ইউপিএর মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনে তারা কংগ্রেসের সঙ্গে থাকবে, নাকি বিজেপির সঙ্গে থাকবে- তা নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারবে না। অতীতে তো তৃণমূল কংগ্রেস বিজেপির সঙ্গেও গিয়েছিল। তাদের স্বার্থ যারা নিশ্চিত করবে, তাদের সঙ্গেই যাবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভারতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক অতীতে ভালো ছিল না। অথচ পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ভারতীয় নেতারা খালেদা জিয়াকে 'হাইপ্রোফাইল' ভিজিটে নয়াদিল্লিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিএনপিকে আস্থায় নিতে তাদের দেরি হয়নি। এ ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামী বিএনপির স্থায়ী মিত্র, তা বলা যাবে না। বিএনপি ইসলামী আদর্শ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের কথা বলে। জামায়াতে ইসলামীও এই মতাদর্শের প্রবক্তা। সে জন্যই এই দল দুটির মধ্যে ঐক্য হয়েছিল; কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর একটা 'অতীত' আছে। ১৯৯৬ সালে জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক ধরনের 'ঐক্য' করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে। এ ধরনের 'ঐক্য' হতেই পারে! তবে খালেদা জিয়াকে আমি সব সময় জামায়াতে ইসলামীর প্রতি 'দুর্বল' থাকতেই দেখেছি।
রাজনীতিতে 'ষড়যন্ত্র'তত্ত্ব বলে একটি কথা আছে। যাঁরা এই 'ষড়যন্ত্র'তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এই বিষয়টি বিবেচনায় নেবেন যে খালেদা জিয়া অতিসম্প্রতি ভারত সফর করে এসেছেন। সেখানে তিনি লাল গালিচা সংবর্ধনা পেয়েছেন। খালেদা জিয়া তাঁর এই সফর 'সফল' হয়েছে বলে দাবি করেছেন। এ ক্ষেত্রে ভারতীয় কোনো কোনো মহল থেকে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পরামর্শও নাকি দেওয়া হয়েছে! যদিও এ ব্যাপারে কোনো পক্ষ থেকেই স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। খালেদা জিয়া নিজে বলেননি। এমনকি তরিকুল ইসলামের সংবাদ সম্মেলনেও এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি। তাই সংগত কারণেই ধরে নিচ্ছি, এর কোনো সত্যতা নেই। জামায়াতে ইসলামীর কোনো কোনো নেতার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার হচ্ছে। বিচার নিয়ে কোনো মন্তব্য করা যাবে না। রামুতে খালেদা জিয়া আবারও বলেছেন, তিনিও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চান। তবে সেই বিচার হতে হবে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের আলোকে। সুতরাং বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না, এটা বলা যায় না। জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি নিশ্চয়ই আছে। তাদের দলীয় স্বার্থ যেখানে বেশি নিশ্চিত হবে, সেখানেই তারা যাবে, এটাই স্বাভাবিক। ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে জামায়াতে ইসলামী শক্তিশালী- এটা তো অস্বীকার করা যাবে না। তারা আগামীতে ১৮ দলীয় জোটে থাকবে, এটা যেমন নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না, তেমনি এ সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না যে জামায়াতে ইসলামী ১৮ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গিয়ে 'তৃতীয় ধারা'র সূচনা করবে না। ইসলামপন্থী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি জোট গঠন করার কথাও বলছেন কেউ কেউ। তবে আমার বিবেচনায় জামায়াত ১৮ দলীয় জোট ছাড়বে না। জামায়াত সমর্থক কিছু কিছু বুদ্ধিজীবীর (ডাক্তার, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার) সঙ্গে মাঝেমধ্যে আলাপে আমার মনে হয়েছে, তরুণ প্রজন্ম জামায়াতকে তুরস্কের 'জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট' পার্টির মডেলে একটি পার্টি হিসেবে দেখতে চায়। খালেদা জিয়ার 'অভিযোগের' পেছনে সত্যতা যা-ই থাকুক না কেন, বাংলাদেশে একটি তথাকথিত 'তৃতীয় ধারার' বিকাশের সম্ভাবনা ক্ষীণ। অনেক দিন ধরেই এই তৃতীয় ধারার কথা বলা হচ্ছে। এখন কার নেতৃত্বে এই তৃতীয় ধারা বিকশিত হবে? এইচ এম এরশাদের নেতৃত্বে? এরশাদ সাহেব তো একটি ইঙ্গিত ইতিমধ্যে দিয়েছেন যে জানুয়ারিতে তিনি ঢাকায় মহাসমাবেশ করে মহাজোট ছাড়ার ঘোষণা দেবেন; কিন্তু যাঁরা এরশাদকে চেনেন, তাঁরা জানেন এ ধরনের বক্তব্য এরশাদ সাহেব বহুবার দিয়েছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও ড. কামাল হোসেনের উদ্যোগেও একটি তৃতীয় ধারার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এর কোনো আবেদন নেই। তাঁরা খুব একটা জনমত সৃষ্টি করতে পেরেছেন বলেও মনে হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে- বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটি পক্ষ, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি পক্ষ, অন্যটি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনীতিতে বিশ্বাসী। অন্যদিকে বিএনপির নেতৃত্বে একটি পক্ষ, যারা ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। জাতীয় পার্টির রাজনীতির সঙ্গে বিএনপির রাজনীতির মূলত তেমন কোনো পার্থক্য নেই। অতীতে এরশাদ ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে একটি জোট গঠন করে নির্বাচনও করেছিলেন। কিন্তু ফলাফল খুব সুবিধার ছিল না। সুতরাং ইসলাম-পছন্দ দলগুলো আলাদাভাবে জোট করলেও তাতে জনসমর্থন থাকবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। নানা কারণে খালেদা জিয়াও চাইবেন না জামায়াতে ইসলামী ১৮ দলীয় জোট ত্যাগ করুক। তিনি মূলত একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে 'বাজার' যাচাই করে দেখাচ্ছেন- বিতর্কিত হলেও ১৮ দলীয় জোটে জামায়াতই বড় দল। তাদের যেমন কর্মী রয়েছে, তেমনি রয়েছে আর্থিক ভিত্তি। তবে সরকার যদি জামায়াতকে 'যেকোনো প্রলোভন' দেখিয়ে ১৮ দলীয় জোট থেকে বের করে নিয়ে আসতে পারে, তাতে তাদের 'সাফল্য' অনেক বেশি। এতে করে নিঃসন্দেহে বিএনপি দুর্বল হবে। তবে যেকোনো বিবেচনায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সঙ্গে এই প্রক্রিয়া 'মেলানো' যাবে না। তরুণ প্রজন্ম চায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক। তরুণ প্রজন্ম একটি 'শক্তি'। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের সর্বশেষ নির্বাচনে তরুণ প্রজন্মের ভোটেই আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছিল।
খালেদা জিয়ার 'অভিযোগ'টিকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই না। বরং তাঁর মন্তব্য জামায়াতের গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ, তা হচ্ছে সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি সাধারণ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব। এতে করে বহির্বিশ্বে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব করেছিলেন বটে; কিন্তু তার কোনো জট খোলেনি। মোদ্দাকথা- বর্তমান সরকারকে অথবা প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতায় রেখে কোনো সরকার বিএনপির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। ফলে সংকট বাড়বে বৈ কমবে না। এটা অস্বীকার করা যাবে না যে সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক আসরে খালেদা জিয়ার গুরুত্ব বেড়েছে। তাঁর চীন ও ভারত সফর আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। চীনের আগামী রাষ্ট্রপ্রধান জি চিন পিং তাঁকে সাক্ষাৎ দিয়েছেন। এটা নিছক সাধারণ ঘটনা নয়। চীনা নেতারা খালেদা জিয়াকে যে গুরুত্ব দেন, এটা তার বড় প্রমাণ। সাম্প্রতিক সময়ে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলকে বিচারে যে মার্কিন নীতি, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান 'ছোট' করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একদিকে পূর্ব চীন সাগরভুক্ত দেশগুলো, অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে 'চীনকে ঘিরে ফেলার' নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাচ্ছে। ওবামার দ্বিতীয় প্রশাসনেও এই নীতিতে কোনো পরিবর্তন হবে না। ওবামার ১৯ নভেম্বর মিয়ানমার সফরকেও এই দৃষ্টিতে দেখতে হবে। ওবামা প্রশাসন তাদের স্ট্র্যাটেজিতে মিয়ানমারকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাইবে। তবে ওবামা প্রশাসন কতটুকু সফল হবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলবে। এসব কারণে চীনা নেতাদের কাছে খালেদা জিয়ার গুরুত্ব অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্র ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি 'অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি' স্বাক্ষর করেছে। 'আকসা' চুক্তি নিয়েও কথাবার্তা হচ্ছে। আকসা চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে মার্কিন মেরিন সেনা বাংলাদেশে অবস্থান ও বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করতে পারবে। খালেদা জিয়ার গুরুত্ব তাই বাড়ছে। খালেদা জিয়া রামুতে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে কিছুটা কৌতূহল সৃষ্টি হলেও বাস্তবতাই বলে, জামায়াতে ইসলামীর কাছে বিএনপি ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। খালেদা জিয়ার মন্তব্যের পর সরকার আরো সতর্ক হয়ে যাবে। জামায়াতে ইসলামী কোন জোটে যোগ দিল বা কোন জোটে থাকল, ওটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা। সরকারের সাফল্য সেখানেই নিহিত।Daily KALERKONTHO27.11.12
0 comments:
Post a Comment